খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology

খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব

Damdama of Kharagpur: History and Geology

সুতনু ঘোষ।


এখন যেখানে খড়্গপুরজংশন ও তার পশ্চিমে ওয়ার্কশপ এই অঞ্চলটি এককালে পরিচিত ছিল খড়্গপুর দমদমা নামে ।



দমদমা কথার অর্থ উচ্চভূমি বা টিলা । আইন ই আকবরীতে সরকার জলেশ্বরের অধীনে খড়্গপুর একটি মহাল। যার জঙ্গলময়পাহাড়ের মাঝে একটি শক্তিশালী দূর্গ ছিল । যেখান থেকে পাঁচশো পদাতিক ও কিছু গোলন্দাজ সৈন্য সরবরাহ করা হয়েছিল সম্রাট আকবরকে । তারপর কেটে গিয়েছে অনেক বছর ।


খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology
খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology চিত্র: সুতনু ঘোষ।

শাল , মহুয়া , পিয়াশাল গাছে পূর্ণ এই ভূখন্ড বিভিন্ন জমিদারির হস্তগত হয়েছে । পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতকের শেষ লগ্নে এই অঞ্চলকে রেল জংশনে পরিণত করার পরিকল্পনা হয় এবং সেইমতো কাজ শুরু হয় ।

1897 খ্রীষ্টাব্দে 30 শে জুন খড়্গপুর দমদমা অঞ্চলে ওয়ার্কশপ হওয়ার ছাড়পত্র মেলে তৎকালীন ভারত সরকারের কাছ থেকে ।



1898 খ্রীষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে খড়্গপুরজংশন রেলের ম্যাপেআত্মপ্রকাশ করে । তবে 1900 খ্রীষ্টাব্দের 19 শে এপ্রিল রেলওয়েজংশন স্টেশন হিসেবে খড়্গপুরের যাত্রা শুরু হয় । কয়েকবছর পর 1904 খ্রীষ্টাব্দেওয়ার্কশপটি সম্পূর্ণভাবে চালু হয় । যদিও ওয়ার্কশপটির কাজ small repair workshop হিসেবে 1898 - 1899 খ্রীষ্টাব্দে শুরু হয় । Bengal Nagpur Railway কোম্পানীর জংশনেরপরিকল্পনাকালে চল্লিশ ফুট উচ্চতার একটি সুবিস্তৃতভূমিখন্ড ছিল এখানে । নাম ছিল খড়্গপুর দমদমা । শাল গাছের জঙ্গল ছিল এই জায়গায় । চূড়াতে বিশেষ গাছপালা ছিল না । ওপরের অংশটি মেটে লাল রঙের দেখাত।


খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology
খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology চিত্র: সুতনু ঘোষ।

বিজয় কুমার মন্ডল মহাশয়ের লেখা " শাল মহুয়ার দিন " বইটি থেকে জানা যায় - উনবিংশ শতকের শুরুতে ইন্দা এলাকার দিক থেকে অযোধ্যাগড় বা আড়াসিনিগড় যাওয়ার জন্য ভারবাহকেরা ঘুরপথ এড়ানোর জন্য পীর সাহেবের দরগার পশ্চিম দিক থেকে একটি রাস্তা ধরে মোরাম পাথরের টিলায় উঠত । সেখান থেকে দক্ষিণ মুখো রাস্তায়সোনামুখীর বন হয়ে আড়াসিনিগড় পৌঁছাত।



রমাপদ চৌধুরী তার প্রথম উপন্যাস " প্রথম প্রহর " এ লিখছেন - ' এই যে দেখছিস নিরুরকোঁকড়াকোঁকড়া চুলের মাঝখান দিয়ে সিঁথি , ঠিক এমনই দুপাশে জঙ্গল আর মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরী হয়েছে তখন । সি এম ই-র বাংলোর পিছন দিয়ে যেখানে লাইন গেছে ঐখানে ছিল দুটো উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড়টা কাটতে বাকি তখন । এদিকে যেটুকু পথ পরিষ্কার করা হয়েছে তার ওপর মাটি ফেলে উঁচু করা হচ্ছে । .... ধোবিঘাটের দিকে রেললাইনটা পাথর কেটে নীচে নেমে গিয়েছে ওটা আগে ছিল পাহাড় । ডিনামাইট দিয়ে ভাঙা হয়েছিল ওটা । .... পাহাড়ে গর্ত করে কি একটা যন্ত্রে ডিনামাইট রেখে দূরে থেকে লম্বা পলতেতে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে । ঘোড়া তৈরী থাকবে পাশেই , পলতেধরিয়েঘোড়ায় চেপে ছুটে পালাতে হবে অনেক দূরে । '


খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology
খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology চিত্র: সুতনু ঘোষ।

