চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
বহু সংখ্যক মোগল এখানে যে জায়গায় বসবাস করতেন তা মোগলপাড়া নামে পরিচিত। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে এই মোগলপাড়াতে একটি মসজিদ তৈরি হয়েছিল, যা মসজিদের দেওয়ালের ওপর একটি জীর্ণ প্রস্তরফলকের আরবি ভাষায় লেখা থেকে জানা যায়। কেশিয়াড়ি থেকে সামান্য দূরে কুরুমবেড়া দুর্গের মধ্যে অবস্থিত মসজিদটির দেওয়ালের ওপর যে প্রস্তরফলকটি আছে তা থেকে জানতে পারি সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে জনৈক তাহির কর্তৃক ১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদটির নির্মাণ হয়েছিল।
এসব তথ্য আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না কেশিয়াড়ি ও গগনেশ্বর একসময় তসর শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে বেশ বিখ্যাত ছিল। যদিও কেশিয়াড়ি ও গগনেশ্বর ছাড়াও সেইসময়ে গুরুত্বপূর্ণ তসর শিল্পকেন্দ্র হিসেবে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চল ও আনন্দপুর বেশ উল্লেখযোগ্য ছিল। কিন্তু এখন এই আলোচনা শুধু কেশিয়াড়িকে নিয়েই।
তসর শিল্পের কাঁচামাল তসর ককুন অর্থাৎ তসর গুটি আনা হত গোগোই, নুনগা, শিলদা, বিনপুর ও রামগাঁও-এর জঙ্গল থেকে। কেশিয়াড়ি-নারায়ণগড়েও কুল-পলাশ গাছে তসরের তন্তুকীট বাসা বাঁধতো। এছাড়াও কাঁচামাল আসত ময়ূরভঞ্জ ও সিংভূম থেকেও। তাঁতিরা এই সমস্ত কাঁচামাল অর্থাৎ তসর গুটি সংগ্রহ করে আনতো। এই গ্রামটিতে প্রচুর সুদক্ষ তাঁতিরা ছিল যারা তৈরি করত তসরের ধুতি, শাড়ি, থান ইত্যাদি। এই ধরণের সাধারণ তসর ছাড়াও তাঁতিরা লাল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি রঙের তসরের কাপড়ও তৈরি করত।
তবে রঙিন তসরের মধ্যে কেশিয়াড়িতে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল দুটি বিশেষ বুননের রঙিন তসর। একটি হলো ময়ূরকন্ঠী- যেটি লাল তসর সিল্ক ও সবুজ রঙের তসর সিল্কের বুননে তৈরি হতো। আর একটি হল পীতাম্বরী- যা তৈরি হতো লাল তসর সিল্ক ও হলুদ তসর সিল্কের বুননে। শুদ্ধাচারী মানুষদের পূজা অর্চনায় তসর ছিল গুরুত্বপূর্ণ পরিধেয় বস্ত্র। সে সময় মন্দিরের গর্ভগৃহের চন্দ্রাতপে তসরের কাপড়ের ওপর সুক্ষ্ম সূচীকার্যের মাধ্যমে দেবলীলা ফুটিয়ে তোলা হত।
এই সমস্ত তসরের বস্ত্র কিছু স্থানীয় বাজারে বিক্রি হতো, কিছু যেতো কলকাতায় বিক্রির জন্যে। তবে বেশিরভাগটাই ইংরেজরা বালেশ্বর বন্দর দিয়ে রপ্তানি করতো। কেশিয়াড়িতে প্রচুর পরিমাণে যে তসর পণ্য উৎপাদন হতো তা ইংরেজ ভ্রমণকারী স্ট্রিনশ্যাম মাস্টার তাঁর ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের রোজনামচায় উল্লেখ করেছেন। "The waters of Casharry giving the most lasting dye to them, and within two days journey of this place." (The Diaries of Streynshyam Master, Vol. II)। কেশিয়াড়ির জলে সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হতো তসরের রঙ, তাঁর রোজনামচায় একথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
