‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’

জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক - সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’

‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony |

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি।


উত্তর-পূর্ব গড়বেতার শেষ প্রান্তে এবং পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি ও বাঁকুড়া জেলার সংযোগস্থল সন্ধিপুরে দীর্ঘকাল ধরে বিরাট এক মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে যা এলাকায় ‘ভবানী মেলা’ নামে পরিচিত। ঐতিহ্যপূর্ণ এই মেলাটি আরম্ভ হয় প্রতিবছর মাঘী পুর্ণিমার দিন এবং চলে তিনদিন ধরে। অবশ্য এর রেশ থাকে সাতদিনেরও বেশি। এই ভবানী উত্স্ব বা ভবানী মেলা এলাকার মানুষের কাছে অতি প্রিয় উত্স।ব। শুধু স্থানীয় এলাকা নয়-গড়বেতা, চন্দ্রকোণা, জয়পুর, কোতুলপুর প্রভৃতি থানার এবং বহু দূর-দূরান্তের মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই মেলায় কাতারে কাতারে সামিল হন প্রাণের আনন্দে। জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িকতা সবকিছু দূর করে এই মেলা সকল মানুষকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছে। সেই দিক দিয়ে এই মেলা যেমন ঐতিহ্যপূর্ণ, তেমনই গৌরবময়। সন্ধিপুর ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোথাও এরকম ভবানী মেলা অনুষ্ঠিত হয় না।



ইতিহাসের বীর নায়ক ছত্রপতি শিবাজী শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের জন্য শিবনের গিরিদুর্গে যে দেবী ভবানীর আরাধনা করেছিলেন সেই অষ্টভুজা দেবী ভবানীর পূজা করা হয় এখানে। সেই উপলক্ষেই মেলাটির নাম হয়েছে ভবানী উত্সদব বা ভবানী মেলা। দেবী ভবানী ভক্ত শিবাজীকে অস্ত্র প্রদান করছেন সেই মূর্তিটিই এখানে গড়া হয়।

‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’
জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’। ছবিঃ লেখক।

এই ভবানী মেলার প্রতিষ্ঠা করেন কাতরাবালি গ্রামের কর্মবীর প্রয়াত রাঘব চন্দ্র সরকার। আর এ কাজে সাহায্য করেন প্রখ্যাত বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ভাবশিষ্য এবং বোমারু বারীন ঘোষের অনুগামী দাদা বসন্তকুমার সরকার। এলাকার যুব- সম্প্রদায় যাতে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করতে পারে এবং জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয় তাই এই ভবানী মেলার সূচনা। ১৯৪৬ সালে দেশবিভাগের আত্মঘাতী কলহে যখন উন্মত্ত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত দেশের মানুষ, মরছে হিন্দু, মরছে মুসলমান-ঠিক তখনই পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অনুষ্ঠিত এই ভবানী উত্সদব। বলতে দ্বিধা নেই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ঘটতে পারেনি এই ভবানী মেলার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণে। সেই যে মহত্ উদ্দেশ্য নিয়ে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছিল সেই সুরটি আজও অদ্বিতীয়ভাবে ধরে রেখেছে এই মেলা।

‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’
২০২১ সালের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’। ছবিঃ লেখক।


‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’
২০২১ সালের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’। ছবিঃ লেখক।

একটি গ্রাম্য মেলার যা যা বৈশিষ্ট্য তার সব কিছুর সন্ধান মেলে সন্ধিপুরের এই ভবানী মেলাতে। বহু মানুষের মিলনভূমিই যদি মেলা হয়ে থাকে, হাজারো মানুষের মিলনে, আনন্দ কোলাহলপূর্ণ ভাব বিনিময়ের কেন্দ্রস্থল যদি মেলা হয়ে থাকে, জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রাণ স্পন্দনের ক্ষেত্রস্থল যদি মেলা হয়ে থাকে তবে সন্ধিপুরের এই ভবানী মেলা তারই সার্থক একটি প্রতমূর্তি। এখানে কোনো বিভেদ নেই, কোনো রাজনৈতিক কোঁদল বা দলাদলি নেই-সবকিছুর উর্ধ্বে থেকে সবাই এখানে এক-সবাই এখানে অভিন্ন। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে উঁচুজাত, কে নিচুজাত, এই ঘৃণ্য প্রশ্ন এখানে দেখা যায় না। একঘেয়েমির ক্লান্তি এড়াতে, দু’দন্ড শান্তির নি:শ্বাস ফেলতে কাতারে কাতারে অসংখ্য মানুষ এখানে ছুটে আসে। হাজারো সমস্যা ও যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত সংসারী মানুষেরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও শান্তি ও আনন্দ লাভ করে। আছে দিন যাপনের গ্লানি, প্রাণ ধারণের হাজারো সংকট, আছে অর্থনৈতিক সমস্যা – তবু মানুষ ছুটে আসে এখানে বহু দূর-দূরান্ত থেকে।

ভবানী মেলা ভবানী মেলাই। এটি একটি অতীব সুন্দর গ্রামীণ মানুষের মেলা। এর কাছে বর্তমান বসানো আধুনিক মেলাগুলির কোনো তুলনায় হয় না। এই মেলাকে ঘিরে মানুষের অন্তরের টান অভূতপূর্ব। মানুষ যতদিন থাকবে-সমাজ যতদিন থাকবে ততদিন এই মেলাও থাকবে বলে অনুমান করা যায়। জাতীয় সংহতি, সম্প্রীতি রক্ষায় এই ভবানী মেলার গুরুত্ব অপরিসীম।

‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’
২০২১ সালের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’। ছবিঃ লেখক।


‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’
২০২১ সালের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’। ছবিঃ লেখক।

বর্তমানে এই ভবানী উত্সববের পরিচালনা করেন নেজাতীনগর শ্রীপতি শিক্ষাসদনের পরিচালন সমিতি এবং ভবানী উত্সতব কমিটি। এই কমিটি গঠিত হয়েছে হিন্দু-মুসলমান, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষদের নিয়ে। মেলার তিনদিন উত্সতবকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় নানা অনুষ্ঠান। যাত্রাগান, কীর্তন, বাউল, পুতুল নাচ, ছৌনাচ ইত্যাদি। লোকায়ত অজস্র অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। ভবানী পুজোর প্রথম দিনে নেতাজীনগর শ্রীপতি শিক্ষাসদন তাদের বিদ্যালয়ের বার্ষিক একটি অনুষ্ঠানও করে থাকে। কৃতী ছাত্রছাত্রী, আবৃত্তি, খেলাধুলা প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় সফল প্রতিযোগীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। উপস্থিত থাকেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক মণ্ডলীসহ জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। বর্তমানে নেতাজীনগর শ্রীপতি শিক্ষাসদন হাইস্কুলের যে উন্নতি, শ্রীবৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি গড়ে উঠেছে তার মূলেও ভবানী উত্স বের অবদান অনেকখানি।

‘Bhabani Mela’ of Sandhipur - Symbol of national unity and harmony | জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’
২০২১ সালের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক, সন্ধিপুরের ‘ভবানী মেলা’। ছবিঃ লেখক।

এই ভবানী উত্সযব এলাকার মানুষকে শুধু আনন্দই দেয় না, পারস্পরিক সম্প্রীতির এক মিলনক্ষেত্র। রাজনীতি, দলমত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এখানে এসে আবৃত্তি করে থাকেন কবিগুরুর মহামন্ত্র:- “এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান।” এখানেই এই মেলার সার্থকতা ও ঐতিহাসিক মূল্য।


midnapore.in

(Published on 27.02.2021)