হিজলী হত্যাকান্ড ও রবীন্দ্রনাথের “প্রশ্ন” কবিতা
Hijli killing and Rabindranath's poem "Prashna"
অখিলবন্ধু মহাপাত্র।
১৯৩১ এর ১৬ সেপ্টেম্বর হিজলী বন্দীনিবাসে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল। প্রাণ দিয়েছিলেন দুই বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র এবং তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। ১৮ সেপ্টেম্বর এই দুই বিপ্লবীর মৃতদেহ নিতে খড়্গপুর শহর সংলগ্ন হিজলী বন্দীনিবাসে উপস্থিত হয়েছিলেন স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ২০২২ সারা দেশের কাছে অত্যন্ত গর্বের, প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূর্যকে অস্তাচলে পাঠিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ তম বর্ষপূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণ। সমগ্র দেশে যখন 'আজাদিকা অমৃত মহোৎসব' এর সাড়ম্বর আয়োজন তখন 'শহিদ তীর্থ' মেদিনীপুরের মাটিতে খড়্গপুর আই আই টি'র পুরাতন ভবন অর্থাৎ হিজলী শহীদ ভবনের নেহরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি'র একটি সুসজ্জিত কক্ষে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সম্বলিত প্রদর্শনী কক্ষ তালা বন্ধ। বারবার ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেও কাজের কাজ হয়নি। আশ্বাস এসেছে তবুও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের স্মৃতি রোমন্থনের উৎসমুখ গভীর অন্ধকারে। আজ ২০২২ এর ১৬ সেপ্টেম্বর আবারও পালিত হবে শহিদ দিবস, খুলবে না একাধিক প্রদর্শনী কক্ষের দরজা। দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতি মন্ত্রী, রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা সকলের কাছে বিনীত আবেদন করেছি কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ আজও গ্রহণ করা হয়নি। অথচ হিজলী শহীদ ভবন, পূর্বের হিজলী বন্দীনিবাস এক রক্তক্ষয়ী, জীবন দান করার ইতিহাসের সাক্ষী।
Nehru museum of science and technology. Photo: Arindam Bhowmik
১৯৩১ এর ১৬ সেপ্টেম্বর । আজ যেখানে খড়্গপুর আই আই টি যা ভারতবর্ষের প্রথম আই আই টি বলে পরিচিত,সেখানে একসময় বন্দীদের আটকে রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল হিজলী বন্দীনিবাস।বৃটিশের কথায় Midnapur Is Land Of Revolt বা বিপ্লবের পীঠস্থান।সেই বিপ্লবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলা তথা মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের সায়েস্তা করতে যে বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৩১ এর ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে। বন্দীনিবাসের পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে অত্যাচারী সাশক ইংরেজ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল দুই বীর বিপ্লবীকে। একজন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী সন্তোষ কুমার মিত্র এবং অন্যজন মাষ্টারদা সূর্য সেনের অনুগামী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত।পরিকল্পিতভাবে রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে এইগুলি চালনার ঘটনায় শুধু দুই বীর বিপ্লবীর মৃত্যু নয়, আহত হয়েছিলেন প্রায় ৪০ জন বিপ্লবী। হিজলী বন্দীনিবাসের এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত “প্রশ্ন” কবিতা। যার প্রথম লাইন
