আমার এই দশ বছরের পাখি দেখার বাউন্ডুলে সময়কালে বেশ কিছু পাখি তাদের আপন স্বতন্ত্র রূপ বৈশিষ্টের জন্য মনের মাঝে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে এমনই এক পাখির সাথে প্রতি বছর মোলাকাত হচ্ছে কিন্তু তবুও মনের তাকে বারে বারে নতুন করে দেখার আশ মেটেনা। ফি বছর সেই পরিযায়ী সুন্দরীর আসবার সময় এলেই তার দেখা পাওয়ার জন্য, শালবনের ভেতর থেকে ভেসে আসা তার গান শোনার জন্য মন ব্যাকুল হয়। উষ্ণতার আবাহনে জঙ্গলমহলের নতুন পাতায় ভরা শালবন জুড়ে তাদের আগমনে ঘনায় এক রঙিন মেজাজ। তাদের রঙিন পালকের মায়াজালে বনের বুকে নেমে আসে রঙিন রূপকথারা।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
তাদের দেখতে গহীন বনের পথে পথে ফেরে পক্ষীপ্রেমিকরা, কারণ গ্রীষ্মের দাবদাহের মাঝে বর্ষাকে সঙ্গী করে বর্ণালী পাখিরা এসেছে বনে। তাদের পালক জুড়ে নয়টি রঙের বিচ্ছুরণ। হিন্দীতে তাই এদের নাম ‘নবরঙ্গ’। স্থানভেদে এই পাখির প্রচলিত বাংলা নামগুলি হল বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি ইত্যাদি।ইংরেজি নাম: ইন্ডিয়ান পিট্টা (Indian pitta)। ‘পিট্টা’ একটি তেলেগু শব্দ, যার অর্থ ‘ছোট পাখি'। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষীবিশারদ অজয় হোম মহাশয় হিন্দী নামটার বাংলা করেছেন ‘বর্ণালি’। বৈজ্ঞানিক নাম: Pitta brachyur। এই বর্ণালী বা ইন্ডিয়ান পিট্টা পাখিরা মূলত উত্তর এবং মধ্য ভারতের বাসিন্দা। এরা আমাদের এলাকার গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি হিসেবে পরিচিত। এই একটিমাত্র পরিযায়ী পাখি আামদের জঙ্গলের অতিথি হয়ে থেকে প্রজনন করে বাচ্চাফুটিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যায় দক্ষিণে।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
বনসুন্দরী হওয়ার পিছনে এদের শরীরের রংটাই মূল কারণ। নয় রঙের সমাহারে সমৃদ্ধ এই পাখি। পাখিটির সব সৌন্দর্যই যেন প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছে নিজ হাতে। লম্বায় বর্ণালী বা ইন্ডিয়ান পিট্টা প্রায় ২০ সেমি থেকে ২২ সেমি। লেজ একেবারেই খাটো। প্রথম দেখাতে মনে হবে বুঝি এদের লেজই নেই। খুব ভালো করে পরখ করলে প্রায় সবসময় নড়তে থাকা ছোট্ট লাল লেজটা চোখে ধরা পড়বে। ওদের পালকে রয়েছে লাল, সাদা, কালো, হলুদ, ফিরোজা নীল, গোলাপী, আকাশী, সবুজ ও বাদামি রঙের সমাহার। মাথার ওপরটা হলদেটে পট্টির মতো। গলার নীচটা সাদা। চোখের দু'পাশ মোটা দাগের কাজল কালির টান দেওয়া। দাগটি একেবারে ঘাড়ে এসে ঠেকেছে। চোখের ওপর রয়েছে সরু সাদা টানা দাগ। পিঠ, কাঁধ সবুজ। ঠোঁট কালো। ডানার শুরুটা নীল, নিচের অংশ বাদামি। বুকের তলার দিকে লালচে বাদামি। লেজের নিচের পালক টুকটুকে লাল। পা ফিকে গোলাপী। উড়বার সময় পাখনার সাদা ও ফিরোজা নীল রঙ স্পষ্ট বোঝা যায়।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
নবরঙ্গ বা পিট্টা পাখিরা পাতাঝরা ঘন জঙ্গলের বাসিন্দা। মিষ্টি গলার বেশ উচ্চস্বরে 'হুই হুইট-টিউ... টিউট টিউট টু...' সুরে গান গায়। সুরে ছান্দসিক তাল আছে। ফাঁকা নির্জন পরিবেশ পেলে গলা ছেড়ে শিস দেয়। খানিকটা দূর থেকেও এদের শিস শোনা যায়। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি গানে বেশি পারদর্শী। গান গাওয়ার সময় শরীর টানটান করে মাথাটা ঘাড়ে ঠেকিয়ে আকাশমুখী হয়ে গান গায়। পাখিটি উঁচু গাছের ডালে থাকার চেয়ে গাছের নিচে ছায়া যুক্ত অঞ্চলে থাকতেই পছন্দ করে। সামনে কোন ছোট ঢিপি বা ছোট ডাল থাকলে তার ওপর উঠে চারপাশ দেখে আবার কিছুটা এগিয়ে যায়। খুব একটা লাজুক নয়, মানুষের কাছাকাছি আসতে তেমন ভয় পায় না।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
