ডুলুং চলে ডুলুং বলে
Dulung River, Jhargram
সুশীলকুমার বর্মন।
Home » Medinikatha Journal » Susil Kumar Barman » Dulung River
নদী বয়ে যায়। দিনের পর দিন বছরের পর বছর যুগের পর যুগ সে বয়ে যায়। বয়ে যায় আপন ছন্দে আপন খেয়ালে। যেতে যেতে সে কথা বলে। কথা বলে মাটি-পাথরের সঙ্গে, কথা বলে পাড়ের গাছপালার সঙ্গে, পশুপাখিআর কূলবাসী মানুষের সঙ্গে। সে কতোও কথা কতোও গল্প কতোও কাহিনী। তার চলার শেষ নেই বলারও শেষ নেই। আজ শুনব সে রকমই এক নদী ডুলুং-এর কথা।
শান্ত ডুলুং (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)
আমি ডুলুং। কেউ কেউ বলে ডোলং। ঝাড়গ্রামেই আমার চলার শুরু ঝাড়গ্রামেই চলার শেষ। ঐ যে তোমরা ঢাঙ্গিকুসুম কাঁকড়াঝোর বেড়াতে যাও, যাওয়ার পথে ওদোলচুয়া, বালিচুয়া, নটাচুয়া, কটুচুয়া, ডুলুংডিহা পার হও, ওই জায়গা থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। ডাইনে বাঁয়ে যে লখাইসিনি, চেরাং, ধ-ডাঙর, ভোরা পাহাড় দেখতে পাও সে সব পাহাড়ের জল চুইয়ে চুইয়ে আমার জন্ম। চলা শুরু করে কয়েক পা এগিয়েই পেয়ে গেলাম এক বোন বারেদহ ঝোরাকে। আরও এগিয়ে ধড়সায় ডানদিক থেকে এসে আমার সাথে পা মিলিয়েছে কুপননদ। শাল-মহুয়া-কেঁদ-ধ-ভেলা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মাকড়া পাথরের চাটানের ওপর নাচতে নাচতে আমি পৌঁছে গেছি এক রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যের সীমানায়। শেষে রোহিণীর কাছে ঝাঁপিয়ে পড়েছি বড়দি সুবর্ণরেখার বুকে।
আমার দু’কূলে কত রাজা-জমিদারদের প্রাসাদ। কত রাজপুত্র-রাজকন্যে আমার খেলার সঙ্গী হয়েছে ! রোহিণীর জমিদার ভ্রমরগড়ের রাজপুত্রের অমর প্রেমের কাহিনী তো তোমরা জানো। রোহিণীর সন্তান রসিক মুরারি কত সাঁতার কেটেছে আমার জলে! পরে তিনিই তো হলেন পরম বৈষ্ণব স্বামী রসিকানন্দ। আর একটা কথা চুপিচুপি বলি শোন। আমার পাড়ে যে কনকদুর্গা মন্দির সেই মন্দিরের ঘাটেএক রাজাকে পাথর চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। সে রাজার রানি আর্তনাদ করতে করতে স্বামীর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। প্রতি অমাবস্যায় রানিএসে ঐ পাথরে মাথা ঠুকে কাঁদেন। রানির সে বুকফাটা কান্না আমিই শুধু শুনতে পাই। সে সব গল্পই আজ শোনাব।
বিকেলের সোনালী ডুলুং (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)
আমি তোলপাড় হই শতশত মানুষের ঝাঁপাঝাঁপি-লাফালাফিতে। সাঁওতাল, শবর, মুণ্ডা, মাহালি ভূমিজ কতো আদিবাসী; বাগদি, দণ্ডছত্র, জালিয়া-কৈবর্ত, ডোম, হাড়িকত জনজাতি আমার পাড় আলো করে রয়েছে। রয়েছে কুড়মি, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈদ্য, মাহিষ্য। সবাই আমার সন্তান। আমার জল তাঁদের কাছে গঙ্গাজলের মতো পবিত্র। এই জলেই তাঁদের যত আচার-অনুষ্ঠান, আমার পাড়ে গাছতলায় তাঁদের যত গরাম থান।
