বেলেবেড়ার প্রহরাজ রাজবাড়ি
ବେଲେବେରାର ପ୍ରହରାଜ ରାଜବରୀ | Beliaberah Praharaj Royal Family
চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
"As the country mostly consisted of the sandy land along the Subarnarekha and Dalang rivers, it was called Belaberia .." ..L.S.S. O'Malley। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে গ্রামটির নাম উল্লেখ আছে বেলাবেড়িয়া। লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে বেলিয়াবেড়া, তা থেকে বেলেবেড়া। অনেকের মতেই সমগ্র এলাকাটি বালিপ্রধান হওয়ায় হয়তো এমন গ্রামনামটি।
অস্ত্র পুজোর আচার
বেলেবেড়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলখণ্ডে ডুলুং নদীর তীরে অবস্থিত যা বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলার দক্ষিণে। এখানেই একসময় একটি উল্লেখযোগ্য রাজবংশ গড়ে উঠেছিল। নাম প্রহরাজ বংশ। "A jungle estate owned for many generations by a family known as the Praharaj family,"। তথ্যn অনুযায়ী এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নিমাইচাঁদ দাশ মহাপাত্র প্রহরাজ। ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই রাজবংশের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা জনশ্রুতি আছে।
একটি জনশ্রুতি হল, কালাপাহাড় যখন উড়িষ্যা আক্রমণ করে নির্বিচারে একের পর এক হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছিলেন সেই সময় পুরীতে সূর্যবংশীয় হিন্দু রাজা প্রতাপচন্দ্র রুদ্র দেব রাজত্ব করছিলেন। নিমাইচাঁদ দাশ মহাপাত্র ছিলেন রাজা প্রতাপচন্দ্র রুদ্রের অধীনে একজন পদস্থ কর্মচারী। বাংলার আফগান শাসক সুলায়মান কররানীর সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়। তিনি প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন। তাঁর নিষ্ঠুরতায় নিমাইচাঁদ আতঙ্কিত হয়ে পুরী থেকে পালিয়ে আসেন উত্তর দিকে মল্লভূম রাজ্যে । সে সময়ে মল্লভূম রাজ্যেঁর রাজা ছিলেন সংসার মল্লদেব। নিমাইচাঁদ রাজা সংসারমল্ল দেবের কাছে আশ্রয় চান।। নিজের পরিচয় গোপন করে রাজবাড়িতে পাচকের কাজে নিযুক্ত হন। একদিন রাজা সংসার মল্লদেব পাত্রমিত্র নিয়ে বেরিয়েছেন রাজ্যচ পরিদর্শনে। পাথরা নামে একটি জায়গায় আহার ও বিশ্রামের জন্যেে রাজার শিবির পড়ল। দুপুরে রাজামশাই আহারে বসেছেন। রাজামশাইয়ের মাথায় পড়েছে রোদ। তাই নিমাইচাঁদ রাজার মাথায় রাজছত্র মেলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আহারের পরে অত্যশন্ত প্রীত হয়ে রাজা বললেন, 'যাও খেয়ে এখন বিশ্রাম কর। আজ থেকে এই ছাতাটি তোমার। ছাতাটি রেখে দাও জায়গামত'। নিমাইচাঁদ উত্তরে বলেন ছাতাটি রাখার মতো জায়গা তো তার নেই। সবই তো রাজার সম্পত্তি। নিমাইচাঁদের রন্ধনপটুত্বে রাজা এমনিতেই খুশী ছিলেন সেই সঙ্গে পেলেন বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। খুশী হয়ে তিনি তাঁকে নিজের একটি ঘোড়া দিয়ে বললেন ওই ঘোড়ায় চড়ে একপ্রহরের মধ্যেে যতটা এলাকা তিনি ঘুরে আসতে পারবেন ততটাই তাঁর নিজস্ব এলাকা বলে