হারিয়ে যাওয়া এক ধর্মের খোঁজে
In Search of a Lost Religion
তপন কুমার রনজিৎ।
ধর্ম দুর্বোধ্য৷ আবার ধর্ম হল বর্ম | বীরকুলের কূলে কূলে নানা নামের দেব-দেবীর সমাহার ৷ নামের পাশে এক একটি ধর্মের ধর্মীয় ছাপ ৷ এই খণ্ডের ঈশাণ কোণে প্রাচীন এক জনপদ মৈতনা- ডেমুরিয়া ৷ তিন ছাপমার্কা তিন দেব-দেবী ও তাঁদের বাসস্থান ৷
পিছলদা নদী অগ্নিকোণে শৌলার কোলে আশ্রয় খুঁজে পেল ৷ দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুরে বঁয়াকে ঘিরে কতই না উপকূলীয় মিথ৷ উপকূলরেখা বরাবর অতীতের 'বোধিপত্রক বন্দর' (বোধড়া) ৷ প্রাচীন ও রক্ষণশীল বৌদ্ধ থেরবাদী সম্প্রদায়ের এক মঠ ৷ দেব বা দেবী এক প্রস্তরখণ্ড মাত্র ৷ পরবর্তী সময়ে লোকায়ত ধর্মের সঙ্গে বিবর্তিত পরিবর্তিত হয়ে দেবী পথেশ্বরী থেকে সপ্তমাতৃকার দেবী পন্থেশ্বরী ৷ চাঁদপুর থেকে চন্দনেশ্বর (হুগলি ) উপকূলীয় অরণ্যাঞ্চল ঘিরে কাপালিকগণের চারণভূমি ও সাধনস্থল ৷ বীরকুল নদী মোহনার সঙ্গমস্থলে প্রস্তর মূর্তি নায়কালী ৷ দেবীর সাধন পন্থা দিক নির্দেশ করে নাথধর্মের দিকে ৷ নাথপন্থীরাই বাংলার আদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উত্তরসূরি ৷ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যুগের দাবী মেনে এঁদের গ্রহণ করেছেন কিন্তু স্থান দিয়েছেন সমাজের নীচুস্তরে ৷ কিংবদন্তী ইতিহাসবিদ ও গবেষক নলিনী ভট্টশালী বলেছেন, "নবম , দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষ মন্ত্রযানের সঙ্গে শৈবধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হয়ে নাথপন্থের সৃষ্টি " ৷ দ্বাদশ শতকে বৌদ্ধধর্মের খ্যাতি ক্রমশঃ মলিন ৷ আপোষের পথে চলেছে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ৷ বৌদ্ধ ধর্মের নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শিব ও মহামায়াকে সংযুক্ত করে প্রাচীন লোকায়ত ধ্যান ধারনার মিলনে নাথধর্মের জন্ম | দেবী নায়কালী সপ্তমাতৃকা কুলেরই এক দেবী - এ তথ্য প্রমাণিত ৷
(১) সাতভৌনিঃ আদিম জনজাতির এই দেবী ধর্মীয় বিবর্তনের নোনা হাওয়ায় হয়েছেন - 'সাতভৌনি' ৷
(২) নাগা মঠঃ উপকূলীয় মালঝিটা বা মালছিটা লৌকিক ভাষার ঠেলায় পড়ে 'লাগা' মঠ-এ রূপান্তরিত ৷ বৌদ্ধধর্মের জোয়ারে সনাতন ধর্ম দিশেহারা ৷ সঙ্কটকালে অদ্বৈত মতবাদী শংকরাচার্যের নেতৃত্বে সনাতন ধর্ম সুসংগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ৷ পাহাড়, পর্বত ,অরণ্য থেকে মহাসাগর - চারদিক সনাতনী জনতা স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলে আবদ্ধ ৷ এই ধারার শৈব উপাসকগণ নিজ নিজ সাধনক্ষেত্র থেকে সাগরের পথে ৷ স্থল পথের সমাপ্তি ৷ ভূখণ্ডের অন্তিম আশ্রয়স্থল ৷ বিচিত্র দর্শণ নাগা সন্ন্যাসীর সান্নিধ্য লাভে উপকূলীয় জনজাতি উদগ্রীব উৎসুক ৷ দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত এই মঠে আরাধ্য রাম-সীতা-লক্ষ্মণ - হনুমান ৷ বর্তমানে লাগা মঠে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া - নাম তার মহাবীর মঠ ৷
(৩) ডেমুরিয়ার জগন্নাথঃ জমিদার মগ্নি নারায়ণের শ্রীক্ষেত্রধামে যাওয়ার পথে বিঘ্ন ৷ কল্পতরু মাধব ৷ ভেসে এল কাষ্ঠখণ্ড ৷ গড়া হল মূর্তি ৷ প্রতিষ্ঠা পেলেন জগন্নাথ৷ ডেমুরিয়া হয়ে উঠল শ্রীক্ষেত্র ৷
