মেদিনীপুরে বৌদ্ধধর্ম।
मेदिनीपुर में बौद्ध धर्म | Buddhism in Medinipur
অরিন্দম ভৌমিক।
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি -
আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম। বোধি লাভ জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। বুদ্ধত্ব মানে পূর্ণ সত্য, পবিত্রতা, চরম আধাত্মিক জ্ঞান।
ধম্মং শরণং গচ্ছামি -
আমি ধর্মের শরণ নিলাম। যে সাধনা অভ্যাস দ্বারা সত্য লাভ হয়, আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ বিকাশ হয় তাই ধর্ম।
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি -
আমি সঙ্ঘের শরণ নিলাম। যেখানে পূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য ধর্মের সাধনা সম্যক্ ভাবে করা যায় তাই সঙ্ঘ।
বৌদ্ধধর্ম হল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম যার অনুসারী সংখ্যা ৫২ কোটিরও বেশি। সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ৭ শতাংশের বেশি। বৌদ্ধধর্ম বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক চর্চাকে ধারণ করে, যেগুলো মূলত গৌতম বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষা এবং এর ব্যাখ্যা করা দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রাচীন ভারতে একটি শ্রমণ ঐতিহ্য হিসেবে উৎপত্তিলাভ করে এবং এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত পণ্ডিতদের দ্বারা স্বীকৃত বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান বিদ্যমান শাখা হল : থেরবাদ, মহাযান ও বজ্রযান।
মেদিনীপুর শহরের দেশবন্ধু নগরে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির (দেশবন্ধুনগর দুর্গামন্দিরের কাছে)। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১৬ সালে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন তোলা)।
বুদ্ধের চার আর্যসত্য অনুযায়ী বৌদ্ধধর্মের লক্ষ্য হল তৃষ্ণা বা আসক্তি এবং অবিদ্যার ফলে উদ্ভূত দুঃখ নিরসন করা। অধিকাংশ বৌদ্ধ ঐতিহ্য নির্বাণলাভের মাধ্যমে অথবা বোধিসত্ত্বকে অনুসরণপূর্বক সংসার তথা মৃত্যু ও পুনর্জন্মচক্রের অবসান ঘটিয়ে স্বতন্ত্র সত্তাকে অতিক্রম করার ওপর জোর দিয়ে থাকে।
থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম - শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়।
মহাযান বৌদ্ধধর্ম - পুণ্যভূমি, জেন, নিচিরেন, শিঙ্গোন ও তিয়ান্তাই ঐতিহ্য যার অন্তর্ভুক্ত - মূলত পূর্ব এশিয়া জুড়ে পাওয়া যায়।
বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম - যা ভারতীয় মহাসিদ্ধদের তন্ত্রসাধনা ও শিক্ষা দ্বারা উদ্ভূত - একটি পৃথক শাখা অথবা মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম - যা অষ্টম শতাব্দীর ভারতের বজ্রযান শিক্ষাবলিকে ধারণ করে - হিমালয় অঞ্চল, মঙ্গোলিয়া ও কালমিকিয়াতে চর্চিত হয়।
মেদিনীপুর শহরের দেশবন্ধু নগরে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির (দেশবন্ধুনগর দুর্গামন্দিরের কাছে)।
বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা হল সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য- এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া (দীপনির্বাণ, নির্বাণোন্মুখ প্রদীপ), বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান। কিন্তু বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ। এই সম্বন্ধে বুদ্ধের চারটি উপদেশ যা চারি আর্য সত্য (পালিঃ চত্বারি আর্য্য সত্যানি) নামে পরিচিত। তিনি অষ্টাঙ্গিক মার্গ উপায়ের মাধ্যমে মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন।
