কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari

কুলটিকরি রাজবাড়ি ।

कुलटिकरि राजबाड़ी | Kultikri Rajbari

চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।


বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া সুবর্ণরেখা নদীর তীরবর্তী জনপদগুলি যা অতীতে বিস্তীর্ণ অরণ্যের কোলে জেগেছিল তারা কত না ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। শাল, পিয়াল, মহুয়া, কেন্দু, কুসুম, বহেড়া, হরিতকী ও কুর্চির জঙ্গলে ঘেরা ছিল এই সমস্ত জনপদ, যেখানে সাঁওতাল, লোধা, ভূমিজ প্রভৃতি আদিম জনজাতির মানুষের সঙ্গে হিংস্র জীবজন্তুর ছিল অবাধ বিচরণ ভূমি। এমনই এক জনপদ কুলটিকরি। জনবসতি গড়ে ওঠার আগে এখানে জঙ্গলের পাশে হয়ত অনেক টিকরা ছিল। টিকরা কথাটি থেকে টিকরী, বানানভেদে টিকরি, অর্থাৎ ঢিপি বা টিলা কথাটি এসেছে। সেই সব টিলায় ছিল কুলগাছ। সুতরাং কুলটিকরি স্থাননামটি প্রকৃতি থেকেই এসেছে।

কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari
কুলটিকরি রাজবাড়ির চাঁদনী পুকুর (রাজার পুকুর)। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

রাজধানী কুলটিকরি ও তার রাজবাড়ি সম্পর্কে জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে অতীতে যখন বাংলায় মোগল-পাঠানে ছিল তুমুল রেষারেষি। ফিরে যেতে হয় সেই সময় যখন বর্গীদের বারবার আক্রমণে ও তাদের অত্যাচারে সমগ্র মেদিনীপুর, বিশেষ করে সুবর্ণরেখার তীরবর্তী এই সমস্ত জনপদগুলি কত না দুর্দশায় পড়েছিল।

মেদিনীপুর জেলা পশ্চিমের অরণ্যভূমি সহ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সীমান্তদেশে অবস্থিত। বিভিন্ন কারণে বহুবার অতীতে এই স্থানের ভৌগোলিক সীমার পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলার শাসনকর্তাদের উড়িষ্যা আক্রমণ কিংবা উড়িষ্যার রাজাদের বাংলায় রাজ্যসীমা বিস্তার অথবা মোগল-পাঠানের যুদ্ধে যে পথটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হত, সেই পথটি হল বর্ধমান, আরামবাগ, মেদিনীপুর, কেশিয়াড়ি, নারায়ণগড়, দাঁতন হয়ে জলেশ্বর। মেদিনীপুরের কাঁসাই পেরিয়ে উড়িষ্যায় ঢুকতে হলে সুবর্ণরেখা নদী পেরোতেই হবে। আফগান সুলতানরা যখন বাংলার শাসক তখন উড়িষ্যা জয়ের জন্যে ক্রমান্বয়ে আক্রমণ চালিয়েছিলেন মেদিনীপুরের ওপর দিয়ে ।

মোগল-পাঠান যুদ্ধ ও সুবর্ণরেখার তীর

তখন ষোড়শ শতক। বাংলার আফগান শাসক ছিলেন সুলায়মান করনানী। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৭২ পর্যন্ত তিনি বাংলার সুলতান ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে দিল্লিতে মোগল রাজত্ব। আকবর শাহ দিল্লির সম্রাট। সুলায়মানের হিন্দুবিদ্বেষী সেনাপতি কালাপাহাড় যখন উড়িষ্যা আক্রমণ করেন, তখন উড়িষ্যার রাজা ছিলেন মুকুন্দদেব। বিপদ বুঝে রাজা মুকুন্দদেব কোটসমা দুর্গে আশ্রয় নেন। এই সময়ে মুকুন্দদেবেরই এক বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটোরায় রাজাকে হত্যা করে উড়িষ্যার সিংহাসন অধিকারের চেষ্টা করেন। কিন্তু এঁদের দুজনকেই কালাপাহাড় পরাজিত ও নিহত করে উড়িষ্যার চিল্কা অবধি দখল করেন। ১৫৬৫-তে উড়িষ্যা আক্রমণ করে পরাস্ত হলেও ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কালাপাহাড় উড়িষ্যা জয় করেন। তার ফলে বর্তমান মেদিনীপুর এবং সুবর্ণরেখার তীরবর্তী অঞ্চল সহ সমস্ত উড়িষ্যা প্রদেশ আফগান পাঠানদের অধিকারে আসে। কালাপাহাড় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হিন্দুই ছিলেন। তাঁর আসল নাম ছিল রাজীব লোচন রায়। এক মুসলমান সেনাধ্যক্ষের কন্যার প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ করতে বাধ্য হন। হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অবাঞ্ছিত নিদানে তিতিবিরক্ত ও কোপিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব-তেজের অসারতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে ভয়ঙ্কর হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর আক্রমণ পথের ছোট মন্দির তো বটেই, কোনারকের সূর্যমন্দির সহ পুরীর মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের মন্দির তিনি তছনছ করে দিয়েছিলেন। কালাপাহাড়ের আক্রমণের ফলে সুবর্ণরেখার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষরা সে সময়ে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন গুনতেন।