চিহ্নিত হবে। নিমাইচাঁদ পূর্বে ছিলেন রাজকর্মচারী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজার এই প্রস্তাব সানন্দে লুফে নিলেন। চললেন ঘোড়া ছুটিয়ে। এক প্রহরের মধ্যেত উত্তরে পাথরা থেকে পূর্বদিকে কালিঞ্জা, দক্ষিণে ঝাটিয়াড়া এবং পশ্চিমে আশুই গ্রাম সহ মোট ১০০টি মৌজা ঘুরে এসে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন। এরপরে রাজা তাঁকে ওই সমস্ত এলাকার জমিদারির স্বত্ব দেন এবং প্রহরাজ উপাধিতে ভূষিত করেন। এক প্রহরের মধ্যে আহরিত সম্পত্তির রাজা তাই তিনি প্রহরাজ। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে এই সম্পর্কে উল্লেখ আছে "... the circuit having been made within a prahar, Nimai Chand was given the title of Praharaj."। ওই জমিদারি এলাকার মধ্যে পেটবিন্ধি, মহাপাল, কালিঞ্জা, খাড়বাঁধি, আমদাপাল, পাঁচরুখি, ভান্ডারডিহা, রামপুরা, আম্বি, বেলিয়াবেড়া, মহুলী, কয়মা, রাঁজিয়া, ভাদুয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য মৌজাগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অস্ত্র পুজোয় বল্লম ও তলোয়ার
দ্বিতীয় জনশ্রুতিটি হল, নিমাইচাঁদ ছিলেন পুরীর হিন্দু রাজা প্রতাপচন্দ্র রুদ্র দেবের পরামর্শদাতা। প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী কালাপাহাড় যখন উড়িষ্যা আক্রমণ করেন সে সময়ে নিমাইচাঁদ উড়িষ্যাদ থেকে চলে আসেন ঝারিখন্ডে। এসে উপনীত হন মল্লভূম রাজ্যেয। মনে অনেক স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে মল্লভুম রাজ্যে পৌঁছোন তিনি। রাজা সংসার মল্লর কাছে আশ্রয় পান। একদিন রাজা সংসারমল্ল নিমাইচাঁদকে তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন। খাওয়ার সময় নিমাইচাঁদের বসার জায়গায় রোদ লাগায় রাজা সংসার মল্ল তাঁর নিজের ছাতাটি নিমাইচাঁদকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর পরবর্তী লক্ষ্যা বা উদ্দেশ্য বা গন্তব্য কী? নিমাইচাঁদ সেই মুহূর্তে তাঁর স্বপ্নের কথা স্মরণ করলেন এবং খাওয়ার শেষে ছাতাটি নিয়ে গিয়ে রাজার কাছে জানতে চাইলেন যে ছাতাটি ভোজনের সময় রোদ লাগার কারণে অত্যরন্ত উদারতার সঙ্গে রাজা তাঁকে দিয়েছিলেন সেই ছাতাটি কোথায় রাখবেন? রাজা বুঝে গেলেন নিমাইচাঁদ রাজার প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে অন্যাভাবে অত্যলন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দিলেন। রাজা সেই মুহূর্তে বললেন এক প্রহরের মধ্যের (তিন ঘন্টা) তিনি যতটা পথ ঘুরে আসতে পারবেন ততটাই তার নিজের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এইভাবে লাভ করলেন বেলেবেড়ার জমিদারি। এক প্রহরের মধ্যেআ ঘুরে যে আহরিত সম্পত্তি তার মালিক নিমাইচাঁদ। তাই তিনি প্রহরাজ।
তৃতীয় লোকশ্রুতিটি হল, কালাপাহাড় পুরী আক্রমণ করলে নিমাইচাঁদ সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে এসে মল্লভূম রাজ্যেল রাজা সংসার মল্লের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সে সময়ে তাঁর কাছে ছিল একটি ঝোলা। রাজা ঝোলাতে কি আছে জানতে চাওয়ায় নিমাইচাঁদ বলেন ওতে শালগ্রাম শিলা আছে। রাজামশাই যেন শালগ্রামশিলাটির একটা সুবন্দো বস্ত করেন।
বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্র
নিমাইচাঁদ দাশ প্রহরাজ মহাপাত্র ৩০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি মারা যান ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে।
'Memoranda of Midnapore 1852' গ্রন্থটিতে মেদিনীপুরের কালেক্টর এইচ. ভি. বেলি সাহেব বেলিয়াবেড়ার প্রহরাজ বংশকে Buia বা ভুঁইয়া বলে উল্লেখ করেছেন।
তথ্যর অনুযায়ী নিমাইচাঁদ দাশ মহাপাত্র ১৪৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রহরাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইনি মারা যান ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু প্রহরাজ বংশের প্রতিষ্ঠাকাল ও জনশ্রুতির কাহিনিগুলিতে যে ইতিহাসের উল্লেখ পাওয়া যায় তা কোনও মতেই একসঙ্গে মেলানো যায় না। জনশ্রুতিতে ইতিহাসের যে সময়কাল ধরা হয়েছে তা বেশ বিভ্রান্তিকর।
ব্যাঘ্রেশ্বর মন্দিরে গাজন
ইতিহাস থেকে আমরা জানি রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের রাজত্বকাল এবং বাংলার পাঠান সুলতান সুলায়মান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড়ের উড়িষ্যাত আক্রমণ একই সময়ে নয়। রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের রাজত্বকাল ১৪৯৭-১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। রাজা প্রতাপরুদ্র দেব মারা যান ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে। কালাপাহাড় উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন প্রতাপরুদ্র দেবের মৃত্যুর অনেক পরে।
এদিকে মল্লভূম রাজবংশের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অনেক অভিমত আছে। তার মধ্যেল একটি হল, মানসিংহ যখন প্রথম উড়িষ্যা য় পাঠান দমনে এসেছিলেন ষোড়শ শতকের শেষে সেই সময়ে মান সিংহের সঙ্গে বীর হাম্বির, হাউ ভূঁইয়া এবং সর্বেশ্বর সিংহও আসেন। পাঠান দমন করে মানসিংহ ফিরে গেলেও থেকে যান হাউ ভূঁইয়া ও বীর হাম্বির। সর্বেশ্বর সিংহ সাময়িক ভাবে ফিরে গেলেও পরে আবার এসে ঝাড়গ্রামে মাল রাজাকে পরাজিত করে সিংহ পদবীর বদলে মল্লদেব পদবী গ্রহণ করেন। ঝাড়গ্রামে মল্লভূম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়া পর্যন্ত পরপর যে সতেরো জন রাজা মল্লরাজবংশে রাজত্ব করেছিলেন তার মধ্যেব সংসারমল্লদেব ছিলেন পঞ্চম রাজপুরুষ।
গোপীনাথজীউ
কিন্তু ওপরের অভিমতটির সঙ্গে নিমাইচাঁদ দাশ মহাপাত্র কর্তৃক প্রহরাজ বংশের প্রতিষ্ঠাকাল ও সংসার মল্লদেবের রাজত্বকাল কোনওভাবেই মেলানো যায় না।
জনশ্রুতি বা লোকশ্রুতি যাই হোক না কেন প্রহরাজ বংশের বংশধরেরা মনে করেন, নিমাইচাঁদ দাশ মহাপাত্র পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্রদেবেরই সভাসদ ছিলেন।
গোপীনাথজীউ