বেশ চলছিল। কোথা থেকে একদিন এসে হাজির হলেন দীর্ঘদেহী এক সুঠাম-সুদর্শন সর্বত্যাগী পুরুষ। পরণের বসনটিও তিনি ত্যাগ করেছেন। তাঁর কিছু চাওয়ার নেই। কিছু পাওয়ার নেই। বনের ফলমূল তাঁর খাদ্য, নদীর জল তাঁর পানীয়। তিনি কাউকে আঘাত করেন না। মশামাছি, পোকামাকড়ের কামড়ে তিনি অবিচল। মানুষ না বুঝে তাঁকে উত্যক্ত করে, তাঁর দিকে পাথর ছুড়ে মারে, তার পেছনে কুকুর লেলিয়ে দেয়। পাথরের আঘাতে, কুকুরের দংশনে তাঁর গায়ে রক্ত ঝরে। তিনি হাসি মুখে সব সহ্য করেন। মানুষ অবাক হয়। তাদের চেতনা জাগ্রত হয়। এ নিশ্চয় কোন মহাপুরুষ। সেই মহাপুরুষ বেভাষায় কী বলতে চান, কী বোঝাতে চান, কারো বোধগম্য হয় না। আভাষে-ইঙ্গিতে তিনি বলতে চান পশুপাখি গাছপালা কাউকে হিংসা করো না, কাউকে আঘাত করোনা, কাউকে বধ করো না। সবাইকে ভালোবাস। তবেই ভালো থাকবে।
সেই অনন্ত ধৈর্য্যশীল দিগম্বর সন্ন্যাসী একদিন চলে গেলেন। তাঁর যাওয়ার কিছু কাল পরে এলেন তাঁর ভক্তের দল। শিক্ষাদীক্ষা বিদ্যাবুদ্ধিতে তাঁরা অনেক এগিয়ে। বাণিজ্য তাঁদের রক্তে। আমার দুপাড়ের ঘন জঙ্গলের বনজ সম্পদ নিয়ে তাঁরা শুরু করলেন ব্যবসাবাণিজ্য। ইতিপূর্বে আমার কূলবাসীরা খুঁজে পেয়েছিল তামাপাথর। কাঠের আগুনে দেশীয় চুল্লিতে তামা পাথর গলিয়ে তারা তৈরি করতে শিখেছিল বিশুদ্ধ তামা। পরে তারা লোহাপাথর থেকে লোহা তৈরিও শিখেছিল। বনজ সম্পদের সঙ্গে বহিরাগত বণিকগণ হাতে পেয়ে গেলেন তামা ও লোহার মতো উৎকৃষ্ট পণ্য। তামা ও লৌহ উৎপাদনে উৎসাহ জুগিয়ে সেই বণিকগণ ধাতু উৎপাদন বহু গুণে বাড়িয়ে ফেললেন এবং শুরু করলেন ধাতুর বাণিজ্য। নদীপথে চলত সে বাণিজ্য। আমার বুকে বড় নৌকা চলতে পারত না। ছোট ছোট নৌকায় পণ্য নিয়ে আমার স্রোত বেয়ে তাঁরা পড়ত সুবর্ণরেখায়। সেখানে নোঙর করা বড় নৌকায় তাঁরা পণ্য বোঝাই করত। তারপর সুবর্ণরেখা-বঙ্গোপসাগরের পথ বেয়ে সে পণ্য পৌঁছে যেত দেশবিদেশের বন্দরে-নগরে।
এই বণিকরা ছিলেন অহিংস জৈনধর্মের মানুষ। যে দিগম্বর দীর্ঘাঙ্গী মহাপুরুষের কথা বলেছিলাম তিনি জৈনধর্মের চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে শেষতম তীর্থঙ্কর ভগবান মহাবীর। তিনি জৈনধর্মের প্রধান প্রচারক। ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে মহাবীরের অনুগামী জৈনরা পরম নিষ্ঠায় নিজেদের জৈনধর্ম অনুশীলন করতেন। ধর্মচর্চার জন্য তাঁরা আমার কূলে গড়ে তুলেছিলেন বেশ কয়েকটি দেউল। আমার অববাহিকায় মাকড়াপাথর সহজলভ্য। তাই দেউলগুলি ছিল মাকড়াপাথরের তৈরি। দেউল মধ্যে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের আরাধ্য তীর্থঙ্করমূর্তি। দেউলের কুলুঙ্গিতে স্থাপন করেছিলেন তীর্থঙ্করদের পার্শ্বদেবতা যক্ষ-যক্ষিণীর মূর্তি।