সুলায়মানের পুত্র দাউদ খান করনানী ১৫৭২ সালে যখন পিতৃ-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন সেই সময় তিনি মোগলের বিরূদ্ধে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করেন। দাউদ খানকে দমন করার জন্যে মোগল সম্রাট আকবর শাহ তাঁর সেনাপতি মুনিম খান ও রাজা তোডরমলকে নিযুক্ত করলেন। সুদীর্ঘকাল ধরে সুবর্ণরেখার তীরবর্তী অঞ্চলেই সঙ্ঘটিত হয়েছে অধিকাংশ মোগল-আফগান যুদ্ধ।

সুবর্ণরেখার তীরবর্তী এমনই এক স্থান হল মোগলমারী। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ মোগল-আফগানের ভীষণ যুদ্ধে বহু মোগল নিহত হয়ছিল ওই স্থানে। তাই এই নাম, মোগলমারী। শুধু মোগলমারী কেন, মোগলদের বহু নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এই সমস্ত অঞ্চলে। মোগল রাজত্বের সময় যুদ্ধের কারণে বহু সংখ্যক মোগলের এই প্রদেশে আগমন ঘটেছিল। কেশিয়াড়ির যে জায়গায় তারা থাকত তা মোগলপাড়া নামে পরিচিত হয়। কেশিয়াড়ির মোগলপাড়াতে মোগলদের সময় একটি প্রধান তহশীল কাছারিও ছিল। ওই সময় মোগলদের দ্বারা নির্মিত মসজিদ্গুলির একটিতে আরবি ভাষায় লেখা যে প্রস্তর ফলক পাওয়া যায়, তাতে জানা যায়, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়ে ওই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।

দাউদ খান মোগলমারীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উড়িষ্যায় পালিয়ে যান। মোগলমারীর যুদ্ধের অপর নাম তুকারই-এর যুদ্ধ। একে বাজহাউরার যুদ্ধও বলা হয়। এই যুদ্ধের পরে কটকের সন্ধির শর্ত অনুসারে দাউদ খান উড়িষ্যা নিজের কাছে রেখে বাংলা-বিহার মোগলদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর ১৫৭৫ সালের অক্টোবর মাসে মুনিম খান-এর মৃত্যু ঘটে। বাংলার মোগল সুবাদার নিযুক্ত হন বৈরাম খানের ভাইপো হোসেন কুলী খান। দাউদ খান-এর পুনরায় উত্থান ঘটে। অবশেষে ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে হোসেন কুলী খান ও রাজা তোডরমল দাউদ খানকে পরাজিত ও বন্দি করেন। দাউদ খানকে হত্যা করে দাউদের ছিন্ন মস্তক আগ্রায় আকবর শাহের কাছে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ সম্রাট আকবর রাজা মানসিংকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন আফগান-পাঠানদের দমন করার জন্যে। আকবর শাহ-র মৃত্যুর পরেও পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরও ১৬০৫ সালে রাজা মানসিংকে কিছু সময়ের জন্যে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন। মোগল পাঠান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে সুবর্ণরেখার যুদ্ধে। শাজয়াল খান রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন, কিন্তু মোগলবাহিনীর দ্বারা সাংঘাতিকভাবে পরাজিত হয় আফগানরা।

কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari
কুলটিকরি গড়ের প্রাচীর। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

ওই সময়কালে প্রতিনিয়ত মোগল-আফগান যুদ্ধে এই এলাকার জনজীবন ছিল কখনও কখনও উৎপীড়নে বিপর্যস্ত এবং অশান্তিতে উদভ্রান্ত। মোগল-পাঠানের নিয়ত বিবাদে, সেই সঙ্গে স্থানীয় জমিদারের অত্যাচারে প্রজাসাধারণ প্রচণ্ড আশান্তিতে দিন কাটাত। সেই সময় প্রজাদের ধন প্রাণ একেবারেই নিরাপদ ছিল না। বেদেরা ছেলে চুরি করত। প্রজাদের নানা রকম কর দিতে হত। দিতে না পারলে দুষ্ট জমিদারেরা প্রজাদের ঘর জ্বালিয়ে দিত, কুলবধুকে ধরে নিয়ে গিয়ে অবমাননা করত। সেই সময় অনেক বৈষ্ণব কবির গ্রন্থে ও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীকাব্যের ভূমিকায়ও এই পরিচয় পাওয়া যায় ।

দীপাকিয়ারচাঁদ রাজ্য ও সামন্তরাজারা

মধ্যযুগে সুবর্ণরেখার দক্ষিণ তীরে আঠেরোটি মতান্তরে বাইশটি জমিদার বংশ গড়ে উঠেছিল। তাঁরা নিজেদের রাজা বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। এঁরা প্রত্যেকেই স্বাধীন ছিলেন, তবে সুযোগ পেলেই প্রতিবেশী জমিদারদের আক্রমণ করতেন এবং লুটপাট চালাতেন। নিজেদের জমিদারিতে নিরাপত্তার স্বার্থে এঁরা এক বা একাধিক দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। উড়িষ্যার রাজারা বাংলার দিক থেকে কোনও আক্রমণ এলে তা প্রতিহত করতে। নয়াগ্রামের এই সমস্ত হিন্দু সামন্ত জমিদারদের সাহায্য নিতেন। প্রয়োজনে গড় স্থাপনে উৎসাহিত করার জন্যে ও যুদ্ধে সাহায্য করার জন্যে আর্থিক সহায়তাও করতেন এদের। নয়াগ্রাম এস্টেট ছিল এমনই এক সামন্ত রাজার রাজত্ব।



সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ যখন পাঠান বিদ্রোহ দমন করতে বাংলায় আসেন তখন তাঁর সামরিক বাহিনীর সৈনিক হাউ ভুঁইয়া এখানকার জমিদারদের পরাজিত করে নয়াগ্রামে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। অধিকার করেন ভূমির কর্তৃত্ব। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে অর্থাৎ ১৫৯৩ সাল নাগাদ তাঁর সাহস ও দূরদর্শিতায় সূচনা ঘটে নয়াগ্রাম রাজবংশের। তিনি ছিলেন অযোধ্যা নিবাসী ক্ষত্রিয় বীর এবং পৌরাণিক মান্ধাতা রাজার বংশধর। তখন এই রাজ্যের নাম ছিল দীপাকিয়ারচাঁদ রাজ্য যা কুলটিকরি থেকে মাত্র এক-দেড় মাইল পূর্বে সুবর্ণরেখার উত্তর তীরে অবস্থিত। সম্ভবত তখন এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল নয়াগ্রাম পরগনা। রাজ্যের প্রধান গড় ছিল চারটি- কুলটিকরি, খেলাড়-নয়াগ্রাম, জামিরাপাল, চন্দ্ররেখাগড়। তবে রাজা মানসিংহ ১৫৯৩ সাল নাগাদ যখন উড়িষ্যায় পাঠান দমন করতে আসেন সেই সময়ে যে দীপাকিয়ারচাঁদ রাজ্য সত্যিই ছিল তা উড়িষ্যা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে। মানসিংহ উড়িষ্যাকে মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত করার পর দিল্লি গিয়ে মোগলদরবারে যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন তাতে দীপাকিয়ারচাঁদের উল্লেখ ছিল। তখন সম্ভবত দীপাকিয়ারচাঁদের রাজধানী ছিল নয়াগ্রাম। পরবর্তীকালে নয়াগ্রাম থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে কুলটিকরিতে হয়। L.S.S. O'MALLY ১৯১১ সালে প্রকাশিত তাঁর বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, মেদিনীপুরে লিখেছেন নয়াগ্রাম এস্টেট সম্পর্কে। তিনি আরও উল্লেখ করেন নয়াগ্রাম রাজবংশের রাজধানী ছিল কুলটিকরি। তিনি লিখেছেন, ‘Nayagram Estate- An estate consisting of paragana Khelar-Nayagram, Dippa kiyachand, Jamirapal. The property lies on both banks of Subarnarekha river and is situated in the most jungly part of Midnapore. The head quarter of the estate is at Kultikri.’

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে গঙ্গাধর ভূঁইয়া এই রাজবংশকে প্রকৃতপক্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি রাজা হিসেবে স্বীকৃতি পান। নয়াগ্রাম রাজবংশ হিন্দু মিতাক্ষরা বিধি দ্বারা শাসিত হত। বড় ছেলে রাজা হত আর অন্য সন্তানেরা বাবু হিসেবে জমিদারি বা ভরণপোষণের অধিকার পেতেন। রাজা গঙ্গাধর, রাজা রামচন্দ্র, রাজা গোপীনাথ, রাজা রঘুনাথ এবং বংশের শেষ রাজা ছিলেন পৃথ্বীনাথ। রাজা পৃথ্বীনাথ খেলাড় গড়ে থাকতেন। তবে কুলটিকরি গড়েই বেশি বসবাস করতেন।

কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari
কুলটিকরি রাজবাড়ীর কোন দেবতার মূর্তির ভগ্নাংশ নিকটবর্তী থানে আজও পূজিত হন। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

তবে যোগেশচন্দ্র বসুর 'মেদিনীপুরের ইতিহাস 'ও হরিসাধন দাসের 'মেদিনীপুর ও স্বাধীনতা' বই থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায় যে হাউ ভুইঁয়া এখানকার ভূমিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে অর্থাৎ ১৪৯০ সাল নাগাদ নয়াগ্রামের খেলাড় গড়টি পত্তন করেন রাজা প্রতাপচন্দ্র সি়ংহ। এরপর বলভদ্র সিংহ খেলাড় গড় নির্মাণ শেষ করেন। প্রস্তর নির্মিত সুবৃহৎ রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়টির চতুর্দিকে সুউচ্চ প্রাচীর ও সুগভীর পরিখা ছিল। এই গড়ের ভেতরে নীল প্রস্তরে নির্মিত একটি অশ্বপৃষ্ঠে একত্রে উপবিষ্ট স্ত্রী ও পুরুষের যুগল মুর্তি ছিল। নয়াগ্রাম পরগনায় চন্দ্ররেখাগড় নামে আর একটি গড়ের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়। এই গড়ের দৈর্ঘ্য ছিল ১০৫০ গজ ও প্রস্থ ৭৮০ গজ। মেদিনীপুর জেলায় যতগুলি প্রাচীন গড় আছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় গড় ও সুরক্ষিত ছিল বলে মনে করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে এই রাজবংশের পরবর্তী রাজা চন্দ্রকেতু মতান্তরে চন্দ্রশেখর সিংহ এই গড়টি নির্মাণ করেন। নয়াগ্রাম পরগনা নয়াগ্রাম ও জামিরাপাল এই দুভাগে বিভক্ত ছিল। নয়াগ্রামের রাজারা মঙ্গরাজ ভুঁইয়া ও জামিরাপালের রাজারা পাইকারা ভুঁইয়া। প্রকৃতপক্ষে জামিরাপাল ছিল নয়াগ্রাম রাজার অধীন একটি সিকমি তালুক।