তবে প্রহরাজ বংশের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে যা জনশ্রুতিই থাকুক না কেন অনেক ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে সে সময়ে উড়িষ্যাষর সীমান্ত লাগোয়া ময়ূরভঞ্জ রাজাদের সঙ্গে প্রায়ই বিরোধ ও সংঘর্ষ বাঁধতো মল্লভূম রাজ্যেের রাজাদের। ঝাড়গ্রামের মল্লরাজা ময়ূরভঞ্জের রাজাদের হাত থেকে নিজের রাজ্য কে রক্ষা করতে সুবর্ণরেখা নদীর তীরবর্তী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বেলেবেড়া, জহরপুর, পাথরা ইত্যাাদি এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা জমিদারির দায়িত্ব উড়িষ্যা র এক প্রহরাজকে দান করেন। বেলিয়াবেড়ার জমিদারিকে ময়ূরভঞ্জ রাজ্য্ এবং মল্লভূম রাজ্যেতর মধ্যের বাফার রাজ্যা হিসেবে তৈরি করেছিলেন এমনটাই অভিমত দেন তাঁরা।
নিমাইচাঁদ দাশ মহাপাত্রর পরে পরপর যে কয়েকজন রাজপুরুষ এই বংশে রাজত্ব করেছিলেন সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। এরপর যাঁর সম্পর্কে জানা যায় তিনি হলেন প্রহরাজ গোবর্ধন দাশ মহাপাত্র। তিনি প্রজাবৎসল ছিলেন। দানশীলতায়ও তাঁর খ্যািতি ছিল অসামান্য। তিনি বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। একটি ধর্মশালা তৈরি করেছিলেন এবং জলাশয়ও খনন করেছিলেন। তাঁর পরের প্রহরাজরা হলেন শংকর দাশ বলভদ্র, শ্যা মসুন্দর, বিষ্ণুসুন্দর। বিষ্ণুসুন্দরের পরে প্রহরাজ ছিলেন গোবিন্দরাম। গোবিন্দরামের সামরিক দক্ষতায় খ্যা তি ছিল। তাঁর সময়কালেই প্রতিবেশি জমিদার মধু কর, মারাঠা বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বেলিয়াবেড়া আক্রমণ করেন। সে সময়ে গোবিন্দরাম অতি দক্ষতার সঙ্গে ওই জোটশক্তিকে পরাস্ত করেছিলেন। এরপরে মধু করের জমিদারি এলাকা বেলিয়াবেড়া জমিদারির দখলে আসে। গোবিন্দরামের পরে যাঁদের কথা জানা যায় তাঁরা হলেন নিমুচাঁদ, কৃপাসিন্ধু এবং নিত্যা নন্দ। নিত্যাোনন্দ দাশ মহাপাত্রর পরে প্রহরাজ জগন্নাথ দাশ মহাপাত্র। এনার প্রজাবৎসল ও দানশীল হিসেবে খুব সুখ্যাোতি ছিল। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে তাঁর দানশীলতার জন্যের 'চৌধুরী' উপাধি লাভ করেছিলেন। এনার তিন পুত্র যথা সীতানাথ, রঘুনাথ, লক্ষ্মণ।
গোপীনাথজীউ
সীতানাথের পুত্র ছিলেন এই রাজবংশের উল্লেখযোগ্য উজ্জ্বল পুরুষ, প্রহরাজ কৃষ্ণচন্দ্র দাশ মহাপাত্র। অত্য ন্ত পণ্ডিত ব্যপক্তি ছিলেন তিনি। সাহিত্যগ চর্চায় ছিল তাঁর সুগভীর পাণ্ডিত্য। বর্ধমান মহারাজের রাজসভায় সাহেবদের উপস্থিতিতে দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে রায়পদ রায়বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। এরপরে তিনি চৌধুরী কৃষ্ণচন্দ্র দাশ প্রহরাজ মহাপাত্র রায়পদ রায়বাহাদুর কবিশেখর নামে পরিচিত হয়েছিলেন। পান্ডিত্য ও কবিত্বশক্তির জন্যের তিনি কবিশেখর খেতাব পেয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্যহপ্রতিভা সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাছত গ্রন্থ দুর্গোৎসব তরঙ্গিনী। তিনি বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্য দর্পণের কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল এই সুবর্ণরৈখিক এলাকার প্রচলিত স্থানীয় উপভাষাকে 'মেদিনীপুরের মাঝিলাভাষা' নাম দিয়ে 'উৎস' নামে একটি পুস্তক রচনা করা যা এর আগে কেউ ভাবতে