দীপঙ্কর দাস।
শ্রীযুক্ত আজহারউদ্দীন খান, এই প্রতিবেদকের কাছে সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অবশ্যই আদর্শ স্থানীয় ব্যেক্তি কিন্তু তার চেয়ে বেশি সাহিত্য ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে গণ্য। যখনি যে বিষয়ে জিজ্ঞাসা নিয়ে গেছি, তা মিটিয়েছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও প্রকাশনার হাল হদিস তাঁর নখদর্পণে এমনকি কোন ব্যেক্তির সংগ্রহে কি ধরণের গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকাদি ও পত্র-পত্রিকা আছে তার বয়ানও; বস্তুতপক্ষে এ বিষয়ে তাঁকে চলন্ত আকর বলা যায়। তিনি যে ঘাঁটিটি আগলে রেখেছেন, সেই জেলা গ্রন্থাগার, সেখানে তিনি মানানসই।
সামগ্রিক ভাব বাঙলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সমালোচক হিসেবে তাঁর ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সরকারি বা বেসরকারি পুরস্কার অনেক সময়েই ঔৎকর্ষ বা বিষয়বস্তুর গুরুত্বের উপরে নির্ভর করে না, অন্য বহুবিধ বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তদ্বির, কোটা, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে পুরস্কৃত না হওয়া মণীষার দীর্ঘ তালিকাতো আছেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নজরুল এ্যকাদেমি পুরস্কারের তিনি যে যোগ্য প্রাপক তাতে সন্দেহ নেই। গ্রন্থ প্রকাশের দুই যুগ পরে এই পুরস্কার, পুরস্কৃত গ্রন্থ, বাঙলা সাহিত্যে নজুরুল, প্রথম প্রকাশিত পুস্তক, তখন বয়েস মাত্র ২৪ বছর। স্বভাবত এই রচনাকে নির্ণায়ক রচনা হিসেবে নেওয়া চলে না, তবু প্রথম পুস্তকেই তাঁকে বিশল্লেষণ প্রয়াসী, যুক্তিগ্রাহী, সাহসী সমালোচক হিসেবে পাই।
বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, তাঁর পরিণতিকে স্পষ্ট করেছে (৭বছর পরে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত), এই গ্রন্থে তিনি আরো দৃঢ়কণ্ঠ, ভাষা-ভঙ্গি বিশিষ্ট, সহজ অতচ সমৃদ্ধ, শ্লেষাত্মক (witty), সমস্ত বিষয়টিকে পরিপ্রেক্ষিত সহ তৌল করা এবং সমব্যবসায়ী-সমসাময়িকদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা জাত চিনিয়ে দেয়। কোথাও পাশ কাটাবার চেষ্টা নেই; বইটা পড়লে, তাঁকে মোহিতলালের উত্তরসাধক মনে হয়। নজরুল সম্পর্কিত আলোচনায় এ ব্যাপারে কিছুটা ঘাটতি আছে। নজরুল যে পুরোপুরি বোহেমিয়ান, কোথাও কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল না, যখন যে হুজুগে মেতেছেন, তাকে চূড়ান্ত করে ছেডে়ছেন, এ কথা স্পষ্ট করে বলেননি যদিও বুদ্ধদেব বসু, গোলা মোস্তাফা, নলিনীকান্ত সরকার, রবি ঠাকুর কে উদ্ধৃত করে, সেই সিদ্ধান্ত অনিবার্য করে তুলেছেন। সাম্যবাদ থেকে শ্যামা সংগীত, বিদ্রোহী থেকে বিরহী যক্ষের আবর্তন যে চূড়ান্ত অব্যবস্থিত চিত্তের পরিচায়ক, তৎসহ বামপন্থী নেতৃত্বের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে তাত্ত্বিক শৃঙ্খলা রক্ষায় দিশাহীন আচরণ; তৎকালে বামপন্থীরাই নজরুলকে মদত দিতে এগিয়ে এসেছিলেন বলে এ কথা উঠতে বাধ্য; এই প্রসঙ্গ যথাযথ ভাবে বিশ্লেষণ না করায়, এই রচনাটিকে আজহারউদ্দীনের রচনা বলে চিনে নিতে কষ্ট হয় কিন্তু আগেই বলেছি, ২৪ বছর বয়েসের রচনা।
আরো পরবর্তী কালের রচনাগুলি; বিলুপ্ত হৃদয়, শহীদুল্লাহ, আবদুল হাই, পরিচিতিমূলক রচনা। যতদূর বুঝেছি, তাঁর রচনার একটিই উদ্দিষ্ট, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য মণীষার স্বল্প জ্ঞাত বা উপেক্ষিত চতিত্রগুলির উপরে আলোকপাত করা, তাঁদের কর্মের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা। এই চেষ্টার পশ্চাতে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর মমতার চাদরখানি বিছানো দেখি।
স্থানীয় সাহিত্যর গতি-প্রকৃতি অনুধাবনে, তাঁর ভূমিকাটি মেদিনীপুর বাসীর কাছে বেশি জরুরী, সমেলোচনা- সম্মার্জনী হাতে এখানেও তিনি সচেষ্ট। ১৯৫০ (১৩৬৫ ফাল্গুন) বীক্ষণী নামের সঙ্কলনটি জেলার সাহিত্যর্চ্চা, সহিত্যর্চ্চীর এবং স্থানীয় পত্র-পত্রকিার উল্লেখ ভিত্তিক জরীপ। সঙ্কলনটি ত্র্রুটিমুক্ত নয়, পত্র-পত্রিকার তালিকা অক্ষরবৃত্তে সাজানো; পত্র-পত্রিকার, প্রথম প্রকাশের তারিখ, প্রকাশস্থানের উল্লেখ নেই, স্থানীয় সাহিত্য গঠনে, তাদের ভূমিকা অনালোচিত। এই ধরণের সরণী কালানুক্রমিক হওয়াই বাঞ্চনীয়। তথাপি মুখবন্ধে, সাধারণ ভাবে জেলায় সাহিত্যচর্চ্চা মান সম্পর্কিত মন্তব্যে মোহিতলালের উত্তসুরীকে প্রত্যক্ষ করা যায় –