দমদমা অঞ্চলের সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ থেকে এই অঞ্চলের বিস্তৃতি ও ভূমিরূপ সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে। বর্তমানে এই অঞ্চলটি একটি সুবিস্তৃত ঢিবির মতো । যার চূড়ার অংশটা ডিনামাইট দিয়েফাটিয়ে সমতল করা হয়েছিল । এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে রেলের কয়েকটি লাইন পাতা হয়েছে । তবে এলাকাটি উঁচু হওয়ার জন্য পাথর কেটে রেললাইনের রাস্তা বানাতে হয়েছে । ওয়ার্কশপ ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি যেমন - টাউন থানা , গেটবাজার , রাবনময়দান ও Gorkha Fc ground সংলগ্ন এলাকা , Up cutting kholi , Down cutting kholi , South side এর পশ্চিম অংশ , পোর্টারখোলি , আইমার কিছু অংশ নিয়ে একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় উঁচু ল্যাটেরাইটের এমন ভূমিরূপ রয়েছে । এলাকাগুলিতে এলে দেখা যায়দুইধারে উঁচু মাকড়া পাথরের দেওয়াল কেটে দশ পনেরো ফুট নীচ দিয়ে রেলের লাইন চলে গিয়েছে । খড়্গপুরজংশন থেকে পশ্চিম দিকে গেলে ভূমিরূপ সামান্য উঁচু হতে শুরু করে । এখান থেকে রেলপথগুলি দমদমা অঞ্চলকে কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত করে বিভিন্ন দিকে চলে গিয়েছে । এলাকাগুলির যোগাযোগ রক্ষার জন্য কয়েকটি ব্রিজ তৈরী হয়েছে এ অঞ্চলে । ছোট আইমা সংলগ্ন New Wagon Shop থেকে একটি রাস্তা ওয়ার্কশপের উত্তর সীমার প্রাচীরের পাশ দিয়েরেললাইনের সমান্তরালে গিয়েupcuttingkholiএলাকায় মিশেছে । এই পথে গেলে দেখা যায় ঢালটি ওয়ার্কশপেরGate no 12 ও Gorkha Fc এর কাছ থেকে পূর্ব দিকে উঁচু হতে শুরু করেছে । টাউন থানা এলাকার ব্রিজটি থেকে দেখা যায়দুদিকের পাথরের দেওয়াল বেশ খাড়া । এখান থেকে পূর্বদিকেupcuttingkholiহয়ে খড়্গপুরজংশনের দিকে এবং উত্তর - পশ্চিম দিকে গিরি ময়দান স্টেশনের দিকে ভূমির উচ্চতা কমতে শুরু করেছে । ওয়ার্কশপের পূর্ব সীমার প্রাচীরের পাশ দিয়েIIT Kgp Rail over bridge এর সংযোগকারী রাস্তাটি দিয়েযাতায়াতের সময় একই ভূমিরূপ চোখে ধরা দেয় । দমদমা অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জঙ্গলময় অনুচ্চ টিলার উপস্থিতি ছিল । দমদমা অঞ্চলের দক্ষিণ পূর্বে আড়াসিনি গ্রামের উত্তর পশ্চিমে এবং আমছাতা গ্রামের পূর্বে ছোট টিলা ছিল । উত্তর পূর্বের ইন্দা এলাকাটির বনাঞ্চলের মাঝখান দিয়ে জগন্নাথ সড়ক চলে গিয়েছিল । এই এলাকাটি রঙ্কিনী বৃত্তান্ত , পীর লোহানীর দরগা , হিড়িম্বেশ্বরী থান , খড়্গেশ্বর মন্দির , জাহের থান , ওঁদা পুকুর প্রভৃতির সাথে জড়িত ইতিহাস ও কিংবদন্তীগুলির জন্য সুপরিচিত । দক্ষিণের হিজলী অঞ্চলটিও কিছুটা উঁচু , ল্যাটেরাইটমৃত্তিকা যুক্ত এবং জঙ্গলাকীর্ন । এখানে বিংশ শতকের শুরু থেকে বন কেটে বসবাস শুরু হয় । প্রথমে Hijli Detention Camp এবং পরবর্তীকালে এখানেই Kharagpur IIT গড়ে ওঠে । কংসাবতীর উত্তর তীরে মেদিনীপুর শহরের কাছে গোপগিরি নামক টিলাটি সীমান্তরাঢ় বাংলার উচ্চভূমির নিদর্শন রূপে বর্তমান ।

পশ্চিমবঙ্গের পাললিক অববাহিকার সীমান্তেখড়্গপুরের অবস্থান । খড়গপুরের পশ্চিম অংশ ছোটনাগপুর এর সীমান্তেররাঢ় বাংলার অন্তর্গত ।



