কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস  | Behind the fame of Zamindar, the miserable condition of the citizens under the pressure of the ‘Tax’

Home » Medinikatha Journal » Citizens under the pressure of the‘Tax’


কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস

Behind the fame of Zamindar, the miserable condition of the citizens under the pressure of the ‘Tax’

অতনু মিত্র ।


মেদিনীপুর জেলায় যে সকল জমিদার রাজত্ব করেছেন তাদের কেউ ছিলেন মুসলমান রাজত্বের সময় থেকে, কেউ ইংরেজ কোম্পানীর আগমন কালে। তাদের কেউ রাজত্ব করেছেন ৬০০ বছর, কেউ ২০০ বছর। সমকালীন সমাজে তাঁদের গভীর প্রভাব ছিল। তাঁরা বহু কীর্তির সাক্ষী। মেদিনীপুর জেলায় এরকম ছয়জন জমিদারকে নিয়ে একটি ছড়া প্রচলিত আছে। ‘দানে চনু, অন্নে মানু, বঙ্গে রাজনারায়ণ/বিত্তে ছকু, কীর্তে নরু, রাজা যাদবরাম’।



ছড়ায় বর্ণিত ‘চনু’ হলেন পিংলার দানশীল জমিদার দাতা চন্দ্রশেখর ঘোষ। তিনি ছিলেন মেদিনীপুরের প্রথম জেলা জজ-কালেক্টর জন পিয়ার্সের দেওয়ান। ‘মানু’ হলেন অন্নদানে ও আপ্যায়নে খ্যাত পুঁয়াপাটের জমিদার মানগোবিন্দ ভঞ্জ। ‘রাজনারায়ণ’ হলেন জকপুরের মহাশয় বংশের শেষ সদর-কানুনগো প্রবাদ-প্রতীম রাজনারায়ণ রায়। ‘ছকু’ হলেন মালিহাটির বিত্তবান জমিদার ছকুরাম চৌধুরি। ‘নরু’ হলেন জলামুঠা বংশের জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরী এবং ‘যাদবরাম’ হলেন মাজনামুঠার জমিদার যাদবরাম চৌধুরি।


কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস  | Behind the fame of Zamindar, the miserable condition of the citizens under the pressure of the ‘Tax’
কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস (Photo Courtesy - Khaydock)

জকপুরের মহাশয় বংশের শেষ সদর-কানুনগো(১৭৬৫) ছিলেন জমিদার রাজনারায়ণ রায়। আকবরের রাজত্বে জেলায় ৪০টির বেশি জমিদারি ছিল। তার মধ্যে জকপুরের মহাশয় বংশ ও গোপীবল্লভপুরের গোস্বামী বংশ জেলার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশ বলে যোগেশচন্দ্র বসু উল্লেখ করেছেন। নবাব এবং ইংরেজ শাসক প্রতি বছর কানুনগোদের সুবর্ণ-পুষ্প ও সুসজ্জিত অশ্ব উপহার পাঠাতেন। মেদিনীপুর শহরের বল্লভপুরে মহাশয় বংশের কাছারী ছিল। বল্লভপুরের সেই সুসজ্জিত অট্টালিকা এখন মেদিনীপুর টাউন স্কুল।



ইংরেজ রাজত্বের শুরুতে মালিহাটির চৌধুরী বংশের জমিদার ছিলেন ছকুরাম চৌধুরী। মারাঠা দমনে জেলার রেসিডেন্ট জনস্টোনকে তিনি প্রভূত সাহায্য করে কানুনগোর(১৭৬০) দায়িত্ব পান। সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা ও জমিদারিতে বহু অর্থ উপার্জন করেন। জমিদারি বৈভবের যত প্রকারের সামগ্রী থাকা দরকার তার সবই ছিল বিত্তশালী জমিদার ছকুরাম চৌধুরীর। সেই জন্যই ছড়ায় তিনি ‘বিত্তে ছকু’ বলে বর্ণিত।


কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস  | Behind the fame of Zamindar, the miserable condition of the citizens under the pressure of the ‘Tax’
কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস (Photo Courtesy - Erudex)

