Few Folk festivals of Medinipur

মেদিনীপুরের কিছু লোক পার্বণ।

Few Folk festivals of Medinipur

বীরকুমার শী।


কথায় বলে, বাঙ্গালির বারো মাসে তের পার্বণ। কথাটা আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার কোন মানে নেই। কথাটার সহজ সরল অর্থ এই, বাঙালির পার্বণ সংখ্যা বেশি এবং সারা বছর এই পার্বণ লেগেই থাকে। কথাটা আক্ষরিক অর্থে না নিলেও শব্দ-গুচ্ছের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাচ্ছি আমি। বছরে মাস সংখ্যা 'বারো” কিন্তু পার্বণ সংখ্যা “তের" কথাটা থেকে আমার মনে হয় প্রবাদ-প্রতীম বাক্যে এই বোঝানো হয়েছে বাঙালির প্রতিমাসেই একাধিক পাবর্ণ। দোল, ঝুলন, ভাইফোঁটা, জামাই ষষ্ঠী, দুর্গাপুজা, নববর্ষের মতো সর্বজনীন অনেক পাবর্ণ যেমন আছে,পড়ুয়া অষ্টমী (প্রথম সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই পার্বণ), নল-বোলানো সংক্রান্তি, গমা (রাখী পুর্ণিমার দিন মেয়ে-জামাইকে ডাকা হয় এবং অনেক রকমমের পিঠে হয়), আখেরি (হালখাতা মহরৎ - নববর্ষ পালন এবং আখেরি পালন একই দিনে হলেও উদযাপনে বেশ কিছুটা পার্থক্য আছে) এর মতো অনেক গ্রামীণ পার্বণ আছে। অধুনা আবার বইমেলা, যুব উৎসব, সুভাষ মেলাও আধুনিক-শিক্ষিত বাঙালির পার্বণের ঘরে ঢুকে পড়েছে। স্থান ভেদেও বেশ কিছু পার্বণ পালিত হয়, যাকে বলা যেতে পারে আঞ্চলিক পার্বণ। তাই “মেদিনীপুরের লোক পার্বণ"এই আলোচনায় আমি এগরা সংলগ্ন অঞ্চলের এই রকম কয়েকটি বিশেষ পার্বণের কথা উল্লেখ করবো।


গমা পূর্ণিমা


গমা পূর্ণিমা । শিক্ষিত, পন্ডিত সমাজে এই পূর্ণিমা রাখি পূর্ণিমা হিসাবে পরিচিত। এগরা সংলগ্ন পাশাপাশি অনেক গ্রামে এই পূর্ণিমা গমা পূর্ণিমা নামেও প্রচলিত। গ্রামে-গঞ্জেও এই দিন রাখিবন্ধন উৎসব হয় তবে বতর্মানে শহরে যে রাখি উৎসব হয় তার সঙ্গে এই উৎসব পালনে কিছুটা পার্থক্য আছে। সকাল থেকে ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অন্য বর্ণের মানুষের হাতে রাখি পরিয়ে দেন এবং অনেকে একটি মন্ত্র (শ্লোক) উচ্চারণ করেন।

Few Folk festivals of Medinipur
মেদিনীপুরের কিছু লোক পার্বণ | Few Folk festivals of Medinipur

শ্লোকটি হল: 'অতি দানে বলি বদ্ধ/অতি মানে চ কৌরবা/ অতি দর্পে হত লঙ্কা/ সর্বম অতি গর্হিতম'। রাখি তৈরি হতো মুলত তুলো ও পাটের দড়িকে রং-এ চুবিয়ে। সেই রং হতো খুবই কাঁচা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই রাখি পরে যখন পুকুরে চান করে উঠত তখন জল হয়ে উঠতো রঙিন আর হাত ভরে উঠত নানান রংএর (মুলত সবুজ ও গোলাপি) জল ছাপে। একটু বয়স্ক সাত্বিক ব্রাহ্মণরা যজমান বা অতি পরিচিত ব্যক্তিকে পৈতা (উপবীত)পরিয়ে দিতেন। অব্রহ্মণরা ঐ দিন উপবীত পরতো। তারপর দিন শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই উপবীত পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিত। রাখি বা উপবীত পরার বিনিময়ে ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবকে সাধ্যমতো কিছু পয়সা দেওয়া হতো। আপাতদৃষ্টিতে এতে লেন-দেনের একটা সম্পর্ক থাকলেও বেশ কিছুকাল আগে পর্যন্ত এই লেনদেন উভয়পক্ষের মধ্যে কোন তিক্ততা সৃষ্টি করে নি। উভয়পক্ষই এই বিষয়টিকে তাদের ধর্মাচরণের একটা অঙ্গ বলে মনে করতেন। অধিকন্তি এই উৎসবের সঙ্গে পিলে-পুঠি, গো-পুজা, জামাইকে কেন্দ্র করে উৎসব একটা অন্য মাত্রা এনে দিত। “মনে করতেন” বা “দিত” বলছি এই জন্যে “গমা"র রমারমা আজ আর তেমন নেই। তবে যেসব অঞ্চলে এই দিনে গো-পুজা এবং জামাইকে ডাকা হয়, সেই সব অঞ্চলে এই উৎসব গমা আজও বেশ সমাদৃত।

