রথের শহর মেদিনীপুর  | Chariot City Midnapore

রথের শহর মেদিনীপুর | Chariot City Midnapore

দীপঙ্কর দাস।


প্রায় ৬৩ বছর আগেকার স্মৃতি, রথের দিন বেলা তিনটে থেকে ভোক্তাদের রথ ঝাড়া-পোঁছা-মাজা দেখতে বালক-বালিকাদের ভিড়ে মিশেছি। গণকগলির পূর্ব মুখে এই ব্যাপারটা চলত। বেলা ৫ টা থেকে গলির পশ্চিম মুখে ভিড় করে দাঁড়াত শুধু বালখিল্যরা নয়, তাদের ঠাকুমা-কাকার দলও। বিশমিনিট-আধঘন্টা পরে পরে জগন্নাথ মন্দির মুখো রথের শোভাযাত্রা ব্যাগপাইপ-কর্নেট-ড্রাম বাজিয়ে যেতে থাকতো। রথের মেলাটা আমরা বেলাবেলি সেরে রাখতাম। গলির ভিড়ের মুখে অনেকের মুখেই বেলুনবাঁশি-তালপাতার ভেঁপু-মটর বাঁশির আওয়াজ; দু/একটা মুখোশ, খুনসুটি। আমাদের ছেলেবেলায় রথ ছিল নির্ভেজাল পরব। ৭ দিন পরে ফেরতি রথ, ইস্কুলে হাফছুটি, একই দৃশ্যের পুনরাভিনয়। রথের শোভাযাত্রা চলত রাত্রি দশটা পর্যন্ত, মানুষের মাথায় কার্বাইডের আলো নিয়ে। কত রথ! আসলে কোন কোন রথ দুবারও পরিক্রমা করত।

রথের আকারে প্রকারে খুব একটা বৈচিত্র বা সতন্ত্র নেই। বড় ও মাঝারিগুলি (১২/১৪ ফুট উচ্চতা) নবচূড়; ছোটগুলি (৬/৮ ফুট উচ্চতা) পঞ্চচূড়ং পাঁজির রথের মতই পতাকা শোভিত। সবগুলির রঙই খয়েরি। সদ্য রঙ করায় পালিশের ঔজ্জ্বল্য। কোন কোন রথের প্রধান চূড়ায় পিতলের চাদর জড়ানো, সেগুলিও মেজে ঝকঝকে করা। সব রথই কাঠের। প্রতিরথেই দুটি করে বড় কাঠের ঘোড়া এবং সারথির পুতুল মূর্তি অবশ্যই থাকবে। সারথি তুলনায় ক্ষুদ্রাকৃতি, নিয়মরক্ষার। এছাড়া রথের চারপাশের কাঠের খুঁটিতে (পরিভাষার বর্ষা) লম্বাভাবে উৎকীর্ণ মূর্তির শৃঙ্খল। চারদিকের কাঠের ঝালটে এবং চূড়ার নিম্নে কৌণিক ঝালটে রিলিফ মূর্তি। রথের বিগ্রহঃ জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা; লক্ষীজনার্দন; রাধাকৃষ্ণজীউ এবং গৌরনিতাই। উচ্চতা দেড়ফুট / দুইফুট। কেবল জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহ তিনটি সাড়ে তিন ফুটের মত। বেশিরভাগ বিগ্রহই কাঠের, রাধামূর্তি কোনটা অষ্টধাতুর, কৃষ্ণমূর্তি কোনটা কষ্টিপাথরের। জগন্নাথ মন্দিরের তিনটি রথ একত্রে যাত্রা করে, এই রথএয় খুবই সাদামাটা এবং একচূড়, উচ্চতা ১৩/১৪ ফুট। কাঠের চাকা, কাঠের হাল। বাল্যস্মৃতি এই পর্যন্তই।

বর্তমানে সংস্কার কমিটির ব্যাবস্থাপনায় জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা দামি অলঙ্কারে সেজে খোল-করতাল, ব্যান্ড, সানাই সহ শহর পরিক্রমা করেন কিন্তু অন্যান্য রথের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০০৩ সালে করা জরিপে দেখা যাচ্ছে চালু রথের সংখ্যা মোট দশ (জগন্নাথের রথ ত্রয়কে একত্রে ধরে) -