বৌদ্ধ যুগে মেদিনীপুর জেলায় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটেছিলো। তাম্রলিপ্ত, মুঘলমারী, বাহিরী, তিলদাগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় তার প্রমান পাওয়া যায়। সম্রাট অশোকের সময়ে তাম্রলিপ্তে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটেছিল। বৌদ্ধদের প্রাচীন ষোড়শ মহাস্থবিরের একজন ছিলেন তাম্রলিপ্তবাসী স্থবির কালিক। ২৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা বৌদ্ধদের আরাধ্য বোধিদ্রুম সিংহলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে রওনা হয়েছিলেন। শকাব্দের তৃতীয় শতাব্দীতে দন্তকুমার তাঁর স্ত্রী হেমলতার সঙ্গে গোপনে বুদ্ধদন্ত নিয়ে তাম্রলিপ্ত থেকে সিংহল গেছিলেন।
মেদিনীপুর শহরের দেশবন্ধু নগরে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির (দেশবন্ধুনগর দুর্গামন্দিরের কাছে)। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১৭ সালে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন তোলা)।
পঞ্চম শতাব্দীতে ফা-হিয়ান তাম্রলিপ্তে বাইশটি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন। সমস্ত দেশটিকেই তিনি বৌদ্ধপ্রধান বলে উল্লেখ করেছেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে হিউ-এন-সাঙ দশটি বৌদ্ধবিহার, একহাজার শ্রমণ, একটি স্তুপ ও চারটি বুদ্ধমূর্তি দেখেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে ইৎসিঙ এসে দেখলেন বিহারের সংখ্যা মাত্র ছটি। অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীর শুরু থেকেই এইসব অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম হারিয়ে যেতে শুরু করে। এর পরেও খিনি নামে একজন ৩০০ সন্ন্যাসী নিয়ে ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন।
মেদিনীপুর শহরে বৌদ্ধধর্মের কতটা প্রভাব পড়েছিল তার কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়না (আমি পাইনি)। বর্তমান কালে মেদিনীপুর শহরে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে। এর সূচনা হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কিছু বৌদ্ধ পরিবারের উদ্যোগে।
২০১১ সালে থাইল্যান্ড থেকে অষ্টধাতু নির্মিত এই বিশাল আকারের সুন্দর বুদ্ধ মূর্তি এনে মেদিনীপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূর্তিটি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি (বৃহত্তম মূর্তিটি রয়েছে দিগবেড়িয়ায়)। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১৭ সালে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন তোলা)।
শুরুটা হয় ১৯৭৬ সালে। শ্রী দেবব্রত বড়ুয়ার উদ্যোগে বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরে বুদ্ধ জয়ন্তী উদযাপনের আয়োজন করা হয়। খবর দেওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমস্ত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পরিবারগুলিকে। সেই দিন থেকেই "মেদিনীপুর বৌদ্ধ সমিতি" নামে একটি প্রতিষ্ঠান জন্ম লাভ করে। এই "মেদিনীপুর বৌদ্ধ সমিতি" -র প্রচেষ্টায় কিছুদিনের মধ্যেই একটি জমি কেনা হয়। ১৯৮০ সালে সেই জমির উপরে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করে একটি বুদ্ধ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বুদ্ধমন্দিরটি মেদিনীপুর শহরের দেশবন্ধুনগর দুর্গামন্দিরের কাছে অবস্থিত।