পারেননি। বঙ্গীয় সাহিত্যহ পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি মূল সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্যি পরিষদের মেদিনীপুর শাখার আজীবন সদস্যি ছিলেন তিনি। তিনি মণি- মঞ্জুষা ও মেদ- মঞ্জুষা নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। শুধু তাই নয় কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ ওই সমস্ত এলাকার দরিদ্র কৃষক প্রজাদের কল্যাদনের জন্যে 'বেলিয়াবেড়া ইউনিয়ন ব্যা ঙ্ক' নামে একটি ব্যা ঙ্ক স্থাপন করেন। প্রথমে নিজেদের রাজবাড়িতেই ব্যানঙ্কের কাজ চলত। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুবর পর ১৯২৮ সালে ওই ব্যা ঙ্কের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় 'বেলিয়াবেড়া সেন্ট্রাল কো -অপারেটিভ'। সেই সময়কার মেদিনীপুর জেলায় দ্বিতীয় সমবায় ব্যাপঙ্ক ছিল ওটি। পরে ১৯৩২ সালে ঝাড়গ্রামে এই ব্যাণঙ্কের নতুন ভবন নির্মিত হয়। বেলিয়াবেড়া সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যা৯ঙ্কের ওই নতুন ভাবে তৈরি ভবন উদ্বোধন করতে ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
শিক্ষা প্রসারেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি দেশপ্রেমিকও ছিলেন। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মগোপন করতে সাহায্য করতেন। কৃষ্ণচন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুল, আম্বি গার্লস স্কুল, ভক্তাপাঠ কেশরাইজির জন্যগ জমিদান সমস্তই এই প্রহরাজ বংশের অবদান।
নবপত্রিকা পুজো
বেলিয়াবেড়া স্কুলটি কৃষ্ণচন্দ্র দাশ মহাপাত্র করেছিলেন। প্রহরাজ কৃষ্ণচন্দ্র দাশ মহাপাত্রর দুই পুত্র। বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্র এবং হরিহর। বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্রের মৃত্যু। হয় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে। তার আগেই ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি প্রথার বিলোপসাধন হয়। বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্র ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী। ক্ল্যাবসিকাল সঙ্গীতে তিনি দক্ষ ছিলেন। খেয়াল গানেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল শুধু তাই নয় সেতার শিল্পী হিসেবেও তাঁর সুখ্যািতি ছিল।
বিশ্বম্ভর দাশের প্রথমা পত্নী ছিলেন উড়িষ্যা র বানপুর নিবাসী গোদাবরীশ মিশ্রের কন্যার তারামনি দেবী। তারামনির একমাত্র পুত্রের নাম ছিল দিলীপনারায়ণ। মাত্র ১২ বছর বয়সে দিলীপনারায়ণ মারা যাওয়ায় বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্র দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন। পত্নীর নাম প্রতিমা দেবী। প্রতিমা দেবীর দুটি পুত্র সন্তান হয়। নাম রণজিৎ দাশ মহাপাত্র ও সুরজিৎ দাশ মহাপাত্র। সুরজিৎ দাশ মহাপাত্রর পুত্র বিশ্বজিৎ দাশ মহাপাত্র ওই রাজবংশের বর্তমান বংশধর। থাকেন ওই ভবনেই। বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্র আম্বি গার্লস স্কুলটি তৈরি করেছেন।