“খুবই দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে যে অধিকাংশ লেখক একালে বাস করেও ভারতচন্দ্র- দাশরথী রায়ের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি- সাধারণ বিবেচনা শক্তির ওপর নির্ভর করে তাঁদের কবি নয় (Versifier) বলা যেতে পারে, অপরাধ যদি না নেন কবিয়ালের শিক্ষিত সংস্করণ বললে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়, কারণ মিলবহুল পদ্যছন্দ যদি কবিতা হয় তাহলে শুভঙ্করের আর্যা অপূর্ব কবিতা সন্দহ নেই।শুধু কবিতা নয় সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগেও আধুনিকতার লক্ষণ অনুচ্চারিত। যে স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর নি:শঙ্ক চিত্তে ঝাঁপিয়ে পডে়ছিল, সেই সংগ্রামের জাগরণী গান ও রূপায়ণ, তাঁর সাহিত্যে পাওয়া যায়নি।“
সাধারণ ভাবে মেদিনীপুর জেলার অভ্যন্তরে সাহিত্যচর্চ্চার অবস্থা সম্পর্কে শ্রী খানের দর্শন যথার্থ, দাশরথী রায় এখনো শরিরী ভাবে প্রত্যক্ষ। আর স্থানীয় সংবাদপত্রের পাতায় যে সব স্তম্ভলিখন ও গদ্য রচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তা দামোদর মুখোপাধ্যাকে অতিক্রম করতে পারেনি।
তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাহিত্য সম্পর্কে বলার কথা এই যে; সংগ্রামের প্রয়োজনে সংগ্রামী সাহিত্য অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছিল এবং সংগ্রামের অগ্রগতির সঙ্গে তা পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল। যে সব লোককবি-গায়ক, পালাকার-পরিবেশক, সাংবাদিক, সৃষ্টির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁদের সংগঠিত ও উন্নীত করায় সচেষ্ট হননি, বিশেষ করে সাংবাদিকতা যথেষ্ট পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল, গোপনে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিই লোকায়ত স্তরের রচনাগুলির যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছিল। এখনো ক্ষেত্র অনুসন্ধানে লোকের মুখে বেঁচে থাকা ছড়া-গীতাংশ-শ্লোগান উদ্ধার করা সম্ভব, শ্রী খান এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে সুখের বিষয় হবে। সেটা হয়ে ওঠেনি।
শ্রী খান আর একটা কাজ করেছেন, যে সব স্মারক তিনি সম্পাদন করেছেন সেগুলিতে পুরোনো মুদ্রণযোগ্য লেখার পুনর্মুদ্রণ সহ বিষয় ভিত্তিক যোগ্যলোককে দিয়ে লেখানো, এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পাঠক, ফেলে আসা দিনের নানা দিক সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে।
জন্ম - ১৯৩০, মীরবাজার, মেদিনীপুর শহর
পেশা - অতিরিক্ত গ্রন্থাগারিক, মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগার
শিক্ষা - কলাবিদ্যায় স্নাতক, গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতক
বিবাহ - ১৯৬১, দুই পুত্র
প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ - বংলা সাহিত্যে নজরুল
ক) বাংলা সাহিত্যে নজরুল, ১৯৫৪
খ) বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, ১৯৬১
গ) বংলা সাহিত্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৯৬৮
ঘ) বাংলা সাহিত্যে মুহম্মদ আবদুল হাই, ১৯৭৬
ঙ) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৯৮১
চ) বিষন্ন প্রান্তর
১) বীক্ষণী,১৯৫৮
২) মোহিতলালের পত্রগুচ্ছ
৩) বঙ্গরঙ্গমঞ্চ শতবর্ষপূর্তি সঙ্কলন, ১৯৭২
৪) বিদ্যাসাগর স্মারক গ্রন্থ, ১৯৭৪
৫) শরৎবীক্ষা, ১৯৭৯
৬) সারস্বত সাধনায় মেদিনীপুর, ২০০১
৭) শেকড়ের খোঁজে
পিয়াসী, মেদিনীপুরের কথা (সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য), সরণী, সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে অর্ধশতাধিক প্রকাশিত প্রবন্ধ।
midnapore.in
কৃতজ্ঞতা স্বীকার ।