Crow Festival of Gopiballavpur | গোপীবল্লভপুরের কাক মহোৎসব

গোপীবল্লভপুরের কাক মহোৎসব বাংলার এক ব্যতিক্রমী উৎসব

The Crow Festival at Gopiballavpur is an exceptional festival in Bengal

সুদর্শন নন্দী।


বারো মাসে তেরো পার্বণের এই বাংলায় উৎসবের যেন আর শেষ নেই। তিথি, ব্রত, পুজো, মেলা এসব ছাড়াও যেমন বিচিত্র ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে উৎসব-মহোৎসবের নেপথ্যে, তেমনি বিভিন্ন উৎসবেও দেখা যায় বিভিন্ন বিচিত্র সব অনুষ্ঠান।এরকমই এক ঘটনাবহুল মহোৎসব হয় মেদিনীপুরের (এখন ঝাড়গ্রাম জেলায়) প্রান্তিক ব্লক একদা নকশাল অধ্যুষিত এলাকা গোপিবল্লভপুরের গোপিবল্লভজীউয়ের মন্দিরে।

গোপীবল্লভপুরের কাক মহোৎসব | Crow Festival at Gopiballavpur
গোপীবল্লভপুরের কাক মহোৎসব | Crow Festival at Gopiballavpur

সদর মেদিনীপুর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে উড়িষ্যা সীমান্তের কাছাকাছি এই গ্রাম্য শহর। পাশেই বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা নদী। নদী না বলে বর্ণময় ইতিহাসের নীরব সাক্ষী বলা যেতে পারে। একদা উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত এই গোপীবল্লভপুর ষোড়শ শতাব্দীতে মেতে ওঠে মহাপ্রভু শ্যামানন্দ-রসিকানন্দের বৈষ্ণবধর্ম আন্দোলনে। আবার সেই আধ্যাত্মিক মাটিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক আগে গর্জে উঠেছিল সশস্ত্র নকশাল আন্দোলন।

সে অন্য বিষয়। আসি কাক মহোৎসবের প্রাক বর্ণনায়। শ্রীচৈতন্যোত্তর কালে মেদিনীপুরে বৈষ্ণব আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন শ্রীশ্যামানন্দ এবং তাঁর শিষ্য রসিকানন্দ। শ্যামানন্দ ১৫৩৫ খৃস্টাব্দে খড়গপুর কলাইকুণ্ডার কাছে ধারেন্দায় (মতান্তরে দণ্ডেশ্বরে) জন্মগ্রহন করেন। দীক্ষা নেন তিনি শ্রীহৃদয়চৈতন্যপ্রভুর কাছে। পরবর্তীকালে শ্যামানন্দ মহাপ্রভু বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছেও দীক্ষা নেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রীহৃদয়চৈতন্যপ্রভু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বৃন্দাবনে গিয়ে শিষ্য শ্যামানন্দকে প্রচণ্ড অপমান করেন এবং আঘাতও করেন। কথিত, এরপর শ্রীহৃদয়চৈতন্যপ্রভু স্বপ্নে চৈতন্যমহাপ্রভুর রুষ্ট বিগ্রহ দেখতে পান। চৈতন্যদেব শ্রীহৃদয়চৈতন্যপ্রভুর ব্যবহারে ব্যথিত হন এবং তাঁকে দণ্ড ( শাস্তি ) দেন। দণ্ড হিসেবে আদেশ দেন তিনি যেন বারোদিন ধরে বৃন্দাবনে দণ্ড-মহোৎসব করেন প্রতি বছর। প্রথম গুরুদেব শ্রীহৃদয়চৈতন্যপ্রভুর কাছে এই কথা শুনে শিষ্য শ্যামানন্দ ঐ উৎসবের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।পরে সেই উৎসব গোপীবল্লভপুরে আরম্ভ হয়।

গোপীবল্লভপুরের কাক মহোৎসব | Crow Festival at Gopiballavpur
গোপীবল্লভপুরের কাক মহোৎসব | Crow Festival at Gopiballavpur

আমরা জানি শ্যামানন্দের শিষ্য রোহিণীর শ্রীরসিকানন্দ সুবর্ণরেখা নদীর অপর তীরে গোপীবল্লভপুরে তাঁদের গোবিন্দজীউয়ের বিগ্রহ সরিয়ে আনেন। পরে গুরু শিষ্য মিলে তৈরি করেন গোপীবল্লভপুরে গোপীবল্লভজীউয়ের মন্দির। জ্যৈষ্ঠ মাসে এই মন্দিরেই হয় বারোদিন ধরে দণ্ড মহোৎসব। আর এই দণ্ড মহোৎসব থেকেই সূচনা হল কাক মহোৎসবের। দণ্ড মহোৎসবকালে রসিকানন্দ খেয়াল করলেন যে বারোদিন ধরে যে সংকীর্তন, পূজা পাঠ হয় তাতে এলাকার সমস্ত কাকপক্ষী ধারে কাছে আর আসে না। তারা সব দূরে কোথায় চলে যায় বা লুকিয়ে থাকে। সে কথা মাথায় রেখে রসিকানন্দ আরেকটি মহোৎসবের প্রচলন করলেন দণ্ড মহোৎসবের পরের দিন।

সেদিন ঠিক হল কাকপক্ষীর বিভিন্ন খাবার তৈরি করে তা মন্দির প্রাঙ্গণ ও বিস্তীর্ণ চত্বরে ছড়িয়ে দেবেন। এবং সেই মতো দণ্ড মহোৎসবের পরের দিন দিলেন তাই। আর সেই খাবার দেখে অসংখ্য পাখি কাক ভিড় জমাল খাবার খেতে। দূরদূরান্ত থেকেও আসতে থাকে কাকপক্ষীর দল। অর্থাৎ বারোদিন দণ্ড মহোৎসবে সঙ্কীর্তনের আওয়াজে চলে যাওয়া পাখির দল আবার ফিরে আসে কাক মহোৎসবে। বলা চলে এ যেন দণ্ড মহোৎসবের জন্য আরেক দণ্ডের প্রায়শ্চিত্ত। জ্যৈষ্ঠ মাসের এই উৎসব দেখতে উড়িষ্যা ঝাড়খণ্ড ও জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন। বসে মেলাও। আর ত্রয়োদশ দিনের কাক মহোউৎসবে মানুষের সাথে ভিড় করে মুক্তবিহঙ্গ ও কাকের দল। সেদিন তাদেরও মহাভোজ। এই কাক-মহোৎসব শুধু মেদিনীপুর নয়, বাংলার এক ব্যতিক্রম উৎসব বলা চলে।


midnapore.in

(Published on 08.11.2020)