আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ

আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব

Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ

চিন্ময় ঘোষ।


বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাংলার আপামর উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের অধিবাসীরা উৎসবের আমেজে মেতে থাকে চিরকাল। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক মেলা, গাজন প্রভৃতি লোকউৎসবে সব সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।



পুরনো প্রস্তর যুগ থেকেই পশুদের মত মানুষের আহার সংস্থানের একমাত্র উপায় ছিল শিকার। একক বা দলবদ্ধ ভাবে কৌশলের শিকার সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। পরবর্তী নতুন প্রস্তর যুগে আগুন জ্বালানো শিখে মানব সভ্যতা জীবনকে আরও নিরাপদ ও সহজ করে নিতে পেরেছে। আগুনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে বলশালী পশুকে বশ মানিয়ে প্রকৃতি ও পৃথিবীর সম্পদকে দখল করে নিয়েছে। উন্নত মস্তিষ্কের প্রভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। যাইহোক ফলমূল সংগ্রহ, চাষাবাদ করে ও পরে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে। শিকার নির্ভরতা কমালেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লোভে জঙ্গলে পশুপাখি নিধন চালিয়ে গেছে। কালকেতু ফুল্লরা কাহিনী সে কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।


আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ
আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ (Photo: Arindam Bhowmik)


পরবর্তী কালে রাজা রাজাদের আমলে বিলাসী রাজ পরিবারের সদস্যরা জঙ্গলে শিকার উৎসবে কিছু নিরীহ পশুপাখি শিকার করে নিজেদের বীরত্ব জাহির করে এসেছে বেশ কয়েকশো বছরে। অভাবী নিম্নবর্গের প্রজাবর্গ উদরপূর্তির জন্য জঙ্গলে বা লোকালয়ের আসে পাশে পশুপাখি শিকার করত নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শিকার এক সৌখিন লোক উৎসব হিসেবে পরিগণিত ছিল। জনবিস্ফোরণে জঙ্গল কেটে বাসভূমি তৈরি করে বনজ সম্পদ লুট করার প্রবণতা বেড়ে গেছিলো বহুলাংশে। বিশাল জলাশয়ে বুনোহাঁস, তিতির, সারস, শামুকখোল প্রভৃতি পাখি, খরগোশ, ইঁদুর, ভাম, বনবিড়াল গোসাপ প্রভৃতি ছোট পশু ছাড়াও শুয়োর, হরিণ, শিয়াল, চিতাবাঘ, ভাল্লুক জাতীয় বড় জন্তু জানোয়ার হত্যা বা শিকার করা আদিবাসী মানুষদের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়েই রয়ে গেছে এতোকাল পরেও।



যদিও বর্ণহিন্দু বা উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে এই শিকার করার প্রবণতা আজকাল আর দেখা যায় না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ভারতবর্ষে বনভূমির উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ায় শিকারের উপযোগী পশু-পাখিও প্রায় লুপ্ত হওয়ার মুখে। সর্বগ্রাসী লোলুপ মানবজাতির আগ্রাসনের কল্যাণে ভূ-প্রকৃতির সবই প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এখনও তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষায় বছরের শেষ দিনে 'চৈত্র সংক্রান্তি' বা 'চীত বক্তা সুচীৎ'-এ শিকার উৎসব পালন করে থাকে।


আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ
আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ (Photo: Arindam Bhowmik)

আদিবাসীদের এই শিকার পর্বটি "আখান সেন্দ্রা" নামে পরিচিত। পূর্বপুরুষ থেকে চলে আখান সেন্দ্রা একটি ঐতিহ্যবাহী লৌকিক ক্রীড়া উৎসবও বটে। এই পর্বের সূচনায় দূর-দূরান্ত থেকে একই সম্প্রদায়ের মানুষ কোন এক নির্ধারিত বনভূমি নির্বাচন করে জড়ো হয়। নির্বাচিত দিনে সূর্যোদয় থেকে একসাথে চলে জঙ্গলে শিকার পর্ব। নানা দলে বিভক্ত হয়ে জঙ্গলে বসবাসকারী পশু-পাখিকে বিভিন্ন কৌশলে ঘিরে শিকার করা হয়। শিকার পর্ব চলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। স্বীকার করার উপকরণও থাকে নানা বিধ। লাঠি, শাবল, তীর-ধনুক, বর্ষা, বল্লম, দা, কুঠার আরো কত কি। শিকার শেষে শিকারের পশুপাখি ডাঁই করে রাখা হয় এক স্থানে .এই স্থান হল সুতীম তান্ডি। এখানেই শিকার করা প্রাণীর ভাগ-বাটোয়ারা করে শুরু হয় ভোজ উৎসব। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সকলে মিলিত হয়ে চলে মজার সাংস্কৃতিক পর্ব। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল এই আখড়া উৎসবে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারে না। এটিতে শুধুমাত্র শিকারে সক্ষম সব বয়সের পুরুষ অংশগ্রহণ করে থাকে।



