ক্ষুদিরামের জন্ম কোথায় হয়েছিল ? হবিবপুর না মোহবনী ?
Where was Khudiram born? Habibpur or Mohobani ?
खुदीराम का जन्म कहाँ हुआ था? हबीबपुर या मोहोबोनी ?
অরিন্দম ভৌমিক।
ছোটবেলায় আমরা সবাই জানতাম তাঁর জন্ম মেদিনীপুর শহরের হবিবপুরে। তাঁকে নিয়ে লেখা সমস্ত বইতেও হবিবপুরের উল্লেখ ছিল। যে কোন অনুষ্ঠানে তাঁর প্রসঙ্গ এলে এই হবিবপুরের নামই বলতেন সবাই। তাঁর জন্মদিনগুলিতে সমস্ত সংবাদপত্রে ছাপা হত হবিবপুরের নাম। অন্ততপক্ষে স্বাধীনতার পরের ৫০ বছর সবাই তাই জানতেন।
স্কুলের পাঠ শেষ করে আমি চলে গিয়েছিলাম অন্য রাজ্যে। ২২ বছর পরে আবার যখন মেদিনীপুরে ফিরে এলাম, শুনলাম ক্ষুদিরামের জন্মস্থান বদলে গিয়েছে। ক্ষুদিরাম নাকি কেশপুরের মোহবনীতে জন্মেছেন। প্রথমদিকে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি। বরঞ্চ ভেবেছিলাম ভালোই হল কারণ বিভিন্ন জায়গার মানুষ যদি ক্ষুদিরামের জন্ম তাদের জায়গায় হয়েছে বলে দাবি করেন তাহলে ক্ষুদিরামকে নিয়ে একটু বেশি আলোচনা হবে, প্রচার হবে। সেটা তো ভালোই, তাতে তো আর ইতিহাস বদলে যাবে না।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। পরে পরে দেখলাম ব্যাপারটা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁচেছে যে ইতিহাস বদলে যাওয়ার মতই পরিস্থিতি।
২০১৮ সালে আমি মেদিনীপুরে পাকাপাকি ভাবে ফিরে এসেছিলাম। সেই বছর থেকেই মেদিনীপুর শহরের হবিবপুরে ক্ষুদিরামের জন্মভিটায় ঘটা করে জন্মদিন পালন শুরু করেছিলাম। পরেরদিন সংবাদপত্রে দেখলাম, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মোহবনী গ্রামে তাঁর জন্মভিটায় জন্মদিন পালন করা হয়েছে। আরো অবাক লাগলো যে সমস্ত প্রথমসারির বাংলা সংবাদপত্রে মোহবনী গ্রামকেই তাঁর জন্মস্থান বলে উল্লেখ করেছে। বেশ অবাক হলাম কারণ সাংবাদিকরা সংবাদ দিলেই তো তা ছাপা হয় না। সেই সংবাদ সম্পাদক দেখার পরেই ছাপা হয়। কিভাবে এতগুলো সংবাদপত্রের সম্পাদকরা মোহবনী গ্রামকেই তাঁর জন্মস্থান বলে মেনে নিলেন ? কেউ কোন প্রশ্ন করলেন না ?
