গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
Glen Hensley 's camera captures old Kharagpur: History captured by an American soldier
সৌমেন গাঙ্গুলি।
Home » Medinikatha Journal » Soumen Ganguly » Glen Hensley 's camera captures old Kharagpur
আসুন আসল লেখাটির ভেতরে প্রবেশ করার আগে সংক্ষেপে বিশ্ববন্দিত সাহিত্য স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পোটা একটু চোখ বুলিয়ে নিই।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কাবুলিওয়ালা' গল্পটি হল এক মর্মস্পর্শী বন্ধুত্বের আখ্যান, যা দেশ, সংস্কৃতি ও বয়সের বাধা অতিক্রম করে গড়ে ওঠে। গল্পের প্রধান চরিত্র রহমত, একজন আফগান ফল বিক্রেতা, যিনি জীবিকার তাগিদে সুদূর কাবুল থেকে কলকাতায় আসেন। তার খদ্দেরদের মধ্যে একজন হলেন ছোট্ট মেয়ে মিনি। মিনি অসম্ভব কথা বলা এক উচ্ছল শিশু, যার সাথে রহমতের এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রহমত মিনির মধ্যে নিজের ছেড়ে আসা ছোট্ট মেয়েটিকে দেখতে পায় এবং মিনিও রহমতের বিশাল দেহের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্নেহপ্রবণ মনটিকে আবিষ্কার করে। তাদের এই সম্পর্ক মিষ্টি খুনসুটি, বাদাম ও কিশমিশের আদান-প্রদান এবং অকৃত্রিম ভালোবাসায় ভরা ছিল। কিন্তু একদিন রহমতকে একটি মারামারির ঘটনায় জেলে যেতে হয়। দীর্ঘ আট বছর পর জেল থেকে ফিরে এসে রহমত যখন মিনির বাড়িতে আসে, তখন মিনি আর সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই; সে এখন বিয়ের মণ্ডপে বসা এক পূর্ণ যুবতী। সময়ের ব্যবধানে তাদের সম্পর্কে পরিবর্তন এলেও, রহমত মিনির বিয়ের খরচের জন্য নিজের কাছে থাকা সমস্ত টাকা দিয়ে দেয়, যা তাদের এই পবিত্র বন্ধনের গভীরতাকে আরও একবার তুলে ধরে। এই গল্প মানব হৃদয়ের সার্বজনীন স্নেহ এবং বিচ্ছেদের বেদনাকে এক সরল অথচ গভীর ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলে।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
প্রায় একই রকম ভাবে "গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় তোলা পুরোনো খড়্গপুরের ছবি" শীর্ষক লেখাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে খড়্গপুরে আমেরিকান সেনাবাহিনীর উপস্থিতির এক ব্যতিক্রমী অধ্যায় উন্মোচন করে। এই লেখাটি গ্লেন হেনস্লি নামের এক আমেরিকান সৈনিকের ক্যামেরায় ধারণ করা খড়্গপুরের পুরোনো দিনের ছবি এবং তার সাথে এক বাঙালি মেয়ে 'মুক্তো'র বন্ধুত্বের গল্প তুলে ধরে। এই গল্প যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি 'কাবুলিওয়ালা' গল্পের মিনি ও রহমতের সম্পর্কের এক প্রতিধ্বনি – দেশ-কাল-সীমানার বেড়া ভেঙে জন্ম নেওয়া দুই ভিন্ন সত্তার নিষ্পাপ বন্ধুত্বের এক হৃদয়গ্রাহী আখ্যান।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে খড়্গপুরের অতীত
গ্লেন হেনস্লির তোলা খড়্গপুরের ছবিগুলো বর্তমানে আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এই ছবিগুলো শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ার ইতিহাস পড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এই ফটোগ্রাফগুলো প্রায় ৭১ বছর আগেকার খড়্গপুরের এক মুখর অতীতকে স্তব্ধ করে রেখেছে।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লি: একজন সৈনিক ও ফটোগ্রাফার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সেনাবাহিনী খড়্গপুরে অবস্থান করছিল। গ্লেন হেনস্লি ছিলেন সেই সৈন্যদেরই একজন। সৈনিকের দায়িত্ব পালনের বাইরে তার নেশা ছিল ছবি তোলা। যেখানেই ডিউটিতে যেতেন, সেখানকার দৈনন্দিন জীবনের ছবি ক্যামেরাবন্দী করা ছিল তার অভ্যাস।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
মুক্তো: গ্লেনের 'ছোট্টবন্ধু'
কলাইকুণ্ডা ও খড়্গপুর শহরের মাঝামাঝি একটি গ্রামের মূল সড়কের পাশে গ্লেনের সাথে মুক্তো নামের এক বাঙালি মেয়ের দেখা হয়। মুক্তোর বয়স তখন দশও হয়নি, কিন্তু গ্লেন তাকে 'ছোট্টবন্ধু' বলেই চিনতেন। গ্লেন ও তার সঙ্গীরা (নোয়েল হেপ, ট্রয়, নাই, বন্ড) এয়ারবেস থেকে একটু দূরে মুক্তোর সাক্ষাৎ পান।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
