পবিত্র পাত্র।
আজ "ডাক সংক্রান্তি"। সমগ্র রাঢ় বাংলায় ঐতিহ্যবাহী একটি লৌকিক উৎসব। এটি মূলত কৃষক দের উৎসব।প্রতিবছর আশ্বিনমাসের শেষ দিনে সাড়ম্বরে পালিত হয় এই উৎসব।স্থানভেদে উৎসব টির ধরন ভিন্ন। এই উৎসব টিকে কেউ কেউ স্থানীয় ভাষায় "ডাক সাঁকরাত" বা "মজুর সাঁকরাত" বা "নলপোতা" ও বলে থাকেন।
জেলাভেদে বা অঞ্চলভেদে এই আঞ্চলিক পরম্পরার পালন রীতি ভিন্ন।অবিভক্ত মেদিনীপুর সহ পার্শবর্তী ওড়িষা রাজ্যে যে ভাবে দিনটি পালন করা হয় তা হল,আগের দিন রাতে জড়ো করতে হয় কাঠি বা নল তৈরীর সরঞ্জাম। এর মধ্যেই আবার ভিন্নতার স্বাদ। কারোর কারোর বাড়িতে পাটকাঠিতে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নানান জিনিসের থেকে তৈরী মন্ড কে বোয়াল পাতায় মুড়ে পাটকাঠিতে সেলাই করার মতো করে তৈরী হয় কাঠি। আবার কারোর কারোর একপ্রকার বিশেষ গুল্মজাতীয় গাছ যার নাম অললি,তাই কাঠির কাজ করে।আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে বোয়াল ডালাই কাঠির কাজ করে থাকে।
এই পূজোর জন্য প্রথমেই বেছে নেওয়া হয় পুকুর বা গাড়িয়া সংলগ্ন কোন বেল বা সিজ বা বিশ্রি গাছ,তারপর তার তলা গোবর দিয়ে নিকোনো হয় এবং সেখানে তৈরী করা হয় মাটির বেদী। সেই বেদীর উপরেই কাঁচা মাটি সহযোগে তৈরী করা হয় দেবী মূর্তি। সেই দেবীমূর্তির পদযুগল থাকে প্রসারিত এবং পায়ে হাতে পরানো হয় মাটির তৈরী অলঙ্কার।অনেকে সাময়িক ভাবে সোনা রূপাও পরিয়ে দেন মা কে। এরপর দেবীর পদযুগলের মাঝখানে মাটির তৈরী কাল্পনিক শিশু প্রতিস্থাপন করা হয়।বিশ্বাস করা হয় ষষ্ঠী দেবী হলেন মা আর সেই মাটির পিন্ডগুলি সংসারের সমস্ত সন্তান। এই পূজোতে যে সমস্ত সামগ্রী দেওয়া হয় তার মধ্যে 'মঁথনি' প্রধান এই মঁথনি বা মন্থন দন্ড হল আসলে নানান বৃক্ষ শাখা। একটা বাঁশের সরু ডাল কাটা হয় তাতে বাঁধা হয় তালপাতা,বাঁশপাতা,কচুপাতা,কেয়া পাতা প্রভৃতি। এই পূজোতে দেবী ষষ্ঠীর প্রতিমা তৈরী হলে চোখ হিসেবে ছোট ছোট মার্বেল ব্যবহার করেন মায়েরা। মঁথনিটিকে দেবীর পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।অনেকে মঁথনির মাথায় শঁশা বা ওই জাতীয় ফল গেঁথে রাখেন। এছাড়া লাগে একটি হলুদ কাপড় বা হলদি কানি (কানি অর্থে ছোট কাপড়), লাল সালু,শিলনোড়া বা পুতা,কাজলপাতি,জুলডালা যা মেহতোর (মেথর) বাড়ি থেকে, ওই সম্প্রদায়ের লোকেরা পূজোর দিন যথাসময়ে দিয়ে যান।
যে সমস্ত সরঞ্জাম প্রয়োজন হয় তা হল,কেঁউ,কেঁই বা তেঁতুল,অন্ শরষা, কাকুড় লাড়ি,ওল,বেল,নীল আদা,ঝোট বা পাটের ছাল এবং জটা। এই সমস্ত জিনিস উদ্ভিজজাত উপাদান।মাঠে বা গোচারন ভূমিতে একটু খুঁজলে পাওয়া যায়। এসব একসাথে রেখে শিল নোড়া দিয়ে বেটে তৈরী হয় মন্ড। সেই মন্ড অল্প অল্প রাখা হয় বোয়াল পাতার বুকে। তারপর পাটকাঠিতে গাঁথা হয় সেই বোয়াল পাতা সহ মিশ্রনটুকু। ব্যাস তাহলেই তৈরী হয়ে যায় নল। আবার দুটো কাঠির ক্ষেত্রে কেবল ডালা জড়ো করলেই হয়। তারপর শালুকফুল বেলপাদা সিন্দুর দিয়ে ঘরের কর্তা পূজো করেন কাঠিদের। এরপর কলাপাতা বিছিয়ে রেখে দেওয়া হয় সব কাঠি।তুলশী তলায় সারারাত শিশিরে ভেজে কাঠি,ভোর হলেই ধুম পড়ে যায় নল পোতার।
