মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি।
মেদিনীপুর যদি স্বাধীনতা যুদ্ধের পীঠভূমি হয় তবে এই জেলার গড়বেতা, চন্দ্রকোনাসহ এর উত্তরাঞ্চল এই স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্স.স্থল। কারণ এই উত্তরাঞ্চল থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিরাট গণবিদ্রোহ তথা গণ আন্দোলন যা ইতিহাসে ‘লায়কালি’ বা ‘নায়েক’ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদরা যাকে অনেকে বলেছেন ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’। ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির অব্যবহিত পরেই শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন এবং চলেছিল প্রায় ১৮২৩ সাল পর্যন্ত। ঐ সময় মেদিনীপুরের উত্তরাঞ্চলের তত্কাজলীন বগড়ী পরগণা বা বগড়ী রাজ্যের গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই, রামজীবনপুর প্রভৃতি জায়গায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই লায়কালি বা নায়েক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। যার বহু নিদর্শন এবং অপূর্ব সব তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে এই এলাকার বিভিন্ন আনাচে-কানাচে ও এখানকার জঙ্গলে, বিশেষ করে মালবান্দির জঙ্গলে।
স্থানীয ইতিহাসের বক্তব্য ব্রিটিশ শাসকরা যখন তাদের শক্ত শিকড় প্রোথিত করতে চাইছে ভারতের বিভিন্ন শহর-নগর এবং গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে, ঠিক সেই সময়েই মেদিনীপুর জেলার উত্তরাঞ্চলে গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই, রামজীবনপুর প্রভৃতি স্থানে এখানকার তত্কারলীন রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে চাষি, তাঁতি-জেলে-নায়েক- মাজি ইত্যাদি তথাকথিত নিম্নশ্রেণির লোকেরা তথা নিচু তলার মানুষেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘লায়েক বা নায়েক বিদ্রোহ’ ঘোষণা করে। যার নেতৃত্ব দেন বগড়ীর তদানীন্তন রাজা ছত্রসিংহের প্রধান সেনাপতি অচল সিং এবং চন্দ্রকোনার নায়েক সর্দার যুগল ও কিশোর নামে দুই ভাই। এছাড়া সুবল, ফাগু প্রমুখ অসংখ্য নায়েক সর্দার এই বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তবে সর্বাধিনায়ক ছিলেন সেনাপতি অচল সিং।
ইংরেজ কর্তৃক এই অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার, নারীদের উপর দানবিক ও বর্বরোচিত নির্যাতন, তাদের চাষের জমিতে জোর করে তুঁত ও নীল চাষ করানো, ভূস্বামীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, জমির খাজনাবৃদ্ধি, তন্তুবায় সম্প্রদায়ের জাতীয় বৃত্তির অধিকার খর্ব করা, এবং তাদের আঙুল কেটে নেওয়া ও জেলেদের মাছ ধরায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদই ছিল এই নায়েক বিদ্রোহ।
অচল সিং- এর নেতৃত্বে বগড়ী পরগণার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই নায়েক বিদ্রোহ দুর্বার আকার ধারণ করে। ইংরেজদের চলার গতি হয় শ্লথ। নায়েক বিদ্রোহীরা যত্রতত্র লুকিয়ে থেকে লালমুখো ইংরেজ সৈন্যদের একাকী যখনই পায় তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে। এইভাবে বহু ইংরেজ সৈন্য মারা যায়। ফলে ইংরেজরা প্রমাদ গুণে। নায়েক বিদ্রোহকে কীভাবে দমন করা যায় তার সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে থাকে তারা। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য এই অঞ্চলে আসে বিখ্যাত ইংরেজ সেনাধ্যক্ষ চার্লস রিচার্ডসন এবং মি. হেনরী। অনেক চক্রান্ত ও জাল বিস্তার করে অবশেষে বিদ্রোহীদের অনেককেই ধরে ফেলে তারা। ধরা পড়েন যুগল-কিশোর সহ বহুনায়েক সর্দার। ১৮১২ খৃষ্টাব্দে বর্তমান চন্দ্রকোনা থানার উত্তরদিকে ৬৮ নং মৌজা বসনছোড়ার অন্তর্গত ‘ফাঁসিডাঙ্গা’ নামক জায়গায় যুগল-কিশোরের ফাঁসি দেওয়া হয়। আর এইসব নায়েক সর্দারের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল বলেই এই জায়গার নাম হয় ফাঁসিডাঙা।
কথিত যুগল-কিশোর সহ প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য এখানে একটি ফাঁসির মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। যার ধ্বংসাবশেষ আজও বর্তমান। আর এই মঞ্চেরই পাশে ছিল বিশাল এক বটগাছ। তারই তলায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অসংখ্য নায়েক বিদ্রোহীদের কাউকে আগুনে পুড়িয়ে, কাউকে ডালকুত্তা দিয়ে খাইয়ে, কাউকে বুলেটের গুলিতে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়। আর বাকি নায়েক বীরদের ঐ বিশাল বটগাছের ডালে ডালে গলায় দড়ি দিয়ে টাঙিয়ে তাদের প্রাণবায়ু কেড়ে নেওয়া হয়। স্থানীয ইতিহাসের ভাষায় সে এক ভয়ঙ্কর-বীভত্স হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন চন্দ্রকোণার গবেষক শ্রদ্ধেয় কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী মহাশয় তাঁর ‘বিদ্রোহ বহ্নি’ গ্রন্থে। কয়েক বত্স র আগে পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের নীরব সাক্ষী বটগাছটা ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। তা না থাক- আনন্দের কথা, চন্দ্রকোনা পুরসভা কয়েক বছর আগে নায়েক বীরদের স্মরণে এখানে একটি শহিদবেদি তৈরি করে দিয়েছেন।
নায়েক বিদ্রোহীদের প্রধান ঘাঁটি অর্থাত্ নায়েক শিবির গড়বেতার গনগনি ডাঙা ইংরেজ কর্তৃক ধ্বসপ্রাপ্ত হলে সর্বাধিনায়ক অচল সিং শিবির ছেড়ে বেরিয়ে যান। জঙ্গলের ভিতরে হেথায়- হোথায় লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। অভুক্ত অবস্থায় ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ধরা পড়েন আরও তিরিশজন নেতার সাথে। অচল সিং সহ এঁদের ফাঁসি দেওয়া হয় মেদিনীপুর পুরাতন জেলখানা সংলগ্ন মাঠে।
এই নায়েক বা লায়কালি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দু’শো বছরেরও বেশি সময় আগে। তখন মেদিনীপুর জেলার উত্তরাঞ্চলের এই এলাকাটি ছিল গভীর জঙ্গলে ঢাকা। বগড়ী থেকে শুরু করে গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, রামজীবনপুর, ক্ষীরপাই পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল ঘন জঙ্গল। শাল-মহুয়া- কুড়চি- আটাং গাছে ভরা সে জঙ্গলের গভীরতা এত বেশি ছিল যে সাধারণ মানুষের ঢোকার সাহসই হ’ত না। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ঘুরে বেড়াতো যত্র-তত্র। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় অকুতোভয় নায়েক বীরেরা তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে শ্বাপদ সংকুল এই অরণ্যকেই বেছে নিয়েছিলেন। এছাড়া নিজেরা আত্মগোপন করে থাকার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে নির্মাণ করেছিলেন গুপ্তঘাঁটি। যা ‘লায়কালি গড়’ নামে অভিহিত। এইসব গড়গুলিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রও মজুত থাকতো।