“ ভগবান তুমি যূগে যূগে দূত পাঠায়েচ্ছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে”।
আজও প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে ১৬ সেপ্টেম্বর। বিশ্বকবির প্রতিবাদী কবিতা, নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের খড়্গপুরে আগমন এবং দুই বিপ্লবীর মৃতদেহ ফেলে রেখে আন্দোলনকে স্মরণ করার দিন।দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে খড়্গপুর আই আই টি’র পুরাতন অট্টালিকা,কয়েক বছর আগে যার নামকরণ করা হয় ‘হিজলী শহিদ ভবন’। ভবনে তৈরি হয়েছে নেহেরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি।কিন্তু সেদিনের সেই ইতিহাস আজ অনুচ্চারিত। এইপ্রজন্মের কাছে সেদিনের সেই ইতিহাস তুলে ধরার কোন উদ্যোগ যেমন নেই তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের এই স্মৃতিসৌধকে জনসমক্ষে নিয় আসার ও কোন পরিকল্পনা নেই। কারন ‘হিজলী শহিদ ভবন’ আজ প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে, হাই সিকিউরিটি জোন বলে পরিচিত খড়্গপুর আই আই টির নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে।সাধারনের নাগালের একেবারে বাইরে।অথচ ‘হিজলী শহিদ ভবন’ প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন একটি অট্টালিকা।প্রতি বছর খড়্গপুর আই আই টি’র নেহেরু মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ১৬ সেপ্টেম্বর এই ভবনের পাশে শহিদচকে শহিদ দিবস টুকু পালন করেন।এইটুকু চর্চাতেই সীমাবদ্ধ থাকে সেদিনের রক্তঝরা কাহিনী জনমানসে তুলে ধরার প্রয়াস।অথচ এই ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা, ইংরেজের বর্বরোচিত অত্যাচার এবং দেশজোড়া প্রতিবাদের ঝড় সব মিলিয়ে একটি ইতিহাস আজও ‘নীরবে নিভৃতে’।
Santosh Kumar Mitra and Tarakeswar Sengupta, were shot dead by the Indian Imperial Police.
প্রথম থেকেই মেদিনীপুর ছিল বৃটিশ রাজশক্তিকে উতখাত করার আন্দোলনের দূর্ভেদ্য ঘাঁটি। অবিভক্ত মেদিনীপুর (বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়্গ্রাম জেলায় বিভক্ত) ইংরেজদের কাছে ছিল আতঙ্কের। এতবড় জেলাকে শাসন করার চেয়ে এই ভৌগলিক সীমানায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য বীরবিপ্লবীকে সায়েস্তা করা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা বৃটিশ শাসকের কাছে। তাই ১৯১৮ সাল নাগাদ মেদিনীপুর জেলাকে ভাগ করে আলাদা হিজলী জেলা তৈরির পরিকল্পনা নিল ইংরেজ।প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয় সুবিশাল মেদিনীপুর জেলাকে ভাগ করে খেজুরীর হিজলী বন্দর সংলগ্ন এলাকাকে নিয়ে তৈরি হবে নতুন হিজলী জেলা। যার সদর হবে কাঁথি বা কন্টাই।নানাকারনে শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা পরিবর্তন করে হিজলী নাম রেখে নতুন হিজলী জেলার পরিকল্পনা শুরু হয় খড়্গপুর সংলগ্ন জঙ্গলে ঢাকা হিজলী এলাকাকে সামনে রেখে। ‘ভাগ করে শাসন করা’র নীতিতে বিশ্বাসী ইংরেজের অন্যতম শাসক মিষ্টার কার্লাইল নতুন এই পরিকল্পনাটি করেন। এই পরিকল্পনা মত হিজলী ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৮ হাজার একর জমি নিয়ে হিজলী জেলার রূপরেখা বাস্তবায়িত হতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে নতুন হিজলী জেলার কাজ শুরু হবে। সেইমত ভবনগুলি নির্মাণের কাজ চলে জোরকদমে। অধ্যাপক অজয় রায়ের মত গবেষকদের মতে তদানীন্তন চরম আর্থিক সঙ্কট ইংরেজসরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বহু আগে থেকেই চরম বিরোধিতা করেন মেদিনীপুরের সাধারন মানুষ। তবে সেই বিরোধিতার আর প্রয়োজন হলনা।