শিকার ভাগ বাঁটোয়ারা হওয়ার পর সারা রাত্রি ব্যাপি চলে সুতীম তান্ডি পর্ব। মজার এই সুতীম তান্ডি পর্ব শিকার ক্লান্ত লোকেদের শরীরে অক্সিজেন যোগায় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ক্লান্তি মেটাতে হাড়িয়া, মদ জাতীয় সামগ্রী ব্যবহৃত হয় এই সময়টাকে উত্তেজনা পূর্ণ করে তোলার কারণে। এনে-সেরেঙ্গঁ, কাহনী ছাড়াও পৌরাণিক পালাগান, বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢোল, মাদল, ধামসা, কাড়া-নাকাড়া, বাঁশি ও কেঁদারা বাজতে থাকে সারা রাত ধরে। লৌকিক অলৌকিক গল্পগাথা, স্বরচিত গীতগল্প ও পরিশেষে অশ্লীল আদিরসের কৌতুকনক্সা পরিবেশকের বাচন মুন্সিয়ানায় উপস্থাপিত হয়। আসর রাত বাড়ার সাথে সাথে জমে ওঠে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে খাওয়া-দাওয়ার পরে সুতীম তান্ডি শেষ হয়।



সুতীম তান্ডির সাংস্কৃতিক পর্বে বিভিন্ন এলাকার পারদর্শী ব্যক্তিরা এ সময় খুব সম্মান পেয়ে থাকে। তাদেরকে খুশি রাখার জন্য নানা বিধ ব্যবস্থা করা থাকে। তাদের মুন্সিয়ানা ও কুশলতা সুতীম তান্ডির উর্বরতা বৃদ্ধি করে শ্রোতাকে আনন্দের চরম সীমায় পৌঁছে দেয়। আদিবাসী নৃত্যের মাধ্যমে শিকারের নানা পৌরাণিক কাহিনী ভেসে ওঠে। মারাংবুরু, জাহের আয়ো, বরাম বুড়ি, মুচরী প্রভৃতি দেবদেবী, চুড়িন (দৈত্য বা রাক্ষস) ডাহানি, বাঘুৎ (ভূত বা প্রেতাত্মা) প্রভৃতি অপদেবতারা অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে অবতীর্ণ হতে থাকে। পুরুষ অভিনেতা মঞ্চে নারীর পোশাক পরে আসরে নেমে পড়ে। শন্ বা পাটের সুতোয় রং করা চুল মাথায় চাপিয়ে, গাছের বাকলের আদলে শাড়ি পরে, নারকেলের মালা দিয়ে বক্ষদেশ শোভিত করে অভিনয়ে নেমে পড়ে। হাতে তৈরি নানা জীবজন্তুর মুখোশ পরে দর্শকের মনোরঞ্জন করে। জঙ্গলের নানা প্রজাতির গাছপালা এদের কাছে পবিত্র। নানাবিধ ঔষধির গুণে জঙ্গলে বড় গাছপালা দেবদেবীর সম্মানে পূজিত হয়। প্রেতাত্মা, বাঘুৎ বা বন্য জন্তুদের থেকে রক্ষা করার জন্য এরা বড়াম বুড়িকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে নিয়মিত পূজা করে থাকে। এক কথায় জঙ্গল এদের কাছে মাতৃসম পবিত্র ও শ্রদ্ধাস্পদ।


আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ
আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ (Photo: Arindam Bhowmik)