সবার সিদ্ধান্তে ২০১০ সালে সমিতির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম হয় "পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বৌদ্ধ সমিতি"। ক্রমশ মন্দিরের শ্রীবৃদ্ধি হয়। বর্তমানে মন্দিরটি দোতলা এবং সারা পশ্চিমবঙ্গে মেদিনীপুরের এই বৌদ্ধবিহারটি দ্বিতীয় বৃহত্তম (বৃহত্তমটি কলকাতার বেহালায় অবস্থিত)। ২০১১ সালে থাইল্যান্ড থেকে অষ্টধাতু নির্মিত একটি বিশাল আকারের সুন্দর বুদ্ধ মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূর্তিটি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি (বৃহত্তম মূর্তিটি রয়েছে দিগবেড়িয়ায়)। মেদিনীপুরের ভিক্ষু রয়েছেন শ্রীল গুণবংশ ভিক্ষু। মেদিনীপুরের এই বিহারটি কলকাতার "ভারতীয় ভিক্ষু সংঘরাজ মাহামণ্ডল" এর অধীনে রয়েছে। মেদিনীপুরের ভিক্ষু নিযুক্ত করেন সংঘরাজ শ্রীল সত্যপাল মহাথেরো (ইনি পূর্বে দিল্লিতে অধ্যাপক ছিলেন)।
শ্রীল গুণবংশ ভিক্ষু, দেশবন্ধুনগর, মেদিনীপুর। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১৭ সালে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন তোলা)।
মেদিনীপুরের এই মন্দিরটি এই জেলার কেন্দ্রীয় বিহার। পূর্ব মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলায় কোনো বিহার না থাকায় তারা এখানেই আসেন। মেদিনীপুর শহরের প্রায় ৩০ টি পরিবার এবং খড়্গপুরের প্রায় ৪৫ টি পরিবার এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও অনেক মারাঠি পরিবার এবং সালুয়ার নেপালী পরিবারের সদস্যরা এখানে আসেন। যদিও খড়্গপুরে মারাঠিদের এবং সালুয়ায় নেপালিদের মন্দির আছে। খড়্গপুরে মারাঠিদের মন্দিরটি ছোট হলেও সালুয়ায় নেপালিদের মন্দিরটি অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী করা হয়েছে। সালুয়ার মন্দিরের একটি বিশাল আকারের গেট রয়েছে। মেদিনীপুরের বিহারে সকাল-সন্ধে পুজো হয়। অনেক পরিবার দুপুরবেলায় নিজের আহার্য পূজা নিয়ে আসেন। এখানে অশ্বিন পূর্ণিমা এবং বুদ্ধপূর্ণিমা ঘটা করে পালন হয়।
"কঠিন চীবর দান" এর অনুষ্ঠানও এখানে হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে অশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই বিহারের ভিক্ষু চীবর দান করেন। যথেষ্ট সমারোহের সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের সময় বিশাখা, বুদ্ধের জন্য এক দিনের ভেতর এভাবেই চীবর তৈরি করেছিলেন। আর তারই ফলশ্রুতি বর্তমান 'কঠিন চীবর দান' অনুষ্ঠানটি।
মেদিনীপুরে কঠিন চীবর দানের নিয়ম।
কঠিন চীবর দান সাধারণত বাংলা চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী প্রবারণা পূর্ণিমা (ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা) পালনের এক মাসের মধ্যে যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ত্রি-চীবর নামে বিশেষ পোশাক দান করা হয়। মেদিনীপুরের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পূণ্যের আশায় প্রতি বছর এভাবে চীবরসহ ভিক্ষুদের অন্যান্য আনুষঙ্গিক সামগ্রীও দান করে থাকেন।
সালুয়াতে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (১৬ ডিসেম্বর ২০১৭)।
ত্রি-চীবর হলো চার খণ্ডের পরিধেয় বস্ত্র, যাতে রয়েছে দোয়াজিক, অন্তর্বাস, চীবর ও কটিবন্ধনী। এই পোশাক পরতে দেয়া হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পোশাক বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে দেয়া হয়। এই পোশাক তৈরি করার জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ প্রথমে তুলার বীজ বোনা হয়, পরে তুলা সংগ্রহ করা হয়, তা থেকে সুতা কাটা হয়, সেই সুতায় রং করা হয় গাছ-গাছড়ার ছাল বা ফল থেকে তৈরি রং দিয়ে, এবং সবশেষে নানা আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়, অর্থাৎ এক দিনের ভিতর তৈরি করা হয় এই ত্রি-চীবর। এই পোশাক বোনায় ব্যবহার করা হয় বেইন বা কাপড় বোনার বাঁশে তৈরি ফ্রেম। এরকম