Home » Corona & Amphan Relief » Amphan Relief 3
আমফান আসার আগেই আমরা ঠিক করেছিলাম যে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্য করব। ২০ তারিখ আমফান হয়ে যাওয়ার পরে ২১, ২২ ও ২৩ তারিখ আমাদের পূর্ব মেদিনীপুরের সদস্য'রা (উপকূল অঞ্চলের) তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ি সারাতেই ব্যস্ত ছিলেন। তাছাড়া অন্যত্র গিয়ে খবর নেওয়ার মত অবস্থাও ছিলো না, সমস্ত রকমের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। নিজেদের মধ্যেই আমরা সারাদিনে হয়ত কোনমতে ১ বার কথা বলতে পারতাম। অনেক সমস্যার মধ্যেও ২৪ ও ২৫ তারিখ আমাদের সদস্যরা (মূলত সুদর্শন ও জ্যোতির্ময়) এলাকাগুলি ঘুরে দেখে জানান যে খেজুরী-২ ব্লকটি সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত। এলাকাবাসিরা জানায়, খেজুরী-২ অঞ্চলে (মূলত মৎসজীবি পরিবারের বসবাস) সেই মুহূর্তে সবথেকে প্রয়োজন শুকনো খাওয়ারের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সদস্য দিনেন্দু মান্না সব ব্যবস্থা করে একটি ছোট ট্রাকে খাদ্যসামগ্রী বোঝাই করে পরের দিন অর্থাৎ ২৬ তারিখ পৌঁছে যান খেজুরী-২ অঞ্চলে। আরেক সদস্য সুদর্শনের সাহায্যে সেখানে বিতরণ করা হয় শুকনো খাদ্যসামগ্রী।
তখনো পর্যন্ত খেজুরী-২ অঞ্চলে কোনরকম সাহায্য পৌঁছয়নি। পৌঁছয়নি কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা সংবাদ মাধ্যম। টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া সারাদিন কলকাতা ও ২৪ পরগনাকে নিয়েই ব্যাস্ত ছিল। আমরা ২৭ তারিখ সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের খাদ্যবিতরণ ও খেজুরী-২ অঞ্চলের পরিস্থিতির কথা জানাই।
তিনদিন অপেক্ষা করে তেমন কোন সাহায্য আসছে না দেখে ৩০ তারিখ জ্যোতির্ময় ও প্রদীপ ছোট ট্রাকে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আবার পৌঁছয় খেজুরী-২ অঞ্চলে। আগেরবারের মতোই সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের খাদ্যবিতরণ ও খেজুরী-২ অঞ্চলের পরিস্থিতির জানানো হয়। এরপর নানা রকমের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে বেশকিছু সংগঠন। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাঁথি রামকৃষ্ণমিশণ।
অন্যান্য সংগঠনগুলি এগিয়ে আসায় আমরা আমাদের ত্রাণকার্য সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখি কিন্তু আমাদের সমীক্ষা (কি প্রয়োজন?) চলতে থাকে। ১ তারিখ দিনেন্দু মান্না জানান যে তার ছোট মেয়ে দেবাদ্রিতা'র অন্নপ্রাশনে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবকে না খাইয়ে খেজুরী-২ অঞ্চলের পরিবারদের খাওয়াতে চান। এদিকে সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে দীর্ঘিদিন বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় অনেক পরিবারে খুব সমস্যা হচ্ছে। সাপের উপদ্রপও বেড়েছে কিন্তু আলো নেই। আমরা ঠিক করি যে ২০০ টি দরিদ্র পরিবারকে রিচার্জেবল লাইট দেব যা টর্চ হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে আবার ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনার কাজেও ব্যবহার করতে পারবে। পরিকল্পনাটি শুনে আমাদের সদস্য ডঃ বিভাসকান্তি মন্ডল জানান যে তিনি তাঁর বাবা নগেন্দ্র মন্ডল ও মা রাধারানী মন্ডলের স্মৃতিতে রিচার্জেবল লাইটগুলি দিতে চান (উল্লেখযোগ্য যে বিভাসদা বাবা-মায়ের স্মৃতিতে শুরু করেছেন নগেন্দ্র-রাধারানী সেবায়তন)। এছাড়াও বেশকিছু পরিবারকে শুকনো খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ঠিক হয় যে ১৫ই জুন একই দিনে আমরা খাদ্যসামগ্রী, রান্নাকরা খাওয়ার ও রিচার্জেবল লাইট দেব। ইতিমধ্যেই একদিন দিনেন্দু কলকাতা গিয়ে রিচার্জেবল লাইটগুলি কিনে আনেন।
১৫ জুন ভোর ৫টা থেকে শুরু হয় আমাদের কর্মকান্ড। রান্নার জিনিসপত্র আগের দিনই কেনা হয়েছিল, বাকি ছিল মাছ। দিনেন্দু ভোর পাঁচটায় হেঁড়িয়া বাজারে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, সমস্ত মাছ কাটিয়ে অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ট্রাকে তুলে দেন। ৬.৩০ টার মধ্যেই সমস্ত রান্নার জিনিস পৌঁছে যায় বনবাসুড়িয়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে (যেখানে রান্না হবে)। আমি মেদিনীপুর থেকে বাইকে যাত্রা শুরু করি ৭.৩০ টার সময় (বৃষ্টির জন্য বেরোতে দেরি হল)। জ্যোতির্ময় বাইকে রওনা দেয় রামনগর থেকে এবং রাজকুমার এগরা থেকে। তমলুকের একটু আগে অনন্তপুর থেকে বাইক নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেয় পার্থ। দিনেন্দু হেঁড়িয়াতেই ছিল এবং সুদর্শন ছিল কালীনগরে'র কাছে।
১০.৩০ টায় আমরা সবাই হেঁড়িয়াতে মিলিত হই (মাঝে মাঝে বৃষ্টির জন্য সময় বেশি লাগল)। একটি বড়ো অটোতে শুকনো খাদ্যসামগ্রী এবং রিচার্জেবল লাইট বোঝাই করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ি (অটোতে সুদর্শন এবং বাকি সবাই বাইকে)। কলাগাছিয়া, বিদ্যাপীঠ পেরিয়ে খেজুরী-বটতলার একটু আগে আমাদের প্রথম গন্তব্য খেজুরী গ্রামে পৌঁছাই।
আজকের এই আমফান বিধ্বস্ত খেজুরী গ্রাম অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর শহর হয়ে উঠেছিল। খেজুরী বন্দরকে বাংলা তথা পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার বলা হতো। আমাদের সদস্য ভগীরথ পাত্র তালিকা তৈরী করে আগের থেকেই অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। তালিকা অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী ও রিচার্জেবল লাইট বিতরণ করার পরে আমরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। পূর্ব পাঁচুড়িয়া,পশ্চিম পাঁচুড়িয়া, নানকার গোবিন্দপুর, ওয়াশীলচক, উত্তর থানাবেড়্যা, দক্ষিণ থানাবেড়্যা ইত্যাদি গ্রামে খাদ্যসামগ্রী ও রিচার্জেবল লাইট বিতরণ করতে চলে গেল সুদর্শন এবং বাকিরা গেলাম আমফান ঝড়ের পরে খেজুরী'র বিখ্যাত প্রাচীন পোস্ট-অফিসের অবস্থা দেখতে।
দেখে আস্বস্ত হলাম যে সরাসরি পোস্ট-অফিসের ওপরে কোন গাছ পড়েনি কিন্তু প্রচুর গাছ চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জায়গাটিকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিনত করেছে। হঠাৎ জোরে বৃষ্টি এল, তার মধ্যেই ছবি ও ভিডিও করে নিয়ে কোস্টাল রোড ধরে আমরা রওনা দিলাম পাঁচুড়িয়ার দিকে। সুদর্শন বিতরণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিল আমরা পৌঁছে বাকিটা করলাম।
বিতরণের শেষে আমরা গেলাম পূর্ব পাঁচুড়িয়া Cyclone Shelter (স্থানীয়রা আয়লা সেন্টার বলে) এর সামনে পড়ে থাকা বিখ্যাত টয়ার দেখতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমুদ্রে ভেসে এসেছিল এই বিশাল টায়ারটি। প্রস্তুতকারক Goodyear, সাইজ 30.00-51। টায়ারটির প্লাই রেটিং (Ply Rating) হল 46 অর্থাৎ 46 টি রাবারের স্তর রয়েছে (The ply rating is how many layers of rubber is on the tyre)। সাধারণত এই ধরণের টায়ারগুলি OTR Vehicle এ ব্যবহৃত হয়। টায়ার দেখতে দেখতেই আবার জোরে বৃষ্টি এল, ঘড়িতে তখন দুপুর ১.৫০।
বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা পৌঁছলাম খেজুরী সমুদ্র সৈকতে। উদ্যেশ্য ছিল পাড়ে অবস্থিত 'দত্ত খটি' পরিদর্শন করা। যারা মাছ ধরতে যান তারা অস্থায়ী ভাবে এই খটিগুলিতে থাকেন, মাছ ধরতে যাওয়ার সমস্ত সরঞ্জামও রাখা হয় এইখানে। উল্লেখযোগ্য যে কাঁথি মহকুমার মোট ৪২ টি খটির মধ্যে ২০ টি রয়েছে খেজুরী অঞ্চলে।
গিয়ে দেখলাম কেউ নেই, সবাই মাছ ধরতে গেছে। দত্ত খটি'র মোট চারটি ঘরের মধ্যে মাঝের দুটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি দুটি ঘরের মধ্যে প্রথম ঘরটি মেরামত করে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করা হয়েছে (গ্রামের যারা বাইরের থেকে ফিরেছে, তাদের জন্য) এবং শেষ ঘরটি মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা সমুদ্র সৈকতে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করলাম।
একটি বড় মেশিন চালিত নৌকা তৈরী দেখলাম। কাদিরাবাদ চর থেকে বোগা ঘাটের একটু আগে পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিমি সমুদ্র সৈকত রয়েছে খেজুরীতে। এখানে বালির থেকে কাদার ভাগ বেশি, বিকেলে গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলে। বাইক চালিয়ে দেখলাম, বেশ সুন্দর চালানো যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে মাছ ধরে ফিরে এল কয়েকজন, সঙ্গে এল জোর বৃষ্টি। আমরা দৌড়ে তাদের সঙ্গে খটি'তে আশ্রয় নিলাম। সেই প্রথম কোন খটি'র ভেতর দেখলাম। ১০/১২ ফুটের ছোট্ট মাটির ঘর, প্রবেশদ্বারের ঠিক উল্টোদিকে পুরো দেওয়াল জুড়ে বাঁশের মাচার মধ্যে মাছ ধরার জাল, দড়ি, ঝুড়ি ইত্যাদি সরঞ্জাম রয়েছে। ঘরে ঢুকেই ডানদিকে রয়েছে মাটির উনান। বৃষ্টি চলাকালীন শুনলাম তাদের দুঃখের কাহিনী। এখানে আর নাইবা বললাম। যদি মানিক বাবু থাকতেন তাহলে তাঁকে বলতাম - 'পদ্মা নদীর মাঝিদের নিয়ে তো লিখলেন এবার একটু এদের নিয়ে লিখুন'।
বৃষ্টি থামতে বাইরে এসে দেখলাম কি কি মাছ ধরেছে। আমাদের জ্যোতির্ময় আবার সব মাছ চেনে, সে বলতে লাগল - লোটে, আমুদি, চিংড়ি ও তাঁপড়া ইত্যাদি। লোটে মাছকে স্থানীয় ভাষায় বাবলা বা লহরা বলা হয় এবং আমুদি মাছকে রাংরুলি বা রুলি বলা হয়। অনেক্ষন থাকার ইচ্ছে থাকলেও বেরিয়ে পড়তে হল কারণ বার বার ফোন আসছিল খাওয়ার ওখান থেকে।
কোস্টাল রোডের পাশে ঠিক যেখানে কাউখালি লাইট হাউসের (ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া'র প্রথম লাইট-হাউস) ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, তার উল্টোদিকে একটি সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই বনবাসুড়িয়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। এখানেই ছোট্ট দেবাদ্রিতা'র অন্নপ্রাশনে'র খাওয়ান-দাওয়ানের ব্যবস্থা হয়েছে। খাওয়ার দেওয়া শুরু হয়েছে অনেক্ষন আগেই, তবুও বিশাল বড় লাইন দেখলাম।
রান্না হয়েছে - ভাত, লাল লাল আলুভাজা, মসুর ডাল, আলু-পটলের তরকারি, মাছের কালিয়া , আমের চাটনী ও পাঁপড়। বেশ একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার। বড়োরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে গল্প করছে, ছোটরা খেলায় মত্ত। অরকবাড়ী, চক অরকবাড়ী, সফরচটা ও বনবাসুড়িয়া এই চারটি গ্ৰামের ৪৫০ জন মৎসজীবী পরিবারকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। আমরা কিছুক্ষন হাত লাগানোর পর ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত কাউখালি খাল দেখতে গেলাম।
আমফানের ২৭ দিন পরেও গ্রামের চতুর্দিকে ধ্বংসের চিহ্ন। দেখতে দেখতে পৌঁছলাম কাউখালি খাল। এই কাউখালি খালই দুটি দ্বীপ হিজলি ও খেজুরীকে আলাদা করেছে। খালের পাড়ে বাঁশের মাচায় আমরা কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিলাম, রাস্তায় দর্শন করলাম সতী-মাতার মন্দির। বিজলী বেরা স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১২ বছর আগে সবার সাহায্যে এই মন্দির বানিয়েছেন।
ফিরে গিয়ে দেখলাম ভিড় কমে গেছে। বিকেল ৩.৩০ বাজে, সবার প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি বললেই চলে, সবাই একসঙ্গে খেতে বসে গেলাম। রান্না বেশ ভালোই হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার শেষে জমিয়ে আড্ডা দিলাম।
সবশেষে তালিকা অনুযায়ী আশেপাশের গ্রামের পরিবারগুলিকে বিভাসদা'র বাবা-মায়ের স্মৃতি'তে রিচার্জেবল লাইট বিতরণ করা হল। মোট ২০০ টি দরিদ্র পরিবারকে রিচার্জেবল লাইট দেওয়া হল। এই লাইট পেয়ে সবাই খুব খুশি, বিশেষ করে মহিলারা।
রওনা দেওয়ার আগে সবার সঙ্গে একটা ছবি তুললাম আমরা। ৪.৩০ নাগাদ ওখান থেকে বেরিয়ে ৫.৩০ টার সময় সবাই হেঁড়িয়াতে পৌঁছলাম। হেঁড়িয়া থেকে সবার আলাদা আলাদা রাস্তা, যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে বাইকের মিটারে দেখলাম সারাদিনে মোট ৩১৫ কিমি চলেছে।
midnapore.in