সুবর্ণ-তীরে বর্গী আক্রমণ

সুদীর্ঘকাল ধরে চলা মোগল-আফগান যুদ্ধের সময় বাংলার জনজীবন যে দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল তার চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক জীবন শুরু হল বর্গীদের আক্রমণের সময়। ইতিহাসে মহারাস্ট্রীয় বা মারহাট্টা বা মারাঠারাই বর্গী নামে পরিচিত। ১৭২০ সালে মোগল বাদশাহ মহম্মদ শাহ মারহাট্টাদের প্রথম পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথকে সরদেশমুখী ও শওরাজী সহ দাক্ষিণাত্যের চৌথের অর্থাৎ রাজস্বের চতুর্থাংশ স্বত্ব প্রদান করেন। মহারাস্ট্রীয়রা তখন দস্যুবৃত্তিতে উন্মত্ত হয়ে চৌথ আদায়ের জন্যে দেশের চারদিকে দুর্দান্ত অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে মারমার কাটকাট শব্দে ছোটাছুটি আরম্ভ করে। পঙ্গপালের মতো তারা ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রাম নগরের ওপর এসে পড়ে এবং যা কিছু পায় তা নিয়ে পালায়। তাদের করালগ্রাস থেকে ধনসম্পত্তি রক্ষা করাই তখন লোকের দায় হয়েছিল।

ইতিমধ্যে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়র ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলী খানকে বাংলার নবাব নাজিম নিযুক্ত করেন। একই সঙ্গে সুবেদার ও দেওয়ান হওয়ার কারণে রাজধানী মুর্শিদাবাদের বৈভব ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হল। ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান এবং পরে ১৭৩৯ সালে তাঁর পুত্র শরফরাজ খান বাংলার মসনদে বসেন। নাদির শাহর ভারত আক্রমণে যখন শাসনব্যবস্থায় এক প্রকারের টালমাটাল অবস্থা, সে সময়ে বঙ্গে যখন নিরবিচ্ছিন্ন অরাজকতা বিরাজ করছিল, নাগপুর থেকে বর্গীরা প্রথম বাংলায় প্রবেশ করে এবং লুটপাট আরম্ভ করে। ভোঁশলে রাজার দেওয়ান ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গীরা পঞ্চকোটের পার্বত্য পথ দিয়ে মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়া প্রভৃতি স্থানে এসে উপস্থিত হয়। মেদিনীপুর উড়িষ্যার সীমান্তদেশে অবস্থিত হওয়ায় এই প্রদেশটি বিশেষরূপে বর্গীদের অত্যাচার সহ্য করেছিল। ১৭৪০ সালের ২৯ এপ্রিল আলিবর্দী খান নিজেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব বলে ঘোষণা করেন। নবাব আলিবর্দীর শাসনকালে বাংলায় বর্গীর হাঙ্গামা এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘটনা। এই সময়কালে বর্গীদের বারবার আক্রমণে নবাব আলিবর্দী ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন।



১৭৪৪ সালে রঘুজি ভোঁসলে পুনরায় ভাস্কর পণ্ডিতকে বঙ্গে প্রেরণ করেন। এই সময় আলিবর্দী খানকে মেদিনীপুরে ভাস্কর পণ্ডিত আক্রমণ করেন। তখন বলপ্রয়োগে বর্গীদের প্রতিহত করার উপায় নেই বুঝতে পেরে নবাব আলিবর্দী কূটপন্থা অবলম্বন করলেন। সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে সুবর্ণরেখার তীরে ভাস্কর পণ্ডিতকে নিজের শিবিরে ডেকে এনে তাঁর মানবলীলা সাঙ্গ করলেন। এই ভাস্কর পণ্ডিতের নাম অনুসারেই হয়েছে ভাস্করঘাট বা ভসরাঘাট ।

