প্রজ্ঞা পারমিতা।
শিক্ষাব্রতী ও সুচিকিৎসক ডঃ শরৎচন্দ্র মিশ্র ১৮৯৪ সালের ২রা নভেম্বর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় তমলুক মহকুমার কল্যাণচক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র উনপঞ্চাশ বৎসর আয়ুষ্কালের মধ্যে শিক্ষা প্রসার, জাতি গঠন ও গ্রামোন্নয়নের জন্য তাঁর নিরলস কর্মকাণ্ড তাঁকে মেদিনীপুরের মহৎ ভূমিপুত্রের স্বীকৃতি দেয়।
মেধাবী ছাত্র শরৎচন্দ্র স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। ১৯২২ সালে স্বর্ণপদক সহ তৎকালীন এম.বি. ডিগ্রি লাভ করে তিনি কলকাতায় চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গ্রামে জনসেবার উদ্দেশ্যে খেজুরী থানার বিরবন্দ গ্রামে এক দাতব্য চিকিৎসালয়ে চাকরি নেন। ক্রমে তাঁর অসাধারণ চিকিৎসা গুণে তিনি কাঁথি ও তমলুক মহকুমায় ‘সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি’র খ্যাতি অর্জন করেন।
আদর্শবান ও বিদ্যোৎসাহী শরৎচন্দ্রের ছিল গভীর স্বদেশ চেতনা। মননে সদাজাগ্রত ছিল এই বোধ যে শিক্ষাই পরাধীন জাতির উত্থানের প্রধান অস্ত্র। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুগবেড়িয়া পার্ক প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৫ বছর পেরিয়ে গিয়ে আজও তাঁর ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান কল্যাণচক গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যায়তন ‘গৌরমোহন ইন্সটিটিউশন’ তাঁরই প্রবল প্রচেষ্টায় মাইনর থেকে উচ্চস্তরে উন্নীত হয়। সমাজ সেবার উদ্দেশ্যে তাঁর সংগঠিত সংস্থা ‘কল্যাণ সেবাশ্রম সঙ্ঘ’-এর দান করা ভূমির ওপর বর্তমান ‘নন্দকুমার মহা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত।
চরিত্রগত ভাবে তিনি ছিলেন বাংলার রেনেসাঁর সন্তান। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই ব্যতিক্রমী সময়ের সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। ছাত্রাবস্থা থেকেই পরোপকার, স্বার্থত্যাগ ও সাহসিকতার নানা ঘটনা এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের আভাস দিয়েছিল। সেই সব গুণাবলী সুসংহত রূপ পায় যখন মুগবেড়িয়ার ভূস্বামী দানবীর সমাজসেবী রায়সাহেব গঙ্গাধর নন্দের দৌহিত্রী শান্তিময়ী দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। শরৎচন্দ্র গঙ্গাধর নন্দের সমাজ হিতৈষী কর্মযজ্ঞের বিশেষ অনুরাগী হন।
বলা যায় গঙ্গাধর নন্দের মৃত্যুর পর তাঁর হাত থেকে সমাজ সেবার ব্যাটনটি শরৎচন্দ্রই তুলে নিয়েছিলেন। গঙ্গাধর নন্দের বিপুল কীর্তির স্মৃতি রক্ষার্থে শরৎচন্দ্র “মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মেমোরিয়াল সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন” নামে একটি সংস্থা গঠন করেন এবং তার মাধ্যমে বহুমুখী কর্মযজ্ঞ শুরু করেন যা সেই সময়ের নিরিখে বিস্ময়কর ছিল। গ্রামকে স্বনির্ভর করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি তাই পল্লী উন্নয়নমূলক এক বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করে একে একে তা বাস্তবায়িত করেন। সুদৃশ্য উদ্যান সংলগ্ন বালক ও বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেই শিক্ষাকেন্দ্র ঘিরে একটি স্বনির্ভর গ্রামের যা যা প্রয়োজন তেমনই সব ব্যবস্থাপনা করেন তিনি।
