সন্তু জানা।
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় আমেরিকান ব্যাপটিষ্ট মিশনারীদের অবদান সম্পর্কে কখনও কোথাও বিস্তৃতভাবে আলোকপাত না করা হলেও -একথা সত্য যে, সুবর্ণরেখা বিধৌত বাংলা -ওড়িশা সীমান্তবর্তী এই প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক জীবন যাপনের উন্নতিতে আমেরিকান মিশনারীদের ভূমিকা ছিল সীমানাহীন। ১৮৩০ এর দশক থেকেই আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে নিয়মিত প্রকাশ পেত “মিশনারী হেল্পার" পত্রিকা। ভারত, মিশর প্রভৃতি দেশে কর্মরত মিশনারীদের অভিজ্ঞতালব্ধ চিঠি নিয়মিত প্রকাশ পেত এই পত্রিকাতে। আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার দাঁতন থেকে প্রেরিত এরকম অসংখ্য পত্রগুচ্ছ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্কের সংবাদ পত্রিকাতে। প্রেরক ছিলেন শ্বেতাঙ্গ মেমসাহেব নেলী, জুলিয়া ও হ্যা ফিলিপস্। চিঠিগুলির পরতে পরতে দাঁতন, জলেশ্বর, নারায়ণগড়, খটনগর এলাকার মানুষজনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
এবার একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক, আমেরিকা থেকে ভারতে আগত প্রথম আমেরিকান ব্যাপটিষ্ট মিশনারী দলের এই দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় প্রভাব বিস্তারের শুরুর কথা, তথা এই প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার ইতিহাসের গোড়ার কথা।
১৮৩৫ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে দীর্ঘ চারমাস সমুদ্রযাত্রার পর উড়িয্যার কটক বন্দরে নোঙর ফেলে রেভারেন্ড জেরেমিয়া ফিলিপসের জাহাজ 'ল্যুভর'। অতঃপর ওই বছরই রেভারেণ্ড এলি নয়েসকে সঙ্গী করে ১৫০০০ মানুষের শহর বালেশ্বরে পত্তন করেন ভারতের সর্বপ্রথম আমেরিকান ফ্রি ব্যাপটিস্ট মিশন। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই রেভঃ ফিলিপস সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দুর্দশাগ্রস্থ আদিবাসী সাঁওতালদের উন্নতির কাজে লেগে পড়েন। সাঁওতালদের কথ্য ভাষাকে লেখ্য ভাষায় রূপান্তরিত করার প্রথম প্রচেষ্টা করেন তিনিই। একটি অখণ্ড দেশের আদিম জনজাতির ভাষায় শব্দকোষ ও ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করে ফেলেন এই উদ্যমী আমেরিকান যুবক। এমনকী মূলত ধর্মপ্রচারের লক্ষ্যেই ওড়িয়া ও সাঁওতালী ভাষায় অনুবাদ করেন বাইবেলের অসংখ্য গল্পকথা।
১৭ জানুয়ারী,১৮৪০ জেমস ও জন নামে যমজ সন্তানের জন্মদিনে জেরেমিয়া ফিলিপস। বালেশ্বরে থাকাকালীন ঘুরে বেড়িয়েছেন জলেশ্বর, দাঁতন, খড়্গপুর,ভীমপুর (বিনপুর) ও ঝাড়গ্রামে। আজীবন নিন্নশ্রেণীর ভারতীয়দের জন্য প্রাণপাত করেছেন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে দক্ষিণ বাংলা ও উত্তর ওড়িশায় ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সময় পীড়িতদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সেবাপ্রদানে, অধিক পরিশ্রমের ফলে তার শরীর ভেঙ্গে পড়ে। পরে আমেরিকাতেই ফিরে গেলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু রেখে দিয়ে যান তার যোগ্য সন্তান জেমস্ ফিলিপসকে। চরিত্রে, মননে বাকী ভ্রাতা-ভগ্নীদের থেকে একেবারেই আলাদা জেমস পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে দরিদ্র, নিম্নশ্রেণীর ভারতীয়দের সেবাদানেই নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন ঠিক করেন। আমেরিকায় শিক্ষালাভ শেষ করে তাই জেমস জন্মভূমি ওড়িশার বালেশ্বরে আবার ফেরত আসন। এবং প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি এই কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকেন। 'ইন্ডিয়া সানডে স্কুল ইউনিয়নের' প্রধান হিসাবে ১৮৯৫ সাল অবধি তিনি মিশনারীদের বিবিধ উদ্দেশ্য সাধন করেন।