‘নরু’ অর্থাৎ জালামুঠার কীর্তিমান জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর ছিলেন অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি। তাঁর রাজবাড়ি ছিল বাসুদেবপুরে। নবাবের নির্দেশে এই বংশের জমিদার ‘চৌধুরী’ আর অন্যরা ‘রায়’ পদবি ব্যবহার করতেন।



অধ্যাবসায়, উদ্যম আর প্রখর বুদ্ধির জোরে ১৭৪৫ সালে বাংলার নবাবের থেকে ‘রাজা’ উপাধিসহ মাজনামুঠার জমিদারি পেয়েছিলেন কাঁথির কিশোরনগরের যাদবরাম চৌধুরি। দেবতা ও ব্রাহ্মণের প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি। কিছু দান না করে তিনি কোনো দিনও জল গ্রহণ করেননি। বিভিন্ন স্থানের ব্রাহ্মণদের তিনি নিষ্কর ভূমি দান করেন। এইভাবে চললে জমিদারী বিলোপ অবধারিত! তাঁর আত্মীয়দের এই আশঙ্কায় নবাব মীরজাফর যাদবরামকে মুর্শিদাবাদে ডেকে সম্পত্তি দানে বিরত হতে বলেন। তা অগ্রাহ্য করায় নবাবের নির্দেশে তাঁকে মাটি্ত আবক্ষ প্রোথিত করা হয়। চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণদের অনুরোধে সেদিন যাদবরাম হাতের হীরের আংটি দান করে জলপান করেন। পরদিন রাজা নিজের জিভ কেটে রক্ত নিয়ে ঘাস দিয়ে শ্রীক্ষেত্রের ব্রাহ্মণকে পাতায় লিখলেন ‘বাস্তদান’। ২৪০ বিঘা রাজপুরী দান করে জলগ্রহণ করেন। নবাব বিস্মিত হয়ে যাদবরামকে সসম্মানে কিশোরনগরে প্রেরণ করেন। পরে ব্রাহ্মণ মাত্র এক টাকায় যাদবরামকে রাজপুরী ফিরিয়ে দেন। তাঁর অবর্তমানে পরিবার ব্রাহ্মণদের সম্পত্তির দখলের আশঙ্কায় তিনি ব্রাহ্মণদের কাছে আশীর্বাদ চাইলেন, ‘আমার বংশ নির্বংশ হোক’। ১৭৮০ সালে যাদবরাম মারা যান। ১৭৮২ সালে তাঁর একমাত্র পুত্র কুমার নারায়ণ এবং ১৭৮৩ সালে তাঁর একমাত্র নাতি জয়নারায়ণ মারা যান।


কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস  | Behind the fame of Zamindar, the miserable condition of the citizens under the pressure of the ‘Tax’
কীর্তির আড়ালে জমিদারের ‘বাবে’ প্রজার নাভিশ্বাস | Behind the fame of Zamindar, the miserable condition of the citizens under the pressure of the ‘Tax’

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমির মালিকানা কৃষকের হাত থেকে কেড়ে জমিদারদের দেয় ইংরেজ। মূল লক্ষ্য কৃষকদের কাছে খাজনাসহ অতিরিক্ত কর ও সেলামী আদায়। প্রায় শত প্রকার ‘সেলামী’ আদায়ের নামে লাগাতার শোষণে জমিদাররা হল গ্রাম-বাংলার সর্বময় কর্তা। আর প্রজা হল সর্বস্বান্ত। এই জমিদারী ‘তহুরী’ বা ‘আবওয়াব’ গ্রাম-বাংলায় ‘বাব’ নামে অধিক প্রচলিত। ১২৮০ সালের ২৪ ভাদ্র ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় জমিদারদের এই ‘বাজে আদায়ে’ প্রজাদের দুরবস্তার করুণ চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে। কত রকমের ‘বাব’ কী কী অজুহাতে আদায় হত তা কাঁথি থানার কিশোরনগরে মাজনামুঠা জমিদারীর ইতিহাসে পাওয়া যায়।