১) ভোক্তাদের - সংগতবাজার

২) লক্ষী-জনার্দন বস্ত্রালয় - বড়বাজার

৩) মুখুজ্যেদের - বক্সিবাজার

৪) ভুতু দত্তদের - পাটনাবাজার

৫) বামুনদের - মিয়াঁবাজার

৬) নন্দীদের - চিড়িমারসাহী

৭) মণ্ডলদের - বল্লভপুর

৮) জেলেপাড়া - বল্লভপুর

৯) মল্লিকদের - মল্লিকচক

১০) জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা - জগন্নাথ মন্দির চক।

আর যেগুলি বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলি হল -

১) বাঁড়ুজ্যেদের - চিড়িমারসাহী

২) সাউদের - বল্লভপুর

৩) পরীর রথ - মানিকপুর

৪) মুক্তারবাবুর রথ - পাটনাবাজার

৫) কাশিকাশুর রথ - পাটনাবাজার।

অর্থাৎ মোট পনেরোটি। বাল্যস্মৃতির সঙ্গে বিস্তর ফারাক। যতদূর মনেপড়ে ১৯৭৬ সালে গণনা করে একুশটি রথের হিসাব পেয়েছিলাম, দুঃখের বিষয় সে হিসাব নথিবদ্ধ করে রাখিনি। তবে ওই ২১ সংখ্যার মধ্যে কিছু ছোট রথ ছিল ৪/৫ ফুট উচ্চতার পঞ্চচূড়, এগুলি ছেলে ভোলানো আয়োজন; এই রথগুলি পাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো, বড় রাস্তায় যেত না।


সাধারণত সেই অঞ্চলের প্রধান দেবতার রথকে ঘিরেই, মেলা এবং উৎসব হয়ে থাকে। মেদিনীপুর ব্যাতিক্রম নয়। রথের মেলা জগন্নাথ মন্দির চকেই বসে। কিন্তু এতগুলি রথ একটি শহরে, পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র দেখা যায় না। তার বাহ্য কারণ এতদঅঞ্চলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে, অনেকগুলি স্বতন্ত্র মন্দিরের অস্তিত্ত্ব। কিন্তু আরো দুটি গুরুকারণ আছে, তা অবধান যোগ্য। মেদিনীপুর জেলা সদর হওয়ায় বেশ কয়েকজন বড় জমিদারের স্থায়ী নিবাস এবং জমিদারী আড়ম্বরের বহিঃপ্রকাশ রথ। দ্বিতীয় কারণ শহরের সম্পন্ন ব্যাবসায়ীদের রথযাত্রাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে গ্রহণ করা। বড়বাজারের ব্যাবসায়ী এবং এমনকি জনৈক মুক্তারবাবু প্রবর্তিত রথ সেই ইঙ্গিত বহন করে।

কলকাতা শহর জমে ওঠার পরেও অনেকগুলি রথ চালু ছিল, তবে কারণ স্বতন্ত্র। বিভিন্ন বর্দ্ধিষ্ণু পল্লীতে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হত; যেমন শিয়ালদহ, ভবানীপুর ইত্যাদি। শহরতলীতেও বিভিন্ন গ্রামে রথযাত্রা প্রচলিত ছিল। আগাগোড়া শহর হয়ে ওঠার পরেও তার অনেকগুলি চালু ছিল, কিন্তু সেগুলি কখনোই গোটা শহর পরিক্রমা করত না। এখন অবশ্য কলকাতার পথে ইস্কনের রথ ছাড়া অন্য কোন রথ বেরোয় না।

মেদিনীপুর শহরে রথ একটি প্রধান উৎসব, ইস্কুল-কাছারি বন্ধ থাকে। জমজমাট মেলা বসে, প্রচুর গাছগাছালি, মাদুর, বাঁশের বোনা ঝুড়ি ঠেকা, তালপাতার ভেঁপু, বেগুনবাঁশি, কাঁচের চুরি, কাঁঠাল, আনারস, খাজা ইত্যাদি মিষ্টান্ন, মনিহারিদ্রব্য বিক্রয় হয়।


midnapore.in

(Published on 14.06.2020)