সম্পূর্ণ হলনা পরিকল্পনা রূপায়ন। অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় থেকে গেল নির্মিয়মান আদালত ভবন, প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি। দীর্ঘ কয়েক বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় এই ভবনগুলি পড়ে থাকার পর ১৯৩১ সালে হিজলী জেলা পরিনত হল হিজলী জেলখানা বা বন্দীনিবাসে।দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহের আগুন আর সেই আগুনে ঝাঁপ দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংখ্যা দিন বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন হয় শাসকগোষ্ঠী। প্রয়োজন হয় বিশাল জেলখানার। প্রস্তাবিত হিজলী জেলার নির্মিয়মান ভবনগুলি সেই অভাব অনেকটাই পূরণ করতে সক্ষম হয়।
১৯২৯ এর লাহোর কংগ্রেসে গৃহিত প্রস্তাব অনুসারে ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হল দেশ জুড়ে। অবিভক্ত মেদিনীপুরের নরঘাট, পিছাবনী, তমলুক, ঘাটাল, চেঁচুয়াহাট প্রভৃতি জায়গায় মেদিনীপুরের অত্যাচারী জেলাশাসক জেমস পেডির নেতৃত্বে গুলি লাঠি চলে। বহু মানুষ শহিদ হন। বহু বিপ্লবী গ্রেপ্তার হলেন।হাজার হাজার বিপ্লবীকে বন্দী করে দিশেহারা হল বৃটিশ পুলিশ। বাধ্য হয়ে হিজলী জেলার নির্মিয়মান ভবনগুলিকেই জেলখানা বা বন্দীনিবাস হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হল। তবে জেলখানার মত কঠোর ছিলনা বন্দীনিবাস। বরং অনেকটাই খোলামেলা পরিবেশে বিপ্লবীদের আটক করে রাখা হল কড়া নজরদারিতে।পুরুষবন্দীদের যে ভবনটিতে রাখা হত সেটি দৈর্ঘে ছিল প্রায় ২৮০ ফুট এবং চওড়ায় প্রায় ৮০ ফুট। এটাই ছিল পরিকল্পিত নতুন জেলার কালেক্টরেট ভবন। ভবনের সিঁড়ির উপর ছিল প্রায় ২৮০ ফুট লম্বা একটি ওয়াচ টাওয়ার। খেলার মাঠ, রান্নাঘর এবং চিকিতসাকেন্দ্র ইত্যাদি।বন্দীনিবাসের বহু বন্দী বিপ্লবীর লিখে যাওয়া কাহিনী থেকে জানাগিয়েছে চারদিকে উঁচু পাঁচিল ও কাঁটা তারের বেড়া ছিল।মূল ভবনের পাশে কয়েকটি সেল থাকলেও তাতে কাউকে রাখা হত না।মূল ভবনের উপর কড়ানজরদারি থাকত বৃটিশ পুলিশের। বন্দীনিবাসের খবর বাইরে যাওয়ার কোন উপায় ছিলনা। এইসময় হিজলী বন্দীনিবাসের প্রধান অর্থাৎ কমান্ডেন্ট ছিলেন বি এইচ বেকার, আর রক্ষীবাহিনীর প্রধান ছিলেন মিঃমার্শাল।
হিজলীর পুরুষদের এই বন্দীনিবাসের কিছুটা দূরে তৈরি করা হয়েছিল মহিলাদের বন্দীনিবাস। যা এখন মাতঙ্গিনীহাজরাভবন নামে পরিচিত। বিচারাধীন বহু মহিলাবন্দীকে এখানে আটক করে রাখা হত। পুরুষ বন্দীদের মত মহিলাদের ও অনেকটা খোলামেলা পরিবেশে আটকে রাখত শসককুল। এটাই মহিলাদের এই বন্দীনিবাসই দেশের প্রথম মহিলাজেলখানা। বন্দীনিবাসের অভ্যন্তরেই ছিল একটি হাসপাতাল ও। মহিলারা অসুস্থ হলে রাখার ব্যবস্থা ছিল।
Prison cell of hijli detention camp. Photo: Arindam Bhowmik
এই দুটি বন্দীনিবাসের বন্দীরা নিজেদের মধ্যে নানান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও করতে পারতেন। নাচ, গা্ন, সাহিত্যসভা,মহাপুরুষের জন্মদিন পালন ইত্যাদির ও আয়োজন করা হত।