ডুলুং নদী (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)
আজ থেকে প্রায় দেড়-দু হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত জৈনদের সেই দেউল এবং মূর্তির অবশেষ এখনও রয়েছে আমার পাড়ে। রাজপাড়া, পড়িহাটি, নুনিয়া বা রোহিণীতে গেলে সে সব দেখতে পাবে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সারা রাঢ়বাঙলার নদী কূলে টিকে ছিল জৈনধর্ম। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে রাঢ় অঞ্চলের রাজাদের পৃষ্টপোষকতার অভাবে এবং ব্যবসাবাণিজ্যের পরিবেশের অবনতি ঘটায় জৈন বণিকগণ এই এলাকা ছেড়ে চলে যান। স্থান ত্যাগ করার সময় তাঁরা নিজেদের ইষ্টদেবতার মূর্তি নদী বা আশপাশের জলাশয়ে বিসর্জন দিয়ে যান। জৈনদের স্থানত্যাগের বহু বছর পর নতুন নতুন বাসিন্দারা এসে আমার কূলে বসবাস শুরু করে। তারাই আমার জল থেকে বা অন্য জলাশয় থেকে কিছু মূর্তি খুঁজে পায় এবং জৈনমূর্তি সম্বন্ধে ধারণা না থাকায় তাঁরা তীর্থঙ্কর ও অন্যান্য জৈন দেবদেবীর মূর্তিকে নিজেদের দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে শুরু করে।
রাজপাড়া খাদিবোর্ড মাঠে পড়ে রয়েছে কালো গ্রানাইট পাথরে খোদিত একটি পার্শ্বনাথ মূর্তি। মূর্তির এদিক ওদিকে মাকড়াপাথরের বেশ কিছু ফলক পড়ে রয়েছে। আর রয়েছে পঁচিশ-ছাব্বিশটি দেউলাকৃতি স্তম্ভ। মূর্তিটিকে গ্রামবাসীরা বিষ্ণুঠাকুর রূপে পুজো করেন। পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন গ্রামের লোধা-শবর সম্প্রদায়ের মানুষ সুবল শবর। যে পাথরের ফলকগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলি আসলে জৈন দেউলের অবশেষ। ছোট দেউলাকৃতি যে স্তম্ভগুলি মাঠে পোঁতা রয়েছে সেগুলি হল নিবেদন দেউল। জৈনরা তাঁদের দেবতার উদ্দেশ্যে এই নিবেদন দেউল প্রদান করত। মৃতদেহ দাহ শেষে নিকটাত্মীয়ের দেহাবশেষ নতুন কলসে রেখে সরা চাপা দিয়ে কলসটি তিন-চার হাত মাটির নিচে পুঁতে দিয়ে তার ওপর একটি করে দেউলাকৃতি নকশা করা নিবেদন দেউল তাঁরা বসিয়ে দিত।
আমার এক ছোট উপনদী বাঁশির খাল রাজপাড়া ঘেঁসে প্রবাহিত হয়েছে। সেই খাল দিয়ে জৈন ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহন করত। মালপত্র বলদের পিঠে ছালায় ভরে ঘাটে নিয়ে আসা হত। রাজপাড়াতে ছিল তাদের বাণিজ্যঘাঁটি। এখানে তারা পার্শ্বনাথের দেউল গড়ে তুলেছিল। এখন তো আমি শুকনোপারা। সে সময় ছিল আমার ভরা যৌবন। কত জল বয়ে যেত আমার বুক দিয়ে ! বর্ষায় টইটুম্বুর হয়ে ফুলেফেঁপে থাকতাম। কতো বড় বড় নৌকা ভিড়ত আমার ঘাটে। সে সব মনে পড়লে এখন কান্না পায়।