এরপর প্রত্যেক বছর একই ঘটনা দেখি। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মোহবনী গ্রামেই জন্মদিন পালন করা হয় এবং পরের দিন সংবাদ পত্রগুলিতেও মোহবনীকেই ক্ষুদিরামের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়। আরো খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম নতুন প্রজন্মের প্রায় সবাই মোহবনীকেই ক্ষুদিরামের জন্মস্থান বলে জানে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও যারা পোস্ট করেন তাদের অধিকাংশই মোহবনী উল্লেখ করছেন। ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। ক্ষুদিরামের জন্মভিটা মেদিনীপুর শহরের হবিবপুরে এই কথাটি সোশ্যাল মিডিয়াতে উল্লেখ করলেই অনেকে প্রতিবাদ করছেন। এছাড়াও বহু উটিউবার "ক্ষুদিরামের জন্মভিটা মোহবনী" এই শিরোনামে অনেক ভিডিও বানিয়ে ফেলেছেন।
ব্যাপারটা এখন এমন জায়গায় এসে পৌঁচেছে যে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইতিহাসের পাতা থেকেই তাঁর জন্মস্থান হবিবপুরের নাম মুছে যেতে পারে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই এই প্রবন্ধ লেখা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে "ক্ষুদিরামের জন্ম মোহবনীতে", এই ব্যাপারটা যারা শুরু করেছিলেন তারা এই তথ্য পেলেন কোথা থেকে ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি মোহবনী গ্রামের অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কারুর কাছে কোন সদুত্তর পাইনি। প্রায় সকলেই উত্তর দিয়েছেন যে - "সবাই বলে শুনেছি"।
তবে কেউ কেউ বলেছেন যে ক্ষুদিরামের সময়ে মোহবনীতে বসন বিশ্বাস নামে এক দাইমা ছিলেন যিনি তাঁর ছেলে সতীশ বিশ্বাসকে বলেছিলে যে ক্ষুদিরামের জন্ম মোহবনীতে হয়েছিল এবং তিনি নিজে ক্ষুদিরামের নাভি কেটেছিলেন। সেই সতীশ বিশ্বাসের কাছ থেকেই হয়তো মোহবনীর বাসিন্দারা জেনেছেন যে ক্ষুদিরামের জন্ম মোহবনীতে। কিন্তু এই তথ্যটি ভুল।
মোহবনীতে যে ক্ষুদিরামের জন্ম হয়েছিল এর সপক্ষে কোন তথ্য বা প্রমান নেই। কোন বইতেও লেখা ছিল না। একদল লোক জোর করে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন মাত্র।
এবার আসি হবিবপুর প্রসঙ্গে। প্রথমেই আমি স্বয়ং ক্ষুদিরামের দেওয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করব। ক্ষুদিরাম ফাঁসির কয়েকদিন আগে নিজের হাতে একটি সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী লিখে কালীপদ বসুকে দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজের হাতেই লিখেছেন "আমার পৈত্রিক ভিটা মেদিনীপুর হইতে ১০/১২ ক্রোশ উত্তর মুখে মোহবনী নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে। মেদিনীপুরে আমার জন্ম হয় ......."। সেই লেখাটির ফটোকপি প্রথম ছাপা হয়েছিল সারা বাংলা শহীদ ক্ষুদিরাম আত্মৎসর্গ শতবর্ষ উদযাপন কমিটির প্রকাশিত বইতে। পরে ২০১৮ সালে আমি আমার লেখা "কে ক্ষুদিরাম" বইতে ছেপেছিলাম।
এছাড়াও ক্ষুদিরামের বড়দি অপরূপা দেবী ৭০ বছর বয়সে "অতৃপ্ত ক্ষুদিরাম" নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধটি ১৯৪৭ সালের ২১ জুলাই 'স্বাধীনতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধেও তিনি বলেছেন - "আমাদের সকলের জন্ম মেদিনীপুরে"।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই ক্ষুদিরামকে নিয়ে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়। মনে রাখবেন যে সেই সময়ে কিন্তু ক্ষুদিরামের সমসাময়িক প্রায় সকলেই জীবিত ছিলেন। তাঁর দিদি, জামাইবাবু, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, ভাগ্নে সকলের সাহায্য নিয়েই বইগুলি লেখা হয়েছিল। সেই সমস্ত বইতেও লেখা রয়েছে ক্ষুদিরামের জন্ম মেদিনীপুর শহরের হবিবপুরে।
এই প্রসঙ্গেই বলি ভাগ্নে ললিতের কথা। সম্পর্কে ভাগ্নে হলেও প্রায় সমবয়স্ক ললিতমোহন ছিলেন ক্ষুদিরামের ভাই, বন্ধু সবকিছু। একসঙ্গে বড় হয়েছিলেন দুজনে। সেই ললিতমোহনবাবু কি লিখেছেন শুনুন -
