রূপময়ী রূপনারায়ণ
Rupnarayan River | रूपनारायण नदी
সুদর্শন নন্দী।
নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলা। এর মধ্যে অবিভক্ত মেদিনীপুরে প্রবাহিত হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদী। আর জেলাতেই যেহেতু সমুদ্রের অবস্থান তাই নদীগুলি নির্বাণ লাভ করেছে অর্থাৎ পরমাত্মায় বিলীনের মতো সমুদ্রে একীভূত হয়েছে জেলার মধ্যে প্রবাহিত হয়েই। আবার একাধিক নদী মিশে তৈরি হয়েছে বড় নদী, অন্য নামে । উদাহরণস্বরূপ জেলার অন্যতম রূপনারায়ণ নদ যা দ্বারকেশ্বর নদ ও শিলাই নদীর মিলিত রূপ। খানিক গিয়ে আবার মুণ্ডেশ্বরী (দামোদরের শাখা) নদীকে সঙ্গে নিয়ে বয়ে চলেছে হুগলী নদীর সাথে সঙ্গমে। আর সেই মিলিত স্থল হল গাদিয়াড়া, সঠিক ভাবে বললে গাদিয়াড়ার উল্টোদিকে গেঁওখালিতে,পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের অদূরে। আর পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়াও রূপনারায়ণ নদ হুগলী ও হাওড়া জেলার সীমা ঘেঁসে বয়ে গিয়ে কোলাঘাট হয়ে তবেই হুগলী নদীতে পড়েছে।
কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণ নদ। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
আসি তার মুল এক নদী দ্বারকেশ্বর নিয়ে। এই নদী পুরুলিয়ার ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং সেই নদী বাঁকুড়া জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুগলী জেলা ছুঁয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল শহরের কাছে শিলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এদিকে শিলাবতী প্রবাহিত হয়েছে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপর দিয়ে । পুরুলিয়ার পুঞ্চা থেকে হুড়া শহরের মাঝে উৎপন্ন এই শিলাবতী নদী। এর ডাক নাম শিলাই।
যাই হোক দ্বারকেশ্বর নদী ও শিলাই নদীর মিলিত রূপই রূপনারায়ণ নদী; শিলাবতী ঘাটাল মহকুমার দক্ষিণপূর্ব ও দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত। নাড়াজোলের কাছে গিয়ে উত্তরমুখী বাঁক নিয়ে বন্দরে ( হুগলী জেলার সীমা) গিয়ে দ্বারকেশ্বরের সাথে মিশেছে সে। এরপর কিছুপথ প্রবাহিত হয়ে তা পুরনো দামোদর নদ বা মুণ্ডেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি, দামোদরও ভাগ হয়ে গিয়ে আবার দূরে নিজের সাথে মিলিত হয়েছে। দামোদরের শেষের মূল দুটি অংশের একটি হুগলী নদীতে মিশেছে গড়চুমুকে, অন্যটিও হুগলী নদীতে মিশেছে গাদিয়াড়ার পাশে নুরপুরে।
রূপনারায়ণ নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার। একসময় নদীটি ইলিশ মাছের জন্যও বিখ্যাত ছিল। এছাড়া এই নদীর তীরেই স্থাপিত হয়েছে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জলপথ হিসেবে এই নদী একসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একসময় জেলা ও জেলার বিস্তৃত অংশের পুন্যার্থীদের গঙ্গাসাগর যাবার মাধ্যম ছিল এই নদী। আজ নাব্যতা হারিয়ে এবং দূষণের কবলে গুরুত্ব অনেকটাই হারিয়েছে বললে বলা ভুল হবে না।
তমলুক শহরের কাছে রূপনারায়ণ নদ। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