আমার পাড়ে পড়িহাটিতে ছিল আর এক জৈন দেউল ছিল। ঋষভনাথের। সেটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। গ্রামের সাতশকড়া পুকুড়ের পাড়েছিল সেই দেউল। সেখানে এখনও দেউলেরকিছু ফলক পড়ে রয়েছে। ঋষভনাথের ভগ্ন মূর্তি উদ্ধার করে গ্রামের ভেতর রঙ্কিণী মন্দিরের সামনে রাখা হয়েছে। প্রায় তিন ফুট উচ্চতার ভগ্ন মূর্তির পাদবেদিতে খোদিত প্রষ্ফুটিত পদ্ম, তার নিচে বৃষ এবং বৃষের উভয় পার্শ্বে সিংহ। পায়ের দুধারে চামরহাতে দণ্ডায়মান সেবাদাস। মন্দিরে যে রঙ্কিণী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত সেটিও বিরল। ভীষণদর্শনা অষ্টভুজা মূর্তির ওপরের দুটি হাত দিয়ে মাথার ওপর একটি হাতি তুলে ধরে রেখেছেন। এই রঙ্কিণী সম্ভবত ছিলেন এক জৈন যক্ষিণী। হয়তো ঋষভনাথের দেউলের কোন অংশে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল।
সবুজে ঘেরা ডুলুং নদী (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)
আমার ডান পাড়ে নুনিয়াতেও ছিল এক জৈন দেউল। সেখানেও রয়েছে মাকড়াপাথরের নিবেদন শিলা, বরাহ ও হস্তীর মূর্তি। প্রাচীন জৈন দেউল ভেঙে সেই মন্দিরের পাথরের চাঁই ব্যবহার করে তারই ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বর্তমানের জগন্নাথ মন্দির। যে ভগ্ন দিগম্বরমূর্তি দেউলের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গিয়েছিল সেটি কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে রাখা আছে। নুনিয়া-পড়িহাটি অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় এক-দেড় হাজার বছর পূর্বে রাজত্ব করতেন ডোম সম্প্রদায়ের সেন পদবিধারী রাজারা। তাঁদের ইতিহাস বলার মতো আজ আর কাউকে পাওয়া যাবেনা। তাঁদের কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। কেবল পড়িহাটিতে কালু বীরের থানটিই কালু সেন রাজার অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে এসেছেন পণ্ডা জমিদার। শেষে পানীরা জমিদারি পান। নুনিয়ার জমিদার নুনের ব্যবসা করতেন। তার থেকে গ্রামের নাম হয়েছে নুনিয়া।
স্রোত ধরে এগিয়ে চলা যাক। পৌঁছনো যাবে চিল্কিগড়ের রাজপ্রাসাদে। ডানপাড়ে ধবলদেব রাজাদের প্রাসাদ। ধবলদেবরা আদতে ধলভূমগড়ের রাজা। মাতুলবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে চিল্কিগড়েও তাঁরা রাজত্ব কায়েম করেছেন। বামপাড়ে যেখানে এখন কনকদুর্গা মন্দির সেখানে গড়ে উঠেছিল ত্রিপাঠি রাজার গড়। পুরীর রাজা প্রতাপ রুদ্রদেবের কাছ থেকে বলভদ্র ত্রিপাঠী এই রাজত্ব লাভ করেছিলেন। তাঁরা পাথরের ভিতের ওপর ইটের তৈরি জগন্নাথ মন্দির গড়েছিলেন। তার