গাজন : শালবনি ব্লকের গ্রাম জলহরি
Gajan: Village Jalhari in Shalboni block
অমর সাহা।
Home » Medinikatha Journal » Amar Saha » গাজন : শালবনি ব্লকের গ্রাম জলহরি
ছোট গ্রাম। নাম জলহরি। যেখানে আমি জন্মেছি। বড় হয়েছি। ক্লাস এইট পর্যন্ত মৌপাল জুনিয়র স্কুলে পড়া। তেরো – চোদ্দো বছরে ঘর থেকে বেরিয়ে খসলা ইন্দুমতী হাইস্কুলে পড়া। এবং মাধ্যমিক পাশ। তারপর মেদিনীপুর শহরের নানান ইনস্টিটিউটে পড়া ও শহরে বসবাস (চল্লিশ বছর ) এবং মেদিনীপুর কলেজে অধ্যাপনা রত।
গাজন : শালবনি ব্লকের গ্রাম জলহরি
জসীমউদ্দীনের কবিতার মতো বলতে পারি ‘ তুমি যাবে ভাই, আমাদের ছোটো গাঁয় ’। সত্যিই জলহরি গ্রাম মনোমুগ্ধকর। অপূর্ব তার প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল একসময়। কিন্তু কালের প্রেক্ষাপটে তার পটভূমি বদলে গেছে। এখন সজল ধারার জল ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। আমাদের ছোটোবেলায় ছিল না। ইলেকট্রিসিটি ছিল না, না ছিল এনডয়েট ফোন, না ছিল ইন্টারনেট।
বিবর্তন উন্নতির লক্ষণ। এই গ্রামটি রূপে-গুণে অদ্বিতীয়া। এর দক্ষিণ দিকে মেদিনীপুর শহর ও তৎসংলগ্ন এলাকা। উত্তর ও পশ্চিম দিকে লাল কাঁকুরে ল্যাটারাইট মাটি। পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় সমতল ভূমির জমি। দক্ষিণ দিকে ফাঁকা মাঠ ও শাল মহুয়া কুরচি কেন্দুর জঙ্গল। একটি খাল রয়েছে - যাতে গ্রীষ্মকালেও ঝরনার জল ঝিরঝির করে বয়ে চলে।
গাজন : শালবনি ব্লকের গ্রাম জলহরি
এই গ্রামের প্রধান উৎসব গাজন। অনেকেই গাজনকে আপাল গাজন বলে। বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহে শিবের গাজন উপলক্ষে ভোক্তারা গ্রামে গ্রামে ঢাক পিটিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিনের শেষে ভোক্তারা জলহরি বাঁধে স্নান ছেড়ে নিরামিষ রান্না ভোজন করে শীতলা ও শিব মন্দিরে কাছে। তাছাড়া ওই সাতদিন বা ন'দিন বৈশাখ মাসে রাত এগারো পর্যন্ত হিন্দোল দোল হয়। গ্রামের ছোটোবড়ো অনেকে পুরুষ মানুষ ‘হিন্দোল দোল'- এ দুলতে আসে। হিন্দোল দোলে উপরের দিকে ফাঁসের মধ্যে দিয়ে পা গলিয়ে তারা দোলে। নিচে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। দোল খাওয়ার সময় তারা বলে ‘বুড়া শিবের জয়' । দশ – পনেরো বছরের কিশোর খুব মজা পায়।
গাজন উপলক্ষে শনিবার বা মঙ্গলবার সূচনা পর্ব। তার তা চলে সাতদিন বা নয় দিন। শিবের গাজন একটি মাঠে হয়। তিন গ্রাম পাশাপাশি থাকায় (জলহরি মৌপাল ও মিরগা ) তাদের প্রত্যেকের একটি করে চড়ক গাছ আছে। মূল অনুষ্ঠান হয় ২রা জ্যেষ্ঠ থেকে ৪ঠা জ্যেষ্ঠ । এই সময় চড়কের মাঠে মেলা থাকে। মেলার রেশ থেকে যায় সাতদিনের মতো। ২রা জ্যেষ্ঠ ভোক্তারা শ্মশানে কাঠ জোগাড় করে চড়ক ডাঙায় আগুন তৈরি করে। ওইদিন তারা ফল-মূল চুরি করে তা খেয়ে থাকে। প্রতিদিন ভোক্তারা জলহরির বাঁধে স্নান সেরে প্রণাম সেবা করে। চড়ক গাছের ঊর্ধ্বে শূন্যে অনেকে ঘুরে পাক খায়। প্রকৃতপক্ষে এটি রুদ্রদেবতা অর্থাৎ সূর্যদেবতার প্রতি নিবেদন বা পুজো। সূর্যের তাপ ওই সময় প্রখর হয়। সূর্যদেবতাকে তুষ্ট করতে পারলে বর্ষা ভালো হবে। এখানে লোকসমাজ বিশ্বাস করে। ঢাকের শব্দ চারপাশে মুখরিত হয়। সকালে ভোক্তারা আমডাল ভেঙে আগুনের ওপর আমডাল ফেলে হেঁটে চলে যায়। একে আগুন ভাঙ্গা বলে। বিকেলে ভোক্তারা কিংবা অন্য কেউ জিব ফোঁড়া, বাহু ফোঁড়া, পিঠ ফোঁড়ায় অংশগ্রহণ করে। ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজনে ভরে যায়। পরস্পরের সৌহার্দের ভাব গড়ে ওঠে।
শিবের গাজন উপলক্ষে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক বেশি হয়। সাঁওতাল নাচ, নাটক অনুষ্ঠিত হয় জলহরির মাঠে। মেদিনীপুর, লালগড়, কেরানিচটি, গোদাপিয়াশাল, শালবনি, গোয়ালতোড়, সারেঙ্গা প্রভৃতি জায়গা থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক জনের সমাগম ঘটে।
গাজন : শালবনি ব্লকের গ্রাম জলহরি
শিবের গাজন উপলক্ষে ছো নাচেরও আসর বসে। অনেক সময় পুতুল নাচের আসরও বসে। এলাকায় মানুষের অর্থনৈতিক পরিবেশের ও একসপ্তাহে আমূল পরিবর্তন। অনেক সময় শিব -পার্বতীর রূপ ধারণ করে শিশুরা মনো মনোরঞ্জন করে। ২রা জ্যেষ্ঠ ও ৩রা জ্যেষ্ঠ কমপক্ষে চল্লিশ- পঞ্চাশ লোকের সমাগম হয় এই মেলায়।
এখানকার চড়ক মেলায় দু’জন হর পার্বতী সেজে ভোক্তাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। এর নাম ‘চড়কের সং’ এর মাধ্যমে লোকসাধারণের মধ্যে হালকা আনন্দ পরিবেশন করা হয়। চড়কের সঙের জন্য ছড়া রচনা করা হয়। সেই গান ও ছড়াগুলিতে আঞ্চলিকতা ছাপ রয়েছে।
এই উৎসবের মধ্যে আর্য – প্রাক্আর্য সংস্কৃতির অপূর্ব মিলন ঘটেছে। আদিবাসী সম্প্রদের মানুষ এই শিব মূর্তির পারাং নদী থেকে পেয়ে এখানে শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। যা ছিল মাটির আজ পাকার হয়ে গেছে। গাজন উৎসবে অংশগণকারীরা বিশেষত ভোক্তারা কোন রকম ভেদাভেদ করে না। উচ্চ নীচ ভেদাভেদ মুছে যায়।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 06.04.2025)
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।