কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে
In search of-the source of Kalaichandi canal
গৌতম মাহাত।
আমার শৈশব ও কৈশোরের কিছুটা সময় কেটেছে কলাইচন্ডি খালের তীরে অবস্থিত ছোট ও সুন্দর গ্রাম সাপকাটা তে। ছোটবেলাকার অনেক স্মৃতি জুড়ে রয়েছে এই কলাইচন্ডি খাল।গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করা, খাল পাড়ে জামগাছে উঠে জাম খাওয়া, খাল পাড়ে ছাগল চরানো কিংবা গৌরা কাকুর( গৌরচন্দ্র মাহাত) সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া ইত্যাদি......।কৈশোরের অনুসন্ধিৎষু মন সব সময় জানতে চেয়েছিল এই খাল দিয়ে এত জল আসে কোথা থেকে আর কোথায় বা গিয়ে পড়ে?মাঝখানে কলাইচন্ডি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে । কৈশোরের সেই অনুসন্ধিৎষু মন কে শান্ত করার জন্য ঠিক করলাম পুরো কলাইচন্ডি অর্থাৎ মোহনা থেকে উৎস পর্যন্ত পায়ে হেঁটে শেষ করব। শুরু হল ম্যাপ ঘাঁটাঘাঁটি আর নিজস্ব কিছু পড়াশুনো। জানতে পারলাম পাথরি ও কলসিভাঙ্গা গ্রামের(শালবনী ব্লক) মাঠের কোনো এক ডোবা থেকে বেরিয়ে প্রায় ৩৭-৪০ কিমি পূর্ব দিকে বয়ে গিয়ে পাথরা র (মেদিনীপুর সদর ব্লক) কাছে কাঁসাই নদী তে পড়েছে।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এর আগে আমার কোনরকম ট্রেকের অভিজ্ঞতা ছিল না। যদিও সাইকেল নিয়ে বেশ কিছু অভিযান করেছি। সেই সুত্রে পাহাড়ে অভিযান করা বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ।এদের অভিজ্ঞতার কথা খুব কাছ থেকে শুনে ট্রেক সম্বন্ধে যা কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। কিছু মানুষ আমাকে সব সময় অনুপ্রানিত করে নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে যাদের নাম না করলেই নয়- অভিষেক তুঙ্গ, সৌম্যজিৎ মন্ডল( গুড্ডু), চন্দন বিশ্বাস , লিপিকা বিশ্বাস , অনির্বান আচার্য্য , সম্রাট মৌলিক, তরুন মাহাতো,সৃজন সাহা,সুদীপ ঘোষ, সৌভিক, তোজো, সিখিন । দেশ বিদেশে এদের অভিযানের গল্প শুনে যতটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছি , সে গুলোয় ছিল আমার সম্পদ ।
যাইহোক ২০২২ এর মার্চ মাসের প্রথম থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়। আমার অভিযানের তারিখ ঠিক করি ১৮ ই মার্চ, দোলের দিন , সরকারি ছুটি তাছাড়াও পরের দুটো দিন শনিবার ও রবিবার , আমার অফিস ছুটি , ঠিকঠাক বিশ্রাম নিতে পারবো এই ভেবে । এই সময় আমার খুব কাছের মানুষ রা হয় পাহাড়ে দৌড়াবে না হয় নাম না জানা কোন রুটে ট্রেক করবে । আমিও তাই ঠিক করলাম বাড়ির কাছে কলাইচন্ডি দিয়ে আমার ট্রেকিং জীবনের সূচনা করতে। উদ্দেশ্য একটায় কলাইচন্ডি কে নতুন করে চেনা , জানা ।
১৮ ই মার্চ, ভোর বেলা আমার ব্যাকপ্যাকে চারটি জলের বোতল, ওআরএস, একটি গামছা, একটি ম্যাস্টিন, ৫০০ গ্রাম ছাতু, আট প্যাকেট ম্যাগি ও একটি ম্যাচিস নিয়ে আমি পৌঁচালাম কলাইচন্ডির মোহানায় । ঘড়িতে তখন ভোর ৫.২০ টা । সবে আলো ফুটছে। কিছু ছবি তুলে ঠিক ৫.৩০ টায় শুরু করলাম হাঁটা । একদিকে কাঁসাই অন্যদিকে পাথরার প্রাচীন মন্দিরের চুড়া দেখা যাচ্ছে। যে জমির আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সেটা জামসেদ ভাই এর।কিছুটা জমিতে বাদাম চাষ আর কিছুটাতে লঙ্কা চাষ করেছে। জামসেদভাই এর সাথে আমার দুদিন আগে আলাপ হয়েছে। পরপর দুদিন সকাল সকাল এই আগন্তুক কে একই জায়গায় দেখে জামসেদ ভাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল -
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
-“ভাই আজ দুদিন ধরে দেখছি সকাল সকাল তুমি আমার জমিতে এসে শুধু নদী দেখ আর এই খালটারে দেখ, ব্যাপারখানা কি ?”