মাজনামুঠার সর্বশ্রেষ্ঠ জমিদা্র ছিলেন পঞ্চম রাজা যাদবরাম চৌধুরী। এই জমিদার পুণ্যশ্লোক হিসেবে বর্ণিত হলেও তাঁর জমিদারিতেও প্রজাদের নানা সেলামী দিতে হত, ‘মেমোর্যা ণ্ডা অব মিডনাপুর’ বইতে তার বিবরণ দিয়েছেন জেলা কালেক্টর এইচ ভি বেইলি। ছেলে বা মেয়ের বিয়ে, বরের মাথায় ছাতা ধরা, বর-বউয়ের আগমন, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, শ্রাদ্ধ-শান্তি, নৌকায় গমন, গণিকাবৃত্তি, মাছ ধরা, সব্জিচাষ, ধান কাটা কোনো কিছুই বাদ পড়ত না। সেলামী ছিল ২ আনা থেকে ৫ টাকা। তখন ১ টাকায় পাওয়া যেত প্রায় পৌনে ২ কুইন্ট্যাল ধান। এর থেকে অনুমান করা যায় জমিদারি আয় কেমন ছিল।



কীরকম ছিল এই ‘বাজে আদায়’ নামে এই সেলামি? বিবাহ নিয়ে বহু প্রকার তহুরি ছিল। জমিদারিতে কোনো প্রজার বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলে জমিদারকে দিতে হত নতুন বস্ত্রসহ ৩ টাকা ‘বিভাতরফী’। একই বছর দুই পুত্রের বিয়ে হলে ‘বিভান্ন বা বিভান্য’। বরের মাথায় ছাতা ধরলে ‘ছাতা হুকুমী’। বরকনে জোড়ে এলে ‘পোনো বিবাহ সেলামী’। কনের পাকা দেখা উপলক্ষে ‘বরপূর্বক কন্যা সেলামী’। অন্য এলাকার বর বাদ্যসহ এলে ‘ডিঙ্গানী’। নিচু জাতির বিয়েতে সাড়ে চার টাকার ‘সংগোত্র দেশ বিবাহ সেলামী’। লগ্নের বিয়ে না হলে ‘অকাল বিবাহ সেলামী’। জমিদারের আদেশ ছাড়া বিয়ে হলে ‘বেহুকুম বিবাহ সেলামী’। কিশোরনগর জমিদারিতে বিধবা বিবাহ হলে ‘সাঙ্গা’। বিবাহ বিচ্ছেদ চাইলে ‘স্বামী-ত্যাগী সেলামী’।

সম্পত্তি নিয়েও প্রজাদের বহু সেলামী দিতে হতো। নিজেদের সম্পত্তির জন্য ‘হুকুম সেলামী’। ভাইয়ে ভাইয়ে পৃথক হয়ে সম্পত্তির ভাগ চাইলে ‘ভাই ভাটি’। অন্যের সম্পত্তি দখল করলে ‘সীমাপুরি’। নিষ্কর ভোগী ভৃত্যদের ‘নোকীরান দু’আনি সেলামী’ দিতে হতো। নৌকায় এলে ‘খেলনা নৌকা সেলামী’। জাতি নিয়েও সেলামির বাড়বাড়ন্ত কম নয়। নিচু জাতের লোকের সাথে নৌকা ভ্রমণে ‘জাত মাল্লা’। নিচু জাতির শ্রমিকের কাজ করলে ‘মজুর ছোড়ুন’। জাত হারিয়ে স্বজাতে ফিরলে ‘সমন্বয়ী’। কুলগুরু দ্বারা সমাজচ্যুত হয়ে পুনরায় সমাজে ফিরলে ‘গুরুত্যাগী ছোড়ুন’। জেলের বাড়িতে নাপিত এলে ‘জৌলি’। নিয়মভঙ্গের জন্য ‘বাহুরমিতি’। ক্রিয়াকর্মের নিয়মভঙ্গের সময় কমাতে ‘যাত্রী ত্যাগ সেলামী’। শ্রাদ্ধ বা অশৌচের সময় কমাতে ‘অশৌচত্যাগী সেলামী’। প্রচলিত বিধির বিরোধিতা করলে ‘অশান্তি সেলামী’। কোন অবৈধ সন্তানের বিধবা মাতা ধোপা-নাপিতের সাহায্য নিলে বা উপপতির সাথে বসবাস করলে ‘বেদোছাড়’। জমিদারের বিনা অনুমতিতে ধোপা-নাপিত এলে ‘বেহুকুমি’। ব্রাহ্মণ বা পিতৃস্থানীয়দের অসম্মা্নে ‘আক্কেল সেলামী’ দিতে হতো। দশহরা পুজায় ‘দশেরা’। ভাদ্রমাসে অনুষ্ঠান করলে ‘ভাদুই মাগন’। বিগ্রহের শীত বস্ত্রের জন্য ‘রাজশিত্তুরী’। জমিদার মহাশয়ের স্নান অনুষ্ঠানের জন্য ‘অভিষেক সেলামী’।