তাই কাহনী'র মধ্যে গাছগাছড়ার বর্ণনা ও উপস্থিতি প্রায়ই থাকে। সরল জীবন যাপনে বিশ্বাস করে বলে গল্পে নাটকে কাহিনীতে বদ-স্বভাব যুক্ত চরিত্রদের পরাজয় বা মৃত্যু ঘটে থাকে। হাস্যরসাত্মক কৌতুক বা তামাশায় আদি রসাত্মক অশ্লীল কথোপকথন একটু বেশি মাত্রায় থাকে। এইগুলি মজাদার পরিবেশনের গুনে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয় সকলের কাছে। আঞ্চলিকভাবে এগুলির পরিবেশনে ভাষার কারণে ভিন্নতর হলেও যোগ্য উপস্থাপকের নৈপুণ্যে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।



সুতীম তান্ডির এক বিশিষ্ট চরিত্র হলো ঠপঙ্গঁ-এর ভূমিকা। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাঁওয়ার (চামর) হাতে সিঙ্গা বা সাঁকয়ী ফুঁকে ঠপঙ্গঁ এক পর্ব থেকে অন্য পর্বকে কমিকসের মাধ্যমে জুড়ে দিতে থাকে। দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য এর ভূমিকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঠপঙ্গঁ-এর উপস্থাপনা উপর অনুষ্ঠানের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুচারু রসবোধ পরিবেশন করার ক্ষমতা থাকতে হয় তার। যাইহোক শেষে সেন্দ্রা বঙ্গা কে প্রণাম জানিয়ে রাত শেষে সুতীম তান্ডি শেষ করে শিকারীরা নিজেদের দল নিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে ফিরে আসে নিজেদের বিশ্রাম কক্ষে। এখানেই ঐদিনের মতো শিকার পর্ব শেষ হয়।



পরের দিন সুতীম তান্ডি এলাকায় এই উপলক্ষে মেলা বসে। যে অঞ্চলে সুতীম তান্ডি অনুষ্ঠিত হয় সেই এলাকার মাতব্বররা (অরাজনৈতিক) এই মেলার আয়োজন করে আর যাতে কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার ব্যবস্থা করে। এই মেলায় দোকানপাট ও নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ এই মেলায় উপস্থিত হয়। মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল আদিবাসীদের নিজস্ব "দঙ্গেঁড় নাচ"। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বা তারও বেশি প্রশিক্ষিত পুরুষ এই নাচে অংশগ্রহণ করে। মারাংবুরুর পূজার পর সেন্দ্রা বঙ্গার পূজা দিয়ে এই দঙ্গেঁড় নাচ অনেক সময় জুড়ে চলতে থাকে। এই দলটিকে বাছাই করে আনা হয় ভাড়া করে। এদের যত্ন আত্তির কোন ত্রুটি যেন না হয় তার জন্য পরিচালক কমিটি নানা জায়গা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। দলের যারা ভালো দক্ষতা দেখাতে পারে তাদের কে পুরস্কৃত করা হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দর্শকাসনে উপস্থিত থেকে মেলাকে সরগরম করে তোলে। সন্ধের আগেই মেলা শেষ হয়। এরপর সকলে যে যার বাসস্থানে ফিরে যায়।


আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ
আখান সেন্দ্রা : শিকার্ উৎসব | Hunting festival | ᱟᱠᱷᱟᱱ ᱛᱷᱟᱱ (Photo: Arindam Bhowmik)

সুতীম তান্ডির অধিকাংশ কাহানি বা গল্প খুবই অশ্লীল। তাই সেগুলি এখানে উত্থাপন করছি না। ওদের নিজস্ব ভাষায় বলা - 'ভালো গল্পের' একটি বাংলাতে অনুবাদ করে জানাচ্ছি -