নায়কালী দেবী (খাস)। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
পিছলদা নদী অগ্নিকোণে শৌলার কোলে আশ্রয় খুঁজে পেল ৷ দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুরে বঁয়াকে ঘিরে কতই না উপকূলীয় মিথ৷ উপকূলরেখা বরাবর অতীতের 'বোধিপত্রক বন্দর' (বোধড়া) ৷ প্রাচীন ও রক্ষণশীল বৌদ্ধ থেরবাদী সম্প্রদায়ের এক মঠ ৷ দেব বা দেবী এক প্রস্তরখণ্ড মাত্র ৷ পরবর্তী সময়ে লোকায়ত ধর্মের সঙ্গে বিবর্তিত পরিবর্তিত হয়ে দেবী পথেশ্বরী থেকে সপ্তমাতৃকার দেবী পন্থেশ্বরী ৷ চাঁদপুর থেকে চন্দনেশ্বর (হুগলি ) উপকূলীয় অরণ্যাঞ্চল ঘিরে কাপালিকগণের চারণভূমি ও সাধনস্থল ৷ বীরকুল নদী মোহনার সঙ্গমস্থলে প্রস্তর মূর্তি নায়কালী ৷ দেবীর সাধন পন্থা দিক নির্দেশ করে নাথধর্মের দিকে ৷ নাথপন্থীরাই বাংলার আদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উত্তরসূরি ৷ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যুগের দাবী মেনে এঁদের গ্রহণ করেছেন কিন্তু স্থান দিয়েছেন সমাজের নীচুস্তরে ৷ কিংবদন্তী ইতিহাসবিদ ও গবেষক নলিনী ভট্টশালী বলেছেন, "নবম , দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষ মন্ত্রযানের সঙ্গে শৈবধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হয়ে নাথপন্থের সৃষ্টি " ৷ দ্বাদশ শতকে বৌদ্ধধর্মের খ্যাতি ক্রমশঃ মলিন ৷ আপোষের পথে চলেছে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ৷ বৌদ্ধ ধর্মের নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শিব ও মহামায়াকে সংযুক্ত করে প্রাচীন লোকায়ত ধ্যান ধারনার মিলনে নাথধর্মের জন্ম | দেবী নায়কালী সপ্তমাতৃকা কুলেরই এক দেবী - এ তথ্য প্রমাণিত ৷
পঁতেই ঘাটে (ভোগরাই ) নৌকা আসছে জামকুন্ডা থেকে (সুবর্ণরেখা নদী)। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
দেবী সিঁদুরমুড়ি (জয়রামপুর)। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার অদৃশ্য সীমারেখা অতিক্রান্ত | বায়ুকোণে তালসারি, চন্দ্রাবলী, কীর্তনীয়া, ফুলবনী , জয়রামপুর (কিরাতগড়) হয়ে সুবর্ণরেখার এক নদী ঘাট - 'পঁতেই ঘাটো' ওপারে বালিয়াপালের জামকুণ্ডা ৷ সমুদ্র ও নদীর মিশ্র কর্মফল 'ত্রিভূজাকৃতি ভূমিখণ্ড ৷ গজিয়ে ওঠা বনাঞ্চল সাতকুশী ৷ চন্দনেশ্বর, ভূষণ্ডেশ্বর, নৌকালি, সিঁদুরমুড়ি, চতুর্ভুজা তারা - শৈব, লোকায়ত ও বৌদ্ধ -উপসনাস্থল এবং দেবদেবীর মন্দির | ক্ষেত্রসমীক্ষক শ্রী অরবিন্দ মাইতি মহাশয় উল্লেখ করেছেন, "সমগ্র বীরকুলখণ্ড বহুপূর্বে সমুদ্র থেকে জেগে ওঠে ৷অষ্টম শতাব্দীতে তাম্রলিপ্তের গৌরবরবি অস্তমিত হওয়ার বহু পূর্বে জয়রামপুর তার গৌরব মহিমায় গৌরবান্বিত হয়েছিল ৷ এখানে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, বন্দর এবং মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাস্থল এবং বৌদ্ধ দেবদেবীর মন্দির | সপ্তম শতাব্দীতে মহারাজ শশাঙ্কের সমসাময়িক মহারাজা গোপচন্দ্রের তাম্রলিপি পাওয়া গেছে ৷"
চন্দনেশ্বর মন্দির। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
পদ্মনাভ , গদাধর (চন্দনেশ্বর )। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