- দাদা আমার নাম ...... আমার বাড়ি......... আমি কলাইচন্ডির শেষ থেকে শুরু পর্যন্ত হাঁটবো বলে ঠিক করেছি। সেই জন্যই দেখতে আসা কোথায় নদীতে মিশেছে ?
-“বা ব্যাপারখানা তো দারুন। কিন্তু তুমি হাঁটতে পারবে এতোটা পথ? কবে হাঁটবে? আমি যদি বাড়িতে থাকি তাহলে সেদিন সকালে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবো”
-আচ্ছা দাদা
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
না আজ আর জামসেদ ভাইয়ের দেখা পায়নি।বোধহয় বাড়িতে নেই। বেশ কিছুটা এগিয়ে দেখি কলাইচন্ডি খুব গভীর । একটু এগিয়ে পাই পাথরা ব্রিজ । খাল থেকে উঠে ডান দিকের সরু মাটির রাস্তা ধরলাম । এই রাস্তা কলাইচন্ডির সমান্তরাল ভাবে সোজা চলে গেছে এলাইগঞ্জ । রাস্তার দুপাসে সারিসারি গাছ ।অদ্ভুত সুন্দর । রাস্তাটা অসম্ভব পরিস্কার , কোথাও একটা নোংরা পড়ে নেই। এর কারন কিছু টা এগোনোর পরে জানতে পারলাম। দেখলাম পাশাপাশি গ্রামের মহিলারা রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের পাতা ঝাড়ু দিয়ে বস্তায় ভরছেন জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহারের জন্য।সকাল সাতটায় এসে পৌঁচালাম এলাইগঞ্জ । এখানে কলাইচন্ডির অন্যরুপ, চারিদিকে থার্মোকল ও প্লাস্টিক জাত বর্জ্যে তার যেন হাঁসফাঁস অবস্থা । মনটা সামান্য হলেও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো।জনবসতি পূর্ণ এবং মেদিনীপুর শহর লাগোয়া অঞ্চল বলেই হয়তো এই অবস্থা। যাইহোক এবার আর কোনো রাস্তা নেই আমাকে হাঁটতে হবে খালের পাড় বরাবর।
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
বেশ কিছুটা এগোনোর পর চারিদিকে সবুজ আর পাখির কলতানে আমি আত্মহারা । এত রকম পাখির ডাক জীবনে খুব কমই শুনেছি। পাশাপাশি কোনো গ্রাম নেই । চারিদিকে জনমানবশুন্য ধু ধু মাঠ । মনে মনে এটাই চেয়েছিলাম , আজ আমার সঙ্গে থাকবে শুধু কলাইচন্ডি ।
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
এলাইগঞ্জের পর থেকে কলাইচন্ডির চরিত্র একটু আলাদা তার গতিপথ সর্পিলাকার, নদীর নিম্ন গতিতে যেমন অশ্বখুরাকৃতি বাঁক থাকে ঠিক তেমনই । স্ট্রাভা তে (দুরত্ব পরিমাপ করার অ্যাপ) দেখলাম মোটামুটি ১২কিমি চলে এসেছি। সাড়ে আট টা মতো বাজছে । শরীরে এখন একটু এনার্জি প্রয়োজন । তাই একটা সুন্দর ছায়া দেখে গামছা পেতে বসলাম । সঙ্গে থাকা ছাতু দিয়ে শরবত বানিয়ে খাচ্ছি , হঠাৎ পেছন থেকে এক বৃদ্ধের আবির্ভাব । আলাপচারিতায় জানতে পারলাম ওনার বাড়ি বাঁধগড়া , নাম হপন হাঁসদা , পেশা- গ্রামের সমস্ত গরু চরানো। সকাল থেকে এই প্রথম কোনও মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা । এখানে যেহেতু আমি আধ ঘন্টা বিশ্রাম নেব, তাই বিভিন্ন ব্যাপারে হপন বাবুর সঙ্গে কথাবার্তা চলতে লাগলো । উৎসাহবশত জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম-
“আপনারা ছোটবেলায় কলাইচন্ডি খাল কে কেমন ভাবে দেখেছেন?”