রূপনারায়ণ নদীর সাথে যেহেতু দামোদর নদীর (মুণ্ডেশ্বরী) মিলন হয়েছে তাই দামোদর নিয়ে দুকথা বলে নিই। হয়তো দামোদরের সাথে অবিভক্ত মেদিনীপুরের কোন সরাসরি যোগ নেই, কিন্তু মেদিনীপুরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা নদ রূপনারায়ণের চেহারাকে সে পুষ্ট করেছে। তাই দামোদরকেও টেনে আনা এই আলোচনায়। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী এই দামোদর। দামোদর নদীটি ঝাড়খন্ড রাজ্যের পালামৌ জেলার ছোটনাগপুর মালভূমির খামারপাত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বর্ধমান হুগলী হয়ে হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার কাছে দুভাগে ভাগ হয়ে হুগলী নদীতে পড়েছে। বর্তমানে দামোদর নদের মুল প্রবাহ শীর্ণ হয়ে গেছে এবং সেই শীর্ণ প্রবাহই হুগলী নদীতে পড়েছে। আর এই নদীর বেশির ভাগ জল তার শাখা নদী মুন্ডেশ্বরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যা রূপনারায়ণকে সমৃদ্ধ করেছে।
এবার আসি রূপনারায়ণ নদকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্রের কথায়। মূল পর্যটন স্থানটি হল নদীর মিলনস্থল গাদিয়াড়া – গেঁওখালি (পূর্ব মেদিনীপুর জেলা) । কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার। বাগনান থেকে ৩২ কিলোমিটার। গাদিয়াড়া থেকে ঘুরে আসা যায় রূপনারায়ণ নদ বেয়ে অপর পাড় গেঁওখালি থেকে অথবা পাশেই নুরপুরে। বিস্তৃত নদী, সাগরে মিশেছে একটু এগিয়ে, তাই অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
তমলুক শহরের কাছে রূপনারায়ণ নদ। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
এছাড়া দেউলটির অদুরে সামতাবেড়ে রূপনারায়ণ নদের তীরে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কুঠি থেকে ঘুরে আসা যায় |এখানেই তিনি কাটিয়েছেন তাঁর সাহিত্যিক জীবনের অনেকটা সময়। তাঁর পড়ার ঘর, ব্যবহৃত আসবাব, নিজ হাতে লাগানো গাছ, ময়ূর পোষার স্থান, পল্লীসমাজ বই এ উল্লেখিত সেই পুকুর সবই এখনো আছে ঠিক আগের জায়গায়। বাড়িটি শরৎ কুঠি নাম পরিচিত | গ্রামবাংলার স্বাদ, নদীর স্নিগ্ধতা আর ইতিহাস সাহিত্যের মিশেল রসিক পর্যটকের কাছে সত্যি লোভনীয়। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ অ্যাক্ট অনুসারে শরৎচন্দ্রের বাড়িটিকে ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৯ সালে পুরো বাড়িটি সংস্কার করা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বাড়িটির তিন দিকে বারান্দা। এক দিকে রয়েছে সিঁড়ি। দুতলা বাড়ি। বাড়িতে সাজানো আছে আসবাবগুলো। রয়েছে নিয়মিত পড়তেন যে ঘরটিত সেটিও।
গেঁওখালীতে রূপনারায়ণ নদ। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
কুঠির সামনেই শরৎচন্দ্রের আবক্ষমূর্তি। বাড়ির চারিদিকে বাগান ও বিভিন্ন ধরণের গাছ স্থানটিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। সেই ঐতিহাসিক বাড়ি ঘুরে রূপনারায়ণের তীরে বেড়িয়ে , সূর্যাস্ত দৃশ্যকে ক্যামেরা বন্দি করে একদিনেই ফেরা যায় কলকাতায়।
হাওড়া থেকে খড়গপুরগামী ট্রেনে চেপে নামতে হবে দেউলটি স্টেশনে। ঘণ্টা খানেকের পথ। দেউলটি থেকে রয়েছে টোটো আর অটো। আর কারে করে গেলে একটু সকাল সকাল বেরিয়ে রূপনারায়ণ নদীভিত্তিক তিনটি স্থানই (শরৎ-কুঠি, গাদিয়াড়া, গেঁওখালি) ঘুরে ঘর ফেরা যায়।
midnapore.in
(Published on 11.09.2021)