ধ্বংসাবশেষ এখনও রয়েছে কনকদুর্গা মন্দিরের ডানদিকে। ত্রিপাঠিবংশের তৃতীয় রাজা বিশ্বরূপ ত্রিপাঠিকে তাঁর সেনাপতি বিরাম সিংহমত্তগজ ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেন। স্নান করার আগে ঘাটে যে পাথরে বসে রাজা প্রতিদিন তৈল মর্দন করতেন সেই পাথর চাপা দিয়ে রাজাকে খুন করেছিলেন সেনাপতি। আর সেই পাথরে মাথা ঠুকে রাজার সঙ্গে সহমরণে গিয়েছিলেন রানি মহামায়া। ঘাটে সে পাথর এখনও রয়েছে। সেটিকে বলা হয় পঁড়াপাথর। ধূপধুনো দিয়ে আজও সে পাথরের পুজো হয়। কনকদুর্গা মন্দিরে এলে দেখে যেও সেই অভিশপ্ত পঁড়া পাথর। চিল্কিগড় ছাড়িয়ে আর একটু এগোলে পাবে সতীঘাটা। এখানেই সতীদাহ হয়েছিল। রানি মহামায়া সতী হয়েছিলেন না জোর করে তাঁকে স্বামীর চিতায় তুলে জীবন্ত দগ্ধকরা হয়েছিল সে শুধু আমিই জানি।
সতীঘাটা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে পেয়েছি মিষ্টি মেয়ে পলপলাকে। ডানদিক থেকে এসে ও আমার সঙ্গে মিশেছে। আর বামদিক থেকে এসে মিশেছে কুৎরঙ্গ। চলার পথে বামদিকে চন্দ্রী গ্রামে রয়েছেন চন্দ্রশেখর শিবঠাকুর। চৈত্র গাজনে নীলের পূর্ব রাত্রে পেতলের কলসিতে আমার জল ভরে ভারে ভারে নিয়ে গিয়ে সূর্যোদয়ের ঠিক আগে বাবা চন্দ্রশেখরকে পুণ্যস্নান করানো হয়। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় গরিয়া ভার। ঢাকঢোল কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে ঘটা করে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। লালপাড় সাদাশাড়ি পরে গ্রামের মেয়েরা আমার পাড়ে জড়ো হয়। কী ভালো যে লাগে! আজ থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে এই চন্দ্রী গ্রামে দিলীপ দাসের উঠোনের পুরনো তেঁতুলগাছের গোড়া থেকে পাওয়া গিয়েছিল এক ঘড়া তামার মুদ্রা। মুদ্রা বিশেষজ্ঞরা বলেন এগুলো কণিষ্কের আমলের। হবেও বা। কত বছরের কথা ! আমার স্রোত ধরে হাজার হাজার বছর ধরে কত বিদেশীর আনাগোনা। কত আর মনে রাখা যায়! চন্দ্রীর পরের গ্রাম যুগীডিহা। ঐ গ্রামে আমার ডান পাড়ে অনেক যুগ আগে একটা মন্দির ছিল। কয়েক টুকরো পাথর ছাড়া সে মন্দিরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তবে ওখানে অশ্বত্থ তলায় অব্রাহ্মণ বা দেহরি পূজিত যুগিয়া বুড়ির থানে যে প্রস্তরমূর্তির ভগ্ন অবশেষ রয়েছে সেই সূত্র ধরে ঐ মন্দিরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
বেশ চলছিলাম জঙ্গল ফুঁড়ে শাল জঙ্গলের ছায়ায় ছায়ায়। ফেকোঘাটের কাছে আমার ওপর একদিন তৈরি হল পাকা সেতু। দিন নেই রাত নেই গোঁ গোঁ শব্দ তুলে দৌড়চ্ছে হাজার হাজার গাড়ি। ওটা যে মুম্বাই রোড। ফেকো ঘাটে আমার বালি তুলে বিক্রি করে কত মানুষ লাল হয়ে গেল। কলকাতা পর্যন্ত আমার বালির কদর। লোকে আদর করে বলে ফেকোর বালি।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ডুলুং নদী (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)