-“তখন এই খালে সারা বছর জল থাকতো। গ্রীষ্মকালে গ্রামের পুকুর শুকিয়ে গেলে জলের একমাত্র ভরসা ছিল এই খাল। এখন সময় পাল্টেছে। এখন খালে বর্ষা কাল ছাড়া জল থাকে কৈ?”
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
যাইহোক হপন বাবু কে বিদায় জানিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার বামতীর বরাবর হাঁটতে থাকলাম । কিছুটা এগোনোর পর দেখতে পেলাম মা কলাইচন্ডি র মন্দির । মন্দির তালাবন্ধ ।তাই ইচ্ছে থাকলেও ভেতরে ঢোকার কোনও উপায় নেই । এই মন্দিরের ইতিহাস আমার জানা নেই।
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
বাড়ুয়া, রেলব্রিজ পেরিয়ে এসে পড়লাম এক সবুজ ভ্যালিতে । যতদুর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ সারা মাঠ জুড়ে বোরো ধানের চাষ। সামনেই কলাইচন্ডির ওপর আমড়াতলা ড্যাম , পুরো মাঠ চাষ হচ্ছে ড্যামের জল দিয়ে । ড্যাম পৌঁছাতেই দেখা হল টোটন দার( টোটন রায়, মেদিনীপুরের সুনামধন্য অ্যাথলিট) সঙ্গে । পকেট থেকে আবির বের করে সারা মুখে মাখিয়ে দিল। এরকম একটা অভিযানে আবির কপালে জুটবে ভাবিনি। যেহেতু পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্যামে স্নান করবো বলে ঠিক করে রেখে ছিলাম, তাই দাদাকে বাধা দিই নি। স্নান সেরে ড্যামের পাড়ে ম্যাগি তৈরী করে দুপুরের খাওয়া সারলাম। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে দুপুর ১২.৩০ টা নাগাদ ড্যামের বাম পাড় বরাবর হাঁটা শুরু করলাম ।
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
দুপাসে পুরো জমিতে বোরো ধানের চাষ । খড়িকাশুলি, সিজুয়া , বেনাশুলি, মৌরা্ ,দহ্ , ধাপড়া , মেট্যাল, গোলকচক গ্রামের মাঠ ছাড়িয়ে এসে পড়লাম আমার গ্রাম সাপকাটা র মাঠে । কলাইচন্ডি র এই দিক টা আমার পুর্বপরিচিত । তখন বেলা গড়িয়ে বিকেল । এখান থেকে উৎস মুখ সেই ডোবা খুব বেশি দূরে নয় ।
কলাইচন্ডি'র উৎস সন্ধানে | In search of-the source of Kalaichandi canal ছবি: গৌতম মাহাত।
শরীর আর টানছে না । ছাতুর শরবত বানিয়ে খেয়েও যেন শান্তি হচ্ছে না । আবার ম্যাগী বানালাম। যা জল ছিল তাও প্রায় শেষের মুখে ।এদিকে পায়ের অবস্থাও খুব খারাপ, কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হল হাঁটা । প্রায় একঘন্টা হাঁটার পর পেলাম সেই ডোবা।তার পর থেকে কলাইচন্ডির আর কোনোও অস্তিত্ব নেই।তখন বাজছে প্রায় বিকেল ৫.৩০ টা। বাম দিকে পাথরি গ্রাম আর ডান দিকে কলসিভাঙ্গা গ্রাম। দীর্ঘ প্রায় ৩৬ কিমির ট্রেক সমাপ্ত হলো। সাধারন ভাবে দেখতে গেলে এই ট্রেক টা খুবই সাধারন একটা ট্রেক কিন্তু আমার কাছে এর একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল ।এটা ছিল আমার কৈশোরের সুপ্ত বাসনা পুরনের ট্রেক।পাথরি আর পাথরার মিলন ঘটানো কলাইচন্ডি খালের পুরো যাত্রাপথের একদিনের সঙ্গী হিসেবে থাকতে পেরে নিজেও মুচকি হাসি হাসলাম।
midnapore.in
(Published on 17.04.2022)