শৈবতীর্থ চন্দনেশ্বরে প্রাপ্ত গদাধর , পদ্মনাভ , গনেশ ও নন্দী মূর্তির ধরণ ও গড়ন বৌদ্ধধর্মের মহাযানী এক শাখার দাবীদার৷ চন্দনেশ্বর শৈবতীর্থে লিঙ্গ পূজার বদলে শিবপূজার প্রথা ৷ ৷চন্দনেশ্বর অলিঙ্গক ৷ জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কথা ও কাহিনী ৷ দক্ষযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, দক্ষকে নিধন করে শিবের প্রলয় তাণ্ডব ৷ বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্রে দেবীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড | ৫১ পিঠের জন্ম | চক্রের গায়ে লেগে থাকা সতীর রুধি , মেদাংশ মহাসাগরে ধৌত করা হলো ৷ বিচ্ছিন্ন মেদাংশের সংযুক্তিতে সতীমেদ এসে আটক পড়ল হুগলির (হোগলা জঙ্গল) চন্দন গাছের গোড়ায় ৷ সতীমেদের জন্যই যোনিপীঠ যুক্ত সুড়ঙ্গে হয় পূজা ৷ চন্দনেশ্বরে হরগৌরী উভয়ের সমন্বয়ে যোনি বেদিকা যুক্ত অলিঙ্গক শৈবতীর্থ | এই তীর্থ গড়ে ওঠার পূর্বে গভীর অরণ্যে ছিল সিদ্ধ যোগীর সাধনক্ষেত্র ও ছিল তাঁর এক ভৈরবী ৷ তাছাড়া তান্ত্রিক যোগী কাপালিক ভৈরবানন্দ দেবী জাহাজীমঙ্গলা ও দেবী কালচণ্ডীর উপাসক ৷ প্রতি অমাবস্যা রাতে নরবলি দিয়ে দেবীকে তুষ্ট করতে হতো৷ লোকায়ত ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আকর্ষণ - বিকর্ষণের স্পষ্ট রেখাচিত্র ধরা দেয় এই শৈবতীর্থে ৷
গনেশ (চন্দেনেশ্বর)। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
কিরাত গড়ে প্রাপ্ত চতুর্ভুজা তারা ( জয়রামপুরে সিঁদুর মুড়ি মন্দিরে রয়েছে)। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
তান্ত্রিক সিদ্ধযোগী দেবীগিরি সন্ন্যাসীর আরাধ্যা দেবী ভোগরাইবাশুলি ৷ প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন৷ ভোগরাই, মানকুন্ডা হয়ে দক্ষিণ- পশ্চিম বাংলার সীমারেখার নৈঋত কোণে পদুবাড়ে দেবী লঙ্কেশ্বরী ৷ পৌরাণিক বৃত্তে রাবণের আরাধ্যা , অবতার তত্ত্বে বরাহ , এখানে তিনি দেবী নয় দেব ৷ ব্রাহ্মণ্য ধারায় ভূদেবী বরাহী ৷ বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মে অবলোকিতেশ্বরের শক্তি তারা৷ আবার বৈরোচন কুলের দেবী মারীচী ৷ প্রাচীন লোকায়ত ভাবনায় দেবী বারাহী- সপ্তমাতৃকা | বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু -দেবীর শূকরাকৃতি মুখমণ্ডলকে ঘিরে ৷ যাঁকে নিয়ে এত কিছু তিনি নিঃশ্চুপ ৷ কালাপাহাড়ের তলোয়ারের আঘাতে কাটা পড়ল দেবীর হাত ও স্তনযুগল ৷ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সামনে তিন রাস্তা ৷ বাঁচতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো নতুবা মরো ৷ নতুবা তলে তলে হিন্দুধর্মে তলিয়ে যাও ৷
সন্ধান - অনুসন্ধানে উঠে আসে ধ্বজাধারীগণ নিজেদের ধর্মীয় পসরা , বনিকরা পণ্যের পসরা , ক্ষমতালোভী থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে হাজির উপকূল থেকে কূলে - জলপথ থেকে স্থলপথে ৷পঁতেই ঘাটো থেকে পূর্বদিকে আদ্যিকালের এক স্থলপথ ভোগরাই, মানকুন্ডা মীরগোদা , পদুবাড়, দেপাল , মানিকাবসান হয়ে মৈতনা ৷ স্থলপথের ইতি৷ দেপালের কাছে মিশে গেল অধুনা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র সরণিতে (রামনগর - কুদি - এগরা )৷ কুদি থেকে পশ্চিমে মোহনপুর হয়ে দাঁতন ৷ মিশে গেল জগন্নাথ রাস্তায় ৷ দাঁতন থেকে হেলেদুলে মেদিনীপুর |অহল্যাবাঈ রোড ( বর্ধমান - রানিগঞ্জ) উত্তর থেকে গড়বেতা শালবনীর ভেদ করে মেদিনীপুর | গড়মান্দারণ থেকে চন্দ্রকোণা হয়ে বাদশাহী রোড মিশে গেল অহল্যাবাঈ রোডে | বীরকুল খণ্ড তথা তাম্রলিপ্তের সংযুক্তি ঘটল উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ভারতে ৷