সেই দু’শো বছরেরও বেশি আগে ঘটে যাওয়া লায়কালি আমলের বহু নিদর্শন ও তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে গড়বেতা, বগড়ী, চন্দ্রকোনার বিভিন্ন অঞ্চলে। আগেই জানিয়েছি ফাঁসিডাঙার কথা, চন্দ্রকোনার অন্তর্গত এই স্থানে যুগল-কিশোর সহ অসংখ্য বীর নায়েকের ফাঁসি হয়েছিল। গড়বেতা- ১নং ব্লকের ১২ নং খড়কুশমা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন মালবান্দির জঙ্গলে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে লায়কালি আমলের অসংখ্য অপূর্ব নিদর্শন। যা দেখলে সত্যিই অবাক না হয়ে থাকা যায় না।
মালবন্দি গ্রাম থেকে সোজা দক্ষিণে যে রাস্তাটি চলে গেছে আনন্দনগর ও ঘোড়ামারা গ্রামের দিকে তারই মাঝখানে পড়ে বিশাল এক পাথর চাটান। এই পাথর চাটানের দিকে একটুখানি চোখ রাখলেই দেখা যাবে কত সুন্দর করে নির্দিষ্ট মাপে মাপে সাইজ করে পাথর কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে। কী করে যে সেই পাথর তোলা হয়েছে মনে প্রশ্ন জাগবেই। এবড়ো-খেবড়ো ভাব নেই কোথাও, সব সরল আকারে আয়তকার মাপে কাটা। পাথর কাটার এমন অদ্ভুত যন্ত্রপাতি কোথায় যে পেয়েছিল তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
ঠিক এরকমই দৃশ্য চোখে পড়ে এই পাথর চাটান থেকে আধ কিলোমিটার পশ্চিমে আরও এক পাথর চাটানে। এত পাথর কেটে কী কাজে লাগিয়েছিল তাতেও প্রশ্ন জাগে। মনে করা হচ্ছে সেই সময় যে সময় লায়কালি গড় নির্মিত হয়েছিল সেখানে এইসব পাথর যেত। কিংবা এমনও হতে পারে সেইসময় নানাস্থানে যে মন্দির নির্মিত হয়েছিল সেখানেও এই পাথরগুলি যেত।
আবার মালবান্দির পাথর চাটান থেকে আরও খানিকটা দূরে বড়ডাঙা বরাশোল নামক স্থানে অন্য একটি নিদর্শন চোখে পড়ে। এখানে একটি জায়গায় প্রায় তিন হাত ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটি গোলাকার মতো জায়গা। যেমন মসৃণ- তেমনই সুন্দর করে কাটা। ঠিক চার-পাঁচ জন ঘুমোতে পারে সেরকম মাপে। একটি নয়। এরকম দু’তিনটি। পাশাপাশি। অনুমান করা হচ্ছে এখানেই রাত্রে ঘুমাতেন নায়েক বিদ্রোহীরা। বিছানার সংখ্যা এবং অন্যান্য ব্যবস্থাদি দেখে মনে করা হচ্ছে – ছোটো ছোটো চার পাঁচজনের দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতেন তারা এবং এইভাবে সারা অঞ্চলটি করায়ত্ত করেছিলেন।
কিন্তু দু:খের বিষয় উপযুক্ত সংরক্ষণ ও তদারকির অভাবে তথ্যসমৃদ্ধ এইসব অপূর্ব নিদর্শন ও চিহ্নগুলি ধীরে ধীরে লোপ লোপ পেতে চলেছে এবং হারিয়ে যেতে বসেছে মানব ইতিহাসের অন্তরালে। নির্বিচারে চলছে পাথর ভাঙার কাজ। সেই পাথর ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে লায়কালি আমলের নিদর্শনগুলিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পুরনো দিনের সে সব অমূল্য সম্পদ ও ঐতিহ্যের অনেকটাই ধ্বংস পেয়েছে ইতিমধ্যে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারের এখনই উচিত এর উপযুক্ত একটা সংরক্ষনের ব্যবস্থা নেওয়া। অযথা দেরি করলে আর কিছুদিনের মধ্যেই মালবান্দির জঙ্গল থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে লায়কালি আমলের বহুমূল্য অপূর্ব-সুন্দর পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি।
midnapore.in