Fa-Hien visits Tamralipta | Fa Xian | 法顯 | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | ফা হিয়েন | फा हिएन

নন্দিত পদধ্বনি

Fa-Hien | 法顯 | ফা হিয়েন | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | फा हिएन

শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।


প্রাক সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি শুনে আসন ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়লেন পর্যটক শ্রেষ্ঠ । দিনের আলো কমে আসছে । এত বড় গ্রন্থাগারের অনেক অমূল্য গ্রন্থরাজি এখনও অপঠিত থেকে গেলো । সুবৃহৎ ' রত্নোদধি ' গ্রন্থাগারটি স্বল্পকালেই তাঁর অনেক জ্ঞানতৃষ্ণাকে পরিতৃপ্ত করেছে । নালন্দা বাসের এক তৃষ্য পর্ব আজ রাত্রেই সমাপ্ত হবে । মহাবিহারের সর্বাধ্যক্ষ পূর্বেই খবর পাঠিয়েছেন যাত্রার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ । এমনকি বিদ্যোৎসাহী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জন্য কিছু পাথেয়ও পাঠিয়ে দিয়েছেন । অপ্রত্যাশিত এ সংবাদে তিনি মনে মনে লোকপ্রিয় রাজাকে ধন্যবাদ জানালেন ।


Fa-Hien visits Tamralipta | Fa Xian | 法顯 | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | ফা হিয়েন | फा हिएन
Faxian at the ruins of Ashoka's palace ( Pataliputra). Photo Courtesy: Hutchinson's story of the nations.

সান্ধ্য উপাসনা শেষে তাঁর কাছে এলেন কয়েকজন শ্রমণ - শিক্ষার্থী , পণ্ডিত ও শ্রুতকীর্তি অধ্যাপক আর্যদেব ও বসুবন্ধু । তাঁদের কাছেই জানা গেল - তাম্রলিপ্তি বেশ কয়েকদিনের পথ । স্থলপথ বিপদসংকুল ও কষ্টসাধ্য , কিন্তু নদীপথ নিরাপদ ও দ্রুতগামী । তাছাড়া রাজমহল পাহাড়ের নিকট দস্যুদলের উৎপাত সত্বেও নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা কুমারগুপ্ত করেছেন শুনে সকলেই সন্তোষ প্রকাশ করলেন । আরও কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে আলোচনার পরে ভগবান তথাগতের চরণ বন্দনা করে একে একে বিদায় নিলেন অভ্যাগতেরা । সামান্য নৈশাহার শেষে পাথরের বেদিতে শুয়ে নানা চিন্তায় তাঁর রাত কেটে গেল দ্রুত ।



পরদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে সর্বাধ্যক্ষ নাগার্জুনের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করে বঙ্গদেশ অভিমুখে যাত্রা করলেন ফা হিয়েন । সঙ্গী সংঘ দর্শন অভিলাষী কিছু তরুণ শ্রমণ । পাটলিপুত্র থেকে বিস্তৃত পথ অতিক্রম করে তাঁদের বজরা এসে থামলো তাম্রলিপ্তি বন্দরের ঘাটে ।


Fa-Hien visits Tamralipta | Fa Xian | 法顯 | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | ফা হিয়েন | फा हिएन
Fa Hien. Photo Courtesy: Amar Chitra Katha by Shubha Khandekar.

সুবৃহৎ এই বন্দর নগরী । সরস্বতী নদীর তীরে সমুদ্রমুখে অবস্থিত এই প্রধান বন্দরে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরণের মানুষের চলাফেরায় স্থানটি সমস্ত সময়েই মুখর । সঙ্গী শ্রমণেরা অবাক চোখে দেখতে থাকেন সেই বিচিত্র বেশবাস চলন বলনের মানুষদের । পূর্ব ব্যবস্থা মতো বরাহ বিহারে তাঁদের দীর্ঘ পথযাত্রার সমাপ্তি ঘটে ।



বিরাট এই বিহারে কিছুকাল বিশ্রামে ও আশ্রমবাসী সকলের সঙ্গে পিণ্ড গ্রহণ করে কাটলো । একদিন সংঘের নবীন শ্রমণদের ' চীবর প্রদান ' অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে হোলো তাঁকে । চৈনিক পরিব্রাজক লক্ষ্য করলেন সংঘের ছোট বড় সকলেই সমস্ত কাজ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সম্পাদন করছেন । কারোর মধ্যেই কর্ম সম্পর্কে লেশমাত্র শৈথিল্য বা ঔদাসীন্য নেই ।


Fa-Hien visits Tamralipta | Fa Xian | 法顯 | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | ফা হিয়েন | फा हिएन
Fa Hien studying Sanskrit at Tamralipta. Photo Courtesy: Amar Chitra Katha.