এই সময় ধান্যক্ষেত্রে ফুল ধরা সবুজ ধানগাছকে গর্ভবতী মা হিসেবে পূজা করা হয় এবং সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করা হয়। মূলত ধানের ফলন যাতে ফলপ্রসু হয় তার প্রার্ধনার্থে এই লোক সংস্কৃতির প্রচলন।
কার কয়টা জমি সেই হিসেব মতো তৈরী হয় কাঠি। জমি বাদেও বাড়ির চাল,তুলশী তলা, পার্শবর্তী শিবালয় মন্দির,বট-অশ্বত্থ গাছ,পুকুর ঘাট,ধানের মরাই ইত্যাদি জায়গায় পুততে হয় নল।আশ্বিনে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের গাছে ফুলে ভরে ওঠে। এই অবস্থায় সম্পদের দেবীর আগমন বার্তা পোঁছে যায় চাষী গৃহস্থের কাছে। আদতে চাষ শুধুই এক জীবিকাই নয়, বিশ্বের মানুষের মুখে খাদ্যতুলে দেওয়ার কাজ করেন, ফাঁকা মাঠে জীবনের অনুষঙ্গ ফুটিয়ে তোলেন চাষীরাই। সেই চাষী-গৃহস্থ-প্রধান শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে এক গাছি শর বা নল গাছ নিয়ে ভোরে ধানখেতের ঈশান কোণে প্রথিত করেন। একইভাবে শরগাছ খড়গাদাতেও প্রথিত করতে হয়। আতপচাল, নানান ফল, মিষ্টি আর তালের শাঁস এক সঙ্গে মেখে দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হয়। এই নিবেদন আদতে ক্ষেতে যাতে ফসলের চারা ফলে ফুলে ভরে যায় সে উদ্দেশ্যে নীরব। শেষে এক ঘটি জল মাঠ থেকে নিয়ে এসে গৃহস্থের সবার মাথায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট জল ঘরের চালে ছড়ানো হয়।
শর পোতার সময় ছড়া বলার চল রয়েছে মেদিনীপুরের প্রায় সব গ্রামে। বিশেষ করে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ওড়িষা ঘেঁষা গ্রাম গুলির ছড়াতে মেলে ওড়িয়া ভাষার টান। কিছু ছড়া এরম-
এই সমস্ত ছড়া বা শ্লোক বলে নল পুততে হয় জমিতে। এই সময় শিশিরে ভেজা ঘাস আর ধানফুলের গন্ধ লেগে থাকে আকাশে বাতাসে।ভোর থেকে সারাদিন চলো নল পোতার কাজ। এই দিনটি ছুটির দিন আনন্দের দিন উৎসবের দিন। সকাল থেকে পিঠেপুলির ধুম পড়ে। আনাজ জোগাড় করার ধুম পড়ে যায়। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বাড়ির মহিলারা জোগাড় করেন সাত রকমের শাক। তার মধ্যে থাতে কলমি,শুশনি,কুমড়ো,লাউ,কুইলেখা,সজনে,পুঁই প্রভৃতি। সাতটা শাক একসাথে মিশিয়ে কাটা হয় তারপর একসাথে ছোঁকা হয়,দুপুরের পাতে থাতে উপাদেয় পদ। সাতটার কম ব্যাঞ্জন করা চলবে না। সাথে বড়ে কাতলা বা রুই মাছ। মাছের ঝোল ও শাকভাজা এবং বাকি তরকারি মিলে সাতের অধিত তরকারি সহযোগে ব্যাবস্থা হয় দুপুরের ভুরিভোজের।
এভাবেই আনন্দের লৌকিক দিবস পালিত হয় মহা সমারোহে। সংস্কৃতি বেঁচে থাকে পরম্পরায়,পরম্পরা বাঁচে ঐতিহ্যে আর ঐতিহ্য বজায় রেখে পথ চলে বাংলার লোক সংস্কৃতি।এভাবে বেঁচে থাক "ডাক সংক্রান্তি"।
একটি সুবর্নরৈখিত কবিতা.....
midnapore.in