রঘুজি ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে বাংলার হতভাগ্য অধিবাসীদের ওপর শুরু করলেন এক অমানুষিক অত্যাচার। বর্গীদের শানিত তরবারির অগ্রভাগ থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, হিন্দু-মুসলমান কেউ নিষ্কৃতি পায়নি। তারা গ্রাম শহর পুড়িয়ে, শস্যের ভাণ্ডারে আগুন লাগিয়ে এবং শেষে মানুষের নাক কান কেটে ও মহিলাদের স্তন কেটে নির্যাতিত করে নির্দয়ভাবে বাংলার প্রজাকূলকে সংহার করতে আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত নবাব আলিবর্দি ১৭৫১ সালে রঘুজি ভোঁশলের সঙ্গে একটা চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী সুবর্ণরেখা নদী বাংলা ও উড়িষ্যার সীমা হিসেবে নির্ধারিত হয়। নদীর দক্ষিণাংশ উড়িষ্যা ও উত্তরাংশ বাংলা হিসেবে পরিগণিত হয়। আলিবর্দী খান বাৎসরিক বারো লক্ষ টাকা করে মারাঠাদের দিতে থাকলেন। উড়িষ্যা মারাঠাদের অধিকারে থাকে। তবুও মারাঠারা নদী পেরিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে অবাধে লুন্ঠন চালাত। ওই সময়ে রোহিনী, সাঁকরাইল, দীপাকিয়ারচাঁদ হয়ে মেদিনীপুর পর্যন্ত যে সমস্ত জনপদ ছিল, তা চরম দুর্দশায় পড়েছিল।

বর্গীরা এইসময় সুবর্ণরেখার দক্ষিণতীরের নানাস্থানে ঘাঁটি গাড়ে। এমনই একটি ঘাঁটি হল বর্গীডাঙা, যা গোপীবল্লভপুরের কাছে অবস্থিত। এছাড়াও নয়াগ্রাম থানার দেউলবাড় গ্রামে সুউচ্চ টিলার ওপর মাকড়া পাথরে তৈরি রামেশ্বর শিবের মন্দির সংলগ্ন স্থানেও বর্গীদের ঘাঁটি ছিল। এই মন্দির টিলা থেকে নদীর উত্তর তীরের সুবর্ণরেখা অববাহিকা অঞ্চলের রোহিনী কুলটিকরির বিস্তৃত স্থানে নবাব সৈন্যের গতিবিধিতে নজর রাখা যেত। সুযোগ বুঝে বর্গীরা নদী পেরিয়ে রোহিনী, সাঁকরাইল, কুলটিকরি, দীপাকিয়ারচাঁদ থেকে খড়্গপুর, মেদিনীপুর পর্যন্ত লুটপাট চালাত এবং তাড়া খেলে নদী পেরিয়ে দক্ষিণে নিজেদের নিরাপদ ঘাঁটিতে ফিরে যেত।

মুসলমান রাজত্বের শেষভাগে নয়াগ্রাম ও জামিরাপালের রাজারা মারাঠাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করেছিলেন। কোম্পানির রাজত্বের প্রথম আমলেও তাঁরা কোম্পানির সঙ্গে শত্রুতা করেছিলেন। ১৮০৩ সালের দ্বিতীয় মারহাট্টা যুদ্ধের পর পটাশপুর প্রভৃতি স্থান, যেগুলি মারাঠাদের অধিকারে ছিল, তা কোম্পানির দখলে এলে নয়াগ্রামের রাজা দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান। যোগেশচন্দ্র বসুর ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ বই থেকে ও কথা জানা যায়, যদিও কোন রাজা তা উল্লেখ নেই। ইংরেজ কালেক্টরেট ও’ম্যালি-ও তাঁর মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। ইংরেজ গভর্নমেন্ট রাজার ছেলে পরশুরাম সিংহের সঙ্গে নয়াগ্রাম জমিদারির বন্দোবস্ত করেছিল।

১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যুর পর পুত্র নজমউদ্দৌলা ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করে ইংরেজদের বাংলা রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করেন এবং কোম্পানির বৃত্তিভোগী হন। ওই ১৭৬৫ সালেরই ১২ আগস্ট দিল্লির মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম এলাহাবাদ চুক্তির শর্ত অনুসারে রবার্ট ক্লাইভকে জায়গীর হিসেবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্পণ করেন। এই দেওয়ানিই বাংলায় ইংরেজ রাজত্বের প্রধান দলিল।

কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari
কুলটিকরি রাজবাড়ীর মন্দির। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

ইংরেজ শাসনকালেও মারাঠাদের অত্যাচারের সীমা পরিসীমা ছিল না। মহারাস্ট্রীয় সেনাপতি নীলু পণ্ডিত যখন বা়ংলা আক্রমণ করেন তাঁদের অত্যাচারে মেদিনীপুর শ্রীহীন শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। শস্যের অভাবে, খিদের জ্বালায় মানুষ কলাগাছের তেউড় এবং পশুরা খড় ও পোয়ালের অভাবে গাছের পাতা খেয়ে করে খিদে মেটাত। যখন তাও জোটাতে পারেনি তখন নিজের বাসগৃহ, গ্রাম ও আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করে যে যেদিকে পেরেছিল পালিয়ে গিয়েছিল। ১৮০৩ সাল পর্যন্ত বাংলার বুকে ঘটেছিল বারবার মারাঠা তথা বর্গী আক্রমণ। অবশেষে ১৮০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর, বেরারের রাজার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে সন্ধি হয় তার পরে বর্গীদের দখলে থাকা পটাশপুর, ভোগরাই ও কার্মাদচোর পরগণা সমেত সমস্ত উড়িষ্যা প্রদেশ কোম্পানির অধিকারভুক্ত হয়।