বেইনে একসঙ্গে চারজন কাপড় বুনে থাকেন। এভাবে ২৪ ঘণ্টা পর তৈরি হওয়া সেসব পবিত্র চীবর, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে তুলে দেয়া হয় কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। এভাবে চীবর দেয়া হলে কায়িক-বাচনিক ও মানসিক পরিশ্রম বেশি ফলদায়ক হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে সাধারণ্যের কঠোর পরিশ্রমে তৈরি চীবর, বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে দান করার বিষয়টি প্রতিদানহীনভাবে কল্যাণের নিমিত্ত কাজ বৈ আর কিছু নয় এবং এজাতীয় অনুষ্ঠান সমাজে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করবে বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস। তাছাড়া বুদ্ধের বাণী হলো, কঠিন চীবর দানই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দান। উল্লেখযোগ্য যে সব চীবরই কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা মেনে দেয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই আজকাল বাজার থেকে কেনা থাই ও বার্মিজ চীবর ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও হিন্দু ব্রাহ্মণদের উপনয়নের মতো বৌদ্ধ কিশোরদের "প্রব্রজ্যা গ্রহণ" অনুষ্ঠান হয়। প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেই একজন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। বৌদ্ধধর্মীয় রীতি অনুসারে বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত (সাধারণত পনেরো বছর বয়সী) গৃহত্যাগী বালকদের প্রাথমিকভাবে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করা হলে তারা তখন প্রব্রজ্যা স্তরে থাকে। এই স্তরের ভিক্ষু বা সন্যাসীদের শ্রমণ বলা হয়।
শসালুয়াতে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (১৬ ডিসেম্বর ২০১৭)।
শ্রমণ ভিক্ষুরা প্রব্রজ্যা স্তরে নিয়মিত একজন পূর্ণাঙ্গ ভিক্ষুর অধীনে বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র, ধর্মীয় রীতিনীতি-আচারুনুষ্ঠান সহ সকল আনুষঙ্গিক নিয়মকানুন শিখে।
মেদিনীপুরে প্রব্রজ্যা গ্রহণের নিয়ম
প্ৰব্যজ্যা প্রার্থীকে প্রথমে মাতা-পিতার অনুমতি নিতে হয়। প্রব্রজ্যা গ্রহণের দিন মস্তক মুন্ডন করতে হয়। তারপর ভিক্ষু শ্ৰমণদের ব্যবহার্য অষ্টপরিষ্কার নিয়ে বিহারে উপস্থিত হতে হয়। অষ্টপরিষ্কার বা আটটি প্রয়োজনীয় দ্রব্য হলো:
১। সঙ্ঘাটি, যাকে দোয়াজিকও বলা হয়। এ চীবরটি ভাজ করে কাধে রাখা হয়;
২। উত্তরাসঙ্ঘ, যাকে একাজিক বা বর্হিবাস বলা হয়। এ চীবরটি দ্বারা শরীরের উর্ধংশ আবৃত করা হয়;
৩। অন্তর্বাস - এ চীবর শরীরের নিম্নাংশ আবৃত করার জন্য পরিধান করা হয়;
৪। ভিক্ষাপাত্র;
৫। ক্ষুর;
৬। সূঁচ সূতা;
৭। কটিবন্ধনী (কোমরবন্ধনী) এবং
৮৷ জলছাঁকনি।
এগুলােসহ বিহারাধ্যক্ষের কাছে প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করতে হয়। অষ্টপরিস্কারসমূহ সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে হয়। চীবর তিনটি ক্রমান্বয়ে গােলাকার করে মুড়িয়ে মন্দিরের চূড়ার মতাে করে সাজাতে হয়। চীবরের চূড়াটি কটিবন্ধনী দিয়ে বাঁধতে হয়। তারপর ভিক্ষাপাত্রে রাখা হয়। অন্যান্য দ্রব্যগুলােও ভিক্ষাপাত্রে রাখা হয়।
সালুয়াতে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (১৬ ডিসেম্বর ২০১৭)।