এই অঞ্চল পূর্বের Medinipur - Faracca fault ( MFF ) এবং পশ্চিমের Chotonagpur Foot hill Fault ( CFF ) এর মাঝখানে অবস্থিত । এটি ছোটনাগপুরেরপ্রান্তীয় ভগ্ন অংশ । স্বাভাবিকভাবেই আয়রন ও অ্যালুমিনিয়ামের আধিক্য বেশি এই মাটিতে । খড়্গপুর শহরের পার্শ্ববর্তী গোপালী , সালুয়া , অযোধ্যাগড় , রাঙামেটিয়া , কাশীজোড়া , ধারেন্দা , কলাইকুন্ডা , রাখাজঙ্গল , টাঙ্গাসোল , মালিসোল প্রভৃতি এলাকাগুলিতে গেলে লাল মাটি ও জঙ্গলের দেখা মেলে । খড়্গপুরের অন্যান্য অঞ্চলগুলি গাঙ্গেয় বদ্বীপের অংশ । উর্বর পলিমাটির জন্য চাষাবাদ ভালো হয় এসব এলাকায় ।

খড়গপুরেরভূস্তরে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমান । কিছু জায়গায়সুবিস্তৃতল্যাটেরাইটের ঢিপি বাইরে উন্মুক্ত হয়েছে । এগুলি মূলত পলি , কাঁকর , নুড়ি , বালির অধঃক্ষেপের ওপর অবস্থিত । ওপরের স্তরে মূলত Secondary Laterite রয়েছে । এছাড়াপ্লাইস্টোসিনপলিমাটির স্তর রয়েছে ।রয়েছে Primary Laterite এর স্তর । কিছু জায়গায়Cretaceous ( 145 to 66 million বছর আগে ) এবং post Cretaceous sediment layer এর স্তর বর্তমান । মনে করা হচ্ছে ,এখানকার ভূস্তরে প্রাচীন ভূখন্ডের বিচ্ছিন্ন অংশ ( Relict type ) কয়েকটি প্রোথিত টিলা ( Buried Hill ) আকারে বর্তমান । সুতরাং দেখা যাচ্ছে এখানকার ভূস্তরেপুরোনোপলিমাটি , বালি ও কাঁকর মিশ্রিত মাটি , শিলা ও অধঃক্ষেপজাতল্যাটেরাইট , নুড়ি পাথর এবং প্রাচীন ভূখন্ডের অংশ বর্তমান ।


খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology
খড়্গপুরের দমদমা : ইতিহাস ও ভূতত্ত্ব | Damdama of Kharagpur: History and Geology চিত্র: সুতনু ঘোষ।

বর্তমানের খড়্গপুর শহর ঘন বসতিপূর্ণ । দমদমা অঞ্চলটিও বিভিন্ন রেললাইন ও রাস্তার জালে জড়িয়ে পড়েছে । খড়্গপুর দমদমা , হিড়িম্বডাঙা প্রভৃতি প্রাচীন নামগুলি বর্তমানে ব্যবহৃত হয় না । এককালেরBengal Nagpur Railway এর জংশন হিসেবে গড়ে উঠলেও পরবর্তীকালে 1955 খ্রীষ্টাব্দেSouth Eastern Railway zone গঠিত হলে এই অঞ্চল তার আওতাভুক্তহয় ।।


midnapore.in

(Published on 13.02.2022)
তথ্যঋণ:
১. প্রথম প্রহর - রমাপদ চৌধুরী
২. শাল মহুয়ার দিন - বিজয় কুমার মন্ডল
৩. মেদিনীপুর জেলার প্রাচীনত্ব - প্রণব রায়
৪. খড়গপুর ইতিহাস ও সংস্কৃতি - শ্যামাপদ ভৌমিক
৫. পশ্চিমবঙ্গের দুর্গ পরিক্রমা - তারাপদ সাঁতরা
৬. মেদিনীপুরের ইতিহাস - যোগেশচন্দ্র বসু
৭. বাংলায় ভ্রমণ : দ্বিতীয় পর্ব - অমিয় বসু
৮. ডাউন খড়্গপুর , আপ জংশন - নরেশ জানা
9. History of the Bengal Nagpur Railway Working class movements 1906 - 1947 - ShyamapadaBhowmik
10. GEOPHYSICAL EVIDENCE OF BURIED HILLS NEAR KHARAGPUR ( WEST BENGAL) - A . ROY and R . S . AGARWAL
11. AIN E AKBARI by ABUL FAZL ALLAMI - COLONEL H. S. JARRETT
12. BENGAL DISTRICT GAZETTEERS : MIDNAPORE - L.S.S O'MALLEY
13. Laterites of the Bengal Basin : Characterization , Geochronology and Evolution - Sandipan Ghosh and Sanat Kr Guchhait
14. Characterization and evolution of primary and secondary laterites in northwestern Bengal Basin, West Bengal, India - Sandipan Ghosh , Sanat . K . Guchhait
15. Quaternary of the East Coast of India - R.Vaidyanadhan and R.N. Ghosh
১৬. সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য