‘ছেলে ঘুমাল, পাড়া জুড়াল, বর্গী এল দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কীসে’। বাংলার বর্গীকাহিনি ছেলে ঘুম পাড়াবার ছড়া নয় শুধু, বাঙালির রক্তরঞ্জিত বেদনার এক বেদনাদগ্ধ অশ্রুসিক্ত কাহিনি।

কুলটিকরি গড় ও রাজকন্যা রাউতমণির কথা

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি আলিবর্দী যখন বাংলার নবাব সেই সময়ে দীপাকিয়ারচাঁদ, বর্তমানে কিয়ারচাঁদ রাজ্যের রাজা ছিলেন জহর সিং। তিনি ছিলেন ছোটখাট এক সামন্ত রাজা। এই সামন্ত রাজার গড় ছিল কুলটিকরিতে। বর্গীদের আক্রমণ ও অন্যান্য বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও প্রজাদের রক্ষা করার জন্যে কুলটিকরির প্রায় এক মাইল পূর্বে দীপাকিয়ারচাঁদ প্রান্তরে সারি দিয়ে প্রায় একহাজার মতো পাথরের স্তম্ভ স্থাপন করেন। স্তম্ভগুলি ছিল আড়াই ফুট থেকে প্রায় সাড়ে চার ফুট উচ্চতার। পাথরের উপরিভাগ মানুষের মাথার আকৃতির মতো অনেকটা গোলাকার। আসলে এই পাথরের স্তম্ভগুলো স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের মৃত আত্মীয়দের উদ্দেশ্য এবং স্মরণে তৈরি করেছিল। এইগুলি কু্লটিকরির আশেপাশের জঙ্গলে ইতঃস্তত ছড়িয়ে ছিল। অসম, মেঘালয়ের গারো, খাসি, নাগা পর্বত ও ছোটোনাগপুরের কিছু জায়গায় এমন পাথরের স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। রাজা জহর সিং এই স্তম্ভগুলি তুলে এনে দীপাকিয়ারচাঁদ প্রান্তরে সারিবদ্ধ ভাবে বসিয়েছিলেন। শত্রুপক্ষের মনে ভয় চারিয়ে দেওয়ার জন্যে রাতে স্তম্ভগুলির মাথায় আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো যাতে মনে হয় সারি সারি অশ্বারোহী সৈন্য দীপাকিয়ারচাঁদ রাজ্য পাহারা দিচ্ছে। রাত্রিতে যখন এই আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হত তখন তা চাঁদের আলোকেও হার মানাত। দীপের আলোর জন্যেই দীপকিয়ারচাঁদ বা দীপাকিয়ারচাঁদ।



রাজা জহর সিং বর্গীদের ও অন্যান্য শত্রুদের হাত থেকে তাঁর রাজ্যকে রক্ষা করতে পারলেও পরবর্তী রাজা কালু ভুঁইয়া তা পারেননি। তখন নদীর দক্ষিণ তীরে নয়াগ্রামের মারাঠাদের অধীনে বাইশ গড়ের রাজা ছিলেন দিব্য সিংহ মান্ধাতা মতান্তরে রঘুনাথ সিংহ। যেমন বীর তেমনই ছিলেন লুঠেরা ডাকাত। তাঁর ভয়ে আশেপাশের সমস্ত জমিদারেরা সন্ত্রস্ত থাকতেন। ময়ূরভঞ্জ রাজদরবারেও ছিল তাঁর বিপুল সমাদর। আসলে উড়িষ্যা তো সেই সময়ে মারাঠাদের দখলে ছিল। আর মারাঠারা অর্থাৎ বর্গীরা এই দক্ষিণ তীরের রাজাদের সাহায্য নিয়েই বাংলা আক্রমণ করতেন।

কুলটিকরি গড়ের রাজা কালু ভুঁইয়ার রাজ্যসীমা ছিল বর্তমান সাঁকরাইল থানার রখণি, পাটাশোল, জঙ্গলকুড়চি, কুলটিকরি হয়ে কেশিয়াড়ি থানার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত বেহেরাসাই পর্যন্ত। রাজা কালু ভুঁইয়ার ছিল এক রানি নাম কুসুম, আর ছিল এক রাজকন্যা রাউতমণি। রাউতমণি ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। তাঁর রূপের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মহারাজ দিব্য সিংহ এই সুন্দরী রাজকন্যার রূপের কথা শুনে তাঁকে বিবাহ করার জন্যে কালু ভুঁইয়ার কাছে প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু এমন এক ডাকাত সর্দারের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিবাহ প্রস্তাব শুনে কালু ভুঁইয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। ক্রোধে অন্ধ হয়ে নয়াগ্রামের রাজা দিব্য সিংহ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে দীপাকিয়ারচাঁদ রাজ্য আক্রমণ করলেন। তখন রানি ও রাজকন্যা কুসমা দিঘিতে নৌকাবিহার করছিলেন। অকস্মাৎ দিব্য সিংহ সেই দিঘি নিজের সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেন। খবর পেয়ে কালু ভুঁইয়া সসৈন্যে কুসমাদিঘির দিকে ধাবিত হন। রণডাঙায় দিব্যসিংহের সঙ্গে কালু ভুঁইয়ার সাতদিন ধরে প্রবল যুদ্ধ হয়। মৃত সৈন্যের রক্তে নিকটবর্তী কুণ্ড ভরে যায়। তারই স্মৃতি নিয়ে এই কুণ্ড আজও রক্তিয়াকুঁড় নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে কালু ভুঁইয়ার মৃত্যু হয় এবং রানি কুসুম সেই কুসমা দিঘিতে আত্মহত্যা করেন। দিব্য সিংহ দীপাকিয়ারচাঁদ রাজ্য অধিকার করেন, রাজকন্যা রাউতমণিকে নয়াগ্রামে এনে বিবাহ করেন।