মুক্তোর সাথে তাদের প্রথম সাক্ষাতের একটি হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা রয়েছে। শহরে টহলরত সেনাদলের চোখে পড়ে রাজপথের একটি কোণে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কন্যাশিশুর ক্রন্দনরত মুখ। করুণ নয়নে মেয়েটি তাদের একটি ভাঙা চিরুনি দেখায়, যা তার অতি আদরের ধন ছিল এবং হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। এরপর আলাপ জমে ওঠে। ছোট্ট মেয়েটি জানায় "মুক্ত" তার নাম। তার পরনে ছিল মাত্র এক টুকরো কাপড়। এই দৃশ্য যেন রহমতের মিনিকে কিসমিস ও বাদাম উপহার দেওয়ার মতোই এক সাধারণ মুহূর্ত থেকে গড়ে ওঠা নিবিড় সম্পর্কের পূর্বাভাস। শহরে ঘোরার সময় গ্লেন ও তার সঙ্গীরা মুক্তোকে একটি চিরুনি উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এয়ারবেসে ফেরার পথে তাকে সেই চিরুনিটি ও ছোট শিশুদের পরার মতো একটি শাড়ি উপহার দেন। উপহার পেয়ে মুক্তোর চোখে-মুখে অনাবিল আনন্দ ও টোলপড়া হাসি ফুটে ওঠে, যা তাদের বিমোহিত করে। এরপর মুক্তো তার বয়সের তুলনায় পরিণত কথাবার্তা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, যা গ্লেন ও তার সঙ্গীদের হৃদয় আলোড়িত করে। মিনি যেমন তার সরলতা দিয়ে কাবুলিওয়ালার হৃদয় জয় করেছিল, মুক্তোও তেমনি তার সারল্য ও কৃতজ্ঞতাবোধ দিয়ে আমেরিকান সৈনিকদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল।
ক্যামেরাবন্দী মুহূর্ত
উপহার পাওয়ার পর মুক্তো নিজেকে ফটোশুটের জন্য প্রস্তুত করে নেয়। সামনে পড়ে থাকা একটি শুকনো কাঠের গুঁড়িতে সে উঠে যায়, এবং ক্যামেরার সামনে কালো চুলের শিশু মডেল হিসেবে তাদের ছবি তোলা শুরু হয়। গ্লেন 'মুক্তো' সিরিজে প্রায় পনেরোটি ছবি তুলেছিলেন। মুক্তোর সাবলীলভাবে ক্যামেরার সামনে নিজেকে মেলে ধরাটা আশ্চর্যের বিষয় ছিল। গ্লেন খড়্গপুরে থাকাকালীন মুক্তোর পরিবারের সাথে বোধহয় বেশ কয়েকবারই দেখা করেছিলেন এবং মুক্তোর তোলা ছবি প্রিন্ট আউট করে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দৃশ্যও ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। সেখানে গ্রামবাসীদের খুশির ভিড় লক্ষ্য করার মতো ছিল।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন তার তোলা প্রতিটি ছবির সঙ্গেই একটি করে টীকা জুড়ে দিয়েছিলেন, যা তার স্ত্রী'র কাজে লাগত, কারণ তিনি সেই সময় মিশৌরিতে বিশ্ব-ইতিহাস পড়াতেন।
খড়্গপুরের অন্যান্য চিত্র
মুক্তো ছাড়াও গ্লেন হেনস্লি খড়্গপুরের আরও অনেক ছবি তুলেছিলেন। এর মধ্যে ছিল খড়্গপুর স্টেশন, গোলবাজার, রেলওয়ে বয়েজ স্কুল, এবং মিক্সড স্কুল। সব মিলিয়ে প্রায় তিরিশটি ছবি তুলেছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তোলা রেলস্কুল এবং গোলবাজারের আলোকচিত্রগুলি পুরোনো খড়্গপুরকে জানতে সাহায্য করে।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
অজ্ঞাত পরিচিতি
এই ছবিগুলো ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দুঃখজনকভাবে, সেখানে এই ছবিগুলো কার তোলা এবং কেন তোলা হয়েছিল, সে সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করা হচ্ছে না। বর্তমানে মুক্তো বা গ্লেন হেনস্লি বেঁচে আছেন কিনা, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য জানা যায়নি।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
এই ছবিগুলো কেবল ফটোগ্রাফি নয়, বরং দুটি ভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে গড়ে ওঠা এক মানবিক বন্ধুত্বের গল্প, যা রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পের মতোই স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। এটি মানব সম্পর্কের এক শাশ্বত রূপ, যেখানে ভাষার বাধা, সংস্কৃতির ভিন্নতা বা ভৌগোলিক দূরত্ব কোনো কিছুই ভালোবাসার বন্ধনকে আটকাতে পারে না।
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
গ্লেন হেনস্লির ক্যামেরায় পুরোনো খড়্গপুরের ছবি: এক আমেরিকান সৈনিকের লেন্সবন্দী ইতিহাস
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 13.07.2025)
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।