মিষ্টি নদী কংসাবতী
Kangsabati Kasai Cossye Cossai
সুদর্শন নন্দী।
স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ও মহা-মনিষীদের অবদানের বিষয়টি সসম্মনানে ও সশ্রদ্ধায় সবার উপরে রেখেই বলি অরণ্য, সমুদ্র, নদী, মন্দির এসবও অবিভক্ত মেদিনীপুরের অলংকার এবং অহঙ্কার দুই। আর নদী অরণ্যের বিস্তৃতি ও খ্যাতি ভ্রাতৃপ্রতিম বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলাতেও। এরমধ্যে নদীগুলি জেলাগুলিকে দিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য। একাধিক নদীর মধ্যে এক সুন্দরী ও মিষ্টি নদী হল আমাদের কংসাবতী। আটপৌরে বা ডাক নাম কাঁসাই।
মিষ্টি নদী কংসাবতী। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
পুরুলিয়া জেলার ঝালদার মুরুগুমা অঞ্চলে প্রায় ৬০০ মিটার উঁচু পাহাড় থেকে উৎপত্তি এই কংসাবতীর। সেখান থেকে উৎসারিত হয়ে পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,ও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুন্দরী কংসাবতী। নদীর গতিপথ প্রায় ৪৬৫ কিলোমিটার।
জানা যায়, কালিদাসের মেঘদূত ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যগ্রন্থে এই নদী কপিশা নামে উল্লিখিত। কথিত, কংসাবতী ছিলেন রূপবতী কন্যা। সমুদ্রের কাছে বাগদত্তা ছিলেন তিনি। কৃষ্ণ নাকি দামোদর নদের রূপ ধরে আলিঙ্গন করতে আসেন কংসাবতীকে। তখন কংসাবতী সেখান থেকে পালিয়ে সমুদ্রে মিলিত হন।
কংসাবতী নদীর উৎপত্তি হবার পর বাঁকুড়া জেলায় ঢুকেছে আর খাতড়ার অদূরে মুকুটমণিপুরে উপর ড্যাম বানিয়ে তৈরি হয়েছে একটি জলাধার ও সেচ প্রকল্প। এই প্রকল্প কংসাবতী সেচ প্রকল্প নামে পরিচিত। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে বর্তমান পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও হুগলি জেলার ৩,৪৮৪.৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জলসেচের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প চালু হয়। বাঁকুড়া জেলার খাতড়ার কাছে মুকুটমণিপুরে ঐ জলাধারটি ৩৮ মিটার উঁচু এবং ১০,০৯৮ মিটার লম্বা । উল্লেখ্য, মেদিনীপুর শহরের কাছে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত কংসাবতীর একটি জলাধারও এই প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হয়।মুকুটমণিপুরে এই কংসাবতী জলাধারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক পর্যটকপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র । কংসাবতীর জল যেন এখানে মনোরম এক বিশাল সরোবর।
এরপর এই জলাধার ছেড়ে বেরিয়ে রায়পুরের পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে মেদিনীপুর জেলার বিনপুর অঞ্চলে প্রবেশ করেছে কংসাবতী। তারপর লালগড়, ধেড়ুয়া হয়ে প্রবেশ করেছে মেদিনীপুর শহরে। মেদিনীপুর ছাড়িয়ে মন্দিরের দেশ পাথরার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কংসাবতী। পাথরা পেরিয়ে কেশপুরের কাছে নদী ভাগ হয়ে গেছে দুটি শাখায় । একটি শাখা দাসপুর অঞ্চলের উপর দিয়ে পালারপাই নামে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদের দিকে এগিয়ে গেছে ও অপর শাখাটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কেলেঘাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এবং শেষে সাগরের অদূরে মিলেছে হলদী নদীতে । কংসাবতীর উল্লেখযোগ্য উপনদীগুলি হল সাহারঝোরা, বান্দু, কুমারী, ভৈরববাঁকী।