কেশিয়াড়ির জলে যে তসরের রঙ সবচেয়ে বেশি স্থায়িত্ব লাভ করত সেই তথ্য আমরা আরও পাই ডব্লিউ. ক্ল্যাভেল-এর বিবরণে। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ডব্লিউ. ক্ল্যাভেল, বালেশ্বরের বাণিজ্য বিষয়ক বিবরণ লিখতে গিয়ে বলেন যে, কেশিয়াড়ির জলে তসরের রঙ সবচেয়ে বেশি স্থায়িত্ব পেত। "As far back as 1676, W. Clavell, in his account of the trade of Balasore, noticed that the waters of 'Casharry' gave the most lasting dye to tusser silk." (Bengal District Gazetteers, Midnapore, L.S.S. O'Malley)। এই তসর শিল্পের উন্নতির জন্যে বালেশ্বরে কোম্পানির ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছিল। ১৮৫২ সালে প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ তাঁতি পরিবার কেশিয়াড়িতে বসবাস করতো এবং তাঁরা বস্ত্রবয়নে নিযুক্ত ছিল। এখানকার তসরপণ্য একসময়ে চীন, জাপান ও ইউরোপেও পরম সমাদরে গৃহীত হতো।
কেশিয়াড়ির তসর পণ্যের বাজারে তসর পণ্য ক্রয়ের জন্যে দূরবর্তী মাদ্রাজ, কোয়েম্বাটুর, পাঞ্জাব প্রভৃতি প্রদেশের এমনকি সুদূর ফ্রান্স ও তুরস্ক দেশের বণিকেরাও সেইসময় বাস করতেন। শ্রীযুক্ত রাধানাথ পতি মহাশয় লিখেছেন "তাঁর বাল্যকালে তাঁহাদের বাড়িতে ইদ্রিছ খাঁ নামে জনৈক মান্দ্রাজি মহাজন আসিয়া প্রতিমাসে অনূন্য পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের একগজ চওড়া পাতলা তসরের থান মান্দ্রাজি পাগড়ির জন্য চালান দিতেন। তাঁহার সহিত কোয়েম্বাটুরের জনৈক মহাজন অংশীদার ছিলেন। বহরমপুরের পদ্মনাভ চৌধূরি নামে একজন মহাজন ওই সময়ে প্রায় কুড়ি হাজার টাকার তসর কাপড়ের ব্যবসায় ঐ স্থানে চালাইতেন।"
ওই সময় এই অঞ্চল তসর শিল্পে এত উন্নতি লাভ করছিল যে এখানকার তাঁতিরা খুবই সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করতো। এই সময়ে কেশিয়াড়ি রুমাল তৈরিতেও প্রসিদ্ধ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। কোম্পানির হুগলি কারখানার প্রধান কার্যাধক্ষ্যের ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে লেখা চিঠি থেকে জানতে পারা যায়- কেশিয়াড়িতে তৈরি রুমাল প্রত্যেকটির মূল্য ৫ টাকা থেকে ৫।।০ টাকা পর্যন্ত ছিল। এই সমস্ত রুমাল ইউরোপিয়দের ব্যবহারের জন্যে ইংরেজ বণিকরা কিনত ও রপ্তানি করত।
কিন্তু প্রায় উনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে এই তসর শিল্পের অবনতি হতে থাকে। কারণ ওই সময়ে মেশিনে তৈরি ইউরোপিয়ান সিল্ক পণ্য আমদানি হতে থাকে। ফলে তাঁতিরা আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারল না। ক্রমে এমন অবস্থা দাঁড়ালো, সুদক্ষ তাঁতিরা সেই সময় অভিযোগ করতে শুরু করলেন যে, তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য তাদের পক্ষে তখন মাসে ১০ টাকা রোজগার করাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে উৎপাদন কমতে শুরু করায় তাঁতিদের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকলো। এভাবেই এককালের উৎকৃষ্ট মানের তসরশিল্প পণ্যের কেন্দ্র প্রায় অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলল।
midnapore.in