গমা পূর্ণিমা' কথাটি কোথা থেকে এল তার কোন সম্যক ব্যাখ্যা নেই। হয়ত এই পূর্ণমায় গরুকে (গো মাতা) বিশেষ ভাবে পুজা করা হতো বলে একে গমা পূর্ণিমা বলা হতো । তবে এক সময় এই উৎসব যে গ্রামীণ জীবনে এক সামাজিক মিলনোৎসব ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।


সাতপুরী অমাবস্যা


এগরার একটি নিজস্ব উৎসব বা পরব সাতপুরী অমাবস্যা। এগরার বললাম এই জন্য যে, আমি ছোটবেলায় দেখেছি, এই সাতপুরী পরব এগরায় যে ভাবে উৎসাহের সঙ্গে পালিত হতো, পাশাপাশি সেইভাবে উৎসাহের সঙ্গে তো দূরের কথা, একটু এগরা ছাড়িয়ে খাড় (গরা থানার উত্তরসীমানা), অন্য দিকে বালিঘাইতে এই পরব সেইভাবে পালিত হতো না। খোঁজ নিয়ে যতদূর জানতে পেরেছি, আজ থেকে মোটামুটি পঞ্চাশ বছর বা তারও আগে হটনাগর মন্দির থেকে অমাবস্যায় এগরার ব্যবস্যায়ীদের মধ্যে সাতপুরি বিতরণ হতো। সেই থেকে এগরায় সাতপুরি অমাবস্যা পালন আরম্ভ হয়। ক্রমে বালিঘাই পেরিয়ে সাতমাইলে (এগরা থানার পূর্ব সীমানা) কিংবা পানিপারুল (এগরা থানার দক্ষিণ সীমানা) পেরিয়ে দেপাল- এদিকে জাহালদা পেরিয়ে খাকুড়দা ছুঁই ছুঁই করছে, কয়েক বছর হলো হাটগোপালপুরে (পটাশপুর-১) মাইক বাজিয়ে সাতপুরি বিক্রি হচ্ছে। এগরার হরেকৃষ্ণের মিষ্টি দোকানের একজন কারিগর তুরকাতে গিয়ে সাতপুরি চালু করেন। এখন সেখানে তো রাখি পূর্ণিমার পরে যে অমাবস্যা আসে সেই অমাবস্যায় সাতপুরী উৎসব পালিত হয়। এই অমাবস্যা “কৌশিকী” অমাবস্যা নামে বিশিষ্ট জনের মধ্যেপরিচিত। ব্রাহ্মণগণ এই অমাবস্যায় কুশ সংগ্রহ করেন। সে প্রসঙ্গ এখন থাক। লোক পরব সাতপুরী অমাবস্যা প্রসঙ্গে আসি। “সাতপুরি” এক ধরণের মিস্টান্ন। নারকেল, গুড় (কোথাও চিনি), কোন কোন ক্ষেত্রে আদা মিশিয়ে প্রথমে পাক করা হয়। তারপর গরম জলে একটু, নুন-চিনি (নরম করার জন্য) দিয়ে ময়দা মিশিয়ে মন্ড প্রস্তুত করে গোল আকারের রুটির মতো করা হয়। তারপর আঙ্গুল দিয়ে মাঝে চেপে একটু গর্ত করে তার মাঝে নারকেল-গুড় -আদার আগে থেকে পাক করা জিনিসটি রেখে মুড়ে দিয়ে দুই দিক একটু লম্বা করে দেওয়া হয় তারপর তেলে ভাজা হয়। এটিই সাতপুরি। এখন অবশ্য নারকেল-গুড়ের বদলে ছানা দিয়ে সাতপুরির চলও হয়েছে। তবে এখনও নারকেল-গুড়ের জনপ্রিয়তাকে পিছনে ফেলতে পারে নি। “সাতপুরী" এই রকম নামকরণে পিছনে কারণ যতদুর জানা যাচ্ছে, আগে সাত রকমের উপাদান (ময়দা, চিনি/গুড়, নারকেল, আদা, এলাচ, তিল, লবঙ্গ) মিশিয়ে এই মিষ্টান্ন তৈরি করা হতো।