গল্প ১


শশুর জামাই নক্সা


আষাঢ়ের ঘোর বর্ষায় জমিতে ধান রোয়া করার জন্য শ্বশুর মশায় জামাই বাবাজিবনকে নিজের বাড়িতে এনেছে। আকাশে রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি। বৃষ্টিতে জমিতে জলে ভরপুর। এদিকে কাঠফাটা রোদ্দুর। চড়চড়ে রোদে টাক ভরা মাথায় শ্বশুরের ভারী বিপদ। মাথায় গামছা পেঁচিয়ে জমিতে নেমে শশুর জামাই কে কাজ শুরু করার জন্য ডাকলো। জলভরা মাঠে জামাইয়ের অস্বস্তি আরও বেশি। তার দুপায়ের গোদ। পা দুটি বেশ ফুলে আছে। জলে নামতেই পা দুটো ভীষণ কুটকুট করছে, চুলকে চুলকে বেচারা নাজেহাল। ওদিকে শশুর চড়া রোদেও মাথায় গামছা বেঁধে অনেকটা নিশ্চিন্ত। এই অবস্থায় কাজে শশুরের সাথে জামাই এঁটে উঠবে না ভেবে জামাই শশুর কে জব্দ করার উপায় ফাঁদতে লাগল। মাঠ থেকে কোন উপায়ে শশুরকে তুলে দিতে পারলে তাকেও আর মাঠে নামতে হয় না। এরপর শ্বশুর বাড়িতে ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুম লাগানো যাবে। ভাবতে ভাবতে একটা ফন্দি তার মাথায় এলো। জল থেকে জমির আলে উঠে সে বেশ কিছুক্ষণ পা দুটো চুলকে নিয়ে শশুর কে উদ্দেশ্য করে বলল -

"জান বাবা। আমাদের গেরামে যারা মাঠে কাজ করে তারা কিন্তু কেউ গায়ে, মাথায় গামছা দেয় না। সেটা ভারী অসম্মানের। আমরা সবাই সেটা মানি"।



জামাই এর কথা শুনে শশুর বিব্রত হয়ে পড়ল। সত্যি যদি অসম্মানের হয় ব্যাপারটা তাহলে গামছাটা মাথা থেকে খুলে ফেলাই উচিত ভেবে টান মেরে মাথা থেকে গামছাটা খুলে ফেলল।

জামাই তো সেটাই চাইছিল। জানত টাক ভরা মাথায় শশুর এই চড়া রোদে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেনা। সে তারই অপেক্ষায় রইল। ওদিকে শ্বশুর কিছুক্ষণ কাজ করতে গিয়ে বুঝলো টাক ভরা মাথায় কাজ চালিয়ে যাওয়া মুশকিল। জমির কাজ ফেলে রাখলেও বিপদ। সে ভাবতে লাগল জামাই তাকে জব্দ করতে চাইছে না তো ? হতেও পারে ভেবে সেও জামাই কে জব্দ করার কৌশল বার করলো। মুখে হাসি টেনে জামাই কে উদ্দেশ্য করে বলল- "জান, বাবা আমাদের এখানে একটা নিয়ম আছে"।

জামাই জিজ্ঞেস করলো- "সেটা কিরকম?"

শশুর বলল- "মাঠের কাজ শুরু করলে, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ মাঠের আলে উঠবে না। আমরা সেটা খুব মান্য করি। তুমি মাঠে নেমেছ, আশা করি আজ কাজ শেষ করেই তবে আলে উঠবে।"

জামাই বেটা পড়লো ফ্যাসাদে- সত্যিই তো, সে মাঠে নেমেই পড়েছে, এদিকে শশুরের সম্মান রক্ষা করতে থাকে তো আবার জলে নামতে হবে। কি আর করে- শশুর-কে জব্দ করতে গিয়ে নিজেই ফাঁপরে পড়েছে বাধ্য হয়ে জলে নামতেই হলো তাকে।



শশুর আড় চোখে জামাইয়ের জলে ডোবা মাঠে নামতে দেখে মনে মনে বেশ মজা পেল। জামাই যে জব্দ হয়েছে তাতে তার বেশ আনন্দ হয়েছে। দুজনে নানারকম গল্প করতে করতে কাজে লাগলো। একটা সময় দুজনের অস্বস্তি চরম সীমায় পৌঁছে গেল। চড়া রোদের উত্তাপে শশুরের চাঁদি ফেটে যাবার জোগাড়। ওদিকে জলে জামাইয়ের গোদা পা অসম্ভব কুটকুট করছে অথচ মাঠ ছাড়ার উপায় নেই। শ্বশুরেরও একই অবস্থা টাক মাথায় এক আঁজলা জল চাপাতে পারলে দারুন হোত- কিন্তু জামাইয়ের সামনে সেটা সম্ভব নয়। কি করবে - দুজনেই উপায় ভাঁজতে লাগলো। অস্বস্তির চরম অবস্থায় জামাই এক ফন্দি এঁটে শশুরকে বললো- "জানো বাবা, আমাদের গেরামে পুজোর সময় মাদল বাজলে নাচতে নাচতে দু-চার জনের এমন ব্যাকড়া লাগে- সে এক দেখার মতো ব্যাপার। দারুন, মজার - দেখবে?"