রেভারেণ্ড জেমস ল্যান্ডেল ফিলিপস ছিলেন মূলত মেডিক্যাল মিশনারী। দরিদ্র মানুষজনের কাছে এই ডাক্তারবাবু তাই ছিলেন দেবতুল্য। নিজেকে 'ইন্ডিয়ান বয়' বলেই মনে করতেন তিনি। রেভ .জেমস বহু স্থানে মেডিক্যাল ক্লিনিক স্থাপন করলেন। প্রকাশ করলেন একটি নিয়মিত সংবাদপত্র। মেদিনীপুর শহরে চালু করলেন 'বাইবেল স্কুল' এবং বালেশ্বর থেকে মেদিনীপুর এই প্রাচীন 'জগন্নাথ সড়ক' পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান ব্যবস্থা। জমিদার ব্যবস্থায় ক্লীষ্ট নিম্নবর্গীয় দরিদ্র মানুষগুলোর শিক্ষা, সাস্থক্ষেত্রে উন্নতিসাধনের উদ্দেশ্যে রেভ. জেমস্ পরপর বিভিন্ন অঞ্চলে “সানডে স্কুল” চালু করলেন। পিতা রেভ. জেরেমিয়ার হাত ধরে ১৮৩৮ সালে বালেশ্বরে ও ১৮৪৩ সালে জলেশ্বরে চালু হওয়া মিশনারী স্কুলের বর্ধিত সংস্করণ হিসাবে সুপুত্র জেমস পরপর ১৮৪৪ সালে মেদিনীপুর, ১৮৫২ শান্তিপুর ১৮৭৩ ভীমপুরে, ১৮৭৭ চাঁদবালী, ১৮৯৩ কাঁথি, ১৮৯৪ খড়্গপুর ও ১৮৯৫ ভদ্রকে স্থাপন করেন মিশনারী স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয়। এই সব স্কুলগুলিতে বিভি্নক্ষেত্রে ভারতীয়দের সেবাদানের ব্যবস্থা করতেন কর্মরত আমেরিকান মিশনারীদের স্ত্রী ও কন্যারা। একথা ঠিক যে, ভারতের শাষনকর্তা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটিশ স্বীষ্টান মিশনারীদের দাতব্য চিকিৎসালয়ও ছিল তবে এই অঞ্চলে তা কেবল বালেশ্বর ও মেদিনীপুর শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওড়িশা-বালেশ্বর সীমান্তবর্তী ছোট ছোট গ্রামগুলিতে কিন্তু আমেরিকান ব্যাপটিষ্ট মিশনারীরাই অধিক প্রভাব বিস্তার করেছিল সাধারণ গ্রামবাসীদের কাছে। দেশের এই অঞ্চলে তৎকালীন সময় কলেরা, গুটি বসন্ত ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ভয়ঙ্কর আক্রমণ থেকে প্রতিহত করার জন্য জনসাধারনের একমাত্র ভরসার জায়গাটি দখল করেছিল কিন্তু জেমস ফিলিপসের দলই।
কিন্তু মিশনারীদের স্বাস্থ সেবাপ্রদান বা ধর্মপ্রচার বা শিক্ষাচেতনা বিস্তার - এই সমস্ত কাজ যে এই গঞ্জ এলাকায় যথেষ্ট সহজ ছিল না তার প্রমান মেলে নেলী ফিলিপসের একটি দুষ্প্রাপ্য সম্পূর্ণ চিঠিতে। ১৮৮২ সালের ১৪ জুন দাঁতন (Dantoon) থেকে আমেরিকার ওহিও প্রদেশের ব্যাপটিস্ট মিশন সদস্যদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি প্রেরণ করেছেন নেলী ফিলিপস্। মিশনারী কাজকর্মের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখছেন -
“ঘটনা হল, ভারতবর্ষ একটি বৃহৎ ভুখণ্ড। বহু জনজাতির বাস, কয়েকশো ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করেন তারা। ..... আসুন এই বিশাল ভারতদেশের একটি গ্রামের কথা আপনাদের শোনাই। নাম দাঁতন (Dantoon) । আমাদের মিশন মানচিত্র অনুসারে গ্রামটি বালেশ্বর ও মেদিনীপুরের মাঝে অবস্থিত। এটি একটি ছোটখাটো গঞ্জ, প্রায় সবাই বিধর্মী, পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করে। আমি এবং মা কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান।....... যে বাড়িটিতে থেকে আমরা এইসব দরিদ্র মানুষগুলির সেবা করতে উদ্যত হয়েছি, সেই বাড়িটি আমেরিকার মত পাথর, ইট বা কাঠেরও তৈরী নয়। কী বলব যেন একখণ্ড দরজা ও জানালা কোনরকমে আচ্ছাদিত করা আছে। কোন চিমনী নেই, না আছে কোন ফায়ার প্লেস। সারা বাড়ি জুড়ে যতগুলি পেরেক ব্যবহাত হয়েছে তা আমাদের একটি মুঠোয় থেকে যাবে। বাড়িটি রোদপোড়া মাটি দিয়ে তৈরী। খড় দিয়ে ছাওয়া। কিন্তু মেঝেটি মসৃণ করে সিমেন্ট দিয়ে বানানো। এতো গেল ভেতরের দৃশ্য।কিন্তু বাহির থেকে বাড়িটিকে মনে হবে যেন খড়ের স্তুপ, ডাই করে রাখা আছে। কয়েকটি সাদারঙের নীচু স্তম্ভের উপরে। আসলে এই দেশ হল কৃষি নির্ভর, দূর দুরান্ত জুড়ে চাষীরা চাষ করেছে। কিন্তু কাঠ মাটি কেটে পুড়িয়ে ইট তৈরী করার অবস্থা ওদের নেই। আমার বাড়িটিতে খুব সামান্য আসবাবপত্র রয়েছে। কয়েকটি চেয়ার, একটি বাইসেল্ফ ইত্যাদি। মেঝেতে কোন কার্পেট নেই। গ্রামবাসীদের হাতে বানানো একপ্রকার ঘাস দিয়ে তৈরী শীতলপটি গোটা ঘরে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।আমরা এগুলি দুই ডলারের বিনিময়ে ক্রয় করেছি। মাঝে মাঝে আমার দেশের কথা মনে পড়ে। আমেরিকার বাড়ীর সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের সঙ্গে যদি এই বাড়ীর তুলনা করি তবে মনে হয় এটি একটি নিঃস্ব, রিক্ত, শৃণ্য...।"
আমেরিকাবাসী মেমসাহেবের এই ভারতীয় গ্রামে দিনযাপন, ও রাত্রি যাপন সত্যিই যে দুঃসহ এবং কষ্টকর সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি নিজেকে নিঃস্ব ভাবতেই পারতেন। কিন্ত চিঠির পরবর্তী অংশে কি লিখলেন নেলী ফিলিপস, দেখে নেওয়া যাক -
".... আমার দাঁতনের বাড়িটিকে যতই শুন্য বলে মনে করি ততই ভুল প্রমাণিত হই। যখন দেখি গরীব, অশিক্ষিত, বাদামী রঙের গেঁয়ো মানুষগুলো এই বাড়ীটিকেই হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। তখন তাদের দুটো চোখের মধ্যে আমি শূন্যতা নয়, পরিপূর্ণতা খুঁজে পাই। প্রথম কোন শ্বেতাঙ্গ পরিবার ও তাদের গৃহবাসস্থান দেখে বিস্বয়ে হতবাক গ্রামবাসীগুলোর সীমাহীন আনন্দ দেখে আমার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে।
ওদের কালো কালো চোখে লেগে থাকে আবেগ, শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম ও বিস্ময়। এতৎ সর্বোপরি বাঁধভাঙ্গা আনন্দ, আনন্দ, উচ্ছাস। নতুন কিছু দেখার, ছুঁয়ে দেখার আনন্দে বিভোর থাকতো ওরা। যেন বলে উঠতো - “আহা কি ভাগ্য আমার। যেন হাতের কাছে স্বর্গ খুঁজে পেলাম।”' বেচারির দল। সত্যি, ওদের অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ঝূপড়ী বাসস্থানের কথা ভাবলেই মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে । আমি ওদের জন্য আরো বেশী করে কাজ করার অনুপ্রেরণা লাভ করি। জানি না, কীভাবে সময় পাবো - আরও বেশী করে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে চর্চা করার পাশাপাশি ভালো করে বাংলা বলতে শেখার পাঠও নিতে হবে। আজকে প্রায় ৮০ জন রোগী আমার বাড়ীতে এসেছিলো । ঈশ্বরের কৃপায় সবাইকে সমানভাবে শুশ্রুষা করতে পেরেছি। গ্রামবাসীরা সগর্বে আশীর্বাদ করেছেন আমাকে। আশা করি, এভাবে চলতে থাকলে স্বপ্ন আমার পূরণ হবেই একদিন। তবে এরজন্য আমাদের কঠোর শ্রমের পাশাপাশি প্রয়োজন আপনাদের সকলের ভালোবাসা ও প্রার্থনা।