ক্রমে সেখানে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, শরীরচর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার থেকে শুরু করে বয়নশিল্প কেন্দ্র, আদর্শ কৃষি কেন্দ্র ইত্যাদির স্থাপনা করেন। সব কটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছিল আধুনিক চিকিৎসালয়টি। সেই হাসপাতালটিতে তিনি শ্বেত পাথরের ঢালু অপারেশন টেবল তৈরি করিয়ে শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সুচিকিৎসক শরৎচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে সেখানে যে চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যেত গ্রামাঞ্চলে আজও অকল্পনীয় তা। বর্তমানের মুগবেড়িয়া গ্রামীণ হাসপাতালটি তাঁর সেই সব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের নীরব সাক্ষী।
শরৎচন্দ্রের সর্বোত্তম কাজ জনচেতনা প্রসারের লক্ষ্যে মুগবেড়িয়া গ্রামে স্বদেশী মেলার ধাঁচে একটি বৃহৎ বাৎসরিক প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করা। সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, উন্নত কৃষি বিষয়ক নানা প্রদর্শনীর সঙ্গে বিনোদনের বিপুল ব্যবস্থাও থাকত। সে যুগে গ্রাম বাংলায় রোগজারি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা তো ছিলই না উলটে কুসংস্কারের শিকড় ছিল গভীরে। তিনি তাই মৃৎশিল্পীকে দিয়ে মডেল তৈরি করিয়ে নানা রোগ সম্পর্কে জনসাধারণকে সজাগ করতেন। ‘গঙ্গাধর মেলা’ নামে পক্ষকাল ব্যাপী এই বিশাল মেলাটি দীর্ঘ এগারো বছর আয়োজিত হয়েছিল।
শরৎচন্দ্রের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল তাঁর জন্মভূমি কল্যাণচক গ্রামেও। তিনি সেই গ্রামটিকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষাব্রতী ও দেশপ্রেমিক বিশিষ্ট জনকে সঙ্গে নিয়ে ‘কল্যাণ সেবাশ্রম সংঘ’ নামে একটি সংস্থা গড়েন। তারপর প্রথমেই গৌরমোহন ইন্সটিটিউশন নামে কল্যাণচকের মাইনর স্কুলটিকে হায়ার ইংলিশ স্কুলে পরিবর্তিত করতে ইংরেজ সরকারের কাছে জোরালো দাবি তোলেন। কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করলে সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির পঠনপাঠন তিনি কল্যাণ সেবাশ্রম সংঘে শুরু করে দেন। সেই পাঠক্রম ওখানে দু বছর চলে এবং পরে সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত হাইস্কুলে উঠে আসে। আমৃত্যু তিনি এই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গৌরমোহন ইনস্টিটিউশনের তিন ছাত্র যখন মাতঙ্গিনী হাজরার সঙ্গে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর শহিদ হন তখন শরৎচন্দ্রই বিদ্যালয় পরিচালক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। গৌরমোহন ইনস্টিটিউশন আজ স্বাধীনতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ঐতিহ্য স্মারকের অভিধা প্রাপ্ত দেশের একমাত্র বিদ্যায়তন। এর ইতিহাস ঘাঁটলেই উঠে আসবে শরৎচন্দ্র মিশ্রের নাম। কল্যাণ সেবাশ্রম সংঘের ন বিঘা জমির উপরেই পরবর্তীকালে নন্দকুমার মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় কল্যাণচকের সামগ্রিক সমৃদ্ধির জন্য অন্যান্য গঠনমূলক প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগেই এই অক্লান্ত কর্মযোগী মানুষটি ১৯৪৩ সালের ২৫শে মার্চ মাত্র ৪৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
পূর্ব মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়া ও কল্যাণচক এই দুটি গ্রাম আজও তাঁর অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
midnapore.in