পেরিয়ে গেলাম বেলিয়াবেড়া প্রহরাজ জমিদারদের প্রাসাদ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ ছিলেন পণ্ডিত মানুষ গুণী মানুষ। আরও এগিয়ে বেষ্টন করেছি বাঘেশ্বর শিবের পদযুগল। বাবার পদধৌত করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছি। বামদিকে আবার এক বিস্মৃত রাজার গড়। গড়ের ধ্বংসস্তূপ এখন মাটির নিচে। পঞ্চদশ শতকে পুরীর রাজা কপিলেন্দ্র দেবের বিতাড়িত পুত্র বলীবন্ত ভাগ্যান্বষণে বেরিয়ে আমার পাড়ে এখানেই তাঁর রাজ্য গড়ে তোলেন। পরে তিনিই ঝাড়গ্রামের তৎকালীন জঙ্গলসর্দারকে পরাজিত করে ঝাড়গ্রাম দখল করেন এবং ঝাড়গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সর্বেশ্বর সিংহ। গড়বালিপালে রাজা বলীবন্তের ইষ্টদেবী কেঁদুয়া মাতা আজও সাড়ম্বরে পূজিত হন। অনাবৃষ্টি দেখা দিলে গ্রামের মানুষেরা আমার জল ভারে ভারে নিয়ে গিয়ে মা কেঁদুয়ার কুণ্ড পুর্ণ করেন। তারপর আসে ঝেপে বৃষ্টি।
বামপাড়ে বনপুরা গ্রামে রয়েছে সাতভউনী থান। রাজা রণজিৎ কিশোরের সাত পত্নী ছিলেন সাত বোনের মতো। একদিন কালাপাহাড়ের আক্রমণে রাজা প্রাণ হারালেন। শত্রুর হাত থেকে মান বাঁচাতে সাত রানি ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন আমার জলে। সেই আত্মবিসর্জনকারী সাত রানিই একত্রে প্রস্তর মূর্তি ধারণ করে বিশালাকার চন্দ্রাবতী লতার বিটপি তলে পুজো পাচ্ছেন সাতভউনী থানে।
এরপর জমজমাট রোহিণী গঞ্জ। রোহিণী প্রবেশের মুখে বামপাড়ে রয়েছে ভ্রমরগড়। সে এক ব্যর্থ প্রেমের করুণ কাহিনী। বরোজীয়া কন্যা দীর্ঘকেশী রূপবতী ভ্রমর চুল আঁচড়ে চুলের গোলা শালপাতায় জড়িয়ে আমার জলে ছুড়ে দিত। আমি সে চুল ভাসিয়ে নিয়ে যেতাম সুবর্ণরেখার দিকে। একদিন প্রকৃতিপ্রেমী রাজপুত্রের হাতে পড়ল শালপাতায় মোড়া সে দীর্ঘকেশের গোলা। রাজপুত্র ভাবেন, যাঁর চুল এত দীর্ঘ তিনি দেখতে কত না সুন্দরী। সুন্দরীর খোঁজে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন রাজপুত্র। শ্যামলবরণ ভ্রমর তখন বরোজঢিবিতে পান বরোজে কলসি করে জল দিচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে প্রেমে পড়ে গেলেন রাজপুত্র। রানি করবেন তাঁকে। কিন্তু ভ্রমরের বাবার না পসন্দ ভিনজাতির বরকে। হোক না সে রাজপুত্র। রাজপুত্রের রোখ। সে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ভ্রমরকে। লড়াই লেগে গেল। ভ্রমর বাবার সম্মান রক্ষায় আমার জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। বুক ভরা ব্যথা নিয়ে রাজপুত্র ফিরে গেলেন। প্রিয়া ভ্রমরের স্মৃতিতে তিনি বানিয়ে ফেললেন ঝকঝকে নতুন প্রাসাদ ভ্রমরগড়।