আপনাদের স্নেহধন্য ভগিনী
নেলীফিলিপস
সীমান্তবর্তী শহর দাঁতনের বুকে প্রথম শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান মিশনারীদের পদার্পনের সাথে সাথেই অঞ্চলের মিশনারী হাউসের দায়ীত্ব অর্পিত হয় মহিয়সী সেবিকা তথা ধার্মিক “জেনানা" মিসেস জেমস্ ফিলিপস ও কন্যাদ্বয় হ্যাটি ফিলিপস এবং নেলী ফিলিপসের উপর। পরবর্তীকালে কিছুদিন এখানে শ্রমদান করেছিলেন মিস জুলিয়া ফিলিপস। রেভ. জেমস ফিলিপস জলেশ্বরের দায়ীত্ব নিলেন এবং দাঁতন ও মেদিনীপুরে নিয়মিত যাতায়াত করে দেখভাল করতেন। দাঁতন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে লিখিত জুলিয়ার একাধিক চিঠিগুলি থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়, যেমন ১৮৭৮ সালে লিখিত একটি চিঠিতে জুলিয়া লিখছেন - ".... আমরা মাত্র ৬ সপ্তাহ ধরে মিশনের কাজে নেমেছি, এখনই দাঁতনে প্রায় ৫০ জন গ্রামবাসী মিশনারী সদস্য হয়েছেন। বড় রাস্তার একেবারে পাশেই একটি পুস্করিণীর পাড়ে আমাদের কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল নির্বাচিত হয়েছে। আশেপাশে প্রায় ১০ মাইলের মধ্যে শুধু আমরাই ছিলাম শ্বেতাঙ্গ পরিবার। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় দলে দলে মানুষজন এসে বাড়ির বারান্দায় বসতেন এবং মাউথ অর্গান বাজিয়ে গান শোনানোর জন্য আবদার করতেন। ওদের একটু করে সুখ, আনন্দ ও বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আমরাও বাইবেলের বিভিন্ন গল্প ও ধর্মকাহিনী শোনাতাম। এবং শুধু তাই নয় শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগতির উদ্দেশ্যে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগও নিলাম আমরা।"
পরবর্তীকালে দাঁতনের মূল দায়িত্বে থাকা মিসেস জেমস মেদিনীপুরে থাকাকালীন দাঁতনে কর্তব্যরত মিশনারী কন্যাদের কাজে খুব খুশি হয়ে আমেরিকাবাসীকে পত্র প্রেরণ করে জানিয়ে দিলেন তার গর্বের কথা:
“১৮৭৯ , এপ্রিল ২, মেদিনীপুর জুলিয়া এখন দেড়মাস হল আমাদের সঙ্গে দাঁতনেই থাকে এবং যেভাবে একা হাতে এতবড় অঞ্চলের এতগুলি মানুষের সেবা শুশ্রুষার দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সে কথা ভেবে ভীষণ খুশী হই। কম দিনেই সকলের মন জয় করে নিয়েছে এই সুন্দরী, ঝকঝকে, যুবা মেয়েটি, যেন সকলকে আপন করে নেওয়া তার জন্মগত অভ্যেস । এমনকী রান্নাঘরে ডিনার তৈরী থেকে কোনো মিশনারী সভার নেতৃত্ব দেওয়া সবেতেই সে ছিল সিদ্ধহস্ত। দাঁতন গ্রামের সকল বাচ্চা, বুড়ো , ছেলে-মেয়ে, দ্রুত তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কাছের মানুষ বলে মেনে নিয়েছে । ..... অপরপক্ষে আমাদের হ্যাটি , যেন সকল শক্তির আধার। প্রকৃত নিয়মানুবর্তী, শিক্ষিতা, এবং শৈল্পিক যোদ্ধা একজন । ভীষণ দৃঢ়চেতা একজন নারী। মিশনারী কাজকে মনে -প্রাণে ভালোবেসেছে। এমনকী দাঁতনের আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথনের কাজেও বহুদুর এগিয়ে গেছে ও। যদি আগামী হেমন্তে এদের সঙ্গে নেলী এসে যোগদান করে তবে শক্ত হাতে পুরুষ সেবকবিহীন এই দাঁতন দুর্গকে আমরা শক্ত হাতে রক্ষা করতে পারবো। কিন্তু হা ঈশ্বর এই দাঁতনভূমি, কী অসাধারণ প্রতিশ্রুতিমান এই অঞ্চলে কীভাবে যে লর্ড জিসাসের নামে উৎসর্গ করে লোকসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবো, সেই ভাবনাতেই রয়েছি ......”