ধান কাটতে ‘হালা মাগনি সেলামী’। সরু ধান চাষ করলে ‘মিহিচাল সেলামী’। খামারে প্রজার ঝাড়াই ধানের উপর হাঁটলে ‘খামারমাড়া’। দুধ বা সব্জি উৎপাদনে ‘দুধশংগ’। লবন তৈরিতে ‘নিমক চিয়ানি’। নদীর ঘাট ব্যবহারে ‘ঘাট সেলামী’। ফেরিঘাটের জন্য ‘খেয়ারো’। পুকুরে জালে মাছ ধরলে ‘পাঁচকুটিয়া’। পালকি বাহকদের ‘বেহারা সেলামী’ আর পাইকদের ‘পাইকান’। অধঃপতিতদের ‘খাদাল বাহমিন’। গোমস্তাদের ‘খানা গোমস্তা’। দাঁড়িপাল্লা ধরলে ‘কয়াল’। পেশাদারও ছাড় পেতেন না। নববর্ষে পেশাদারদের দিতে হতো ‘শুনিয়া কুরচা’। মোড়লদের ‘প্রামাণিক সেলামী’। মুদি দোকানিকে ‘দোকান মাগন’। জ্যোতিষিদের ‘ফতের চৌপনি’। চোর বা ধর্ষণকারীদের উপর ‘উরি-চুরুনি’।

তখন জমিদারিতে বারবণিতা বসানোর চল ছিল। গণিকাবৃতি গ্রহণ করলে ‘কশবিয়ান ছাড়’ দিতে হতো। তাদের বলা হতো ‘কশবিয়ান কুড়ারী’। এদের কেউ কোন ভৃত্যের সাথে সহবাস করলে দন্ড হিসেবে দিতে হতো ‘বেহুকুমী সেলামী’।



বেইলি বলেছেন, এখানকার খাজনার হার বেশ চড়া এবং প্রজারা আবওয়াবের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিল। ইংরেজদের ‘ল্যান্ড রেভেনিউ কমিশন’ এর কাছে এই সব ‘আবওয়াব’ বা ‘তহুরী’র বিষয় জেলার জমিদারগণ পুরোপুরি অস্বীকার করেন। কিন্তু জেলার এক বিদেশি জমিদার ‘মেসার্স মিডনাপুর জমিন্দারি কোম্পানি’ কমিশনের কাছে স্বীকার করে জানায়, এই ধরনের বাজে আদায়(Miscellaneous) প্রচলিত থাকলেও কোম্পানি নোটিশ দিয়ে এই এসব আদায় দিতে প্রজাদের নিষেধ করেছিল।

আজ সেই জমিদারও নেই, আর জমিদারিও নেই। জমিদারি প্রথা নামক সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্ত হলেও, আজ রাজনীতি থেকে মুক্তি নেই প্রজাদের।


midnapore.in

[Published on 30.04.2022 / প্রথম প্রকাশ - আনন্দবাজার পত্রিকা (২১.০৫.২০১৯)। ]