১৯৩১ এর ২৪মার্চের পরিবর্তে ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় পাঞ্জাবের লাহোর (এখন যা পাকিস্তানে) জেলে বীরবিপ্লবী ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হল।এরই প্রতিশোধ নিতে মেদিনীপুরের বিপ্লবীরাও থেমে থাকলেন না।১৯৩১ এর ৭ এপ্রিল মেদিনীপুরের দুই বীরবিপ্লবী জ্যোতিজীবন ঘোষ এবং বিমলেন্দু দাশগুপ্ত অত্যাচারী জেলাশাসক জেমস পেডিকে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে প্রদর্শনী দেখার সময় খুন করলেন।মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের এই কর্মকান্ডেড় কথা ক্রমে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লো। থেমে থাকলো না বৃটিশও। মেদিনীপুরের জেলাশাসক হয়ে এলেন আরও এক অত্যাচারী ইংরেজ শাসক রবার্ট ডগলাস।
Prison cell of hijli detention camp. Photo: Arindam Bhowmik
১৯৩১ এর ১৫ সেপ্টেম্ব্ লন্ডনে চলছে মহাত্মা গান্ধী ও আরউইনের মধ্যে গোল টেবিল বৈঠক। আর সেদিনই ঘটলো এক বিপত্তি। হিজলী বন্দীনিবাসের তিন বন্দী ফণি দাশগুপ্ত,চিন্তামণি দাস এবং নলিনী দাস রাতের অন্ধকারে ইংরেজ সিপাহীদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। এরপর বন্দীনিবাসের বন্দীদের উপর আরও কড়া নজরদারি শুরু হল। সেবছর ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলার ৩১ ভাদ্র। ৩১ ভাদ্র কথাসাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন কিভাবে পালিত হবে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন বন্দীরা। এমন সময় প্রবল চিৎকার শুরু হল। হঠাৎ কিছু সিপাহী চিৎকার করতে শুরু করলো “হুকুম মিলগয়া, শালালোগকো মারডালো”। তারপর রাতের অন্ধকারে শুরু হল চরম অস্থির এক পরিস্থিতি। বাজতে শুরু করলো বন্দীনিবাসের পাগলাঘন্টা। চললো এলোপাথাড়ি গুলি।বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্রের তলপেটে পর পর দুটি গুলি লাগায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। জীবনদীপ নিভলো তাঁর। আর আশঙ্কাজনক অবস্থাতেও অনেকটা সচল ছিলেন বীরবিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। কিন্তু তাঁকে লক্ষ্য করে বারবার গুলি চালনায় তাঁরও মৃত্যু হল। প্রভাত মল্লিক, গোবিন্দ দত্ত এবং শশী ঘোষ সহ প্রায় ৪০ জন আহত হলেন। বন্দীরাই আহতদের সাধ্যমত সেবা শুশ্রূষা করলেন।
ঘটনার কিছুক্ষণ পরে বন্দীনিবাসে পৌঁছান বেকার সাহেব। আগে থেকে, পরিকল্পনা মাফিক বেকার সাহেব এবং রবার্ট ডগলাস খড়্গপুরে ইউরোপিয়ান ক্লাবে হাজির ছিলেন। বেকারসাহেব বন্দীনিবাসের দায়িত্ব রক্ষীদের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন ক্লাবে সান্ধ্যকালীন প্রমোদে। বন্দীনিবাসে তখন তীব্র উত্তেজনা মৃত এবং আহতদের নিয়ে। আন্দোলনকারী বিপ্লবীদের বক্তব্য তাঁরা এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের বিচার চান। প্রচুর পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হল বন্দীনিবাস। এই ঘটনার খবর যাতে বাইরে ঘুনাক্ষরে কেউ না জানতে পারে তার জন্য সব ব্যবস্থা পাকা করলো ইংরেজ রাজশক্তি। বেশকিছু পুলিশ আর গাড়ি নিয়ে রেলওয়ে পুলিশসুপার হাজির হয়ে এক ঘৃণ্য মন্তব্য করলেন, “ ONLY TWO ARE DEAD, THEY SHOULD BE TAUGHT A GOOD LESSON”, বিপ্লবীদের বুঝতে দেরি হলনা এই ঘটনাটা আসলে পূর্ব পরিকল্পিত। আরও মৃত্যু চেয়েছিল রেলওয়ের পুলিশ সুপার। প্রথমে আহতদের রেলওয়ে হাসপাতালে বিপ্লবীরা নিয়ে যেতে বাধা দিলেও পরে বহুকষ্টে রাজি করানো সম্ভব হয়। আহতদের বি এন আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।