যাইহোক, একথা সত্য যে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ অবধিও বাংলার এই দক্ষিণ-সীমান্ত অঞ্চল দাঁতন, রাণীসরাই, খটনগর, নারায়ণগড় অঞ্চল তখন প্রায় জঙ্গলাবতীর্ণ ছিল। মাঝখান দিয়ে বুক চিরে এগিয়ে গেছে পবিত্র “দণ্ড পথ জগন্নাথ ধামের উদ্দেশ্যে। উত্তর দিক থেকে তীর্থধাত্রীরা দিনের পর দিন ধরে পায়ে হেটে পুরীতে পৌঁছাতো। পথে ক্লান্তিতে অনাহারে মৃত্যু হলে শকুনের খাদ্যবস্তু হয়ে উঠতো। এই দুর্ব্ষহ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা-দীক্ষা-অর্থনীতিতে একেবারে পিছিয়ে থাকা এইসব অঞ্চলগুলিতে টিমটিম করে চলতো কিছু পাঠশালা, ধর্মীয় টোল ও চতুষ্পাঠী। সংস্কৃত ও বাংলা শিক্ষা দেওয়া হত এই সকল গ্রাম্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এই অঞ্চল পড়ে ছিল সহস্র ক্রোশ পেছনে । গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত কলেরা, বসন্তরোগে। ছিল না কোনো চিকিৎসক, কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র।
ঠিক এই কারনে প্রথমে ব্রিটিশ মিশনারী ও পরে আমেরিকান মিশনারীরা এইসব অঞ্চলে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে পোরেছিল। মিশনারীরা সর্বপ্রথম গরীব জনসাধারণের চিকিৎসা, বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ ও সেবা করেন। পরে মানুষের আরো ঘনিষ্ট হবার উদ্দেশ্যে তাদের ভাষা শেখেন। পুরোনো গল্পকথা, কিংবদন্তী কাহিনী। ধর্মশাস্ত্রকে গল্পাকারে বলতে থাকেন, শোনাতে থাকেন। তৈরী করেন বালিকা বিদ্যালয়, উপাসনাগৃহ এবং চিকিৎসা কেন্দ্র। সীমান্ত অঞ্চলের মাটিতে আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি ও অগ্রগতির একটা প্রাথমিক প্রচেষ্টা অন্তত শুরু করেছেন তারা। মনে রাখতে হবে সমগ্র অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের প্রথম কার্যকলাপ শুরু হয় ১৮৪৪ সালে মেদিনীপুরে এবং তার কয়েক বছর পরেই কিন্তু ১৮৭৭ সালে সীমান্ত এলাকার এই গঞ্জ দাঁতনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়া মিশন হাউস। সীমান্ত এলাকার কেন্দ্রীয় শহর হয়ে ওঠে দাঁতন। তাই এই বৃহৎ দাঁতন অঞ্চলের প্রাথমিক উন্নতিতে আমেরিকান মিশনারীদের প্রভূত অবদান যে অপরিসীম সেকথা অনস্বীকার্য্য।
midnapore.in