সারাবছর এগরার দুটি দোকানে সাতপুরি পাওয়া গেলেও সাধারণত বর্ষাকাল থেকে শীত আসা পর্যন্ত এগরার সমস্ত মিষ্টি দোকানে এই মিষ্টি পাওয়া যায়। আর সাতপুরি অমাবস্যায়? যে না দেখেছে সে বিশ্বাসই করতে পারবে না। প্রতিষ্ঠিত দোকানে অতিরিক্ত লোক লাগাতে হয়। মূল দোকানের বাইরে সাতপুরি কয়েক টন জমা হয়, নিমেষে বিক্রি হয়ে যায়। অনেকে সেই দিন অস্থায়ী দোকান তৈরি করে রাস্তার ধারে সাতপুরি বিক্রি করে। এ দিন এত সাতপুরি কি হয়? প্রত্যেক বাড়িতেই কেনা হয় - যাঁর যেমন সামর্থ্য। বাজারে-অফিসে বন্ধু বান্ধবদের সাতপুরি খাওয়ানোর একটা রেওয়াজও আছে। আর রেওয়াজ আছে মেয়ের বাড়িতে সাতপুরি পাঠানোর। এখন মেয়েদের বাড়িতে সাতপুরি পাঠানোর রেওয়াজ কিছুটা কমলেও বিক্রি কমে নি। আর পরব পালনের সীমানা বর্তমানে এগরা থানা ছাড়িয়ে পটাশপুর থানার শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌছে গেছে। আর এগরা পাশাপাশি হওয়ার সুত্রে মোহনপুর ছাড়িয়ে দাঁতন এবং এদিকে জাহলদা ছাড়িয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরেও বেশ ভালো করেই এই উৎসব পালিত হয়।


চিতি অমাবস্যা


এটি আর একটি স্থানীয় লোক পার্বণ। তবে এই উৎসবের ব্যাপ্তি সাতপুরী অমাবস্যার চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণত শ্রাবণ মাসে হয়। 'চিতি'এক ধরণের পিঠা (পিষ্টক)। এ দিন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নানান ধরণের পিঠা তৈরি হলেও চিতি পিঠা আবশ্যিক। তাই এই অমাবস্যাকে বলা হয় “চিতি অমাবস্যা”। চিতি পিঠা চালের তৈরি। চাল ভিজিয়ে শিলনোড়া দিয়ে বাটার পর এর সঙ্গে নারকেলের গুড়ো মিশিয়ে দেওয়া হয়। তারপর উনুনে তেলানি (মাটির তৈরি এক ধরণে পাত্র, অনেকটা অর্ধ-গোলাকৃতি থালার মতো), সরা (এটিও মাটির তৈরি আর এক ধরণের পাত্র, তেলামির মতো গভীর নয়, তেলামীর উপর চাপা দিতে ব্যবহার করা হয়) চাপা দেওয়া হয়। এক-একটি করে চিতি পিঠা প্রস্তুত করা হয়।

