রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় খড়্গপুর শহরের উল্লেখ আছে ? In which poem of Rabindranath the city Khargpur is mentioned?

রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় "খড়্গপুর" শহরের উল্লেখ আছে ?


In which poem of Rabindranath the city Khargpur is mentioned?


সৌমেন গাঙ্গুলি।



Home » Medinikatha Journal » Soumen Ganguly » রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় "খড়্গপুর" শহরের উল্লেখ আছে ?



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি কুইজ অনুষ্ঠানে খড়গপুরের খ্যাতিমান আবৃত্তিকার ও নাট্যকর্মী শ্রী কমল দন্ড ঠিক এই প্রশ্নটাই শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে করেছিলেন। অচেনা, অজানা এই প্রশ্ন শুনে বিস্ময় ও হতবাক দৃষ্টি মেলে প্রশ্নকর্তার দিকেই সবাইয়ের অপেক্ষা, মনে সন্দেহ, মস্করা হচ্ছে না কি! দেশ বিদেশ ঘোরা রবীন্দ্রনাথ এত জায়গা থাকতে হঠাৎ কেন আনকোরা এই শহর টাকে তার কবিতায় স্থান দেবেন!


রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় খড়্গপুর শহরের উল্লেখ আছে ? In which poem of Rabindranath the city Khargpur is mentioned?
রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় খড়্গপুর শহরের উল্লেখ আছে ?

উত্তরের অপেক্ষা শেষে কুইজ মাস্টার নিজেই জানালেন উত্তর হলো “শ্রাদ্ধ”। “সঞ্চয়িতা” কাব্যগ্রন্থে যে দুটি মাত্র ছড়া সংকলিত আছে এটি তারমধ্যে একটি। মহাপ্রয়াণের বছর খানেক আগে ১৯৪০ সালের ২৮শে মার্চ (১৫ই চৈত্র '৪৬) শান্তিনিকেতনে বসে কবি সুদীর্ঘ (১০৬ লাইন) এই ছড়াটি লিখেছিলেন। আসলে রবীন্দ্রনাথের এই ছড়ায়, কবিতার গাম্ভীর্য ও ছড়ার মজা এক সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে।


রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় খড়্গপুর শহরের উল্লেখ আছে ? In which poem of Rabindranath the city Khargpur is mentioned?
রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতায় খড়্গপুর শহরের উল্লেখ আছে ?

একটি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের মাল-মশলা, সাজ সরঞ্জাম জোগাড় করবার জন্য দেশের যে সব জায়গায় যেতে হয়েছে- সেই সূত্রেই খড়গপুরের নামও এসেছে। সমগ্র ছড়ায় দু জায়গায় দু'বার খড়গপুরের নাম এসেছে। আমরা যেভাবে দুরকমভাবে খড়গপুরকে উচ্চারণ করি সেইভাবে কবিও দু'জায়গায় দু'রকম বানান ব্যবহার করেছেন যা লক্ষ্যনীয়। একবার “খড়গপুর” এবং আরেকবার “খড়্গপুর”। উচ্চারণের এই ভিন্নতা যা সেদিনও ছিল, আজো প্রচলিত আছে। পুরোনো ইতিহাসে দেখা যায় আজকের খড়গপুর অতীতে 'খড়কপুর' বলে পরিচিত ছিল। শহরটিকে নির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ দুটি বানানকেই মান্যতা দিয়েছেন। ছড়াতে প্রথমবার তিনি লিখলেন -


“ও পারেতে 'খড়্গপুরে' কাঠি পড়ে বাজনায়

মুন্সিবাবু হিসাব ভোলে জমিদারের খাজনায়।”


ছড়ায় শেষবার তিনি লিখেছেন -


“কোথায় ঘাটের ফাটল থেকে ডাকল কোলাব্যাঙ।

খড়গপুরে ঢাকে ঢোলে বাজল ডাড্যাং ড্যাং।”


সারাজীবন কবি ভ্রমণ করেছেন। রেলভ্রমনে বোম্বে, দক্ষিণভারত অথবা ওড়িশার সমুদ্র সৈকত পুরীতে বেড়াতে যাওয়ার সময় খড়গপুর জংশনকে অতিক্রম করতে হয়েছে বিশ্বকবিকে। স্টেশনের অদূরে থাকা গোলবাজার দুর্গা মন্দিরের শারদ উৎসবের ঢাকের আওয়াজ কি কবি পেয়েছিলেন দুরগামী ট্রেনের স্টেশন বিরতিতে। জংশন স্টেশনে ট্রেনের বিরতিতে পেয়েছিলেন চিন্তার রসদ। পুজো অবকাশে বাহির পথে পা বাড়ানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতির অভিজ্ঞান বহন করছে 'শ্রাদ্ধ' ছড়ায় খড়গপুরের নাম।



আগ্রহী পাঠকদের জন্য সম্পূর্ণ ছড়াটি দেওয়া হল -


শ্রাদ্ধ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে;

পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।

আপনি এল ব্যাক্‌টিরিয়া, তাকে ডাকা হয় নাই,

হাঁসপাতালের মাখন ঘোষাল বলেছিল, ‘ভয় নাই!’