মহাবীর মঠ (বকশিস পুর_ মৈতনা) - নাগা মঠ। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
বঁয়া ( দক্ষিণ পুরুষোত্তম পুর )। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
হারিয়ে গেল কোথায়? খুঁজতে খুঁজতে আদিম লোকায়ত , বৌদ্ধ, হিন্দু ,শাক্ত, তন্ত্র, বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্ম ও তাদের নানা সম্প্রদায়, ভাগ, বিভাগ,ধারা, উপধারার জটিল আবর্তের ঘূর্ণাবর্তে ঘূর্ণায়মান৷ ঝাপসা চোখে মহাভারতীয় এক জলছবি- বেচারা! বিষ্ণুর উপাসক তাম্রধ্বজ৷ কৃষ্ণ -অর্জুনের রথ আটকে দিয়ে মহা ফাঁপরে ! পূর্ব ভারতে অনার্য- আর্যের করমর্দন । সময়ের ব্যবধানে বৌদ্ধ ধর্ম বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল জনমানসে ৷ অশোক কলিঙ্গে উদ্দেশ্য পূরণ করেই বিজ্ঞাপনী কায়দায় বৌদ্ধধর্মকে আন্তর্জাতিক তকমা এনে দেন ৷ কণিষ্ক ধর্মীয় বিবাদ ও বিভেদের সীমারেখা ঘোচাতে গিয়ে মহাযানী ধর্ম নিয়ে মেতে ওঠেন ৷ ধর্ম রেশমি পথ ধরে চীন হয়ে জাপান- কোরিয়া'য় ৷ 'মহাযানীধর্ম নিজেকে জনপ্রিয় করার অভিপ্রায়ে স্থানীয় লৌকিক ধর্মবিশ্বাস সমূহের সঙ্গে আপোষ করেছিল বলেই অসংখ্য স্থানীয় দেবদেবীকে বৌদ্ধ ধর্মে দেখা যায় ' ৷ মন্তব্য করেন, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য৷ বসুমিত্রের দাদা অসঙ্গ পর্বত ও অরণ্যের সুবৃহৎ কৌম সমাজকে বৌদ্ধধর্মের সীমার মধ্যে আকর্ষণ করার জন্য ভূত, প্রেত যক্ষ, রক্ষ, যোগিনী, ডাকিনী , পিশাচ ও মাতৃকাতন্ত্রের নানা দেব- দেবীকে মহাযান দেবতায়নে স্থান দেন এবং নানা গুহ্য, মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী প্রভৃতিকে মহাযান ধ্যান কল্পনায়, পূজাচারে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে অনুমোদন করেন ৷এক সময় তো তথাকথিত হিন্দু নামে পরিচিতদের ত্রাহি ত্রাহি রব ৷ শঙ্করাচার্যের সৌজন্যে সনাতনীদের মান বাঁচে ৷ সেই শুরু। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য - উভয় সম্প্রদায় নিজেদের প্রভাবসীমা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আদিম কৌম সমাজের সামনে উপস্থিত ৷ এই সমাজও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও ধ্যানধারণা ও দেবদেবী নিয়ে মিলিয়ে যায় উভয় সম্প্রদায়ে ৷ এই রূপান্তরের গতি আসে অষ্টম - নবম শতকে ৷ সপ্তম শতকে বন, পর্বত দেশসমূহের সঙ্গে উপকূলীয় সম্পর্ক স্থাপিত হয় ৷ ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রদৌত্য বিনিময়, সমরাভিযাণ প্রভৃতিকে আশ্রয় করে আদিম সংস্কার ও সংস্কৃতির স্রোত প্রবাহিত হয় বাংলা-বিহারে তথা পূর্ব ভারতে ৷ সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবক্ষয়ের সূত্রপাত৷ শূন্যস্থানে শৈব ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিকাশ ও বিস্তার ৷