এই পিঠা তৈরি করে প্রথমে পুকুরে দেওয়া হয়, তারপর গৃহস্থরা সবাই খায়। পুকুরে দেওয়ার পিছনেও একটি লোক-ধারণা প্রচলিত আছে। পুকুর থাকে গুজ্জরি (গুজি গ্যাড়া - ছোট ছোট গ্যাড়া ) এই সময় মাঠে ধান গাছের গোড়ায়ও এই গ্যাড়া প্রচুর পরিমাণে থাকে । (এখন জমিতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক মারার ফলে এই গ্যাড়ার পরিমান অনেকটা কমে গেছে)। তখন তো ধান রোপন হতো না, হলেও নামমাত্র। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ধান বোনা হতো, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে জমি বাছা হতো অর্থাৎ জমিতে ডান হাঁটু মুড়ে আগাছাগুলো উপরে ফেলে জমিতে পুতে ফেলা হতো । হাত ভেজা থাকায় এই সময় গুজ্জরি গ্যাড়ায় হাত কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকত। গ্রামীণ মানুষের বিশ্বাস ছিল চিতি অমাবস্যায় পুকুরে গুজরি গ্যাড়াকে চিতি পিঠা খাওয়ালে গুজ্জরি গ্যাড়া আর হাত কাটবে না।

Few Folk festivals of Medinipur
মেদিনীপুরের কিছু লোক পার্বণ | Few Folk festivals of Medinipur

এই চিতি পিঠা উৎসব সম্ভবত উড়িষ্যার গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ। এগরা উড়িষ্যার সংলগ্ন হওয়ায় এবং এক সময় উড়িষ্যা রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকায় স্বাভাবিক ভাবে সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এই চিতি পিঠা উৎসব আমাদের গ্রামীণ লোক সংস্কৃতিকে বুঝতে সহায়তা করে।


কোল ষষ্ঠী


এটিও মুলত এগরার লোকিক পার্বণ। খোঁজ নিয়ে জেনেছি এগরা থেকে সামান্য দুরে খাকুড়দা বা কাঁথির দিকে এর তেমন প্রচলন নেই। তবে মোহনপুরের দিকে প্রচলন আছে। দুর্গা পূজার ষষ্ঠীর ঠিক এক মাস আগে যে ষষ্ঠী আসে সেই দিনই 'কোল ষষ্ঠী' । পঞ্জিকায় লেখা থাকে 'মন্থন ষষ্ঠী'। লোক বিশ্বাস এই, ষষ্ঠীর ইচ্ছায় শিশু জন্মায়, তারই দয়ায় শিশুরা ভালো থাকে। তাই 'কোল যষ্ঠী'র প্রচলন না থাকলেও শিশু জন্মাবার একুশ দিনের মাথায় ষষ্ঠী পূজা করার প্রচলন অনেক জায়গায় আছে। ষষ্ঠীর ধ্যানে ষষ্ঠী দেবীর কোলে একজন শিশুর কথা বলা আছে। তাই শিশুর মঙ্গল কামনায় এই পুজাকে বলা হয় 'কোল ষষ্ঠী'। মজার কথা এই, ষষ্ঠী দেবীর প্রতীক হিসাবে যা করা হয় তা অনেকটা নবপত্রিকার মতো । কচু গাছ, তিন-চারটি পাতা সহ বেল ডালা, তিন-চারটি পাতা সহ ডালিম ডালা, চ্যাপটা দল (এক প্রকার জলজ ঘাস অপেক্ষাকৃত কম জলে জন্মায়, পাতাটা চ্যাপটা)-কে এক সঙ্গে বেঁধে কোল ষষ্ঠী দেবীর মুর্তি হিসাবে কল্পনা করে পুজা করা হয়। সম্পূর্ণ ঘরোয়া পুজা। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে বাড়ির লোক (সাধারণত মা-জ্যাঠাইমারা) স্নান করে পুজা করেন। সকাল থেকে এই সব উপকরণ সংগ্রহের ধুম পড়ে যায়। সাধারণত বাড়ির কোণে পুজা করা হয়। তারপর দিন সকাল বেলা বাসি মুখে পুকুরে এই দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়। সাধারণত বাড়ির বড় ছেলে দেবীকে বিসর্জন দেন। ঘরের কোণে পুজো করা হয় বলে এবং সম্ভবত কিছুটা অজ্ঞানতাবশত “কোণ ষষ্ঠী” সাধারণে “কোল ষষ্ঠী” হিসাবে পরিচিত।


