মন্দিরের দ্বারে দ্বারে ( ভগবন্তপুর-২, চন্দ্রকোণা)
							Temples of Bhagabantapur-2, Chandrakona
							
							গণেশ দাস। 
							 
							
							নতুন বছর৷ যদিও এই বছর হৈ হুল্লোড় তেমন হচ্ছে না৷ তবুও তো নতুন বছর বলে কথা৷ হৈ-হুল্লোড়, ভিড়-ভাট্টা বা সবাই মিলে পিকনিক খুব একটা না থাকুক, আবেগ, আনন্দ তো থাকবে? বিষাদের মাঝেও সবাই আনন্দটাকে মাটি করতে রাজি নয়৷ তাই করোনার আবদ্ধ বেড়াজাল টপকে অনেকেই নতুন বছরের উন্মুক্ত বাতাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছে৷ এই অবসরে চলুন না আমাদেরই আশে পাশের কিছু অঞ্চলের মন্দিরে বেড়িয়ে আসা যাক৷ তবে হ্যাঁ মাস্ক পরে বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই এই ভ্রমনে পা বাড়াতে হবে৷ চলুন এবার বেরিয়ে পড়ি আর বেড়াতে বেড়াতে জেনে নিই সে সব দেবদেউলের অজানা কিছু কথা৷
							গ্রামের নাম 'দেউলবাটি'(ভগবন্তপুর-২)৷ অপভ্রংশ হয়ে পরে যার নাম হয়েছে 'দেউলবেড়িয়া' বা 'দেউলবেড়'৷ না সরাসরি ঐ গ্রামে আমরা পৌঁছাবো না৷ বরং সেই গ্রামের আগের গ্রামগুলোর মন্দিরগুলো দেখতে দেখতে শেষে শিলাবতীর দক্ষিন তীরস্থ ঐ গ্রামে আমরা পৌঁছাবো৷ চন্দ্রকোণা শহরের ঠাকুরবাড়ী বাজার থেকে আধকাটা হয়ে সোজা আমরা পৌঁছে গেলাম ভগবন্তপুর- ভৈরবপুর বাজারে৷ ভৈরবপুর যে ধীরে ধীরে দোকান বাজারের সমারোহে গ্রামীন চরিত্রের খোলস থেকে মুক্ত হয়ে নগরায়ণের পথে পা বাড়িয়েছে তা বেশ বোঝা যায়৷ ভৈরবপুর ইউকো ব্যাঙ্কের পাশ দিয়ে পূর্বদিকে যে মোরাম রাস্তাটি এঁকে বেঁকে চলে গেছে কেশাডালের দিকে, আমাদের যাত্রা করতে হবে ঐ পথেই৷ সামনে দোলুরায়ের মন্দির৷ ঐ মন্দিরই আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল৷
				
							
							দোলুরায়ের মন্দির। 
							
							ইউ-কো ব্যাঙ্ক থেকে হাফ কিমি যাবার পরই একটা মোড় পড়ল৷ গ্রামের নাম ভৈরবপুর৷ এই মোড়ের কাছে দোলুরায়ের মন্দিরটি নজরে পড়ল৷ মন্দিরটি চাঁদনি আদলের এবং নবনির্মিত৷ মন্দিরের প্রধানবিগ্রহ দোলুরায় আসলে ধর্মঠাকুর৷ তাঁর রূপ হল শিলা৷ এই দোলুরায় শতাব্দী প্রাচীণ কাল থেকে এখানে প্রতিষ্ঠিত৷ প্রাচীণ ধর্মমঙ্গল কাব্যগুলোর দিকবন্দনাতে দোলুরায়ের উল্লেখ প্রাচীণত্বের কথায় স্মরণ করায়৷ এই দোলুরায় ছাড়াও বাঁকুড়া রায়, জগৎরায়, ঝুরঝুরি রায় প্রমুখ নামে আরও ৭ টি ধর্মশিলা মন্দিরে পূজিত হন৷ যেগুলি পরে পরে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন মানুষ নানান কারণে এই মন্দিরে দিয়ে গিয়েছেন৷ ধর্মঠাকুর মানে তাঁর শক্তির তথা কামিন্যার উপস্থিতিও থাকা দরকার৷ এই মন্দিরে ধর্মকামিন্যা হিসাবে অষ্টধাতুর লক্ষ্মীপ্রিয়া রয়েছেন৷ তিনিই আবার দুর্গা হিসাবে পূজিত হন৷ মূল মন্দির ছাড়াও একটি অপরূপ রাসমঞ্চও রয়েছে মন্দিরের দঃপঃ কোণে৷
											