২০২১ জুন মাসে একজোড়া পিট্টা খুঁজে পেয়েছিলাম শালবনীর পাথরকুমকুমি গ্রামের এক বাগানের ভেতরে। যারা নীচু ডালে বসে আশেপাশের মানুষদের বিশেষ পাত্তা না দিয়েই আপনমনে ডেকে চলছিল। এরা খুব বেশি দূর একটানা উড়তে পারেনা, থেমে থেমে ওড়ে। মাঠপ্রান্তরের চেয়ে জঙ্গলের ভিতর ফাঁকাস্থানে বিচরণ করে বেশি। এই পাখিরা ঘন শাল জঙ্গলের ঘাসপুর্ন জমিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং খাবার সংগ্রহ করে। লাফিয়ে কিছুটা গিয়ে থেমে এদিক-ওদিক তাকায়। খাবারের খোঁজে মাটিতে অনবরত লাফাতে থাকে আর পা দিয়ে বনের পাতা সরিয়ে খাবার খুঁজে বেড়ায়। বনের মাটিতেই এরা বেশি বিচরণ করে। বনের ঝরে যাওয়া পাতা যখন পচে তখন সেই পাতার নিচে পোকা মাকড় ও কেঁচো জন্ম নেয়। এরা বনের পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে ঠোঁট দিয়ে খাবার খুঁজে খায়। যার জন্য সর্বক্ষণ তাদের ঠোঁটে মাটি লেগে থাকে। খাবারের মাঝে মাঝে বনের ভিতরে গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নেয়। কেঁচো, পতঙ্গের লার্ভা ও বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী এদের প্রধান খাবার। খাবারের সংকট দেখা দিলে মাঝে মাঝে পোকামাকড় খেয়ে থাকে।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
এরা একাকী চলাফেরা করতে পছন্দ করে। জোড়ায় জোড়ায় খুব একটা দেখা যায় না। পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিটিকে তাড়া করে তার চারপাশে ঘুরঘুর করে। মাঝে মাঝে দুজনেই মোরগ লড়াই এই ভঙ্গীমায় লাফিয়ে উঠে তাদের প্রাক্ প্রজনন নাচ করে। প্রজননের জন্য জোড়া বাঁধার পর থেকে এরা ব্যস্ত থাকে বাসা বানানো ও বংশবৃদ্ধির জন্য। প্রজনন মরসুমে (জুন থেকে আগস্ট) পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম সহ জঙ্গলমহলের ঘন শালবনগুলিতে দেখা মেলে এই পাখির। ২০১৮ সালে আমাদের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গর্ব আড়াবাড়ির জঙ্গলে এমনই এক বন সুন্দরীর জঙ্গলের মেঝেতে পড়ে থাকা সরু কাঠি সংগ্রহ করে বাসা বানাতে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল। মাটি থেকে প্রায় বারো থেকে পনেরো ফুট উপরে গাছের দুটি ডালের মধ্যবর্তী ইংরেজি ‘Y’ আকৃতির মাঝখানে সরু সরু কাঠি দিয়ে লম্বাটে ধাঁচের বাসা বানায়।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
বাসার ভেতর স্ত্রী ইন্ডিয়ান পিট্টা ডিম পাড়ে চার থেকে ছয়টি। ডিমের রং সাদা, গায়ে হালকা বাদামি ছোপ থাকে। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৪ থেকে ১৬ দিন। বাচ্চা উড়তে শেখে ২০ থেকে ২৫ দিনে। উড়তে শেখার আগেই বাচ্চারা মাটিতে নেমে মায়ের পেছন পেছন হাঁটাহাঁটি করে। সে মুহূর্তেই বাচ্চারা বিপদে পড়ে যায় বেশি। বিপদ বুঝলে গাছ থেকে মা বা বাবা বিশেষ ধরনের আওয়াজ করে বাচ্ছাকে সব সময় সতর্ক করে রাখে এবং সেই সময় বাচ্ছা ঘন ঝোপের ভিতর ঢুকে যায়। বাচ্চা বড় হয়ে গেলে শীতের প্রাক্কালে এরা আবার পাড়ি জমায় দক্ষিণ ভারতে। ইন্ডিয়ান পিট্টা বা বর্ণালী পাখি 'ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন ১৯৭২' অনুযায়ী তফসিলি ৪ তালিকাভুক্ত।
"বন সুন্দরী, বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি, Indian pitta, Pitta brachyur
পাখিদের দেখতে ভালো লাগে, তাদের ছবি তুলতে পারলে মনে আলাদা তৃপ্তি আসে। তেমনই তাদের বিপদ দেখলে মন আশঙ্কিত হয়। বিশেষ করে এবছর এপ্রিল মাসে গোপগড় সংলগ্ন বনাঞ্চলের কিছু ছবি দেখে রীতিমতো শিউরে উঠেছি। আদিম সংস্কৃতির ছুতোই হয়ে চলা কতিপয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিকার পরবে গুলতির আঘাতে অন্যান্য দেশীয় পাখিদের সাথে শিকার হতে দেখেছি এই বন সুন্দরী পিট্টাদেরও। তাদের মেরে বীরবিক্রমে ঝুলিয়ে নিয়ে গেছে শিকারীর দল। এরসাথে বাসস্থান সংকোচনের সমস্যা তো রয়েছেই। বর্তমানে আমাদের এলাকার বিক্ষিপ্তভাবে টিকে থাকা শালবনগুলিতে নজরদারির অভাবে গাছ চুরি ও বন কেটে উজাড় করার জন্য এই পাখিগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। প্রকৃতি বাঁচলে এইপাখিগুলোও বাঁচবে। তাই আমাদের সচেতন হওয়া উচিত এদের রক্ষা করার জন্য।
গত প্রায় সাত বছর ধরে বর্ণালীর সাথে মোলাকাতের কিছু বিশেষ মুহূর্ত জুড়ে বানিয়েছিলাম ‘বর্নালীর বর্ণমালা’। আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম। নীচে দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে ফেলুন।