আর বন্দীনিবাসে মৃতদেহ ফেলে রেখে বীর বিপ্লবীরা অনশন শুরু করলেন। ইংরেজ সিপাহীরা ঘিরে রাখলো গোটা বন্দীনিবাস। মাছি গলে যাওয়ার ও অবকাশ ছিলনা। এরই মাঝে মৃত তারকেশ্বর সেনগুপ্ত এবং সন্তোষ কুমার মিত্রের একটি স্কেচ পেন্সিলে আঁকলেন এক বিপ্লবী। অপর এক বিপ্লবী তৈরি করলেন ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট।পরেরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল থেকে এলেন বন্দী শ্রীমন্ত ভট্টাচার্য এবং কালিবিলাস ভট্টাচার্যের বিধবা মা। তিনি এসেছিলেন অনেক সাধ নিয়ে তাঁর বিপ্লবী ছেলেদের একবার চোখের দেখা দেখে যেতে।এই বিপ্লবীমা ঘটনার স্কেচ এবং রিপোর্ট নিয়ে সোজা ছুটলেন কলকাতায়।বিপ্লবীদের নির্দেশ মত আনন্দবাজার পত্রিকার দপ্তরে রিপোর্টটি তিনি দেন। আনন্দবাজার পত্রিকার দপ্তর হয়ে ঘটনার খবর পৌঁছায় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নেতাদের কাছে।নিরপরাধ বন্দীদের উপর নির্বিচারে গুলিচালনায় ক্ষোভে ফেটে পড়লো দেশ।পরেরদিন আনন্দবাজার পত্রিকা হিজলীবন্দীনিবাসে গুলিচালনার ঘটনা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করল।
Nehru museum of science and technology.
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তখন প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি। এই নারকীয় হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে তিনি দুই কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত এবং নৃপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর সোজা হিজলীতে উপস্থিত হলেন। প্রথমে ইংরেজের পুজলিশ তাঁকে হিজলী বন্দীনিবাসে যেতে বাধা দেয়। বাধ্য হয়ে খড়্গপুর ষ্টেশনেই সুজভাষচন্দ্র অনশনে বসার হুমকী দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই পুলিশ তাঁদের হিজলীতে যাওয়ার অনুমতি দেয়। হিজলী বন্দীনিবাসে নির্বিচারে গুলিচালনার কাহিনী শুনে স্তম্ভিত হন নেতাজী ও তাঁর দুই সহকর্মী। নেতাজী অনশনরত বন্দীদের সঙ্গে কথা বলেন। বি এন আর এর শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা মিষ্টার গডবাল ট্রেনে বিশেষ কফিনে মৃতদেহ দুটি কোলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।১৮ সেপ্টেম্বর কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে নেতাজী ও তাঁর দুই রাজনৈতিক সহযোদ্ধা দুই বিপ্লবীর মৃতদেহ নিয়ে কলকাতায় রওনা দিলেন। হাওড়া ষ্টেশনে সেই ট্রেন পৌঁছানোমাত্র আছড়ে পড়েছিল এক জনসমুদ্র। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হাজারহাজার মানুষের মৌণমিছিল হাওড়া থেকে কেওড়াতলা মহাশ্মশন পর্যন্ত তৈরি হয়েযায়। হিজলী বন্দীনিবাসে গুলিচালনার ঘটনায় গোটাদেশ ক্ষোভে ফুঁসলেও শোকে বাকরুদ্ধ ছিল বিপ্লবী সন্তোষকুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্তের শেষযাত্রা।
সন্তোষকুমার মিত্র ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রেসিডেন্সী কলেজের সহপাঠী। নেতাজী সুভাষের মত সন্তোষকুমার মিত্র ও ছিলেন দৃঢ়চেতা। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলোনের সাথে যুক্ত হন। প্রথমে তিনি স্বরাজ সেবক সংঘ নামে একটি সংগঠন গড়ে বৃটিশের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। পরে শাঁখারিতলা হত্যা মামলা এবং আলিপুর বোমা মামলায় জড়িয়ে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেন। বিপ্লবী মুজফফর আহমেদের সঙ্গে থেকে দীর্ঘদিন কৃষক আন্দোলোনেও নেতৃত্ব দেন তিনি। নাথামা আন্দোলোনকারী হিসেবে সন্তোষকুমার মিত্র ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ।সারাবাংলা যুবলীগের তিনি ছিলেন অগ্রনী সেনা।