এক সকালে যখন ভিক্ষুগণ ' পরিষ্কার ' , ' ঠবিকা' , দণ্ডকাষ্ঠ ও জপমালা নিয়ে ভিক্ষা সংগ্রহে বেরোচ্ছেন , তখন তিনিও সংঘাধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে পা রাখলেন জনপদের মধ্যে । দেখলেন - নাগরিকদের প্রায় সকলেই বিত্তবান , উন্নত চেহারার অধিকারী ও যথেষ্ট সাহসী । যদিও অনেকের ব্যবহার খানিকটা রূঢ় , তবুও ভিক্ষুদের প্রতি তাদের অসীম শ্রদ্ধা । সমাজের সর্বস্তরের মানুষ , যথা - ক্ষেত্রধর , তক্ষণ , সূত্রধার , চিত্রকার , তৈলকার , কর্মকার , শাঙ্খিক , সুবর্ণবণিক , ধীবরজালিক ....যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের সাধ্যমত ভিক্ষা দিতে লাগলেন । তাঁর তীক্ষ্ণ চোখে ধরা পড়লো এখানকার ভূমি অত্যন্ত সমতল , বায়ু বেশ উষ্ণ । চারিদিকে প্রচুর ফল ফুল ও শষ্যের সমারোহ । নগরপ্রান্তে দিগন্তপ্রসারী শালিধান্যের ক্ষেত , কোথাও বা ইক্ষুক্ষেত , পানের বরজ , আম্র বন ; এসব দেখতে দেখতে তাঁরা এসে পৌঁছলেন গঙ্গাবন্দরে । কৌতূহলী হয়ে দেখলেন , এখানে নৌযান গুলিতে প্রচুর পরিমাণে তেজপাতা , পান , গুবাক , কাজুবাদাম এমনকি চন্দনকাষ্ঠও জমা করা হচ্ছে । এখানকার বিষয়পতি , জ্যেষ্ঠ কায়স্থ , প্রথম সার্থবাহ এবং প্রথম কুলিক - প্রায় প্রত্যেকেই অমিত স্বর্ণমুদ্রা এমনকি রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে তাঁদের সানন্দে আপ্যায়িত করলেন । আনন্দিত ফা হিয়েন ও সঙ্গীরা তাঁদের আশীর্বাদ জানাতে লাগলেন ।



দ্বিপ্রহরে অত্যন্ত শ্রান্ত অবস্থায় তাঁরা বিহারে ফিরে এলেন ।

চিত্র বিদ্যার অনুশীলনে , সংস্কৃত শিক্ষায় এবং পাঠ অধ্যয়নে আরও কিছুকাল অতিবাহিত হোলো । জ্ঞানসাগর রাহুল মিত্র তাঁকে যথাসাধ্য সহায়তা করতে লাগলেন । এরই মধ্যে একদিন দূতমুখে জানতে পারলেন সামন্ত মহারাজ চিরাত দত্ত ও মহাপ্রতিহার দিবাকর নন্দী তাঁদের দণ্ডভূক্তি প্রদেশে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন । ফা হিয়েন স্থির করলেন এই আমন্ত্রণ তিনি রক্ষা করবেন । এক উজ্জ্বল দিনে দ্রুতগামী অশ্বে তিনি পথপ্রদর্শকের সঙ্গে যাত্রা করলেন ।


Fa-Hien visits Tamralipta | Fa Xian | 法顯 | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | ফা হিয়েন | फा हिएन
Faxian aka Fa-Hien and Fa-hsien, 337 – c. 422. Chinese Buddhist monk who travelled by foot from China to India, depicted here on his return to China after fifteen years. Photo Courtesy: Hutchinson's story of the nations.