রাসমঞ্চ
প্রথমে এই প্রহরাজরা ডুলুং নদীর তীরে মাটির কোঠা বাড়িতে বসবাস করতেন। পরে কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ বেলিয়াবেড়াতে অবস্থিত বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন।
রাজবাড়ির ভেতরে আছে কুলদেবতা গোপীনাথজিউ। নিত্যমপুজো হয়। প্রতিদিন হয় অন্নভোগ এবং সন্ধ্যাবয় হয় আরতি। একসময় এই কুলদেবতার মন্দিরে ছিল বিশাল ঘন্টা। দুবেলা কুলদেবতার অন্নভোগের পরে ওই ঘন্টায় ঘা দেওয়া হত। পূণ্যানর্থী প্রজারা তারপরে এসে অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করতেন। ওই বিশাল ঘন্টা বাজত প্রত্যে ক পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথির রাত্রিতেও। মাসে দুবার হত কাঙালী ভোজন। সেসব এখন ইতিহাস।
তবে এই প্রহরাজ বংশে এখনও দুর্গাপুজো হয়। আগের জাঁকজমক না থাকলেও পূর্বের রীতি মেনেই পালিত হয় এই পুজো। কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণ থাকার কারনে দুর্গাপুজোয় মূর্তিপুজো হয় না। উড়িষ্যাা মতে শুধু নবপত্রিকা পুজো হয়। আগে জিতা অষ্টমীর দিন থেকেই পুজো প্রক্রিয়া শুরু হতো। এখন এতদিন ধরে একসঙ্গে অনেক ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় না। তাছাড়া নেই লোকবল। রয়েছে আরও অনেক সমস্যাএ।
এখন রাজবাড়ির নিজস্ব মন্ডপে ষষ্ঠীর দিন রাত্রে পুজো শুরু হয়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যেববেলায় বেলবরণের পরে তৈরি করা হয় দেবীর প্রতীকী অবয়ব নবপত্রিকা। একটি কলাগাছের সঙ্গে বেলসহ ডাল, হলুদ, কচু, ডালিম, জয়ন্তী, অশোক, মানকচু এবং ধানগাছকে পাটকাঠি ও অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে তৈরি হয় নবপত্রিকা। নবপত্রিকায় পরানো হয় লাল ও নীল রঙের বেনারসি। সপ্তমীর দিন সকালবেলা রাজবাড়ি থেকে দুর্গামন্ডপে নিয়ে যাওয়া হয় রাজলক্ষ্মী এবং মন্দির থেকে নিয়ে যাওয়া হয় সরস্বতী। রাজবাড়ির নিকটেই আছে বাঁধপুকুর। ওখানে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। রাজবাড়ির পেছনে কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে যাওয়া ডুলুং নদী থেকে দেবীর ঘট ভরে আনা হয়। সপ্তমীর সকালেই রাজবাড়ি থেকে মন্ডপে আনা হয় একটি তলোয়ার ও বল্লম। তা দিয়ে শুরু হয় অস্ত্রপুজো। লোকশ্রুতি ওই অস্ত্রদিয়েই একসময় প্রহরাজ বংশের রাজারা ওই এলাকায় বর্গীদমন করেছিলেন।
এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর বৈশিষ্ট্য হল গাওয়া ঘি দিয়ে দেবীর সমস্ত ভোগ রান্না হয়। দেবীকে অন্নভোগের সঙ্গে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি, লুচি, পাঁচমিশেলি ঘন্ট, কাঁচকলা ভাজা, চালতার অম্বল, মিষ্টি আর পান। এছাড়া সপ্তমী থেকে নবমীর রাতে দেবীকে ভোগ নিবেদনের শেষে দেওয়া হয় ডাবের জল। সপ্তমী থেকে নবমী চালকুমড়োর বলি দেওয়া হয়।
দেবীর বিসর্জনটিও বেশ বৈশিষ্ট্যযুক্ত। দশমীর দিন বিকেলবেলায় ডুলং নদীতে দেবীর বিসর্জন হয়। ওই দিন ডুলুং নদীর তীরে পোঁতা হয় তিনটি কাঠের বল্লি। বিসর্জনের শেষে পুজারি বল্লি তিনটিতে তীর ছোঁড়েন। আর তৎক্ষণাৎ ওই বল্লিগুলিতে তলোয়ারের কোপ দিয়ে কেটে ফেলা হয়। বল্লি তিনটি আসলে রাবণের প্রতীক। বিশ্বম্ভর দাশ মহাপাত্রর আমলে ওই কাঠের বল্লি গুলিতে বন্দুক দিয়ে গুলি করা হত।