আর বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামের ভূমিপুত্র তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য সেনের বিশ্বস্ত অনুগামী। মাষ্টারদার নেতৃত্বে কখনো মানুষের সেবার নামে আবার কখনো সরাসরি স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এবং জালালাবাদের বিপ্লবীদের নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন সন্তোষকুমার মিত্র।
তবে হিজলী বন্দীনিবাসে এইদুই বীর বিপ্লবী ছাড়াও যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বাধীন ভারতের দুটি রাজ্যের চার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী, প্রফুল্ল সেন, প্রফুল্ল ঘোষ, নৃপেন চক্রবর্তী। এছাড়াও এখানে বন্দী ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত,বিশ্বনাথ মুখার্জী, আব্দুল হালিম, নরেন সেন প্রমূখ। আর মহিলাদের মধ্যে ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, লীলা নাগরায়, কল্পনা দত্ত যোশী,বীনা দাস, কমলা দাশগুপ্ত,শান্তি দাস ঘোষ প্রমূখ। ২০১৬ সালে শান্তি দাসঘোষের শততম জন্ম জয়ন্তী পূর্ণ হয়েছে।
হিজলী হত্যাকান্ডের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল এই ঘটনার দুদিনের মধ্যে প্রাদেশিক কংগ্রেসের অভ্যন্তরে চলা দ্বন্দ্ব মিটে যাওয়া। ১৮ সেপ্টেম্বর দুই বীরবিপ্লবীর মৃতদেহ সতকারের পর স্বয়ং নেতাজী সুভাষ প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভায় বলেছিলেন, “আমি খড়্গপুর হইতে অবর্ণনীয় বেদনা লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। আমাদের বন্ধুদের জেলের মধ্যে কুকুর বিড়ালের মত গুলি করিয়া মারিবে ,আর আমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদে রত থাকিব? সকল বিভেদ ভুলিয়া আজ আ্মাদিগকে পরস্পরের সহিত মিলিত হইতে হইবে, শত্রুর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইতে হইবে”। একলহমায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরের বিভেদ মুছে গিয়েছিল। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এক বার্তায় এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করলেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় হিজলী হত্যাকান্ড নিয়ে নানান প্রতিবেদন প্রকাশ হল। বর্বর ইংরেজের হিংস্রতার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই ঘটনায়।
স্থির থাকতে পারলেন না স্বয়ং বিশ্ব কবি। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তাঁর বিখ্যাত প্রশ্ন কবিতা-
“ ভগবান,তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারেবারে
দয়াহীন সংসারে-
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’ বলে গেল ‘ভালোবাসো-
অন্তর হতে বিদ্বেষ বিশ নাশো’।
বরণীয় তারা ,স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।।
আমি যে দেখছি গোপন হিংসা কপট রাত্রি-ছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি – প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি যে দেখিনু তরুন বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথাকুটে।।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীত হারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।
তাইতো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে-
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ,তুমি কি বেসেছ ভালো?”