"ত্রৈলোক্যনাথ বসু, হবিবপুর মহল্লায় অবস্থিত প্রসিদ্ধ সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের সম্মুখস্থ এক ব্রাহ্মণের ভূখন্ড ক্রয় পূর্বক তথায় বাসোপযোগী একটি কাঁচাঘর প্রস্তুত করান এবং সপরিবারে তথাতে বাস করিতে থাকেন। ক্ষুদিরামের বড়দিদি অপরূপা, মেজদিদি সরোজিনী এবং ছোট দিদি ননীবালা উক্ত হবিবপুরস্থ বাটিতেই ভূমিষ্ঠ হন। ত্রৈলোক্যনাথ বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র ক্ষুদিরাম ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ রা ডিসেম্বর মঙ্গলবার প্রাতঃকাল ৬ টার সময় এই বাসভুমিতেই জন্মগ্রহণ করে।"
ক্ষুদিরামের আগেই দু-দুটি পুত্রসন্তান কোল শূন্য করে চলে গেছিল লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর। তিনি দীর্ঘজীবি পুত্রলাভের কামনায় তিন দিন শুদ্ধভাবে অনাহারে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে হত্যা দেন। তৃতীয় দিন গভীর রাত্রে স্বপ্নে মা-কালী আবির্ভূতা হয়ে বর দেন যে, তিনি আবার একটি পুত্র লাভ করবেন।
এই ঘটনার প্রায় এক বছর পরে, ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর, শুক্লপক্ষে মহাকাশ থেকে খসে পডে়ছিল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। মেদিনীপুর শহরের হবিবপুর মহল্লার একটি বাড়িতে ভেসে উঠেছিল নবজাতকের কান্না, ধন্য হয়েছিল মেদিনীপুর, শঙ্খধ্বনীতে মুখরিত হয়েছিল একটি বাড়ি, শিশুর কান্নায় জন্ম নিয়েছিলেন সিদ্ধেশ্বরী কালী মায়ের বরপুত্র–“ক্ষুদিরাম”।
এই সেই বাড়ি আর এর ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালী মায়ের মন্দির। অনেকেই বলেন যে এই বাড়িটি ক্ষুদিরামের দিদির বাড়ি আবার কেউ কেউ বলেন বাড়িটি তাঁর মাসির। তারা ভুল জানেন। জায়গা কিনে এখানে মাটির বাড়ি করেছিলেন ক্ষুদিরামের পিতা ত্রৈলোক্যনাথ। তিনি মেদিনীপুরে নাড়াজোল রাজ এস্টেটের তহসিলদার ছিলেন। তৎকালীন প্রচলিত সংস্কার ছিল যে– আঁতুড় ঘরে সন্তানকে বিক্রি করতে পারলে সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করবে। সেই আশা ও বিশ্বাসে ক্ষুদিরামের জন্মের দিনই লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী ক্ষুদিরামকে তিন মুঠো ক্ষুদের বিনিময়ে তাঁর বড়ো মেয়ে অপরূপার কাছে বিক্রি করে দেন। অপরূপা দেবী তখন থাকতেন ঘাটাল মহকুমার হাটগেছিয়া গ্রামে তাঁর শশুরবাড়িতে।
এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন অপরূপা দেবী নিজেই। অপরূপা দেবীর মৃত্যু হয় ১৯৫০ সালে। তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়িতেই এখন থাকেন তাঁর পৌত্র সুব্রত রায় এবং স্ত্রী মমতা রায়। তাঁরাও সেই একই কথা বলেন। নিচের ভিডিওতে দেখুন।
ফেইসবুক-এ ভিডিওটি দেখুন | Watch the video on Facebook.
ইউটিউব-এ ভিডিওটি দেখুন | Watch the video on YouTube.
ত্রৈলোক্যনাথ বসুর মৃত্যুর পরে তাঁর দেনার দায়ে বাড়ি সমেত জায়গাটি নিলাম হয়ে যায়। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্থাৎ স্বাধীনতার ঠিক আগের দিন হবিবপুরের বাসিন্দারা ঠিক করেন যে ক্ষুদিরাম যেই জায়গায় জন্মেছিলেন ঠিক সেই জায়গায় একটি বেদি তৈরী করবেন। কিন্তু কে দেখিয়ে দেবেন সেই জায়গা ? ঘোড়ার গাড়িতে করে আনা হল অপরূপা দেবীকে, তিনিই দেখিয়ে দিলেন ঠিক কোন জায়গায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন অগ্নিশিশু ক্ষুদিরাম। সেইদিন রাত্রি ১২ টার সময় দেশ স্বাধীন হল। সেই বেদি থেকেই মশাল হাতে এক বিশাল শোভাযাত্রা মেদিনীপুর শহর পরিক্রমা করেছিল।
মোহবনীতে আরো ঘটা করে জন্মদিন উদযাপন করা হোক কিন্তু পৈতৃকভিটা উল্লেখ করে, জন্মভিটা নয়। ইতিহাসকে পাল্টে ফেলা ঠিক নয়। সর্বোপরি ক্ষুদিরামের জন্মভিটা বদলে দিলে তাঁকেই অসম্মান করা হয়।