ডুলুং নদীর তীরে কনকদুর্গা মন্দির (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)
এই রোহিণীতে জমিদার অচ্যুত পট্টনায়কদের সন্তান হিসেবে জন্মেছিলেন ‘রসিকমঙ্গল’-এর নায়ক বৈষ্ণব চূড়ামণি রসিকানন্দ মহাপ্রভু। বালক রসিকমুরারী অন্য বালকের সঙ্গে আমার পাড়েই খেলা করত। তাঁর জন্মস্থানে বর্তমানে গড়ে উঠেছে কৃষ্ণমন্দির। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার নাম প্রথম লিখিত রূপে প্রকাশ করেছিলেন রসিকানন্দের প্রিয় পার্ষদ গোপীজনবল্লভ দাস। রসিকানন্দের জীবনাশ্রিত গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীরসিকমঙ্গল’-এ তিনি লিখেছিলেন-
ডোলঙ্গ বলিয়া নদী গ্রামের সমীপে।
গঙ্গোদক হেন জল অতি রসকূপে।।
সুবর্ণরেখা দিদির কোলে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগে রোহিণী গ্রামে আমার বাম পাড়ে ছিল এক জৈন দেউল। হাজার-দেড় হাজার বছর আগে পরিত্যক্ত সে দেউলের ধ্বংসস্তূপের ঢিবির মাথায় বট-কুচলার জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট দুটি মূর্তিকে ভৈরব হিসেবে পুজো করা হয়। যেগুলি এক সময় ছিল জৈন দেবতার মূর্তি।
এই রে গল্প বলতে বলতে টুসু-ঝুমুরের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। টুসু-ঝুমুরই তো আমার প্রাণের গান। মকরের দিন আমার ঘাটে ঘাটে হলুদ লাল শাড়ি পরে মেয়েরা তাদের আদরের টুসুমণিকে ভাসান দেয়। গানে গানে মুখর হয় আমার চরাচর। আমি কান পেতে শুনি তাদের সরল জীবনের সরলগান। আমিও তখন আমার প্রিয় কবিপুত্রের সুরে সুর মিলিয়ে বলি-
টুসুমণিআল্লাদিনী দেশের দুখে মন কাঁদে
আউল্যা চ্যুল তার বিনাঞ দেগো
ম্যায়সর মাঁসের আবাদে। (টুসুগীত- ভবতোষ শতপথী)
ঝুমুর গানের তো জবাব নেই। কত কবি যে কত ঝুমুরগান বেঁধেছে কত শিল্পী যে সে সব গান তাঁদের মরমী কণ্ঠে গেয়েছে তার কোন লেখাযোখা নেই ! আমাকে নিয়ে কী আবেগভরা গান বেঁধেছেন আমার আর এক গীতিকার পুত্র। এসোসে গানের দু-এক কলি তোমাদের শোনাই-
ডুলুং বাঁচায় হামাদেরই পরান
ডুলুং হামদের মায়েরই সমান।
গিধনী চিলকি জামবনী
তারই জলে সোনার খনি।
ঝাড়গাঁয়ে ফলায় সোনার ধান
ডুলুং হামদের মায়েরই সমান। (ঝুমুরগীতি -ললিতমোহন মাহাত)
এবার আমি সুবর্ণরেখায় মিলিয়ে যাব। মিলিয়ে যাব কিন্তু হারিয়ে যাব না। ইতিহাসের গন্ধ নিয়ে টুসু-ঝুমুরের ছন্দনিয়ে ধামসা মাদলের বোলে মাতোয়ারা হয়ে থাকব। আরচলতে চলতেতোমাদের গল্প শুনিয়ে যাব।
Medinikatha Journal
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 10.07.2023)