শশুর সম্মত হয়:- "দেখাও - তবে, দেখি।"

জামাই আর উত্তরের অপেক্ষায় থাকে না - "দেখ তবে"-

- বলেই হাতে ভেজা ধানের চারা পায়ে ঘষতে ঘষতে অসম্ভব নাচ শুরু করে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ঘষাঘষি আর নাচানাচি করাতে পায়ের কুটকুটানি অনেকটা কমে এল। জামাই-এর স্বস্তি ফিরে এলেও শশুর বেচারা, কি করে টাকের জ্বালা কমায় তা দেখতে জামাই উৎসুক। শশুরের এই অস্বস্তিকর অবস্থা তাকে বেশ মজা দিচ্ছিল। যখনই পায়ে কুটকুটানি বাড়তে থাকে তখনই সে শ্বশুরকে তার ব্যাকড়া নাচ দেখায়। শশুর বুঝতে পেরেছে তার সাধের জামাই কৌশল করে তার নিজের অস্বস্তি কাটিয়ে নিচ্ছে। তাকেও কিছু একটা করতে হবে না হয় সে আর চাঁদির তাপ নিতে পারছে না। সেও এক ফন্দি এঁটে অপেক্ষা করতে লাগল। পরের বার জামাই পায়ের অস্বস্তি কাটাতে যেই নাচ শুরু করল তখনই জামাই কে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল -



"গড় করি তোমার ঠাকুর কে, গড় করি তোমার গেরামকে, আর গড় করি তোমাকে, বাবা, গড় গড়, গড় টি।"

বলেই প্রতিবারই এক আঁজলা করে জল মাথায় দিয়ে গড়ের ভঙ্গিমায় হাত মাথায় ঠেকাতে লাগলো।

এভাবে শশুর জামাই দুজনই নিজেদের ফন্দিতে নিজেদের মুক্ত করল।

এই সাথে প্রকাশযোগ্য একটি 'এনে সেরেঙ্গঁ' দিয়ে (গানের সাথে নাচ) লেখা শেষ করছি। এটি অলচিকি ভাষায় করা হয়। সকলের বোঝার জন্য বাংলায় অনুবাদ করে নিচে দিলাম -


সেন্দ্রা বাঙ্গার পূজা দিব

বড়াম বুড়ির থানে,

জঙ্গলেতে যাতে হবেক

শিকারেরই টানে।

গায়ে বাকল জড়াঁই লিব

গামছা মাথায় বাঁধি,

শিকার গুলান রাখব গাঁথি

লটা পাটাই ছাঁদি।

সুতীম তান্ডির আসর বসাঁই

মহুল বনের পাশে,

চুড়িন, বাঘুৎ তাঁড়াই দিব

চৈত বঙ্গার শেষে।

জাহের আয়ো মারাংবুরু

রাখ্যে মোদের শিরে,

শিকার সেরে যে যার ঘরে

যাব ইবার ফিরে।


এখানে পাঠকদের জানিয়ে রাখি 'আখান সেন্দ্রা' লেখাটির সুতীম তান্ডি পর্বে যে গলাগাথা, কাহিনী আর 'এনে সেরেঙ্গ' পরিবেশিত হয় তা ওই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির আদিম রূপায়ণ। যার আশি ভাগ কথনই অশ্লীলতার মোড়কে উপস্থাপিত হয়। এরকম প্রচুর উপভোগ্য গল্প বা রসাত্মক কাহিনী জানা থাকলেও শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হওয়ার কারণে তা প্রকাশ করা গেল না। এই কারণে প্রকাশ যোগ্য একটি গল্প ও এনে সেরেঙ্গই এখানে উল্লেখ করেছি।


midnapore.in

(Published on 02.04.2022)