বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)

বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু)

बंकिम बिहारी पाल (गुजीबाबू) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)

(জন্ম ১ জুলাই ১৯০৫, মৃত্যু ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৯)


দীপঙ্কর দাস।


স্বাধীনতা সংগ্রামী, আদর্শ স্থানীয় জনসেবক, মেদিনীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের এম এল এ, দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর, নাট্যকার, কবি, বঙ্কিম বিহারী পাল। নারী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা; সুদামা, উর্বশী, ধনুর্যজ্ঞ (নাট্যরঙ্গে মেদিনীপুর, চারুচন্দ্র সেন) মেদিনীপুর শহরে পথনাটিকার প্রবর্তক। ওই নারী বাহিনীকে (ভীমা বাহিনী) নিয়ে মেদিনীপুর শহরে পথ নাটিকার প্রবর্তন করেন। সম্ভবত ১৯৪৮ সালে বেয়াল্লিশের সামুদ্রিক ঝড়ের উপরে লিখিত সাইক্লোন নামের নাটক করেন, নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক রূপে; সম্ভবত কোনোটিই ছাপা হয়নি।


মেদিনীকথা জার্নাল , Medinikatha Journal



১৯৩০ সালে প্রেস এক্ট জারি করে খবরের কাগজের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে শেকলে বাঁধা সরস্বতীর পূজা করে শহরে বিষম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। শহীদ প্রশস্তি সমিতির প্রধান উদ্যোগী। তিনি অহিংস ধারার স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেও অকুতোভয়, কৌশলী, দৃঢ়চিত্ত, সশস্ত্র ধারার সংগ্রামীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগ রেখে চলতেন কিন্তু খয়ের খাঁ হননি, বিবৃতি দেওয়ার রোগও ছিল না। সবচেয়ে বড় গুন; জন সেবায় অক্লান্তকর্মা পুরসভার সদস্য হিসেবে প্রতিদিন, সকালে পূজা-পাঠ সেরে নিজ ওযার্ডের সকল বাসীন্দার বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন, দুস্থ অসুস্থকে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন, নিরন্নকে অন্ন দিতেন, এমন চরিত্র বিরল।


বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)
বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু), ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

রাজনারায়ন বসু মেদিনীপুর জেলাস্কুলের (পরে নাম হয়েছে কলেজিয়েট স্কুল) অধ্যক্ষ্য অর্থাৎ হেডমাষ্টার হয়ে আসার পর, কোম্পানি সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে নানা ভাবে ছাত্রদের মধ্যে স্বাদেশিকতার বীজ বপন করে ছিলেন, তাঁর ভাই অভয় বসুর পৌত্র জ্ঞানেন্দ্র নাথ বসুর উদ্যোগে ১৯০২ সালে স্থাপিত হয় বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি, তিনি অগভীর ব্যাক্তিত্ব কিন্তু তাঁর ভ্রাতা সতেন্দ্রনাথ (কালেকটরেটের কর্মচারী) এবং ঐস্কুলের সহশিক্ষক ও কলেজ ল্যাবরেটরির ডেমন্সট্রেটর হেমচন্দ্র কানুনগো এই সমিতিকে সামনে রেখে স্বাদেশিকতা প্রচারের কাজ চালিয়ে যান। দূরদর্শী সত্যেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন সহায়ক গণ সংগঠন ছাড়া গুপ্ত সমিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে না, একই বোধিতে পৌঁছেছিলেন মেদিনীবান্ধব কাগজের সম্পাদক দেবদাস করণ। সেই ১৯০২ সালে বাঙলা-ভারতের হাতে গোণা কয়েকজন স্বতন্ত্র ভাবে এই বোধিতে পৌঁছেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন, দেবদাস করণের মেদিনীবান্ধব হয়ে ওঠে গণ আন্দোলনের প্রকাশ্য মুখপত্র।



এই পর্বে গোষ্ঠবিহারী চন্দ্র/গোষ্ঠচন্দ্র চন্দ্র (বিভিন্ন উল্লেখে দুটি নাম দৃষ্ট হয়) রাস্তার মিছিলে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বেড়াতেন, তারমধ্যে স্বরচিত-সুরারোপিত গানও ছিল এমন মনে করার কারণ আছে কিন্তু সে সব গান কেউ উদ্ধৃত করেননি, যেমন মেদিনী বান্ধবের কপি এস পি দপ্তরে এবং কলকাতার আই বি দপ্তরে থাকার কথা কিন্তু কেউ তার সন্ধান করেননি। ঐকাগজে গানও উদ্ধৃত হয়ে থাকতে পারে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হবার পরেও গোষ্ঠবিহারী অনেক দিন জীবীত ছিলেন, কিন্তু শহরের পত্র-পত্রিকা বা ছাপাখানা সেগুলি সংগ্রহ করে ছাপার উদ্যোগ নেননি। হারমোনিয়াম মেদিনীপুরে এসেছিল রাজনারায়নের জীবদ্দশায় তাঁর কন্যা স্বর্ণলতার বিবাহ উপলক্ষ্যে কিন্তু তাকে রাস্তায় নামিয়ে গণরূপ দিয়ে ছিলেন গোষ্ঠবিহারী তবে সম্ভবত পরের পর্বে গোষ্ঠবিহারী স্বদেশী আন্দোলনের ধারা থেকে প্রস্থিত হয়ে থিয়েটারের গান-বাজনায় লিপ্ত হওয়ায় কেউ তাঁর স্বদেশী গান সংগ্রহের গরজ দেখাননি।


বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)
মেদিনীপুর পৌরসভার প্রবেশপথের বামদিকে তাঁর মূর্তি, ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

সত্যন্দ্রনাথের রিক্রুট ক্ষুদিরাম, অকুতোভয়, বাঁচামরার তোয়াক্কা নেই, অর্থ সংগ্রহে সমিতির নির্দেশে ডাকাতি করেছে, তাঁতশালার দায়িত্ব নিয়ে হামড়ে পডে়ছে, কিংসফোড্র কে হত্যার জন্যে দীনেশ দাসের সঙ্গে (প্রফুল্ল চাকী) মজফফরপুরে প্রেরিত হয়ে ধরা পড়ে, ফাঁসি হয়, দীনেশ লড়াই করে মারা যান। যদিও পরে মেদিনীপুরের গুপ্ত সংগঠন প্রকাশ্যে এসে যায়, কলকাতা বোমার মামলার সঙ্গে মেদিনীপুর বোমার মামলায় ব্যাপক ধরপাকড় হয়, রাজনারায়নের দৌহিত্র বারিণের বিবৃতিও বিপ্লবী সংগঠনের বিপত্তির কারণ হয়েছিল। মেদিনীপুরের বোমার মামলা ফেঁসে যায়, একজন পুলিশ ইনফরমার রাখালচন্দ্র লাহা এই মোকোদ্দমা কাঁচিয়ে দেন, দৈনিক রিপোর্টের তলায় তিনি লিখে রেখেছিলেম, যাহা লিখিলাম তাহা অসত্য পুলিশের কথা মত লেখা (মেদিনীপুরে বোমার মামলা, অতুল চন্দ্র রায়) পুলিশ মোকোদ্দমা তুলে নিতে বাধ্য হয়।



শুধু তাই নয় দুজন জুরি রাখাল চন্দ্র চক্রবর্তী এবং কুমেদ চরণ ঘোষ অসামীদের নির্দোষ ঘোষণা করেন, জজ স্মিদার তা অগ্রাহ্য করে সন্তোষচন্দ্র দাস এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে অস্ত্র আইনে দশ বছর কারাদণ্ড অধিকন্তু কলকাতা ষড়যন্ত্র মামলায় সোপর্দ করেন (History of Medinipur, part 2, Narendranath Das), সত্যেন সেই মোকদ্দমায় রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে হত্যা করে ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দেন। রাখাল লাহা আদালতে শপথ নিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে ৫ বছর সাজা হয়। কিন্তু এই ডামাডোলে তখনকার মত বাঙলায় বিপ্লবী সংগঠন তছনছ হয়ে যায়। তা আবার জেগে ওঠে দীনেশ গুপ্তের নেতৃত্বে, বি ভি সংগঠন রূপে ১৯২৮ নাগাদ এবং তিনজন অত্যাচারী সহেব ম্যাজিস্ট্রেটকে হতাা করে ইংরেজকে বাধ্য করে মেদিনীপুরে বাঙালী ম্যাজিষ্ট্রেট পাঠাতে এবং কড়াকড়ি শিথিল করতে কিন্তু আবার মেদিনীপুরে সস্ত্র সংগ্রামীদের সংগঠন ভেঙে যায়, বেয়াল্লিশের ভারত ছাড়োতে যোশ দেখাতে পারেনি।


বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)
তাঁর বাড়ির সংলগ্ন এই পুকুরেই রোজ সকালে স্নান করতেন, ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

মেদিনীপুর শহরের এই বিশিষ্ট স্বদেশ প্রেমের ধারায় স্নাত বঙ্কিম বিহারী পাল। তাঁর সকল কর্মের পশ্চাতে আছে মেদিনীপুর শহরের স্বাদেশিকতার প্রকাশ। তাঁর এই স্বদেশপ্রেম কত গভীর, বোঝা যায় এই রচনাগুলি থেকে: 'শহীদ রক্তে সিক্ত মেদিনীপুর', 'অগ্নিযুগের দ্রোণাচার্য', শহীদ রামকৃষ্ণ ইত্যাদি।


বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)
বঙ্কিম বিহারী পাল-এর বসতবাড়ি (বাড় মানিকপুর), ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।


বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)
বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু)।


সংযোজন

১৯৭৩ সালে দেখেছি গুজিবাবু এই নামেই বঙ্কিম বিহারী পাল অধিক পরিচিত ছিলেন, সকাল সাতটা নাগাদ ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়তেন রাস্তায় পরিচিত কেউ দেখা হলেই সম্ভাষণ করতেন। ঝোলায় প্যাড-ষ্ট্যাম্প থাকতো, সংশাপত্রের দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিতেন, এ্যমনকি অন্য ওয়ার্ডের কেউ হলেও তাঁর চেনা কারো রেফারেন্স দিলে সংশাপত্র লিখে দিতেন, রোগোগ্রস্তের চিকিৎসা, দুঃস্থ পরিবারের রেশনের ব্যাবস্থা। সম্ভবত ১৯৯০ সালে, বাঙলা স্কুল (বালক বিভাগ) ভবনে, তখন সর্বরজ্ঞন পড়িয়া প্রধান শিক্ষক, গুজিবাবুর স্মৃতি রক্ষার বিষয়টি বিবেচনার জন্যে অনুরাগীদের নিয়ে একটি সভা আহুত হয়, সেখানে স্থির হয়, তাঁর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে, স্থান পৌর ভবনর সম্মুখে, লেখক সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন, সভার লিখিত বিবরণ পৌর কতৃপক্ষের নিকট প্রেরিত হয়, কতৃপক্ষ সেই প্রস্তাবকে মান্যতা দেন।


midnapore.in

(Published on 26.02.2022 / ২০২২ মেদিনীপুর পৌরসভা নির্বাচনের আগের দিন)

কিছু কথা ...

গতকাল বিকেলে পৌরসভা ভোটের প্রচার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই প্রচার করছিলেন কাউন্সিলার প্রার্থীরা।
আজ প্রচারে নেবেছে 'মিডনাপুর-ডট-ইন'। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রচারটি তাঁদের জন্য, যারা আগামী দিনে কাউন্সিলর রূপে যোগদান করতে চলেছেন ১৫৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেদিনীপুর পৌরসভায়।
এই প্রবন্ধটি বঙ্কিম বিহারী পাল-এর জীবনী নয়। তিনি যেহেতু দীর্ঘদিন জনপ্রিয় কাউন্সিলর ছিলেন এবং সামনেই মেদিনীপুর পৌরসভা ভোট। সেই কারণেই আমি দীপঙ্কর দাস মহাশয়কে এই প্রবন্ধটি লিখতে বলেছিলাম। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত প্রবন্ধ পরে 'মেদিনীকথা জার্নালে' প্রকাশিত হবে।
উল্লেখযোগ্য যে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত 'বঙ্কিম স্মৃতি সব পেয়েছির আসর' সংস্থাটি এখনো বাংলা স্কুলের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে (করোনার জন্য বন্ধ রয়েছে)।

বঙ্কিম বিহারী পাল (গুজিবাবু) | Bankim Bihari Pal (Gujibabu)
এই জায়গাতেই রোজ বিকেলে বসে 'বঙ্কিম স্মৃতি সব পেয়েছির আসর', ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

মিডনাপুর-ডট-ইন প্রতিনিয়ত যে সমস্ত শহীদদের মূর্তিতে মাল্যদান করে চলেছে (জন্মদিন ও বলিদান দিবসে), সেই মূর্তিগুলি প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল বঙ্কিম বিহারী পাল-র । তিনি বহু দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, সে-সব কিছুই প্রায় পাওয়া যায় না (তিনটি বই ছাড়া)। যদি কারুর সংগ্রহে সেই সব রচনা থাকে, অনুগ্রহ করে জানাবেন।
তাঁর মৃত্যুর পরে বঙ্কিম স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতির উদ্যোগে এবং বঙ্কিম স্মৃতি সব পেয়েছির আসরের সক্রিয় সহযোগিতায় পৌরসভার সামনে তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আবরণ উন্মোচন করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী শিবপ্রসাদ পাইন। মূর্তিটির ব্যায় ভার বহন করেছিলেন রাধাকান্ত মহাপাত্র (মডার্ন ষ্টুডিও)। এছাড়াও মূর্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন রঘুনাথ রাই লোধা, ধেনুরতন গুঁই, চুনিলাল রামনারায়ণ, বংশীলাল ঝাওব ও মেদিনীপুর পৌরসভা। মূর্তিটির ভাস্কর সুনীল চৌধুরি।

অরিন্দম ভৌমিক।