হিজলীর নারকীয় হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে শুধু “প্রশ্ন” কবিতা লিখে ক্ষান্ত থাকেননি ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করা আমাদের প্রিয় বিশ্বকবি। হিজলী হত্যাকান্ড ও চট্টগ্রাম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় একটি সভার আয়োজন করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর এর সিদ্ধান্ত মত ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হল কলকাতার টাউনহলে অনুষ্ঠিতব্য সেই সভার বিজ্ঞপ্তি। বলা হল হিজলী ও চট্টগ্রাম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। এইসভায় সভাপতিত্ব করবেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়,সুভাষ চন্দ্র বসু, স্যার নীলরতন সরকার,বীরেন্দ্রনাথ শাসমল,মহম্মদ আক্রম খাঁ, উর্ম্মিলা দেবী সহ প্রায় ১২ জন বক্তা। ২৬ সেপ্টেম্বর সভা শুরুর অনেক আগে থেকেই টাউন হলের দিকে এত মানুষ এলেন যে সভার সভপতি অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সেই ভীড় ঠেলে ভেতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলনা। বাধ্য হয়ে টাউনহলের পরিবর্তে মনুমেন্টের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি সভার ব্যবস্থা করা হল। উত্তর দিকের সভায় দাঁড়িয়ে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য রাখলেন। এই সভায় দাঁড়িয়ে বিশ্বকবি শুরু করেছিলেন, “ প্রথমেই বলে রাখা ভাল আমি রাষ্ট্রনেতা নই, আমার কর্মক্ষেত্র রাষ্ট্রীক আন্দোলনের বাইরে। কর্ত্তৃপক্ষদের কৃত কোন অন্যায় বা ত্রুটি নিয়ে সেটাকে আমাদের রাষ্ট্রীক খাতায় জমা করতে আমি বিশেষ আনন্দ পাইনে। এই যে হিজলীর গুলিচালনার ব্যাপারটি আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় তার শোচনীয় কাপুরুষতা ও পশুত্ব নিয়ে যাকিছু আমার বলবার সে কেবল অবমানিত মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে”। অনেকটা দীর্ঘ ছিল কবির লিখিত ভাষণ। আসলে কবি যে এই ঘটনায় নিদারুন আহত হয়েছিলেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল যেমন তাঁর কবিতায় , তেমনি তাঁর বক্তব্যেও। শুধু বিশ্বকবি নন,জাতিরজঙ্ক মহাত্মা গান্ধী সহ ভারতবর্ষের প্রখ্যাত বহু ব্যক্তিই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিলেন।
Nehru museum of science and technology. Photo: Arindam Bhowmik
আজও হিজলীর সেই বন্দীনিবাস দাঁড়িয়ে আছে । যেখানে শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে দেসের প্রথম কারিগরি উচ্চশিক্ষার আঁতুড়ঘর খড়্গপুর আই আই টি। বহুবছর পরে খড়্গপুরে আই আই টির প্রথম সমাবর্তনে যোগ দিতে এসে দেশের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুও স্মরণ করেছিলেন ১৯৩১ এর হিজলি হত্যাকন্ডের স্মৃতি, তাঁর সেদিনের দীক্ষান্ত ভাষণের শুরুতে। তবে হিজলী বন্দীনিবাস এখন হিজলী শহিদ ভবন নামে পরিচিত।ভবনের খানিকটা দূরে তৈরি হয়েছে ‘বোন্ডেজ টু ফ্রীডম’ শীর্ষক এক স্থায়ী প্রদর্শন কক্ষ। ২০০২ সালে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর হাতে লাগানো গাছ দিয়ে তৈরি হয়েছে দেশের প্রথম ফ্রীডম পার্ক। আর নেহেরু মিউজিয়ামে রয়েছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা সময়ে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা। আসলে শহিদতীর্থ মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সৌধটি জনসমক্ষে আনা প্রয়োজন। প্রয়োজন বর্তমান প্রজন্মের কাছে এইভবনের গুরুত্ব মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরার।
midnapore.in
(Published on 13.11.2022)
তথ্য সহায়তা :
● খড়্গপুর আই আই টি’র নেহেরু মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পত্র পত্রিকা
● অধ্যাপক ডঃ অজয় রায়ের সাক্ষাতকার।