নল বোলানো সংক্রান্তি মেলা


আশ্বিন মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন নল বোলানো হয়ে থাকে। তাই এই দিনটিকে বলা হয় নল সংক্রান্তি। কোথাও কোথাও এই উৎসবটিকে বলে, 'ডাক সাঁকরাত'। রাঢ় বাংলার এটি একটি ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উৎসব। পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যা রাজ্যেও বেশ কিছু অংশে এই উৎসব পালিত হয়। নল সংক্রান্তি আসলে ধান গাছের সাধ ভক্ষণ উৎসব। সেই হিসাবে এটি মূলত চাষীদের উৎসব।

Few Folk festivals of Medinipur
মেদিনীপুরের কিছু লোক পার্বণ | Few Folk festivals of Medinipur

স্থানভেদে উৎসব পালনের মধ্যে কিছুটা তফাৎ থাকলেও মোটামুটি একই। সংক্রান্তির দিন চাষীরা নল প্রস্তুত করে, মাঠে, ঘরে ও নানান জায়গায় পুতে এবং পোতার সময় ছড়ার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে। নলের মধ্যে থাকে: ১. ধান ২. ভাঙা চাল ৩. আদা ৪. কেউ পাতা ৫. কুঁকড়ো নাড়ি (শুকনো শশা গাছ) ৬. ওল ৭. বওল গাছের পাতা (বকুল গাছ নয়) ৮. রাই সরিষা ৯. কাঁচা তেতুল ১০. পাট।

কোথাও কোথাও নলের মধ্যে থাকে: ১) কুহলীরেখা (কুলেখাড়া) ২) চিকিনপাতা (চিকনীপাতা) ৩) কাঁচা হলুদ ৪) আদা ৫) রসুন ৬) ওল ৭) কেঁউ ৮) পাট ৯) কুঁকড়ো নাড়ি (শুকনো শশা গাছ) ১০) কেঁউ

সন্ধ্যার আগে আগেই এই সব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহীত উপাদানগুলি একসঙ্গে মেশানো হয়। মেশানো উপকরণগুলিকে বলে “ওষুধ” । তারপর বাড়ির পুরুষ মানুষ এবং ছেলেমেয়েরা নল বাঁধতে বসে যায়। নল বাঁধার উপকরগুলো যত্ন সহকারে বউলপাতাটিতে মুড়ে পাটদড়ি দিয়ে বেঁধে পুটুলি তৈরি করে। তারপর নলগাছের ডগায় নলপাতা ও পুটলী ভালো করে জড়িয়ে নতুন পাট দিয়ে শক্ত করে, বেঁধে সাবধানে রাখে। নল বাঁধা শেষ হলে নলগুলো কুলায় বা পাছিয়ায় রেখে একটা ফাঁকা জায়গায় রাখা হয় যাতে রাতের শিশিরে ওগুলো ভিজে । কুলায় নিমকাঠির দাঁতনও রাখা হয়।

Few Folk festivals of Medinipur
মেদিনীপুরের কিছু লোক পার্বণ | Few Folk festivals of Medinipur

তারপর দিন সুর্য ওঠার আগে ওষুধ বাঁধা নলগুলো বামকাঁধে নিয়ে চাষীরা 'হরিবোল', 'হরিবোল' বলতে বলতে প্রথমে তুলসী তলায় তারপরে ঘরের চালে, বট অশ্বথের তলায়, মন্দির বা মাড়োর তলায় একটি করে নলগাছ দিয়ে হরিধ্বনি করতে করতে ধান মাঠের দিকে বেরিয়ে পড়ে। মনের আনন্দে নিজের ধান জমির ঈশান কোণে একটি করে নল পুঁতে মুখে বলতে থাকে প্রচলিত বোল বা ছড়া -

হরি- হরি- হরি বোল

মহাদেবের ধান ফোওল।

এতে আছে কাকুড় নাড়ী

যা রে পোকা ধানকে ছাড়ি।

এইরে আছে শুকতা।

ধান ফলবে গজমুক্তা।

এইরে আছে কেঁউ

ধান ফলবে বেঁউ বেঁউ।

এইরে আছে ঝোটপাট

সব পোকার মাথাকাট।

এইরে আছে হল্দি

ধান ফলবে জলদি ।

এইরে আছে ওল

ধান হবে গোল।

এইরে আছে বিরি

আমার করিই যাবে ভরি।

এইরে আছে আদা

ধান ফলবে গাদা গাদা।

হরি-ই বোল, হরি-ই বোল .....