মিষ্টি নদী কংসাবতী। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
সত্যি বলতে কি, কংসাবতীর পুরো পথটিই নয়নাভিরাম। কংসাবতী তার প্রবাহের রাস্তায় তৈরি করেছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। এরমধ্যে প্রথমেই বলতে হয় উপরের আলোচ্য মুকুটমনিপুর।কংসাবতী ও তার উপনদী কুমারীর মিলন স্থলের এই বিশাল জলাধার পর্যটকদের প্রায় সারা বছর আকর্ষণ করে। এছাড়া রয়েছে পুরুলিয়ার অদূরে দেউলঘাটা। পুরুলিয়া শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে জয়পুর থেকে দক্ষিণে আরও ৭ কিলোমিটার দূরে কংসাবতী নদীর দক্ষিণ পাড়ে এই দেউলঘাটা অবস্থিত। এখানে পাবেন প্রাচীন মন্দির যদিও প্রায় সব মন্দির নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া বাঁকুড়া জেলার সারেঙ্গার অদূরে বড়দিতে কংসাবতী নতুন রূপেসেজেছে।জায়গাটি কংসাবতী নদীর তীরে ছোট্ট একটা পাহাড়। শাল মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা সারেঙ্গার সেই বড়দি পাহাড়তলিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে চড়ুইভাতি করতে শীতকালে অনেকে আসেন। তবে যাতায়াতের সমস্যা আর পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। যদিও এই পর্যটনকেন্দ্রকে আকর্ষণীয় করতে কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে প্রশাসন। এখানে যেতে গেলে চারচাকাই ভরসা। বাঁকুড়া থেকে রাইপুরের রাস্তায় পড়ে পিড়রগাড়ি মোড়। পিড়রগাড়ি মোড় যাওয়া যায় চন্দ্রকোনা রোড বা গড়বেতা হয়েও। আসা যায় ঝাড়গ্রাম দিক থেকেও। সেখান থেকে খাতড়া যাওয়ার রাস্তায় ছ’কিমি দূরে চুয়াগাড়া মোড়। ওই মোড় থেকে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা ধরে চার কিমি গেলেই পাওয়া যাবে কালাপাথর গ্রামের পাশেই বড়দি পাহাড়। মুগ্ধ করে কংসাবতী নদীর মাতাল করা রূপ। নদীর তীরে কালাপাথর গ্রামে রয়েছে একটি ঝর্ণা। স্থানীয় মানুষের কাছে তা কালাঝর্ণা নামে পরিচিত।
এছাড়া লালগড়, ধেড়ুয়া প্রভৃতি জায়গায় কংসাবতী অন্যরুপে সেজেছে। তবে এসব স্থান পর্যটন কেন্দ্র নয়। তাই নদীর সম্পূর্ণ স্বাদ নিতে আসতে হবে মেদিনীপুর শহরে। কংসাবতীর তীরেই মেদিনীপুর। নদীর তীর বরাবর হেঁটে হারিয়ে যাওয়া যায় কংসাবতীর মিষ্টি জলে। তাছাড়া মেদিনীপুরের অদূরে মন্দিরময় পাথরাও কংসাবতীর তীরে। অপরূপ রূপে সেজেছে সে। নদীর তীরে অসংখ্য মন্দির। কবীর পুরস্কারপ্রাপ্ত স্থানীয় ইয়াসিন পাঠানের কঠিন পরিশ্রমে গড়ে উঠতে চলেছে পর্যটনকেন্দ্র। এরপর নদী কেশপুর দিয়ে গিয়ে কেলেঘাই তথা হলদী নদীতে মিশেছে।
মিষ্টি নদী কংসাবতী। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
সত্যি বলতে কি, সুন্দরী কংসাবতী এই অঞ্চলের শুধু নদী নয়, সে জঙ্গলমহলের প্রতিটি পরিবারের প্রিয় সদস্যা এবং অবশ্যই জীবনদাত্রী।
midnapore.in
(Published on 10.04.2021)