দেবী মুগেশ্বরী, মুগবেড়িয়া, Debi Mugeswari, Mugberiya

দেবী মুগেশ্বরী এবং মুগবেড়িয়া

Debi Mugeswari and Mugberiya

ডঃ বিভাসকান্তি মন্ডল।


"ঈশ্বরীরে পরিচয় করেন ঈশ্বরী"


ভারতচন্দ্রের এই বাণী আর এক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হল মুগবেড়িয়ার উৎস সন্ধানে মুগেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে। মন্দিরের তালা খুলে সযত্নে মুগেশ্বরী দেবী দর্শন করালেন শিশির ধৌত নির্মল শিউলির মত অপাপাবিদ্ধ তরুণী সেবাইত কন্যা সুনন্দা। শরতের শিশিরের মত ঝরে পড়ছে সদ্য কলেজে পড়া ব্রাহ্মণ কন্যার কথা। দেবী মূর্তির সঙ্গে যেন আঙ্গিকের অনেক মিল। দেবী মুগেশ্বরী থেকেই মুগবেড়িয়ার উৎপত্তি - এটাই লোকায়ত অবিতর্কিত জনশ্রুতি। তবে মুগেশ্বরীর পরিচয় জানলে জানা যাবে মুগবেড়িয়ার কথা।


দেবী মুগেশ্বরী, মুগবেড়িয়া, Debi Mugeswari, Mugberiya
দেবী মুগেশ্বরীর মন্দির, মুগবেড়িয়া (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক)

প্রকৃতপক্ষে পূর্ব মেদিনীপুরের যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে মানুষ মুগবেড়িয়া বলে জানে তার অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা এবং থাকলে কতটুকু আছে তা জানলে বিস্মৃত হতে হয়। হান্টারের বেঙ্গল গেজেটে এ রকম কোন নামেরই উল্লেখ পাওয়া যায় না। লর্ড ক্লাইভের সময় (১৭৫৭) কিন্তু জায়গাটি জরিপ করা হয়েছিল। তবে মুগবেড়িয়া স্থানটি নির্দিষ্ট করে খুঁজে পেতে হলে যেতে হবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার ভুপতিনগর থানার সুয়াদিঘী গ্রামে। ওই গ্রামে রয়েছে মুগেশ্বরী দেবীর মন্দির। মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন মোট পাঁচ কাঠা জায়গা ঘিরে যে স্থান দেবীর জন্য নির্দিষ্ট তার নামই মুগবেড়িয়া। আশ্চর্য হলেও এটিই সত্য। তবে দেবীর তো আর নির্দিষ্ট গণ্ডি থাকে না। তাই মুখ বেড়িয়া যেন এক অনির্দেশ্য এলাকার নাম। সুয়াদীঘি, মুগবেড়িয়া, কেসাইদীঘি, খাঞ্জাদাপুর সহ যে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা তা যেমন মুখবেড়িয়া নামে পরিচিত বা নামাঙ্কিত তেমনি আবার বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়, মুগবেড়িয়া প্রভৃতিও মুগবেড়িয়ার নামেই নামাঙ্কিত। এমনকি ব্যায়াম সমিতি থেকে পাঠাগারও মুগবেড়িয়া নাম যুক্ত। আবার মুগবেড়িয়া একটি বিধানসভার নাম। ১৯৫৮ সালের ১লা এপ্রিল ভগবানপুর ভেঙ্গে দুটি ব্লক হয়। ভগবানপুর ২ নম্বর ব্লকের আয়তন হয় ১০০.০২ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে এটি মুগবেড়িয়া বিধানসভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।



পশ্চিমবঙ্গের মৎসমন্ত্রী কিরণময় নন্দ মুগবেড়িয়া বিধানসভা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক। বস্তুত ওই নন্দ পরিবারের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে মুগেশ্বরী দেবী এবং মুগবেড়িয়া।


দেবী মুগেশ্বরী, মুগবেড়িয়া, Debi Mugeswari, Mugberiya
মুগবেড়িয়ার বিখ্যাত ঝুরিভাজা (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক)

দেবী মুগেশ্বরী থেকে মুগবেড়িয়ার ইতিহাস জানতে হলে অতীতে ফিরে যেতে হবে। মাজনামুঠার কিশোরনগরের জমিদার যাদবরাম রায় চৌধুরী ১১টি পরগনার অধিকারী ছিলেন। তিনি পঞ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ এনে বসতি ঘটান। ত্রিপাঠি (বর্তমানে দেবীর সেবাইত), ষড়ঙ্গী, হোতা, দ্বিবেদী এবং নন্দ - এই পঞ্চ শ্রেনির ব্রাহ্মণের মধ্যে নন্দরাই গুণে, বিদ্যায় এবং প্রভাবে পরবর্তীতে ভাস্বর হয়ে উঠেন। নন্দ পরিবারের আগত পুরুষ ছিলেন অপর্তিচরণ নন্দ। এদের পঞ্চম পুরুষ ভোলানাথ নন্দ (জন্ম ১৮১৯) প্রভাত প্রতিপত্তি ঘটান। প্রবোচন্দ্র বসুর "ভগবানপুর থানার ইতিহাস" থেকে জানা যায় ভোলানাথ নন্দ স্বাপদসংকুল জঙ্গল মহাল গুলি পরিষ্কার করে সরকারের কাছ থেকে বেশি জায়গা বন্দোবস্ত করে তার জমিদারি বিস্তৃত করেন। ওই জঙ্গলের মধ্যেই মুগেশ্বরীর সন্ধান মেলে। জঙ্গলের মধ্যে কোন সুউচ্চ স্থানে দেবী ছিলেন বলেই তিনি মুগেশ্বরী।



পন্ডিত চিন্ময়নন্দ মনে করেন মুগ শব্দটি দক্ষিণভারতীয়। এর অর্থ উচ্চস্থান। এভাবেই হয়ত নাম না জানা বনদেবীকে মুগেশ্বরী অর্থাৎ উচ্চ স্থানের (জঙ্গলের) ঈশ্বরী রূপে ভাবা হয়েছে। আর সেই অঞ্চলকে 'বেড়' করে অর্থাৎ ঘিরে থাকা এলাকাকে মুগবেড়িয়া বলা হচ্ছে। মুগবেড় হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। আসলে ওই অঞ্চলের মানুষ এখনো যে কোন শব্দের সঙ্গে আদর বা যত্ন অর্থে 'য়া' ধ্বনি যুক্ত করে (যে সে নামের সঙ্গেও হরিকে হারিয়া বলে ডাকে)। সেজন্য হয়ত মুগবেড়ে একসময় মুগবেড়িয়া হয়েছে। আবার ওই বনদেবীকে পশুদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও বলা যেতে পারে (তবে দেবী চণ্ডীর সঙ্গে অবয়বের মিল নেই)। লোকায়ত বনদেবীর ওই এলাকা একসময় উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংস্কৃত মৃগবাটিকা উড়িয়া ভাষায় মুখবাটিকা হয়েছে। মৃগ শব্দের আদি অর্থ পশু (এখন কেবলমাত্র হরিণকে বোঝায়)। আর বাটিকার অর্থ কুঁড়েঘর। পশুদের দেবী যিনি কুঁড়ে ঘরে বা পর্ণ কুটিরে থাকতেন তিনি মুগবাটিকা। অবশ্য শ্যামাচরণ নন্দর মায়ের দাবিতেই দেবীর পাকাঘর নির্মিত হয়। তার পূর্বে তা ছিল কুঁড়েঘর। মুগবাটিকা ভাষার ক্রম বিবর্তনের মধ্যে মুগবেড়িয়া হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আবার বেড়িয়া শব্দের অর্থ পথও হয়। জঙ্গল পরিষ্কার করে পথ বা বেড়িয়া তৈরি করা হয়েছিল। মুগেশ্বরীর সামনে দিয়ে পথ নির্মাণ করে তার দুপাশে যে অঞ্চল আবাদ করা হয়েছিল তা মুগবেড়িয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। আবার 'বেড়ে' মানে বেশ ভালো বা উত্তম পরিবেশ 'বেড়ে চাষ হয়েছে মানে খুব ভালো আবাদ হয়েছে। ভোলানাথ নন্দ বেশ পরিশ্রম করে ওই অঞ্চল পরিষ্কার করেছিলেন। ভালো আবাদও যে হত তার প্রমান এখনো ওই অঞ্চলের ফসল উৎপাদন থেকে বোঝা যায়। অতিরিক্ত ভালো অর্থে আঞ্চলিক 'য়া' যুক্ত হয়ে বেরিয়ে হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে বেড়িয়া শব্দটি যেভাবেই আসুক তা যে মুগেশ্বরীর সঙ্গে সংযুক্ত এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। তবে এও ঠিক মুগবেড়িয়ার বাস্তব অস্তিত্ব মাত্র পাঁচ কাঠা জমি হলেও তার সীমানা ঐতিহ্য দিয়েই পরিমিত। মহান শিক্ষাব্রতী বিদ্যানিধি দিগম্বর নন্দ, সংস্কৃতি সাধক গঙ্গাধর নন্দ আর পরবর্তীকালে প্রখ্যাত দার্শনিক পন্ডিত জ্যোতির্ময় নন্দ মুগবেড়িয়াকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দর্শনের পীঠস্থান করে সমুজ্জ্বল করে গেছেন। যার ফলে মুগেশ্বরীর মুগবেড়িয়া এত ব্যাপ্তি লাভ করেছে।


দেবী মুগেশ্বরী, মুগবেড়িয়া, Debi Mugeswari, Mugberiya
দেবী মুগেশ্বরী, মুগবেড়িয়া (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক)

কিন্তু যে মুগেশ্বরীর মুগবেড়িয়ার এত নাম নন্দ পরিবারের সেই দেবীর স্থানটি বড় মলিন। দেবালয় ও দেবীর পাশে একটি বিষ্ণুমূর্তি রয়েছে। যার নিচের অংশ ভাঙা। চুরি হয়ে গেছে দেবীর কংসাল, ঘড়ি, ঘন্টা আর রুপোর মুকুট। আভরণহীন দেবী মূর্তি তবুও 'অতিপ্রীতিকর'। অভিধানকার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে 'সুনন্দা' নামের অর্থও তাই (অতিপ্রীতিকর)। হ্যাঁ, মুগেশ্বরীর পরিচয় দাত্রী 'সুষ্ঠু নন্দয়িতা' সেই সুনন্দা।


midnapore.in

(Published on 15.10.2022)