জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू

কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)

Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. | कूड़कूड़ा चातू

রাকেশ সিংহ দেব।


Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.


মাড় ভাত আর শুশনি শাক...

সঁগে পুটকা ছাতুর ঝোল!


ও খুড়ার মসি, টিপিক টিপিক জলে

আইজ পুটকা কুড়হাতে যাবঅ চল।


মনে পড়ে কৈশোরে ঠাকুমার সাথে প্রতিদিন জঙ্গলে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আসলে ভোরের আভা মাখা জঙ্গলের লাল মোরামের পথ আমাকে টানত। আমাদের গ্রামের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেছে কংসাবতী সেচ ক্যানেল। একদিন সকালে নজরে এল সেচ ক্যানেলের একজায়গায় কাঁকুরে লালমাটি ফুলে রয়েছে এবং শক্ত মাটিতে হালকা ফাটলের দাগ। ঠাকুমাকে দেখাতে উনি বলেছিলেন – “ভাই, এখানে কুড়কুড়া ছাতু উঠবে তাই মাটি ফাট নিচ্ছে।“ এরপর হাতের শাল দাঁতন দিয়ে জায়গাটির মাটি সরিয়ে একমুঠো ছাতু তুলে আমার হাতে দিয়েছিলেন। সেদিন প্রথম দেখেছিলাম বাজার থেকে বাবার কিনে আনা পুটকা ছাতুর মতো ধবধবে সাদা নয় বরং মাটিমাখা গায়ে সরু সরু শিকড়ের মতো লাগানো কালচে রঙের মার্বেল গুলি! পরিস্কার জলে ভালো করে কচলে নিলে এই ছাতুর সাদা ধবধবে রূপ বেরিয়ে আসে। এরপর ফালি করে দেখতে হয়, যে ছাতুর ভেতরের মাংসল অংশটি কালো হয়ে যায় সেটিকে বুড়ো ছাতু বলে বাতিল করা হয়। সামান্য নুন, হলুদ, লঙ্কাবাটা আর অল্প জিরেবাটা দিয়ে মাখিয়ে বড় বাটিতে সামান্য সরষের তেল দিয়ে মিনিট দশেক নাড়াচাড়া করলেই তৈরি অমৃতের বুনো সংস্করণ। মা কুড়কুড়া ছাতু দিয়ে লোহার তাওয়াতে খুব সুস্বাদু ঝালঝাল মেলা পিঠা বানান যা আজও আমার কাছে অন্যতম ডেলিকেসি। ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে এই সমস্ত বুনো ছাতুই ছিল জঙ্গলবাসীদের প্রধান আহার। কেবল নুনটুকু জুটলেই তা পুড়িয়ে, সেদ্ধ করে খাওয়া যেত। খরা বা অনাহারের সময় এই ছাতুই জঙ্গলবাসীদের মৃত্যু ঠেকিয়েছিল।

জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু) | Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. of Jangalmahal | कूड़कूड़ा चातू