ই-সিঙ (৬৭৯ খ্রিঃ) তাম্রলিপ্ত ও তার আশেপাশে পাঁচ- ছয়টি বৌদ্ধ বিহার দেখেন ৷ অর্থাৎ হিউয়েন সাঙ বর্ণিত দশটি বিহারের মধ্যে চারটি বিলুপ্ত বা শ্রেষ্ঠী সওদাগরদের ব্যবসা-বানিজ্যের প্রয়োজনে দখলিকৃত ৷ তাঁর দেখা ৬টি বিহারের মধ্যে তিনটি আবিষ্কৃত - রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, নন্দদীর্ঘিকা এবং মোগলমারীতে 'শ্রীবন্দক মহাবিহার' (৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দী) I তিনি তাম্রলিপ্ত সংলগ্ন 'পো - লো- হো' বা বরাহবিহারের সমৃদ্ধির কথা বলেছেন ৷ তবে তা আজও আবিষ্কৃত হয়নি ৷ তবে অনুমান বরাহবিহার বাহিরী বা পদুবাড় বা কীর্তনীয়ার ভূষণ্ডেশ্বর শৈবতীর্থে খোঁজ পাওয়া সম্ভব৷ তবে এটা নিশ্চিত, উপরিউক্ত তিন জায়গায় উৎখনন করলে তিন-তিনটি মহাবিহার পাওয়া যাবে ৷ ই-সিঙ এর দেওয়া হিসেব মিলে যাবে ৷অষ্টম - দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বজ্রযানী বৌদ্ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ পূর্ব ভারতে দ্রুতগতিতে হয় ৷ কিন্তু এয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে মুসলমান আক্রমণের অভিঘাতে বজ্রযান নিষ্প্রভ হয়ে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায় ৷ বজ্রযানীরা হিন্দুসমাজে মিশে যায়, নতুবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ৷ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় চৈতন্যদেব বহু বজ্রযানীকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন ৷
বঁয়াকালী। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
পুরোনো নাগা মঠ। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
ভারতের মাটিতে বিকশিত বৌদ্ধধর্ম সমন্ত জনজাতিকে আপন করে নিয়ে সকলকে সমষ্টিতে মিলিয়ে অহিংসা সহিষ্ণুতার বার্তা দিয়ে লোকায়ত ধর্ম , শাক্ত- তন্ত্র ও হিন্দুধর্মের মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেও বহির্বিশ্বে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত ৷ উপকূলীয় জনজাতির জীবনাচরণের আদর্শ বুদ্ধের নির্দেশিত ব্রত- 'অষ্টাঙ্গিক মার্গ' ৷ বাঙালির মননে চিরভাস্বর - 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ' ৷
midnapore.in
(Published on 23.10.2022)
তথ্যসূত্রঃ-
১ | প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (২য় খণ্ড) - সুনীল চট্টোপাধ্যায় |
২ | ভগবান বুদ্ধ--ধর্মানন্দ কোশাম্বী ৷
৩ | বৌদ্ধধর্মের অধঃপাত -হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ (তৃতীয় খণ্ড) |
৪ | বৌদ্ধদের দেবদেবী - ড. বিনয়তোষ ভট্টাচাৰ্য্য ৷
৫ | বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) - ধর্মকর্ম : ধ্যানধারণা - নীহাররঞ্জন রায় ৷
৬ |ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রাচীন ভারতীয়প্রেক্ষাপট :- নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য ৷
৭ | দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা বাংলার ইতিহাস সম্পাদনা - সন্তু জানা৷
৮ | মেদিনীপুরের ধর্মকথা - সম্পাদনা তাপস মাইতি
৯ | মেদিনীকথা - অরিন্দম ভৌমিক৷
১০ | চন্দনেশ্বর মহিমামৃত - পণ্ডিত ননীগোপাল শতপথী ৷
১১ | রামনগরের ভূমিগঠন - অরবিন্দ মাইতি
সফরসঙ্গী - প্রদীপ কুমার জানা- অধ্যাপক ( রামনগর কলেজ)