রাজা দিব্য সিংহ রাউতমণিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। সুপুরুষ রাজা দিব্যসিংহের ভালোবাসায় যে কোনও খাদ ছিল না তা রাউতমণিও জানতেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি ভুলতে পারেন না যে এই রাজার হাতেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং এর জন্যেই তাঁর মাতাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। হাজার চেষ্টা করেও সুন্দরী রাজকন্যা রাউতমণি কিছুতেই পিতৃ-মাতৃ হন্তারককে স্বামী বলে মেনে নিতে পারেননি।

কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari
কুলটিকরি গড়ের ভেতর থেকে গুলি করার জন্য দেওয়ালে তৈরী করা গর্ত। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

বিকেল হলেই কুলটিকরির আকাশ বাতাস যেন তাঁর মন কেড়ে নেয়। প্রতি বিকেলেই তিনি রাজপ্রাসাদের উত্তরের জানালা খুলে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকেন সুবর্ণরেখা নদীর অপর পাড়ে কুলটিকরি রাজপ্রাসাদের দিকে। রাজার মনে সন্দেহ দেখা দেয়। রানি রাউতমণি কি অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত! তিনি কি রাজাকে ছলনা করে চলেছেন! পরীক্ষা করার জন্যে একদিন বিকেলে রাজা দিব্য সিংহ ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র হয়ে সুবর্ণরেখার তীর বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে ঘোরাঘুরি করছিলেন, কিন্তু চোখ রেখেছিলেন রাজপ্রাসাদের দিকে। তিনি দেখলেন সত্যিই রানি রাউতমণি উত্তরের জানালা দিয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে। রাজা দিব্য সিং চুপিসাড়ে অন্তঃপুরে এসে রানি কে তাঁর সঙ্গে ভ্রমণে যাওয়ার আহ্বান জানালেন। রানি তা প্রত্যাখ্যান করায় ক্রোধোন্মত্ত রাজা অকস্মাৎ রানি কে নিজের তরবারি দিয়ে হত্যা করলেন। ঘটনার পর রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারেন তাই রানির স্মৃতি রক্ষার জন্যে নয়াগ্রাম এস্টেটের রাজধানী নয়াগ্রাম থেকে কুলটিকরিতে স্থানান্তর করেন।

কুলটিকরিতে রাজধানী স্থানান্তরের সময় এই রাজবংশের বীরত্বের প্রতীক হিসেবে কুলটিকরি গড়ে ১২ টি খড়্গ আনা হয়। ২২ টি জমিদারের প্রতীক হিসেবে খড়্গগুলো চিহ্নিত ছিল। এই রাজবংশের কুলদেবী সিংহবাহিনী দুর্গা কুলটিকরিতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কারও মতে তিনি অভয়াদুর্গা। অভয়াদুর্গার মন্দিরের চূড়া নয়াগ্রাম রাজপ্রাসাদ থেকে দেখা যেত। এছাড়াও মন্দিরের আমলকসহ চতুর্ভুজ নারায়ণ নৃসিংহ মুর্তিও ছিল। কুলটিকরির সাতদুয়ারি রাজপ্রাসাদে কষ্টিপাথর ও অন্যান্য পাথরের বহু শিবলিঙ্গ ও বিষ্ণুমুর্তি এবং কুলটিকরির নিকটবর্তী বালিগেড়িয়াতেও কষ্টিপাথরের সুন্দর দ্বাদশ শিবলিঙ্গ স্থাপিত ছিল।