এছাড়াও এই রাজবাড়িতে হয় রাস উৎসব। টানা ৬ দিন ধরে রাস উৎসব চলে। এই ভবনের চৌহদ্দি থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরেই আছে রাসমঞ্চ। রাসের সময় গোপীনাথজিউ এর বিগ্রহ গোপীনাথজিউ মন্দির থেকে রাসমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সমগ্র জেলা জুড়ে এক সময়ে এই প্রহরাজ বংশের রাস উৎসবের খুব সুখ্যােতি ছিল। এই রাজবাড়িতে 'জ্যো ৎস্না রাস' হওয়ার পরে মেদিনীপুর শহরে মল্লিকবাড়িতে 'আঁধারি রাস' হবে এমনটাই ছিল দীর্ঘদিনের রীতি। এছাড়াও রাজবাড়িতে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। গোপীনাথজিউ ও সঙ্গে লক্ষ্মী থাকায় পালিত হয় জন্মাষ্টমী ও রাধাষ্টমী।
রাজবাড়ি থেকে এক-দেড় কিমি দূরে এই রাজবংশের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি শিবের মন্দির আছে। ডুলুং নদীর কোলে অবস্থিত শিবমন্দিরটি। ব্যারঘ্রেশ্বর শিব। দেবাদিদেব মহাদেব। যে সময়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সময় এই সমস্ত এলাকা ছিল শ্বাপদ সংকুল এবং দুর্গম অরণ্যয দ্বারা পরিবেষ্টিত। হিংস্র জন্তুর হাত থেকে যাতে এই দেবতা রাজা ও প্রজাকে রক্ষা করেন সেই উদ্দেশ্যেই এই মন্দির ও দেবতার প্রতিষ্ঠা। গ্রামের সীমানায় গড়ে তোলা হয়েছিল এই মন্দির। এখনও এই দেবতাকে ঘিরে লোকমুখে ফেরে কত গল্পকথা, কত কাহিনি। আশেপাশের গ্রামের বহু মানুষ দেখেছেন বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেবাদিদেব। ওখানে চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন উৎসব এখনও সাড়ম্বরে পালিত হয়। প্রায় ১০০-১৫০ জন ভক্তার সমাবেশ হয়। গাজন উপলক্ষে তিনদিন ধরে মেলা চলে। শিব চতুর্দশীও হয়। ছো নাচের আসর বসে সে সময়ে।
রাজবাড়ির দেউড়ি
কালের প্রবাহে রাজবাড়ির সেই অতীত জৌলুস আজ আর নেই। সংস্কারের অভাবে রাজবাড়ি আজ জীর্ণ। কিন্তু থেকে গেছে এই রাজবাড়ির গৌরবগাথা, ইতিহাস, জনশ্রুতি। তবে এখনও রাজবাড়ির দেউড়ী দেখলে তার অতীতের চোখধাঁধানো ঐতিহ্য ও গরিমার কথা বোঝা যায়।
midnapore.in
(Published on 30.10.2022)
তথ্যঋণ:
১. বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার- মিডনাপুর: এল.এস.এস.ও' ম্যা লি।
২. মেদিনীপুরের ইতিহাস: যোগেশচন্দ্র বসু।
৩. বেলিয়াবেড়া: মহুয়া দাস। মেদিনীপুরের রাজবাড়ি জমিদারবাড়ি: সম্পাদনা তাপস মাইতি।
৪. ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ঝাড়গ্রাম: ড.মধুপ দে। অরণ্যজসুন্দরী ঝাড়গ্রাম: সম্পাদনা ড. বাবুলাল মাহাতো।
৫. গোপীবল্লভপুর -২ ব্লক: লক্ষীন্দর পালই। অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম: সম্পাদনা ড. বাবুলাল মাহাতো।
৬. গোপীবল্লভপুর- ড. মধুপ দে।
৭. গুণীজন: রণজিৎ কুমার নায়েক। জঙ্গলমহল কথা: সম্পাদনা তাপস মাইতি।
৮. ছবি ও বর্তমান তথ্যল: শ্রী বিশ্বজিৎ দাশ মহাপাত্র রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর।