অতৃপ্তের আনাগোনা , Dissatisfied soul, असंतुष्ट आत्मा, Raja Narendra Lal Khan Womens College, Midnapore, Ghost, ভূত

অতৃপ্তের আনাগোনা

Dissatisfied soul | असंतुष्ट आत्मा

শাশ্বতী গোস্বামী।


তখন আমি কলেজে পড়ি ।ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ার হবে । মেদিনীপুর শহরের শেষ পশ্চিম প্রান্তে বিশাল এলাকা জুড়ে ও সুঊচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত তৎকালীন জেলার নামকরা মহিলা কলেজ ওটা । মাধ্যমিকের পর কলেজের সুখ্যাতি শুনে বাবা ভর্তির জন্য নিয়ে আসেন । পড়বো কিনা ঠিক ছিলো না কারণ ইলেভেন টুয়েলভ এ সবাই স্কুলেই পড়াতে চাইতো ।



কিন্তু এসে কলেজের প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের এতটাই প্রেমে পড়ে গেলাম যে , বাবার কোন কথা না শুনেই ভর্তি হয়ে গেলাম চান্স পাওয়া মাত্র ই । কিন্তু বাড়ি দূরে তাই হোস্টেলে থাকতে হবে । বাবা বললেন তাহলে তাই থাক , একেবারে গ্রাজুয়েশন টা ও হয়ে যাবে । আমায় আর বেশী ঘোরাঘুরি করতে হবে না কলেজে ভর্তির জন্য ।


অতৃপ্তের আনাগোনা , Dissatisfied soul, असंतुष्ट आत्मा, Raja Narendra Lal Khan Womens College, Midnapore, Ghost, ভূত
Raja Narendra Lal Khan Women's College

দেখতে দেখতে দুটো বছর বেশ কেটে গেলো । গ্রাজুয়েশনেও ভর্তি হলাম ওই কলেজেই । বাবার ধারনা ভুলই ছিলো । কারণ পুরোনো ছাত্রী বলে কোনরকম রেয়াত করে নি ভর্তির ক্ষেত্রে । নির্ধারিত নম্বর দেখেই ভর্তি নিলো কলেজ কর্তৃপক্ষ । সে যাই হোক , ভর্তি হয়ে দেখি বেশির ভাগ পুরনো বন্ধুই নেই । তার মধ্যে কেউ কেউ আবার হোস্টেল পেলো না । কয়েকজন ছাড়া বেশীরভাগই নতুন বন্ধু । প্রথমটা একটু মন খারাপ হয়েছিলো ঠিকই , তবে বন্ধুরা কখনো খারাপ হয় না নতুন ই হোক বা পুরোনো । নতুনদের সাথেও বেশ ভাব জমে গেলো কয়েকদিনের মধ্যেই ।

আগেই দু বছর কলেজ হোস্টেলে থাকার দরুন আমি এই কলেজ সম্পর্কে কিছু কিছু কথা শুনেছিলাম । ফার্স্ট ইয়ারের নতুন বন্ধুদের সাথে আমার আগের শোনা বিভিন্ন ভূতের কথা গুলোই শেয়ার করতাম । ওরাও বেশ ভয় পেতো কারণ গল্প গুলো এই প্যালেস টা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের জন্য এটাই বরাদ্দ ছিলো ! তা আমাদের সেই সব গল্পের বেশিটাই ছিলো অশরীরীর গল্প । যেগুলো বিভিন্ন সময়ে আমরা রান্না মাসি , মাছকাটা মাসি , কালুদা , সুশীলদা , অঞ্জুদি প্রভৃতির থেকে শুনে এসেছি ।



একদিন সকালে ডাইনিং হলে চা আনতে গেছি হঠাৎ অঞ্জুদি বললো কাল কি তোরা রাতে কোনো আওয়াজ পেয়েছিলি ?

বললাম কই না তো ? কেন গো ?

কিছু একটা চিন্তা করে অঞ্জুদি বললো , গতকাল রাতে তার নাকি গরমে ঘুম আসছিলো না তাই জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলো । হঠাৎ শোনে যে , একটা করুণ কান্নার আওয়াজ আসছে পেছন থেকে । তার পরই নাকি একটা দমকা হাওয়া এসে খাটের মশারি উড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো । ওই দিদি বলেছিলো এখানে বহু অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায় । তবে কারুর কখনো যে কোনো ক্ষতি করেছে এমনটা কিন্তু কেউ শোনেনি ॥ রাতে অনেকেই দেখেছে । একটা মেয়েকে তো নাকি প্রায় ই দেখা যায় । আসলে সে এক কাহিনী ।



সত্যতা জানা নেই যদিও । শোনা কথা । বহু যুগ আগে রাজ বংশের কোনো এক রাজপুত্র এক বাইজির প্রেমে পড়ে তাকেই বিয়ে করবে পণ করে বসে । তাই বংশের সম্মান রক্ষার্থে তার বাবা ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে মেয়েটিকে চলে যেতে বলে । মেয়েটি ঘটনাটা সব্বাইকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলো । দ্বাররক্ষীকে প্রথম বলে ঘটনাটা । সেটা রাজার কানে গেলে বংশের সম্মান রক্ষার্থে বাইজি মেয়েটিকে রাজা পিস পিস করে কেটে গুমঘরে ফেলে দেয় । গুমঘর হলো প্যালেসের একতলা থেকে দোতলা যাওয়ার সিঁড়ির তলায় একটা অন্ধকার খুপরি মতো জায়গা ওটা মাটির তলা দিয়ে কাঁসাই নদীর সাথে যুক্ত। ওটা জমিদারের গোপন ঘরের সাক্ষীস্বরূপ আজ ও বর্তমান। বিশ্বাসঘাতক এবং শত্রুদের গর্দান নিয়ে বডি টা কুটি কুটি করে কেটে ফেলে দিতো সেই গুমঘরে। তারপর দিনে নদীর জলে ভরে যেতো গুমঘর ....আবার যখন জল বেরিয়ে যেত তখন সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ করে নিয়ে চলে যেতো । আর সেই খুনের খবর গোপন ই থাকে । তা সেই বাইজি মেয়ের মৃত্যুর পর তার দেহের অংশ গুলোও ঐ গুমঘরে ফেলা হয়। জোয়ারের জল নাকি তার দেহের সব অংশটা নিয়ে গেলেও একটা হাত কোথাও আটকে থেকে যায় । কিছুদিন পরে ছেলেটি বিদেশ থেকে ফিরে এসে মেয়েটির খোঁজ করে মেয়েটিকে দেখতে না পেয়ে রাজার ছেলে পাগলের মতো হয়ে যায় । দিনরাত মদ খেতে শুরু করে । একদিন রাতে মদ খেয়েই নাকি সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে গোপন সুড়ঙ্গে পড়ে যায় । কেউ জানতেও পারে নি । একা আর উঠতে না পেরে ওই গুমঘরে পড়ে মারা যায় । কিভাবে গেলো কে নিয়ে গেলো কিছুই জানা যায় নি । শুধু জলে ভেসে ওঠা কুমারের হাতে ধরা ছিলো সেই বাইজির হাতের কঙ্কালটা । যার অনামিকায় তখনও জ্বলজ্বল করছিলো কুমারের নামাঙ্কিত হীরের আংটি ।


অতৃপ্তের আনাগোনা , Dissatisfied soul, असंतुष्ट आत्मा, Raja Narendra Lal Khan Womens College, Midnapore, Ghost, ভূত
অতৃপ্তের আনাগোনা | Dissatisfied soul | असंतुष्ट आत्मा

আমি ভয় পেয়ে অঞ্জুদিকে জিগ্গেস করেছিলাম কেন গো ওরা ঘুরে বেড়ায় ?

বললো কেন কি গো ? এ যে রাজবাড়ি ? কত অতৃপ্ত আত্মা রয়েছে এখানে ? ওই অতৃপ্ত আত্মারা তো জন্ম নিতে পারে নি কোথাও । তাই আজও এখনেই গুমরে মরে । অবশ্য কারুর ক্ষতি করে নি আজ অব্দি ।

ওই যে রে ....তোরা যেখানে প্রেয়ার করতে যাস ? প্যালেসের যে গাড়ি বারান্দাটা আছে ওখানে মজলিস বসতো রাজাদের । বাইরা নাচ করতো রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য । আর ওর পাশের আয়না বসানো দেওয়াল আর কাঠের মেঝের যে বিশাল ঘরটাতে টি ভি দেখতে যাস ? ওখানেই নাচ গান হতো বাইজিদের । দূরদূরান্ত থেকে বাঈজীদের আনা হতো । বাংলার বাইরেরই বেশি ছিলো শুনেছি । ওই দুটোই অর্থাত গুমঘর আর নাচঘর নামে তোমাদের টিভি দেখার হল টাই হলো অতৃপ্ত আত্মার আঁতুড়ঘর । ওখানে কখনো একা থেকেছিস টি ভি দেখতে গিয়ে ?



আমি ভয়ে ভয়ে বলি না তো? কেন গো ?

কখনো যাস না একা একা ।

ওখানেই নাকি সেই বাইজির আত্মার বাস । অনেকেই দেখেছে ।

একদিন প্রিন্সিপাল ও নাকি একটা অপ্রিয় ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন।সেকথা আমাদের এক বন্ধু ই বলেছিলো ।ঐ বন্ধু প্রিন্সিপাল এর আত্মীয় ছিলো। তারপর ও যা বললো সেটা এইরকম যে ...স্যারের কয়েকদিন ধরে বেশ জ্বর চলছে । তা গতকাল বেশ রাতের দিকে স্যার এর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে স্যার একটু প্যালেসের বারান্দাতে এসে দাঁড়ান । ( আসলে ঐ প্যালেসের একটা অংশে প্রিন্সিপাল স্যার তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন )বেশ হাওয়া দিচ্ছিল সেসময় । তারপর হঠাৎ স্যার একটা মিষ্টি গন্ধ পান । উনি উনার পোরশানের সাথে গাড়ি বারান্দার (যেখানে মেয়েদের প্রার্থনা হয় সেই অংশের সাথে স্যারের অংশটাতে একটা কাঠের দরজার পার্টিশান থাকে )পার্টিশনের প্লাই এর দরজার দিকে তাকাতেই একটা ঘুঙুরের মৃদু আওয়াজ পান । উনি রাত কত মনে করতে না পেরে ভাবেন কোন মেয়ে হয়তো পড়াশুনো করছে । তাকে রুমে পাঠাবার ঊদ্দ্যেশ্যে ওদিকের দরজাটা খোলেন এবং দেখেন যে একটা সাদা ঘাগরা পরা অপরূপ সাজের মেয়ে। যদিও উনি মুখটা স্পষ্ট দেখতে পান নি । ওই নাচ বারান্দাতে খুব মৃদু পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে । স্যারের কেমন যেন লাগলো উনি চাইছেন ফিরে যেতে কিন্তু পারছেন না ।



মন্ত্র মুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলেন পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় । মেয়েটি নাচের ছন্দে ঘুরছে কখনো বা গাড়িবারান্দার মাঝখানে অবস্থিত পদ্মআঁকা জায়গাটাতে বসে পড়ছে নাচেরই মুদ্রায় ।চারিদিক স্তব্ধ । চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওই পদ্মের মাঝ বরাবর । এছাড়া কিন্তু আর কোথাও কোন আলো নেই । একটা অপরূপ মায়াময় পরিবেশ । যেন বহুযুগ আগের সময়ে চলে গেছেন স্যার ।যখন রাজারা বাইজি নাচাতেন আর শখ মিটে গেলেই মেরে ফেলে দিতেন ওই সিঁড়ির তলার আন্ডারগ্রাউন্ড এ ।

ভাবতে ভাবতে তিনি হুঁশ ও হারিয়ে ফেলেছিলেন মনে হয় । কতক্ষণ যে স্যার এইভাবে দেখছিলেন উনার মনে নেই । ভাবতে ভাবতেই মনে হয় উনি এক পা এক পা করে উঠে চললেন দোতলা ,তারপর তিনতলা, একটা সময় উনি নিজেকে চারতলার ছাদে আবিষ্কার করলেন একদম একা এবং করা মাত্রই কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে আসতে শুরু করেন তারপর নিজের ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে ডেকে সবটা বলেন । উনি বলেছেন যে ওই মেয়েটিকে ফলো করেই নাকি উনি চলছিলেন আর পায়ে হঠাৎ কিছুর আঘাত পেয়েই সম্বিৎ ফিরে দেখেন যে উনি প্যালেসের শেষ তলায় এসে গেছেন । এবং কেমন একটা ভয় ভয় পাচ্ছিলেন । তাই দৌড়ে নেমে আসেন ।

মাসি বলেছে ওই পার্টিশন টা একেবারেই সিল করে দেবে । কারন , ওইসব অশরীরীর অতৃপ্ত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় আর কখন যে কার ক্ষতি করে বসে ঠিক নেই । হয়তো স্যারকে ওই চারতলা থেকেই ঠেলে ফেলে দিতে পারতো ?

আমায় বলে বললো এই ঘটনাটার কথা কিন্তু তুই আর কাউকেই বলবি না । তাহলে মাসিকে স্যার খুব বকবে রে । আমিও হ্যাঁ বলে ঘটনাটা নিজের মনেই রেখে দিলাম ॥



মনে মনে সেদিন অনেক টানাপোড়েন চলছিলো.... সারাটা দিন ভেবেই চলেছি সেসময়ের সব কথা তখন নদীতেও জোয়ার ভাটা হতো । আর দিনে দুবার জোয়ারের জল সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ভরে দিতো ওই আন্ডারগ্রাউন্ড টা । আবার ভাটার টানে যখন জল ফিরে যেত তখন ওইসব অপকর্মের সমস্ত চিহ্ন টুকু নিশ্চিহ্ন করে নিয়েই ফিরে যেত আপন গতিতে । নদীতে কত লাশ ই তো বয়ে যায় ! কেই বা তার কিনারা খুঁজতে যায় বলো ? আমি যে সেই অর্থে খুব সাহসী ছিলাম এমনটা ভাবার কিন্তু বিশেষ কারণ নেই ! কারণ এবার যে গল্পটা শোনাবো সেটা আমারই । তবে ঘটনাটা ঘটেছিলো নাকি মনের ভ্রম সেটা পাঠকই বিচার করুন ।

সেসময় আমাদের হোস্টেলগুলো বেশ কিছুটা দূরে দূরে অবস্থিত ছিলো । মোট পাঁচটা হোস্টেল বিল্ডিং । আর প্রতি ইয়ারেই চেঞ্জ করতে হতো।পাস করেই ছেড়ে যেতে হতো পুরনো ভবনটা। এভাবেই ঘোরা হয়ে যেতো প্রতিটা বিল্ডিং । অর্থাৎ প্রতি বছর পরীক্ষার পর নতুন ক্লাসে ওঠার সাথে সাথেই লোটা কম্বল নিয়ে নতুন বিল্ডিং এ যেতে হতো । বিভিন্ন ইয়ারের জন্য বিভিন্ন নামের বিল্ডিং । যেমন সারদা ভবন , নিবেদিতা ভবন , ভগবতী ভবন , মাতণ্গীনী ভবন । সব মহিয়সী নারীদের নামেই নাম ।

সে যাই হোক ফার্ষ্ট ইয়ারে অনিবার্য ভাবে এসে উঠলাম মাতঙ্গীনি ভবন অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের নিচের তলায় । অনান্য নতুন বিল্ডিংএ একটা রুমে চারটে করে বেড হলেও এখানে রুমগুলো বড় বড় হওয়ায় ছয়জন করে থাকতে হতো । তবে কিছু কিছু চারজনের বা দুজনের রুম ও ছিলো । অবশ্য আমাদের কোন অসুবিধেই হতো না । আড্ডাবাজ তো ?যত বন্ধু ততই ভালো ।



ওই ঘরগুলো ভীষণ ঠান্ডা । পুরনো আমলের চুন সুরকির দেওয়াল । এমনিতেই ওই কলেজে আমি ইলেভেন টুয়েলভ এ পড়ার দরুন আমার একটা ধারনা হয়েছিলো যে, আমায় হয়তো এই কলেজের ইঁট কাঠ পাথরেরাও চিনে রেখেছে । ভীষণ ভালোবাসতাম আমার এই কলেজটাকে । সে যাই হোক ...নতুন হোস্টেল বিল্ডিং নতুন বন্ধু। নতুন বন্ধুদের কেউ কেউ আমাদের ভুতুড়ে গল্পগুলো বিশ্বাস করতে চাইতো না । কলেজ আর হোষ্টেল একই ক্যম্পাসে । কলেজ থেকে ফিরে কোনোদিন প্রাচীরের মধ্যে এদিক ওদিক বেড়াতে যাই আবার কখনো চারতলায় উঠে যাই ফাঁকা ছাদের থেকে নদী , টিলা , ব্রিজ , ট্রেন দেখি । । খুব সুন্দর লাগে দেখতে । সেইসঙ্গে দূরের জঙ্গলাকীর্ণ গোপগড় টা ও ভীষণ টানে । ওইসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়তাম । ভাবতাম কি নিশ্চুপ এখন এই মহল অথচ একসময় এখানে সারাদিনই কি হৈচৈ না চলতো । লোকলস্কর ঘোড়া হাতি অন্দরমহল বাহিরমহল , বিচার , শাস্তি , অতিথি আপ্যায়ন , পূজা অর্চনা , যুদ্ধ বিগ্রহ সবকিছু কি নিপুণভাবেই না চলতো ! আর রাতে রাজারা তাদের ইয়ার দোস্তদের নিয়ে মজলিশ বসাতেন । চলতো মদের ফোয়ারা , বাইজির চটুল গান নাচ । ছুটির দিনগুলোতে আমরা দুপুরে ভাত খেয়েই যেতাম টিভি দেখতে সেই নাচঘরটাতে । যার চারিদিকে কেবল বড়বড় আয়না । প্রথম প্রথম ভাবতামএই নাচঘরে কেনএতো আয়না? পরে এখানে টিভি দেখতে বারবার আসার সূত্রে বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছিল আমার কাছে।আসলে হলটির যেকোনো জায়গায় বসলেই পুরো ঘরটা স্পষ্টভাবে দেখা যাবে বলেই সারা দেওয়াল জুড়েই এতো আয়নার ঘটা । তারমানে বাঈজিরা যখন নাচতেন তখন তাঁদের প্রতিটা মুদ্রা , প্রতিটা বিভঙ্গ ঘরের যেকোনো কোনায় বসেই দেখতে পেতো প্রতিটা মানুষ । কি বুদ্ধি সব ....


অতৃপ্তের আনাগোনা , Dissatisfied soul, असंतुष्ट आत्मा, Raja Narendra Lal Khan Womens College, Midnapore, Ghost, ভূত
Raja Narendra Lal Khan Women's College

সেবার গ্রীষ্মের ছুটি পড়ার আগের দিন । হোস্টেল প্রায় ফাঁকা । আমার বাবা একটু কাজে আটকে গেছিলেন তাই সেদিন আনতে আসতে পারেননি । তখন গার্ডিয়ান ছাড়া মেয়েদের লম্বা ছুটিতে বাড়ি যেতে দেওয়া হতো না ।আমি সেদিন হোষ্টেলে থেকে গেছিলাম । আমার রুম ফাঁকা । তাই পাশের রুমের শ্রুতির সাথেই ছিলাম সকাল থেকে । কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে ওকে বললাম , আজ শনিবার দুপুরে হিন্দি সিনেমা হয় । তখন টিভি তে এখনকার মতো এতো চ্যানেল ছিলো না দু তিনটে ছাড়া।তাই বললাম চল টিভিতে একটা সিনেমা দেখে আসি ।কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চারদিক । সব বিল্ডিং এই দু চারজন করেই আছে দেখছি । এইভাবে হোষ্টেল ফাঁকা হলেই মন ও খারাপ লাগে খুব।

দুজনে মিলে সেই বিশাল হলঘরটাতে গিয়ে বসলাম টিভি খুলে । বিশেষ কিছু হচ্ছিলো না । একটা হিন্দি মুভি খুলে ও বসে পড়লো । আজ আর কেউ এলো না টিভি দেখতে । আমি আর শ্রুতি । ওকে বারবার করে বললাম আমায় একা ফেলে যাস না প্লিজ । আমি যদি ঘুমিয়েও পড়ি তুই উঠিয়ে নিয়ে যাবি । কারণ এই ঘরটার প্রতি সবারই একটা ভয় আছে। ও বললো ঠিক আছে তুই ঘুমো নিশ্চিন্তে ।

আসলে যখন হোস্টেল ভর্তি থাকে তখন এতটা ভয় করে না । গমগম করে ঘরটা । কিন্তু এখন তো ভাঙ্গা হাট । সব ঘরে দু একটা করে মেয়ে কোনটাতে আবার তাও নেই । আর নাচঘর তাই ফাঁকা।আজ কেউ আসেনি।

যাই হোক , নিশ্চিন্তে একটা গল্পের বই নিয়ে পড়ছিলাম ।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই । হঠাৎ একটা প্রচন্ড ঘড়ঘড় আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো ।



মনে হলো যেন আমার চারপাশে কেউ খুব জোরে জোরে নাচতে নাচতে ঘুরে চলেছে । প্রতিটা আয়নায় একটা অদ্ভুত রকমের ঝিলিক উঠছে ।কিন্তু কোন ছবি পড়ছে না । আলোর ঝিলিকটা কিন্তু এক্কেবারেই স্পষ্ট । আমি নিজেকেও কোনো আয়নাতেই আর দেখতে পাচ্ছি না । কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না । আমি কোথায় ? বেঁচে আছি তো ?একটা প্রচন্ড ভয় মনের মধ্যে চেপে বসেছে । ছুটে গেলাম দরজার কাছে । প্রাণপণে টেনে ও দরজাটা খুলতে ব্যর্থ হলাম ।আমি যে ছুটে গেলাম তাতে কিন্তু সেই ঘুঙ্গুরের আওয়াজ মেশা ঘড়ঘড় আওয়াজটা থেমেও গেলো না !

চারদিক তাকিয়ে ও শ্রুতি কে কোথাও দেখতে পেলাম না । ডাকবার চেষ্টা করে ও হাল ছেড়ে দিলাম । সেই ভয়ংকর আওয়াজ ভেদ করে তা কারুর কানেই পৌছানো সম্ভব নয়। হলঘরটা এমন জায়গায় ওখান থেকে কোনো আওয়াজ ই বাইরে পৌঁছানো অসম্ভব ।

ফিরে ওখানেই বসে পড়লাম ।

একটা কেউ আমার সাথে আছে , যার উপস্থিতি আমি পরিষ্কার টের পাচ্ছি । কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না । এমনকি নিজেকেও না । এতবড় ঘর তাই সবসময় প্রায় সাত আটটা টিউব জ্বলে । তার ওপর আয়নাতে রিফ্লেক্ট করে ঘরটা সারাক্ষণই উজ্জ্বল থাকে । আর এখন কেমন একটা ম্যজ্মেজে নীলচে আলো জ্বলছে আর বহুদিনের অব্যবহৃত ঝাড়বাতিটা ও উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেছে । কেউ অসহ্য তীব্রতায় নেচে চলেছে।কেউ নাচছে ঠিকই আর তার সেই নাচের ফলে বাতাসে যে তরঙ্গের ঢেউ উঠছে আমি বিলক্ষণ সেই অনুভূতির মধ্যেই রয়েছি ।বিভিন্ন তালে , বিভিন্ন মুদ্রায় নেচে চলেছে যেন পাগলের মতো ! আমি প্রতি ক্ষণেই ভাবছি আমায় স্পর্শ করছে না কেন ? আমি কি ওই নাচে কোন বাধা নই । নাকি আমি বসে আছি বলে আমায় দেখতে পাচ্ছে না ? তবে আমার ছবি নেই কেন আয়নাতে ? আমি কি তাহলে মৃত ? অসম্ভব একটা ভয় চেপে বসেছে । অথচ যেন চোখটা ও বন্ধ করতে পারছি না । কেউ টেনে রেখেছে চোখের পাতা দুটো ।



কতক্ষণ এভাবে চলেছিলো জানি না ।

কি করবো ? কিভাবে বেরোব কিছুই বুঝতে পারছি না । আর বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে আমি হার্টফেল করবো নিশ্চিত । আশঙ্কা হচ্ছে বেঁচে ফিরবো তো?মনে হচ্ছে ভেঙ্গে পড়বে ঘরটা । আতঙ্কে আর বহু কষ্টে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললাম । মনে হলো অনেক মানুষ আমার চারপাশে অনেক হাততালি । বাহবা ! একটা উগ্র কটু গন্ধে ভরা সারা ঘর । দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার ।

তারপর সব হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে এলো । একটা মৃদু গোঙানীর আওয়াজ । কেউ যেন খুব কষ্টে কেঁদে চলেছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । ভীত মনটা একটা গভীর কষ্টে ভরে গেলো ।

তারপর মনে হলো ক্যাঁচ করে কিছু আওয়াজ হলো ।সব এক ফুঁয়ে কেউ নিভিয়ে দিলো । অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটু বাইরের আলো এসে পড়লো । মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকালাম আমি ! কে এলো আবার রাজপুত্র টা কি ? মেয়েটার সব কষ্ট ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে ? খুব আশা নিয়ে তাকালাম দরজার দিকে ।



দেখলাম অপ্রস্তুত মুখে শ্রুতি দাঁড়িয়ে আছে দরজাটা অর্ধেক ফাঁক করে । ঢুকেই বললো ...সরি রে ...মানসীদি (হোষ্টেল সুপার )ডেকেছিলেন মায়ের ফোন এসেছিলো । তাড়াহুড়োতে তোকে ডেকে যেতে পারি নি রে ! ভাবলাম এখুনি ফিরে আসবো তো?

কি রে তুই এরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন রে ? কি হয়েছে তোর ? এ্যাই ....

মনে ছিলো না আর কিছু ।

পরে শুনি ও আমায় ধরে ধরে নিচে নিয়ে আসে । ওর রুমেই ছিলাম সেদিন । সারারাত ভয়ে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিই দুজনে । একটু সুস্থ হতেই ওকে সবটা বলেছিলাম আমি ।

সব বলে আমি ওকে বললাম হ্যাঁ রে , আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম তখন ? নাকি সত্যি ছিলো রে ?


অতৃপ্তের আনাগোনা , Dissatisfied soul, असंतुष्ट आत्मा, Raja Narendra Lal Khan Womens College, Midnapore, Ghost, ভূত
Raja Narendra Lal Khan Women's College

শ্রুতি বললো ...আমি যখন দরজা খুললাম তখন দেখি কারেন্ট অফ অর্থাৎ লোডশেডিং ছিলো । অন্ধকার ঘরে ও তুই হাঁ করে ঘরের বাম দেওয়ালের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে বসে আছিস ! হতভম্ব , বিহ্বল , ভীত চাউনিতে একটা স্পষ্ট অ্যাবনরম্যালিটি ছিলো তোর । তুই ফেরার রাস্তা টা ও ভুলে গেছিলি । ধরে ধরে রাস্তা চিনিয়ে আনতে হলো ।

আমি কি শুয়ে নাকি বসে ছিলাম ?

নাকি আধশোয়া ছিলাম রে ?

মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই না রে ? আর ওটা স্বপ্নই ছিলো বল ?

তুই গল্পের বইটা বুকে চেপে বিহ্বল দৃষ্টি মেলে আয়নার দিকে তাকিয়ে বসেছিলি আতঙ্কের চোখ মেলে।


উল্লেখযোগ্য যে মেদিনীপুরের সার্বিক উন্নয়নে নাড়াজোল রাজ পরিবারের অবদান অতুলনীয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অবদান সর্বজনবিদিত। এই কলেজটিও তাঁদেরই দানে গড়ে উঠেছে। সেই পরিবারে এই ধরণের ঘটনা স্বপ্নেও কল্পনা করা যেতে পারে না। এটি নিছকই একটি গল্প মাত্র।


midnapore.in

(Published on 10.07.2021)