সে বলে, ‘সব বাজে কথা, খাবার জিনিস খাদ্য।’

দশ দিনেতেই ঘটিয়ে দিল দশ জনারই শ্রাদ্ধ!

শ্রাদ্ধের যে ভোজন হবে কাঁচা তেঁতুল দরকার,

বেগুন-মুলোর সন্ধানেতে ছুটল ন্যাড়া সরকার।

বেগুন মুলো পাওয়া যাবে নিলফামারির বাজারে;

নগদ দামে বিক্রি করে, তিন টাকা দাম হাজারে।

দুমকাতে লোক পাঠিয়েছিল, বানিয়ে দেবে মুড়কি;

সন্দেহ হয়, ওজন-মত মিশল তাতে গুড় কি।

সর্ষে যে চাই মণ দু-তিনেক ঝোলে ঝালে বাটনায়;

কালুবাবু তারি খোঁজে গেলেন ধেয়ে পাটনায়।

বিষম খিদেয় করল চুরি রামছাগলের দুধ,

তারই সঙ্গে মিশিয়ে নিলে গম-ভাঙানির খুদ।


ওই শোনা যায় রেডিয়োতে বোঁচা গোঁফের হুমকি -

দেশ-বিদেশে শহর-গ্রামে গলা কাটার ধুম কী!

খাঁচায়-পোষা চন্দনাটা ফড়িঙে পেট ভরে;

সকাল থেকে নাম করে গান-- হরে কৃষ্ণ হরে ॥


বালুর চরে আলুহাটা, হাতে বেতের চুপড়ি,

ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে কালু মুলো নিল উপড়ি।

নদীর পাড়ে কিচির-মিচির লাগালো গাঙশালিখ যে,

অকারণে ঢোলক বাজায় মুলোক্ষেতের মালিক যে।

কাঁকুড়-ক্ষেতে মাচা বাঁধে পিলেওয়ালা ছোকরা,

বাঁশের বনে কঞ্চি কাটে মুচিপাড়ার লোকরা।

পাটনাতে নীলকুঠির গঞ্জে খেয়া চালায় পাট‌নি,

রোদে জল নিতুই চলে চার পহরের খাটনি,

কড়াপড়া কঠিন হাতে মাজা কাঁসার কাঁকনটা,

কপালে তার পত্রলেখা উল্কি-দেওয়া আঁকনটা।

কুচোমাছের টুকরি থেকে চিলেতে নেয় ছোঁ মেরে -

মেছনি তার সাত গুষ্টি উদ্দেশে দেয় যমেরে।

ও পারেতে খড়গপুরে কাঠি পড়ে বাজনায়,

মুন্সিবাবু হিসেব ভোলে জমিদারের খাজনায়।


রেডিয়োতে খবর জানায় বোমায় করলে ফুটো,

সমুদ্‌দুরে তলিয়ে গেল মালের জাহাজ দুটো।

খাঁচার মধ্যে ময়না থাকে, বিষম কলরবে

ছাতু ছড়ায়, মাতায় পাড়া আত্মারামের স্তবে ॥


হুইস্‌ল্‌ দিল প্যাসেঞ্জারে, সাঁতরাগাছির ড্রাইভার

মাথায় মোছে হাতের কালি, সময় না পায় নাইবার।

ননদ গেল ঘুঘুডাঙায়, সঙ্গে গেল চিন্তে -

লিলুয়াতে নেমে গেল ঘুড়ির লাঠাই কিনতে।

লিলুয়াতে খইয়ের মোওয়া চার ধামা হয় বোঝাই,

দাম দিতে হায় টাকার থলি মিথ্যে হল খোঁজাই।

ননদ পরল রাঙা চেলি, পাল্কি চড়ে চলল;

পাড়ায় পাড়ায় রব উঠেছে গায়ে হলুদ কল্য।

কাহারগুলো পাগড়ি বাঁধে, বাঁদি পরে ঘাগরা।

জমাদারের মামা পরে শুঁড়-তোলা তার নাগরা।

পাঁড়েজি তাঁর খড়ম নিয়ে চলেন খটাৎ খটাৎ|,

কোথা থেকে ধোবার গাধা চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ।

খয়রাডাঙার ময়রা আসে, কিনে আনে ময়দা;

পচা ঘিয়ের গন্ধ ছড়ায়-- যমালয়ের পয়দা।


আকাশ থেকে নামল বোমা, রেডিয়ো তাই জানায় -

অপঘাতে বসুন্ধরা ভরল কানায় কানায়।

খাঁচার মধ্যে শ্যামা থাকে; ছিরকুটে খায় পোকা,

শিস দেয় সে মধুর স্বরে-- হাততালি দেয় খোকা ॥


হুইস্‌ল্‌ বাজে ইস্‌টিশনে, বরের জ্যাঠামশাই

চমকে ওঠে-- গেলেন কোথায় অগ্রদ্বীপের গোঁসাই!