করিই হচ্ছে মরাই, যেখানে ধান রাখা হয়। ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন বোল প্রচলিত আছে। এক জায়গার বোল সময়ের বিবর্তনে মিশে গেছে অন্য জায়গার বোলের সাথে।

এতে আছে কেঁউ - ধান ফলবে বেঁউ বেঁউ।

এতে আছে ছোটপাট- সব শনির মাথা কাট।

এতে আছে আদা- ধান ফলবে গাদা গাদা।

এতে আছে ওল- মহাদেবের বোল।

নল রাজাকে ধ্যান করে বল্ হরিবোল।

একটু ভিন্ন রূপে একটি ছড়ার অংশ বিশেষ-

নল বা শর পোতার সময় ছড়া বলার চল সর্বত্র। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে বাংলার ওড়িষা ঘেঁষা গ্রামগুলির ছড়াতে স্বাভাবিক ভাবে ওড়িয়া ভাষার টান মেলে। এই রকম আর একটি ছড়া উল্লেখ করছি-

এথরে আচে ওল..

বুড়া মহাদেব কি হরিবোল।

এথরে আছে নীল আদা,

ধান ফলবু গাদা গাদা।

এথরে আছে কেঁউ

ধান ফলবে বেঁউন বেঁউন।

নলপোতা শেষ করে চাষীরা একটি বড় দেখে নল নিয়ে ঘরে ফেরে । ঐ নল ঘরের সামনের চালায় রেখে দেয়।

নলবোলানো জল :

'সংক্রান্তির দিন সকালবেলায় অন্ধকার থাকতে একটি পরিষ্কার ঘসা মাজা ঘটিতে জল,যেটা পুকুর থেকে ডোবানোর সময় জল না বেরিয়ে যায় এরকম অবস্থায় তুলে এনে একটি থালায় রাখা হয়। তারপর আগের দিনের আলিগুলোকে ওতে ধুয়া হয়। এসময় সকালবেলার ধানের ক্ষেতের শিশিরের জল ধরে একসঙ্গেখেতে হয়।

নলবোলানো জল খুবই পবিত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। এ জল ঘরের নানা স্থানে ছড়িয়ে দেওয় হয়। আমাদের এই দিকে যাদের বাড়িতে বরোজ আছে তারা বরোজে এই জল ছিটিয়ে দেয়।

নল সংক্রান্তির দিন রান্না

এ দিন শুধু যে নলবোলানো জল খাওয়া হয় তা নয়, খুব ধুমধামের সঙ্গে রান্না হয়। সাতটি তরকারী অবশ্য থাকে। ১. সাত শাকের ভাজা (আবশ্যকীয়) ২. ওল মলা (আবশ্যকীয়) ৩. ডাল (আবশ্যকীয়) ৪. চচ্চড়ি ৫. কুমরোর ঘন্ট ৬. মাছের ঝোল (আবশ্যকীয়) ৭. কাঁচা তেঁতুলের অথবা চালতার টক (আবশ্যকীয়)।

নল বোলানো সংক্রান্তি খুবই পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দিন চুল-নখ কাটা, কাপড় কাচা বারণ।


শেষ কথা।


লোক-পার্বনগুলি লোক-চরিত্র, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় চেতনা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি বুঝতে বিশেষ ভাবে সহায়তা করে। যেমন “গমা” পূর্ণিমায় “গো-পুজা গ্রামীণ জীবনে গরুর ভুমিকা তৎকালীন সময়ে অনস্বীকার্য ছিল তা প্রমাণ করে। কালের নিরিখে, অর্থনৈতিক পরিবর্তনে এই সমস্ত লোক-পার্বণ হয়ত হারিয়ে যাবে একদিন। তবে ইতিহাসের প্রয়োজনে এর গুরত্ব হারাবে না কোন দিন। অন্য কোন লোক পার্বণ সমাজে আসন করে নিয়ে লোক-পার্বণের ধারাকে বজায় রাখবে।


midnapore.in

(Published on 26.03.2021)

(নল সংক্রান্তি নিবন্ধে তথ্যের ক্ষেত্রে হরিশচন্দ্র দাসের “এগরা থানার ইতিবৃত্ত" গ্রন্থ এবং দীপক কুমার মাইতি ও শিবশঙ্কর সেনাপতির প্রবন্ধের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।)