এই প্রব্রজ্যা স্তর শেষে পরিপূর্ণ ধর্মীয় দীক্ষালাভের পর একজন পরিপূর্ণ বৌদ্ধভিক্ষুতে রূপান্তরিত হওয়াকেই উপসম্পদা বলে। শ্রামণ্য ধর্ম গ্রহণের পর ২০ বছর বয়স হলে "উপসম্পদা" গ্রহণের বিধান আছে। কারণ বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিঅনুসারে গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ থেকে শুরু করে বিশ বছর পূর্ণ হলেই তাকে পরিপূর্ণ বিশ বছর বয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হয়। বিনয় পিটকের মহাবর্গের ১২৪ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে কুমার কশ্যপমুনির উপসম্পদার জন্য বয়স গণনা করতে গিয়ে প্রতিসন্ধি গ্রহণ হতে শুরু করে বয়স গণনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মাতৃগর্ভস্থ মাসগুলো সহ হিসাব করে বিশ বছর বয়সে উপসম্পদা দিয়ে তাঁকে পূর্ণ ভিক্ষু করা হয়েছিল।
এই উপসম্পদা গ্রহণ করলে তবেই ভিক্ষু হতে পারা যায়। উপসম্পদা (পালি) হচ্ছে একজন বৌদ্ধ সন্যাসির প্রব্রজ্যা স্তরের শ্রমণ ভিক্ষুদের (নবীন ভিক্ষু) থেকে একজন পরিণত ও পূর্ণাঙ্গ ভিক্ষুতে রূপান্তরের ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
সালুয়াতে অবস্থিত বুদ্ধমন্দির। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (১৬ ডিসেম্বর ২০১৭)।
গৌতম বুদ্ধের আমলে মোট আটটি পদ্ধতিতে শ্রমণ ভিক্ষুদের উপসম্পদার মাধ্যমে পূর্ণ ভিক্ষু করা হতো। কিন্তু এই আট পদ্ধতির মধ্যে ‘ঞত্তিচতুত্থ কম্ম’ ছাড়া সাতটিই বুদ্ধের অবর্তমানে করা সম্ভব নয়। তাই মেদিনীপুর সহ অনত্র শুধুমাত্র ‘ঞত্তিচতুত্থ কম্ম’ই বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে।
মেদিনীপুরে উপসম্পদা গ্রহণের নিয়ম
ঐতিহ্যগতভাবে, উপসম্পদা অনুষ্ঠানটি একটি সিমা (সিমা মালাকা) নামক সু-নির্ধারিত ও পবিত্র স্থানের মধ্যে সম্পাদিত হয়। এই অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভিক্ষুর উপস্থিতি প্রয়োজন; সাধারণত দশ জন তবে ন্যূনতম পাঁচজন ভিক্ষুর প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে প্রথমে একজন শ্রমণ ভিক্ষু উপসম্পদা গ্রহণের মাধ্যমে পুর্ণাঙ্গ ভিক্ষু হওয়ার যোগ্য কি-না তা পরীক্ষা করা হয়। যদি সে যোগ্য প্রমাণিত হয়; তাহলে তাকে উপসম্পদা দানের জন্য উপস্থিত হওয়া ভিক্ষুদের নিকট মোট তিনবার প্রার্থনা করতে হয়। তারপর অন্যান্য সকলের সম্মতিক্রমে উপস্থিত ভিক্ষুরা বৌদ্ধধর্মীয় বিধানানুযায়ী তাকে উপসম্পদা প্রদান করেন। তবে পুণ্যার্জনের আশায় এই অনুষ্ঠানে গৃহী বৌদ্ধরাও শ্রদ্ধাসহকারে অংশগ্রহণ করে। তবে উপসম্পদা অনুষ্ঠান প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানের মতো খুববেশি জাঁকজমকের সাথে পালন করা হয় না।
সালুয়াতে অবস্থিত বুদ্ধমন্দিরের ভিক্ষু। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (১৬ ডিসেম্বর ২০১৭)।
প্রত্যেক বছর বুদ্ধপূর্ণিমার দিন এই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিহার গুলিতে মহা ধুমধামের সঙ্গে বুদ্ধপূর্ণিমা পালন করা হয়।
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
(Published on 10.05.2017, Updated on 26.05.2021)
সাক্ষাৎকারঃ-
● শ্রীল গুণবংশ ভিক্ষু
● শ্রীল শুদ্ধানন্দ ভিক্ষু
তথ্য সূত্রঃ-
● "Buddhism". (2009). In Encyclopædia Britannica. Retrieved 26 November 2009, from Encyclopædia Britannica Online Library Edition.
● মেদিনীকথা - পূর্ব মেদিনীপুর পর্যটন ও পুরাকীর্তি অরিন্দম ভৌমিক।
● স্বধর্ম রত্ন চৈত্য , জিনবংশ মহাস্থবির - বুদ্ধ এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন তাইওয়ান হতে প্রকাশিত । প্রকাশকাল : ২৫৩ বুদ্ধাব্দ/১৩৬৬ বঙ্গাব্দ।
● ত্রিপিটক পরিচিতি - ডঃ সুকোমল বরুয়া ও সুমন কান্তি বরুয়া।
● ত্রিপিটক পরিচিতি - ডঃ সুকোমল বরুয়া ও সুমন কান্তি বরুয়া।
● https://en.wikipedia.org/wiki/Buddhism
● অষ্টম শ্রেণীর বৌদ্ধধর্ম বই এর সপ্তম অধ্যায়।
● https://www.britannica.com/topic/upasampada
● http://gansanta.org/