সাঁতরাগাছির নাচনমণি কাটতে গেল সাঁতার,

হায় রে কোথায় ভাসিয়ে দিল সোনার সিঁথি মাথার।

মোষের শিঙে ব’সে ফিঙে লেজ দুলিয়ে নাচে -

শুধোয় নাচন, ‘সিঁথি আমার নিয়েছে কোন্‌ মাছে ?’

মাছের লেজের ঝাপটা লাগে, শালুক ওঠে দুলে;

রোদ পড়েছে নাচনমণির ভিজে চিকন চুলে।

কোথায় ঘাটের ফাটল থেকে ডাকল কোলা ব্যাঙ,

খড়গ্‌পুরের ঢাকে ঢোলে বাজল ড্যাড্যাঙ ড্যাঙ।

কাঁপছে ছায়া আঁকাবাঁকা, কলমিপাড়ের পুকুর -

জল খেতে যায় এক-পা-কাটা তিন-পেয়ে এক কুকুর।

হুইস্‌ল্‌ বাজে-- আছে সেজে পাইকপাড়ার পাত্রী,

শেয়ালকাঁটার বন পেরিয়ে চলে বিয়ের যাত্রী ॥


গ্যাঁ গ্যাঁ করে রেডিয়োটা কে জানে কার জিত,

মেশিন্‌গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্যবিধির ভিত।

টিয়ের মুখের বুলি শুনে হাসছে ঘরে পরে -

রাধে কৃষ্ণ, রাধে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে ॥


দিন চলে যায় গুন্‌গুনিয়ে ঘুমপাড়ানির ছড়া;

শান-বাঁধনো ঘাটের ধারে নামছে কাঁখের ঘড়া।

আতাগাছের তোতাপাখি, ডালিমগাছে মউ;

হীরেদাদার মড়্‌ মড়ে থান, ঠাকুরদাদার বউ।

পুকুরপাড়ে জলের ঢেউয়ে দুলছে ঝোপের কেয়া,

পাটনি চালায় ভাঙা ঘাটে তালের ডোঙার খেয়া।

খোকা গেছে মোষ চরাতে, খেতে গেছে ভুলে -

কোথায় গেল গমের রুটি শিকের ’পরে তুলে।

আমার ছড়া চলেছে আজ রূপকথাটা ঘেঁষে,

কলম আমার বেরিয়ে এল বহুরূপীর বেশে।

আমরা আছি হাজার বছর ঘুমের ঘোরের গাঁয়ে,

আমরা ভেসে বেড়াই স্রোতের শেওলা-ঘেরা নায়ে।

কচি কুমড়োর ঝোল রাঁধা হয়, জোর-পুতুলের বিয়ে

বাঁধা বুলি ফুকরে ওঠে কমলাপুলির টিয়ে।

ছাইয়ের গাদায় ঘুমিয়ে থাকে পাড়ার খেঁকি কুকুর,

পান্তিহাটে বেতো ঘোড়া চলে টুকুর-টুকুর।

তালগাছেতে হুতোমথুমো পাকিয়ে আছে ভুরু,

ভক্তিমালা হড়মবিবির গলাতে সাত-পুরু।

আধেক জাগায় আধেক ঘুমে ঘুলিয়ে আছে হাওয়া,

দিনের রাতের সীমানাটা পেঁচোয়-দানোয়-পাওয়া।

ভাগ্যলিখন ঝাপসা কালির, নয় সে পরিস্কার -

দুঃখসুখের ভাঙা বেড়ায় সমান যে দুই ধার।

কামারহাটার কাঁকুড়গাছির ইতিহাসের টুকরো

ভেসে চলে ভাঁটার জলে উইয়ে-ঘুণে-ফুক্‌রো!

অঘটন তো নিত্য ঘটে রাস্তাঘাটে চলতে -

লোকে বলে,’ সত্যি নাকি’- ঘুমোয় বলতে বলতে ॥


সিন্ধুপারে চলছে হোথায় উলট-পালট কাণ্ড,

হাড় গুঁড়িয়ে বানিয়ে দিলে নতুন কী ব্রহ্মাণ্ড!

সত্য সেথায় দারুণ সত্য, মিথ্যে ভীষণ মিথ্যে;

ভালোয় মন্দে সুরাসুরের ধাক্কা লাগায় চিত্তে।

পা ফেলতে না ফেলতেই হতেছে ক্রোশ পার -

দেখতে দেখতে কখন যে হয় এস্‌পার ওস্‌পার ॥


- শান্তিনিকেতন, ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৪০ (৪ ফাল্গুন ‘৪৬)



M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 31.08.2024)



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।