												 
											দোলুরায়ের মন্দির, ভৈরবপুর।
											 
							
							
							
											
											
												 
											দোলুরায়ের মন্দিরের সামনে প্রতিষ্ঠিত রাসমন্দির, ভৈরবপুর।
											 
											
							মন্দিরের সেবাইত বংশধরগণের বসবাস মন্দিরের পাশেই৷ তাঁরা পন্ডিত পদবিধারী৷ রবীন্দ্রনাথ পন্ডিত নামে এক সেবাইত জানালেন, মন্দিরে দুবেলা নিত্যসেবাপূজো হয়৷ নিত্য সেবা ছাড়াও দুর্গাপুজা, একাদশ রাস,মকরসংক্রান্তি বেশ জাঁকজমক ভাবেই পালন করা হয়৷ দুর্গাপূজোর সন্ধিক্ষনে ছাগবলির প্রথাও রয়েছে৷ রাসের সময় কীর্তন, যাত্রাপালাও হয়ে আসছে এখানে৷ এই মন্দিরে চোক্ষুরোগের ঔষধও দেওয়া হয়, যা বিশেষ প্রসিদ্ধ৷
							
							কুড়ানী মায়ের মন্দির। 
							
							দোলুরায়ের মন্দির থেকে সোজা উত্তরমুখী রাস্তাটি ধরে আমরা এগিয়ে চললাম৷ এক দেড়শ মিটার যাবার পর একটি হরির আটচালা নজরে পড়ল৷ হরির আটচালা দেখার আগে আমাদের কুড়ানী মায়ের মন্দির দেখতে হবে৷ তাই ডানদিকের পূর্বমুখী রাস্তাটি ধরে ঢুকে পড়লাম৷ কিছুটা যাবার পর বামপাশে নজরে পড়ল মন্দিরটি৷ এই জায়গাটাও ভৈরবপুর৷ এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাস করতে উনি বললেন এটাই কুড়ানী মায়ের মন্দির৷ ভদ্রমহিলার নাম বন্দনা সরকার মহাশয়া৷ উনি কিছু তথ্য আমাদের দিলেন৷ একটু পরে সেবাইত বংশের(চৌধুরী) এক তরুণ এসে হাজির৷ ওনার নাম রাজেশ চৌধুরী৷ ওনারা জানালেন কুড়ানী আসলে দুর্গা৷ এই মন্দিরের দুটি কক্ষের ডানদিকের কক্ষটিতে দুর্গা ও বিষ্ণু পূজিত হন এবং বাম দিকের কক্ষে শিব ও শীতলা পূজিত হন৷ নিত্য সেবা দুবার হয়৷ এছাড়াও বাৎসরির বিভিন্ন পালাপার্বন যেমন দুর্গাপূজো, শীতলাপূজো ইত্যাদি হয়ে আসছে বহুদিন ধরেই৷
											
												 
											কুড়ানী মায়ের নবনির্মিত মন্দির, ভৈরবপুর।
											 
							
							
							
											
											
												 
											কুড়ানী মায়ের প্রাচীণ ভগ্ন ও পরিত্যক্ত মন্দির, ভৈরবপুর।
											 
							
							
							
											
											
												 
											কুড়ানী মায়ের মন্দিরের বিগ্রহগণ৷ ব্রাহ্মণ পূজোয় বসার পূর্বমুহূর্তের তোলা ছবি।
											 				
							দুকক্ষবিশিষ্ট মূল মন্দিরটি চাঁদনি আদলের এবং নব নির্মিত৷ এই মন্দিরের দঃপূঃ কোণে ইটের আদি মন্দিরটি পরিতক্ত ও ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় ঝোপঝাড়-আগাছার অন্তরালে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মন্দিরটির সামনের অংশ ভেঙে যাওয়ার ফলে কোন টেরাকোটার কাজ বা প্রতিষ্ঠালিপিও নজরে আসল না৷ যদিও দেখে বোঝায় যায় মন্দিরটি শতাব্দী প্রাচীণ৷ কম করেও ২০০-৩০০ বছরের পুরানো তো বটেই৷ তবে যা অবস্থা দেখলাম তাতে মনে হয় মন্দিরটির আয়ু আর বেশি দিন নয়৷ মন্দিরের পুরোহিত পরেশ ঘোষালের মহাশয়ের সঙ্গেও দেখা হল৷ উনি বললেন ওনারা বংশ পরাম্পরায় এই মন্দিরের পূজারী৷
							
							হরির আটচালা। 
							
							কুড়ানী মায়ের মন্দির থেকে বেরিয়ে সেই আটচালার কাছে আসলাম৷ যদিও নামে আটচালা কিন্তু আদপে তা টিনের চারচালা মন্দির৷ একটি বটবৃক্ষকে কেন্দ্রকরে এই হরিচালাটি নির্মিত হয়েছে৷৷ এই পবিত্র বৃক্ষের গোড়াটিকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে বেদী করা হয়েছে৷ বেদীর পূর্বদিকে হরির ঘট স্থাপন করা আছে এবং বেশ কয়েকটি নিতাই গৌরাঙ্গের ছবির ফলক সেখানে লাগানো আছে৷ 
											
												 
											চৌধুরী পাড়ার হরিচালা, ভৈরবপুর।
											 	
							নিমাই দাস ও বাদল দাস নামে দুভাই এই হরি মন্দিরের বর্তমান সেবাইত৷ জন্মাষ্টমীর সময় এই আটচালাতে তিনদিন ব্যাপি হরিনাম সংকীর্ত্তণ হয় খুবই আড়ম্বরপূর্ণভাবে৷ শুধু দাস পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না এই আনন্দ অনুষ্ঠান৷ এই হরিনাম শুনতে চৌধুরী পাড়া ছাড়াও ভৈরবপুরের অধিকাংশ মানুষ আসেন৷ তিনদিন তাঁরা আনন্দের জোয়ারে গা ভাসান৷
							
							গড়গড়ে শিব মন্দির। 
							
							হরির আটচালা মন্দির দেখার পর আমরা উত্তরমূখী রাস্তা ধরে বাইক ছুটিয়ে দিলাম৷ একটু এগোতেই বামদিকে নজরে পড়ল আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল গড়গড়ে শিব মন্দিরটি৷ মন্দিরের দুয়ারে দুজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বসেছিলেন৷ মন্দির সম্পর্কে তাঁদের জিজ্ঞাস করতে তাঁরা বললেন, 'আমরা কিছু জানি না'৷ তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, 'যাদের মন্দির তাদের কাউকে আমি ডেকে দিচ্ছি', বলে উনি চলে গেলেন৷ একটু পরে ফিরে এসে বললেন, 'কত্তাবাবু বাড়ীতে নেই আর ছোটবাবু বাজারে গেছে৷ ফোন করে দিয়েছে, এক্ষুনি চলে আসবে'৷
											
												 
											গড়গড়ে শিব মন্দির, ভৈরবপুর।
											 
							আমরা এই অবসরে মন্দিরটি দেখে নিই চলুন৷ মন্দিরটি ইটের নির্মিত চারচালা রীতির এবং টিনের ছাউনি দেওয়া৷ সামনের দিকে আর একটি ছাউনি দিয়ে দুয়ার নামানো হয়েছে৷ দুয়ারের পরেই একটি ছোটো অলিন্দ, তারপরেই গর্ভগৃহ৷ গর্ভগৃহের ভেতরে শিবলিঙ্গ পূজিত হন৷ মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি হরগৌরীর থান৷ 
											
												 
											গড়গড়ে শিব মন্দিরের হরগৌরীর থান, ভৈরবপুর।
											 
							এরই মাঝে বাইকে করে এক তরুণ এসে উপস্থিত হলেন৷ জানালেন উনিই মন্দিরের সেবাইত বংশের একজন এবং মন্দিরের পূজা পার্বণগুলি উনিই এখন দেখভাল করছেন৷ নাম জানালেন সন্তু চৌধুরী৷ ওনার সঙ্গে ওনাদেরই পরিবারের একজন যুবকও ছিলেন৷ সন্তুবাবু জানালেন, মন্দিরটি আনুমানিক একশত বৎসরের পুরোনো৷ প্রথমে মন্দিরটি মাটিরই ছিল, পরে সেটি ভেঙে ইট দিয়ে পাকার করা হয়৷ সেটিও ভঙ্গুর হয়ে গেলে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়৷ টিনের ছাউনি থাকায় ওনারা নতুন করে বড় একটি মন্দির করার পরিকল্পনাও করেছেন৷
							মন্দিরের দুবেলা নিত্য সেবা হয়৷ বাৎসরিক পূজো বলতে চৈত্রমাসের গাজন খুব ধুমধাম করে হয়৷ প্রায় ৫০০-৭০০ জন এই মন্দিরের সন্যাসী হন৷ পয়লা বৈশাখ এই মন্দিরে রাতগাজন হয়৷ এই সময় দূরদূরান্ত থেকে বহু দর্শণার্থী ও ভক্তের সমাগম ঘটে এখানে৷ গাজন ছাড়াও শিবরাত্রি ও শ্রাবন মাসে জলঢালা উপলক্ষ্যে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় এই মন্দিরে৷ এই মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত হলেন সুবীর চক্রবর্তী৷ এই মন্দিরেও বিশেষ কিছু স্বপ্নপ্রদত্ত ঔষধ দেওয়া হয়৷ বিশেষ করে কোন দম্পতির সন্তান বিশেষ করে পুত্রসন্তান না হলে তার ঔষধ দেওয়া হয়৷
							
							
							
							
							বেলা গড়িয়ে চলেছে৷ এবার এখান থেকে বেরোতে হবে৷ এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে৷ কেননা একটু দূরেই আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে একগুচ্ছ মন্দির৷ একটা রাসমন্দির, তিন তিনটা শিব মন্দির ও দামোদর মন্দির৷ পরের পর্বে আমরা সেসব মন্দিরের দ্বারে দ্বারে ঘুরব আর অজানা কিছু কথা জেনে নেবো৷
							
							
							
							এতক্ষন আমরা দেখলাম দোলুরায়, কুড়ানী মা, হরির আটচালা সহ গড়গড়ে শিব মন্দির৷ শুনেছি সেসব মন্দিরের বিষয়ে কিছু কথা৷ সবগুলোই ভৈরবপুর গ্রামেই অবস্থিত৷ এবার আমরা এগিয়ে যাব সামনের দিকে৷ সামনেই পড়বে ভগবন্তপুর গ্রাম৷ যদিও একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভালো যে ভৈরবপুর আর ভগবন্তপুর গ্রাম যেন এখানে অভিন্ন৷ আলাদা হলেও কোথাও যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে৷ যাইহোক চলুন এবার যাওয়া যাক ভগবন্তপুরের বেশ কয়েকটি মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে৷ 
							গড়গড়ে শিবমন্দির পর্যবেক্ষন করে লাল মোরামের বুক চিরে এগিয়ে চলল আমাদের বাইক বাবাজী৷ ভৈরবপুর গ্রাম হলেও মাটির বাড়ির তুলনায় পাকাবাড়ির সংখ্যায় নজরে পড়ল বেশি৷ বেশ কিছুটা যাবার পর এই সংকীর্ণ মোরাম রাস্তাটা মিশেছে একটা প্রশস্ত মোরাম রাস্তাতে৷ এই রাস্তাটা এঁকেবেঁকে উত্তরে চলে গেছে কেশাডাল৷ আর এই জায়গাটাতে বাঁক নিয়ে পশ্চিমদিকে চলে গিয়ে ভীম মোড়ের কাছে মিশেছে প্রধান রাস্তাতে৷ প্রশস্ত মোরাম রাস্তাটাতে উঠতেই সোজাসুজি আমাদের নজরে পড়ল দুটো রঙচঙে মন্দির৷ সামনে সবুজ ঘাসের প্রাঙ্গন৷ চলুন জেনে দেখে নিই ঐ দুটো মন্দিরের কথা৷
							
							রাসমন্দির ও গঙ্গাধর শিব মন্দির। 
							
							সামনের মন্দিরটি রাসমন্দির৷ মন্দিরটি সাতচূড়া বিশিষ্ট এবং ছ'টি প্রবেশদ্বার যুক্ত৷ প্রতিটি দ্বারে দ্বারপালও লক্ষ্যনীয়৷ রাসমন্দিরের একটু উত্তরেই দ্বিতীয় মন্দিরটির অবস্থিত৷ দক্ষিনমুখী চারচালা রীতির এই মন্দিরটি শিব মন্দির৷ নাম গঙ্গাধর শিবমন্দির৷ দুটো মন্দিরই নতুন রং করা হয়েছে দেখলাম৷ রাসমন্দিরে কোন প্রতিষ্ঠালিপি না থাকলেও শিবমন্দিরের ফলকটি এখনও জীবিত রয়েছে, তবে অনেকটা উঁচুতে থাকায় ও মোবাইলের ক্যামেরা খুব একটা উন্নত না থাকায়, ছবি অস্পষ্টই আসল৷ আর তাই সে লিপির পাঠ দিতে অপারগ হলাম৷ দেখলাম দুজন স্থানীয় ভদ্রমহিলা রাসমঞ্চের ভেতরে বসে গল্প করছেন৷ জিজ্ঞাসা করতে ওনারা মন্দির দুটির নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারলেন না৷ বললেন যাদের মন্দির (ঘোষ পরিবার) তাদের জিজ্ঞাস করতে ও তাঁদের বাড়িও দেখিয়ে দিলেন৷ এবং এটাও জানালেন যে ওদের বাড়ির পাশে আরও কয়েকটি মন্দির আছে৷
											
												 
											রাসমঞ্চের পাশে গঙ্গাধর শিব মন্দির,ভগবন্তপুর।
											 
							
							
							
											
											
												 
											রাসমন্দির, ভগবন্তপুর।
											 
							
							ঘোষ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটু পরে কথা বলে মন্দিরের ইতিহাস তেমন না জানতে পারলেও, জেনেছিলাম যে, ওনারাই মন্দিরগুলোর সেবাইত বংশধর৷ ওনাদের পূর্বপুরুষেরা এসব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা৷ ওনারা সেবাইত বংশ হিসাবে বিগ্রহগণের সেবাপুজো চালিয়ে আসছেন৷ এই শিবমন্দির ছাড়াও আরও দুটো শিব মন্দির, তিনটা দামোদর মন্দির রয়েছে৷ সেসব মন্দিরের কথা আমরা একটু পরেই তুলে ধরব৷ ওনারা বললেন, সব থেকে জাঁকজোমক ভাবে যে অনুষ্ঠানটি হয় তা হল রাস উৎসব৷ কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমাতে এই রাসমন্দিরেই হয় সে উৎসব৷ দামোদর মন্দির থেকে রাধা দামোদরকে এই সময় রাসমঞ্চে আনা হয়৷ ঘোষ পরিবারের যে সব সদস্য দেশ বিদেশে থাকেন তাঁরা বছরের অন্য সময় আসতে না পারলেও রাসের সময় অবশ্যই আসেন৷ তবে এই উৎসব কেবল ঘোষ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না৷ গোটা ভগবন্তপুর, ভৈরবপুর সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের মানুষও এই সময় আসেন৷ বোঝা যায় রাসউৎসবকে কেন্দ্র করে বিশাল জনসমাগম ঘটে ওই সময়৷ যাত্রাপালা, নাটক, কীর্ত্তন প্রভৃতিও হয়৷
							
							বিশ্বম্ভর ও গগনেশ্বর শিব মন্দির এবং দামোদর মন্দির। 
							
							রাসমন্দিরের পাশ দিয়ে উত্তরদিকে যে ঢালাই রাস্তাটি ঘোষ পাড়ার দিকে ঢুকে গেছে আমরা সে পথেই ঢুকলাম৷ একটু যেতেই সামনে নজরে পড়ল দেওয়াল ঘেরা তিন তিনটা প্রাচীন মন্দির৷ লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই প্রাণটা জুড়িয়ে গেল৷ মন্দির প্রাঙ্গন সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন৷ বাম পাশের দেউল রীতির মন্দিরটি বিশ্বম্ভর শিবের৷ মন্দিরটির গেটের উপরে একটি অপরূপ কারুকার্যমন্ডিত টেরাকোটার কাজ লক্ষ্য করলাম৷ ডান পাশের মন্দিরটিই দামোদরের৷ এটি চাঁদনি আদলের এবং মন্দির গাত্রে টেরাকোটার ফলক চোখে না পড়লেও পঙ্কের অপরূপ কাজ লক্ষনীয়৷
											
												 
											বামপাশে বিশ্বম্ভর শিব মন্দির৷ মাঝে দামোদর মন্দির৷ আর তার সম্মুখে গগনেশ্বর শিব মন্দির৷ স্থান— ভগবন্তপুর৷।
											 
							মন্দিরে রাধা, দামোদর ছাড়াও শীতলাও পূজিত হন৷ এই মন্দিরের দঃদিকে লাগায়া মন্দিরটিও শিব মন্দির এবং এটিও বিশ্বম্ভর শিব মন্দিরের মত শিখর আদলেই তৈরি এবং তাতেও টেরাকোটার ফলক লক্ষ্য করা গেল৷ এই মন্দিরের শিব হল গগনেশ্বর শিব৷ জানা গেল, প্রতিদিনই মন্দিরের বিগ্রহগনের নিত্যসেবা হয়ে থাকে৷ এখানে উল্লেখ থাকে যে এই দামোদর মন্দির ছাড়াও আরও দুটো দামোদর মন্দির রয়েছে এই পাড়াতেই, আর দুটোরই সেবাইত বংশধর ঘোষরা৷ চলুন সে দুটো মন্দির ও দেখে নেওয়া যাক৷
							
							অপর দুটি দামোদর মন্দির । 
							
							এই স্থান থেকে বেরিয়ে পশ্চিমমুখী যে ঢালাই রাস্তাটা এই পাড়ার ভেতর দিকে ঢুকেছে আমরা সেই পথ ধরে এগিয়ে গেলাম৷ একটু যেতেই ডানদিকে নজরে পড়ল একটি প্রাচীন আটচালা মন্দির৷ মন্দিরটি ইটের তৈরী৷ দক্ষিনমুখী ও ত্রিখিলান প্রবেশপথ যুক্ত৷ মন্দিরের সামনে টেরাকোটার ফলকগুলোর একটিও আর অবশিষ্ট নেই৷ কেবল পঙ্কের কিছু কাজ লক্ষ্য করা গেল৷ মন্দিরটির চূড়াতে আগাছা আর গাছ জন্মেছে৷ যা মন্দিরটিকে আরও ভগ্নপ্রায় করে তুলছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ জানা গেল, এই মন্দিরটিও দামোদরের৷ এবং আরও একটি দামোদর মন্দির আছে দঃপঃ কোণে৷ তিনটি আলাদা আলাদা মন্দির হলেও তিনটি মন্দিরেই একই বিগ্রহ পূজিত হন৷ কেন এই একটি বিগ্রহের জন্য তিন তিনটি মন্দির তৈরী হল? সেবাইত বংশের সদস্যদের জিজ্ঞাসা করে যেটুকু বোঝা গেল তা হল, এই বংশের যিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি অথবা তার কোন উত্তরপুরুষ পরবর্তীকালে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তার সাথে পরিবার আলাদা হতে শুরু করলে, আলাদা আরও দুটি মন্দির নির্মিত হয়৷ 
											
												 
											ত্রিখিলান প্রবেশপথ যুক্ত দামোদরের চাঁদনি৷ স্থান— ভগবন্তপুর।
											 
							
							
							
							
											
												 
											দামোদরের অপর আর একটি মন্দির৷ কয়েক বছর আগে সংস্কার করা হয়েছে৷ স্থান— ভগবন্তপুর।
											 
							
							
							
											
											
												 
											দামোদরের আর আর একটি মন্দির৷ আটচালা রীতির মন্দিরটি বর্তমানে ধ্বংসপ্রায়৷ স্থান— ভগবন্তপুর।
											 
							জানা গেল, শ্রীরাধা দামোদরকে এই মন্দিরে নিয়ে এসে আট মাস পূজা করা হয়৷ আর আগের দামোদর মন্দিরটিতে দু' মাস করা হয়৷ এবং অপর যে মন্দিরটি আছে সেখানে বাকি দুমাস শ্রীবিগ্রহগণকে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়৷ তৃতীয় মন্দিরটি এই প্রাচীণ চালা মন্দিরের একটু অদূরেই (দঃপঃ কোণে) অবস্থিত৷ দক্ষিনমুখী এই মন্দিরটি চাঁদনি আদলের৷ মন্দিরটি গায়ে লাগানো একটি মার্বেল ফলক থেকে জানা যায়, ১৪১৩ সনে মন্দিরটি পুনসংস্কার করা হয়৷
							
							শীতলা মন্দির। 
							
							ঘোষ পরিবারের তৃতীয় দামোদর মন্দিরটি দেখার পর আমরা ভীমমোড়মুখী মোরাম রাস্তাটিতে গিয়ে উঠলাম৷ একটু দূরেই দেখা গেল দেশের শীতলা মন্দিরটি৷ মন্দিরের সামনে একটি হরিচালাও লক্ষ্য করা গেল৷ আমরা বেশিক্ষন এখানে কাটালাম না৷ কারণ আমাদের অনেকটা পথ এখনও যেতে হবে৷ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কেশাডাল৷ তাই শীতলা মন্দিরের ছবিটি তুলেই আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম৷
							(চলবে)
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
											
							
								
							midnapore.in
							(Published on 03.01.2021)
							 
							
							কৃতজ্ঞতাঃ- 
							 ● ভ্রমণসঙ্গী ও ছবিওয়ালা— রাজকুমার প্রসাদ ও সুরোজ খান
						
							 ● ভ্রমণ সহায়ক গ্রন্থ—'চন্দ্রকোণা ইতিহাস ও সংস্কৃতি'—ডাঃ সুদর্শণ রায়
						
							 ● ভ্রমণ সহায়ক প্রবন্ধ—'ভগবন্তপুর অঞ্চলের পুরাকীর্তি ও শিক্ষা সংস্কৃতি'—সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
						
							 ● সাক্ষাৎকার—সর্বশ্রী বুদ্ধদেব ঘোষ, নবীনানন্দ ঘোষ, অরুণ ঘোষ,বাবুসোনা ঘোষ
						
							 ● বিশেষ সহায়তা—সর্বশ্রী চিন্ময় দাশ, সন্তু অধিকারী