অসংখ্য বাস্তুক্ষেত্র , শষ্যক্ষেত্র , জলাধার , লবণাকর , হাট-বাট পার হয়ে অপরাহ্ণে তিনি প্রবেশ করলেন দণ্ডভূক্তি প্রদেশে । প্রধান শাষনকর্তা রাজা স্বয়ম্ভুদেব ও তাঁর অধীনস্থ গ্রামপতি , মহাদণ্ডনায়ক , মহাক্ষপটলিক , ক্ষেত্রপ , দান্ডিক , নাবাধ্যক্ষ প্রমুখের কাছে অভূতপূর্ব অভিবাদন ও সাম্মানিক নিয়ে তিনি বিশ্রাম নিতে এলেন দন্তবন বিহারে ।



মৃগদাবের পরেই বহু গুরুত্বপূর্ণ এই দন্তবনবিহার । তথাগতের দেহরক্ষার পরে শিষ্য ক্ষেম বুদ্ধদন্ত সংগ্রহ করে সযত্নে তা এখানে এনে অর্চনা করতে থাকেন । ফা হিয়েনের মনে হোলো , ব্রহ্মদত্ত কর্তৃক নির্মিত এই সুবর্ণ সুগতালয়ের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ যেন অমিতাভের আশীর্বাদে আনন্দময় । কোথাও কোন বিদ্বেষ নেই , নেই বিশৃঙ্খলাও ।


Fa-Hien visits Tamralipta | Fa Xian | 法顯 | 法显| Fǎxiǎn | Fa-hsien | ফা হিয়েন | फा हिएन
তাম্রলিপ্তে ফা-হিয়েন। চিত্রাঙ্কন: শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।

নিকটবর্তী অমরাবতীতে সমাচারদেব একটি বিহার নির্মাণ করে সেখানে নিত্য অর্চনার জন্য ভগবান তথাগতের মূর্তি স্থাপন করেছেন - এ সংবাদ শ্রবণমাত্রেই তিনি উৎফুল্ল হয়ে পরদিন সেখানে যাত্রার আয়োজন করেন ।



ধুলো ওড়া লাল মাটির পথ । পথের দুধারে নানান বৃক্ষের সমারোহ । পথশ্রম লাঘবকারী তাদের ছায়া । বৃহৎ স্তূপ যত নিকটবর্তী হতে থাকে ততই তাঁর কান ভরে উঠতে থাকে শত শত ভিক্ষুদের গম্ভীর উচ্চারণে -


" বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ।

ধম্মং শরণং গচ্ছামি ।

সংঘং শরণং গচ্ছামি ॥ "


অনির্বচনীয় মনোহারক পরিবেশ । ভিক্ষুগণ , নাগরিকদের সঙ্গে যেন চারপাশের সমস্ত তরুরাজি , অনন্ত আকাশ - বাতাস , অদূরের ঊর্মিল সুবর্ণরেখা - সকলেই যেন কণ্ঠ মিলিয়েছে সেই প্রার্থনায় - অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের সকলের চিরকালীন কল্যাণ কামনায় - সমস্ত বিদ্বেষের বিনষ্টির জন্য ।

হাতের পুষ্পরাজি সমর্পণের জন্য উদগ্রীব , অন্তরে জেগে উঠেছে অদ্ভুত এক আকুলতা , কণ্ঠে যেন বহু শতাব্দীর তারুণ্যের ছোঁয়া ....

.... ফা হিয়েন দ্রুত পদক্ষেপ করতে থাকেন ॥


midnapore.in

(Published on 18.07.2021)

পাদটীকা:
● এ গল্পের সময়কাল বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্মের সুবর্ণযুগ ।
দিবাকর নন্দী, স্বয়ম্ভুদেব এবং চিরাত দত্ত নাম তিনটি কাল্পনিক।
রাহুল মিত্র-র সঙ্গে ফা হিয়ান-এর দেখা হওয়ার কোন ঐতিহাসিক প্রমান নেই। ।
● দাঁতনে দন্তবন বিহার ও মোগলমারিতে অমরাবতী বিহার অবস্থিত ছিল উল্লেখ করা হলেও, বিষয়টি ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত নয়।

সমার্থক:
চীবর = বৌদ্ধদের পোষাক ।
পরিষ্কার = বৌদ্ধদের ভিক্ষাপাত্র ।
ঠবিকা = বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ঝোলা ।
মৃগদাব = সারনাথের পূর্বনাম ।
দন্তবন = দাঁতন
অমরাবতী = মোগলমারী ।

রঙিন চিত্রাঙ্কন:
শুদ্ধসত্ত্ব মান্না ।