football player Jiban Rana (Midnapore), জীবন রানা

জীবন রানা | Jiban Rana

সুশান্ত ঘোষ।


"ওর বাঁ দিকটা ব্লক কর, ওকে বাঁ পায়ে বল তুলতে দিসনা" -

তিনি মাঠে খেললে, মাঠের বাইর থেকে অভিজ্ঞ ব্যাক্তিরা এমনটাই বলে সাবধান করতেন নিজের দলের খেলোয়াড়দের। সেন্টার লাইন পেরোনোর পরে বাঁ পায়ে সট নেওয়ার অল্প একটু জায়গা পেলেই, নির্ভুল ভাবে সেই বল সেকেন্ড-বারে'র গা ঘেসে পৌঁছে যেত লক্ষে।

football player Jiban Rana (Midnapore), জীবন রানা
জীবন রানা | Jiban Rana

ফুটবল যেমন ছিল তার জীবন, নামটাও তার জীবন। পুরো নাম "জীবন রানা", মেদিনীপুরের ফুটবল মহলে অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। ফুটবল প্রিয় হতদরিদ্র এই মানুষটিকে আজ থেকে পনের বছর আগেও মেদিনীপুর লীগ সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে দেখা যেত। পেশায় ভ্যান-রিক্সা চালক জীবন'দার খেলায় ছিল শিল্পের ছোঁয়া।

খুব ঠান্ডা মাথার এই খেলোয়াড়টি খেলতেন বাঁ পায়ে। এমনিতেই বাম পায়ের খেলোয়াড়দের খেলা বেশ দৃষ্টিনন্দন হয়, সঙ্গে ছিল খুব সুক্ষ ড্রিবলিং, ছোট্ট ছোট্ট টাচ, ও ফাইনাল পাস বাড়ানোর অসাধারণ ক্ষমতা। তার কয়েক টি নিখুঁত ফাইনাল পাস যে কোন ম্যাচের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। খেলতেন মিডফিল্ডার পজিশনে, যার ফলে অনেক দায়িত্ব নিতে খেলতে হত। গোটা মাঠ জুড়ে যখন জীবন দা খেলতেন, তখন যেন মনে হতো ওর শরীরে বোধহয় অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানো আছে। এমনিতে রোগা পাতলা শরীর কিন্তু কভারিং টা তুখোড় হওয়ার কারনে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের তার কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নেওয়া ছিল বেশ কঠিন। স্পিড খুব একটা ছিল না, কিন্তু বল ধরা ও ছাড়ার বোধবুদ্ধি প্রখর থাকার কারনে স্পিডের প্রয়োজন পড়তো না।

যারা তার সঙ্গে খেলেছেন তারাই জানেন, পঞ্চাশ বছর বয়সেও তার পায়ের সঙ্গে হালকা টাচ হলেই মনে হত লোহার তৈরী পা। তার খেলায় ছিল অনেকটা প্রয়াত কিংবদন্তি ভারতীয় ফুটবলার কৃশানু দে'র ছোঁয়া। প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবল খেলেছেন, 'ডানকান কাপ', 'গোষ্ঠ পাল স্মৃতি ফুটবল' এর মতো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও পেয়েছেন, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। পেটে ছিল ক্ষুধা ও শিক্ষা দুটোরই অভাব। এছাড়াও আমাদের ফুটবলের পরিকাঠামোর অভাব থাকার কারনে এই শিল্পি খেলোয়াড়'টির পক্ষে খুব বেশিদূর নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, তাই এই সত্তর বছর বয়সেও জীবনদা'কে জীবনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রতিদিন মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটি এলাকায় ভ্যান রিক্সা নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় খদ্দেরের আশায়।

ঐ যে বললাম আমাদের ফুটবলের পরিকাঠামো গত সমস্যা। না হলে কি এমন একজন শিল্পী ফুটবলার কে জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয় ? ফুটবল কে জীবনদা অনেক কিছুই দিয়েছেন, তার শিল্পি ফুটবল অনেককেই আনন্দ দিয়েছে কিন্তু ফুটবল জীবনদা'কে কিছুই দেয়নি। খেলেছেন ডায়মন্ড স্পোর্টিং ক্লাব (এই ক্লাবে উনার শেষ সময়ে উনার পাশে আমারও ২ বছর খেলার সুযোগ হয়েছিল), নেতাজী স্পোর্টিং ক্লাব, প্রদীপ সংঘ, মিত্র কম্পাউন্ড অ্যাথলেটিকস্ ক্লাব, বজরং ব্যায়ামাগার, খড়গপুর সেটেলমেন্ট সহ অনেক নামি দামি ক্লাবে। তাই যে মানুষটার নিজের নামের সঙ্গে ফুটবল ছিল সমার্থক শব্দ, এখন তার কাছেই ফুটবলের কথা বললে যেন নীরব শ্রোতা হয়ে যান। ফুটবল সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে চান না।

football player Jiban Rana (Midnapore), জীবন রানা
জীবন রানা | Jiban Rana

ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে গেলেও বেঁচে থাকার জন্য চলছে জীবনদা'র সংগ্রাম। আমি জীবনদা'র জন্য বলতে চাই - "ফুটবল কে ভালোবেসে সর্বহারা তুমি, কিন্তু জিতে নিয়েছো হাজার হাজার মানুষের মন। তাইতো তোমাকে এখনও আমরা মনে রেখেছি জীবনদা, ধন্য তুমি।"


midnapore.in

(Published on 30.08.2020)