‘কুড়কুড়া বা পুটকা ছাতু’ জঙ্গলমহলের একটি অন্যতম অর্থকরী বনজ সম্পদ। সাধারণত, বর্ষাকাল অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবন মাসে কুড়কুড়া ছাতু জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যায়। এই বর্ষার সময়ে জঙ্গলমহলের মানুষ এই ছাতু সংগ্রহের পর তা বাজারে বিক্রি করে কিছুটা হলেও বাড়তি আয়ের সংস্থান করে। বর্ষার মরশুমে ইলিশের স্বাদের সঙ্গে টেক্কা দিতে জঙ্গল মহলের বাজারে আসে পুটকা ছাতু। বাজারে ভালো ইলিশের দিকে যেমন চেয়ে থাকে অনেকেই, তেমনি সুস্বাদু পুটকা ছাতুর দিকেও নজর থাকে অনেকের। পদ্মার ইলিশ যেমন বাঙালির “অভিজাত”খাদ্য, জঙ্গলবাসীদের কাছে পুটকা ছাতুও "প্রাণের" খাবার। পুটকা ছাতুর মরসুমে এখানকার বাজারে ঘুরলে সহজেই অনুমান করা যায়, ইলিশের থেকেও জঙ্গল মহলে কদর বেশি এই পুটকা ছাতুর।“পুটকা”অর্থে ছোট। এই ছাতুর গায়ের খোলকটি বেশ শক্ত যা রান্নার পরে বেশ কড়কড়ে হয়ে যায় তাই অনেকেই একে কুড়কুড়া ছাতুও বলে থাকে। এই ছাতু সাদা বা কালচে রঙের এবং গোল বা চ্যাপ্টা গোলাকৃতি দেখতে হয়। এই ছাতুর সঙ্গে শালাগছের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। জঙ্গলের গাছের পাতা পচা মাটিতেই কুড়কুড়া ছাতু হয়। প্রাক্ বর্ষায় দু-তিন দিন স্বাভাবিক বৃষ্টি আর তারপর কয়েকটা দিন রোদ ঝলমলে আবহাওয়া অর্থাৎ ভিজে মাটির উপর চড়া রোদ কুড়কুড়া ছাতু ফোটার উপযুক্ত পরিবেশ। ঠিকঠাক বর্ষা নামলে, জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত জঙ্গলে এই ছাতু পাওয়া যায়। কৃত্রিম উপায়ে অন্যান্য প্রজাতির মরশুমি ছাতুর চাষ আবিষ্কৃত হলেও এই পুটকার বিকল্প কিছু এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বছরের একটা বাড়তি রোজগারের উৎস হওয়ায়, এই ছাতুকে জঙ্গলবাসীরা কেউ অবহেলা করতে চায়না। কচি অবস্থায় কুড়কুড়া ছাতু তুলতে হয়। তোলার সময় এগুলো মাটির সাথে গেঁথে থাকে। জঙ্গল ও সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞ চোখই মাটির সাথে লুকোচুরি করে গেঁথে থাকা কুড়কুড়া ছাতু কে চিনতে পারে। কোন অনভিজ্ঞ লোক জঙ্গলে কুড়কুড়া ছাতু খুঁজতে গেলে তার অবস্থা খড় পালোই-এ সুঁচ খোঁজার মত হবে। মরসুমে ছাতুর চাহিদা এবং জোগানের উপর বাজারে এর দাম ওঠানামা করে। জোগান বেশি থাকলে দাম কিছুটা কম হয়। ছাতুর দাম ১০০ টাকা প্রতি কেজি থেকে ৪০০-৪৫০ টাকা প্রতি কেজি পর্যন্ত ওঠানামা করে। দাম যাইহোক এসব বনজ ছাতুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধান সমস্যাটি হল দু-তিন দিনের মধ্যে এই ছাতু সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতে না পারলে তা পাকা বা বুড়ো হয়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সময়মত ছাতু বাজারে নিয়ে আসবার অসুবিধা ও ঝক্কির কারণে ছাতু কুড়ানিদের চেয়ে মুনাফাকারী ব্যবসায়ীরাই এই পণ্য কেনাবেচায় অধিক ফায়দা তোলে। বিভিন্ন ছাতু ব্যবসায়ী সকাল সকাল জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে বাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছাতু কুড়ানিদের কাছ থেকে ছাতু সংগ্রহ করে শহরের বাজারে বিক্রি করে। পুটকা বা কুড়কুড়া ছাতুর বিজ্ঞানসম্মত নাম - Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.



পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলার জঙ্গলমহলের লাল কাঁকুরে বা বেলে দোঁয়াশ মাটিতে কুড়কুড়া ছাতু মেলে। মাটির উপরের স্তরের ঠিক নিচে জন্মায়। এই ছাতু জঙ্গলের লাল মাটির সঙ্গে গেঁথে থাকে। ছাতু তোলার সময় কোন সরু কাঠি বা আঙুলে করে মাটির উপর সামান্য আঁচড় দিলেই উঠে আসে। তারপর ছাতুর সঙ্গে লেগে থাকা মাটি পরিস্কার করে বাজারে বিক্রি করা হয়।

জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু) | Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. of Jangalmahal | कूड़कूड़ा चातू

ছোট ছোট গোল মার্বেলের মত দেখতে এই ছাতু কুঁড়ি অবস্থায় মাটির নিচে থাকে। পরে মাটির আস্তরণ ফাটিয়ে কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে। আরও কিছুদিন পরে বাইরে শক্ত আবরণ ক্রমশ শক্ত হতে হতে অনেকগুলি তিন কোনা খন্ডে ফেটে যায় ও তারার মতো আকার নেয়। এই তারার মত অংশের মাঝে গোলাকার রেণুর থলির ভিতর অসংখ্য কালো রেণু থাকে, যা থলির ওপরের দিকে ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এসে বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় এই ছাতু খাওয়া যায়না। শুধুমাত্র কচি অবস্থায় (ছাতু ফাটালে যখন পর্যন্ত ভিতরের অংশ সাদা থাকে এবং খোলক নরম থাকে) খাওয়া যায়।



কুড়কুড়া ছাতুর মধ্যে যথেষ্ট পরিমানে মাংসল প্রাকৃতিক আঁশযুক্ত পদার্থ বা ন্যাচারাল ফাইবার থাকায় রান্না করলে একে মাংসের মত খেতে লাগে। বর্তমান গবেষনায় জানা গেছে, এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।

জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু) | Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. of Jangalmahal | कूड़कूड़ा चातू


জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু) | Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. of Jangalmahal | कूड़कूड़ा चातू

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাব আর গ্রীষ্মে অধিকাংশ জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কারণে এখন আর আগের মতো কুড়কুড়া ছাতু পাওয়া যায়না। আগে এই ছাতু বিক্রি করে ভালো রকমের রোজগার হলেও এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। বনদফতরের উপযুক্ত রক্ষনাবেক্ষনের অভাব আর অসাধু ব্যক্তিদের জঙ্গলের পালাপাতায় আগুন লাগানোর ঘটনাকেই যথেষ্ট ছাতু উৎপাদন না হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী বলে মনে করছেন অনেকেই। বনদফতরের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ আর প্রতি গ্রীষ্মে জঙ্গলে আগুন লাগানোর নিত্য ঘটনা বন্ধ করতে না পারলে জঙ্গলমহল থেকে হারিয়ে যাবে কুড়কুড়া ছাতু। জঙ্গলমহলের মানুষ হারাবে বাড়তি আয়ের পথ। আর আগামী প্রজন্মের কাছে কুড়কুড়া ছাতুর কথা অজানাই থেকে যাবে।


এক নজরে পুটকা বা কুড়কুড়া ছাতু


সাধারণ নাম :কুড়কুড়া ছাতু / মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু

বিজ্ঞানসম্মত নাম : Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.

জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু) | Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. of Jangalmahal | कूड़कूड़ा चातू


জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু)  | <i>Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg.</i> of Jangalmahal  | कूड़कूड़ा  चातू
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়া ছাতু (মার্বেল ছাতু / পুটকা ছাতু) | Astraeus hygrometricus (Pors.) Morg. of Jangalmahal | कूड़कूड़ा चातू

কোথায় হয় :নরম বেলে, দোঁয়াশ, কাঁকুরে ল্যাটেরাইট মাটির উপরের স্তরের ঠিক নীচে।

এলাকা :পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম সহ সারা জঙ্গলমহলে পাওয়া যায়।

চেনার উপায় :২ সেমি থেকে ৩ সেমি চওড়া গোল মার্বেলের মতো আকার। কোনও টুপি, ডাঁটা, গিলস থাকেনা। রেনুর রং কালো।


midnapore.in

(Published on 25.07.2021)

পাদটীকা:
● শুরুতে ঝুমুর গানটির লেখক অরূপ মাহাত, (ঝাড়গ্রাম)।

আলোকচিত্র ও অঙ্কন:
● রাকেশ সিংহ দেব।