কুলটিকরি রাজবাড়ির অন্তিম পর্যায়

রাজা রঘুনাথের ছেলে পৃথ্বীনাথ। রাজা পৃথ্বীনাথের দুই রানি। রানি কুয়োরমণি দেই ও রানি গোলকমণি দেই। কুয়োরমণি দেই-এর একমাত্র কন্যা হলেন মোহিনী দেই। রাজা পৃথ্বীনাথ ১৮৮৪ সালে মারা যান। তিনি ভিজিয়িনার মহারাজের কাছে ঋণগ্রস্ত ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এই সম্পত্তি কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে ন্যাস্ত হয়। বাইশ গড়ের সরকারি কর মেটাতে না পারায় সূর্যাস্ত আইনে নিলামে ওঠে রাজ্য। রানি কুয়োরমণি দেই রাজার ঋণ শোধ করতে খেলাড়-নয়াগ্রাম পরগনাটি ১৮৯০ সালে পাঁচ লাখ টাকায় মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে ব্রিটিশের চাতুরীতে বিক্রি করে দেন। পরে কুয়োরমণি দেই নবাব বাহাদুরের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কুলটিকরি রাজবাড়ি তাঁর দৌহিত্র উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেন । শুধু দীপাকিয়ারচাঁদ ও নাপে পরগনা ( ?) অধিকারে থাকে। পরে কুয়োরমণি দেই নবাব বাহাদুরের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কুলটিকরি রাজবাড়ি তাঁর দৌহিত্র উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেন। রানি কুয়োরমণির জামাতা রায় বসন্ত সিংহ রাজ্য পরিচালনা করেন। তাঁর আমলে প্রজাদের ওপর বেশ অত্যাচার অবিচার বেড়ে যায়। নারীলোলুপতা, মদ্যপান, মামলা -মোকোদ্দমা, চুরি-ডাকাতি হামেশাই ঘটতে থাকে। এই সমস্ত রাজাদের সহায়তায় গ্রামে ডাকাতদলও গড়ে ওঠে। ডাকাতদের লুঠ করা সামগ্রীর একাংশ নজরানা পেতেন রাজা। দুর্ধর্ষ ডাকাত বড় টিপু ও ছোটো টিপু সাঁওতালের নাম শুনলে মানুষের হৃৎকম্প হতো।



রায় বসন্ত সিংহের ছেলে ঈশ্বরচন্দ্র শৌখিন ছিলেন। ছিলেন ভোজনরসিক ও নৃত্যগীতের অনুরাগী, কিন্তু প্রজাপীড়নে কমতি ছিল না। তাই নিপীড়িত প্রজাদের কিছুজন প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তাঁরা পৃথ্বীনাথ সিংহের ভাইপো নয়াগ্রামের গোলাপ সিংহকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন সম্ভবত ১৯৩৪-এ।

রানি কুয়োরমণির আমলে একটি পাঠশালা ও দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল। পরবতীকালে এগুলি বন্ধ হয়ে যায়। কুয়োরমণির আমলে ম্যানেজার রাজকৃষ্ণ মণ্ডলের দক্ষতায় লোধাপুকুর, সাতবনি, কদমা প্রভৃতি পুকুরের সংস্কার হয়। রাজবাড়ির উত্তরের প্রান্তরে নানাজাতের প্রায় একহাজার আমগাছের সুন্দর বাগানটি গড়ে ওঠে। কুলটিকরি থেকে কুসুমপুর রাস্তা ও পুলগুলি তৈরি হয়।

কুলটিকরি রাজবাড়ি, Kultikri Rajbari
এই থানেই দেবতার মূর্তির বিভিন্ন ভগ্নাংশ রয়েছে। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

কুলটিকরি রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষটুকু কিছু বছর আগেও ছিল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ির ভেতরে স্থানে স্থানে ঝোপঝাড়, আর কিছু সুড়ঙ্গও ছিল। সুড়ঙ্গগুলি ধাপে ধাপে নেমে গেছে নীচের দিকে। সুড়ঙ্গর মুখগুলি ভাঙা, অন্ধকার আর ঝাঁটিজঙ্গলে ভরা। লোকমুখে শোনা, এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে গেলে একমাইল পূর্বে দীপাকিয়ারচাঁদ প্রান্তরে ওঠা যায়। রাজারা সাধারণত যুদ্ধের সময় এই পথ ব্যবহার করতেন। আর ব্যবহার করতেন রানি ও রাজকন্যারা । রাজবাড়ি থেকে কুসমা দিঘিও প্রায় এক মাইল পুবে। কথিত আছে, কালু ভুঁইয়ার রানি কুসুমের নাম অনুসারেই এই দিঘির নাম কুসমা দিঘি। কুলটিকরির দক্ষিণে প্রায় এক-দেড় মাইল দূরে রোহিণী যাওয়ার পথে যে খালটি তিরতির করে সারা বছর বয়ে চলে, তার নাম কুসমি। সেটিও রানির নাম অনুসারে। রানি বা রাজকন্যা সাধারণত যখন কুসমা দিঘিতে নৌকাবিহারে যেতেন বা মন্দিরে যেতেন, কুলটিকরি রাজবাড়ি থেকে এই সুড়ঙ্গ পথেই বেশিরভাগ সময় যেতেন। আসলে প্রজাদের সামনে খুব একটা আসতেন না তাঁরা। এছাড়াও রাজবাড়ির গা ঘেঁষেই ছিল রাজার এক পুকুর। রাজবাড়ির গা থেকেই পাথরের সোপানশ্রেণি নেমে গেছে জল পর্যন্ত। নাম চাঁদনি পুকুর। সেই সময় কুলটিকরি গ্রামটি ছিল শাল,মহুয়া, কুর্চি, কেন্দুর জঙ্গলে ঘেরা আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু সাঁওতাল, ভূমিজ, লোধা সম্প্রদায়ের মানুষের কুটির। কাঁকুরে লালমাটি, তরঙ্গায়িত মালভূমির ধু-ধু পাথুরে প্রান্তর। ছোটখাট দু-একটা টিলা। এই পাথুরে প্রান্তরের মাঝে ছিল রাজার গড়। গড়ের গা ঘেঁসে টলটলে স্বচ্ছ জলের চাঁদনি পুকুর। যখন চাঁদের আলো পড়ত, তখন তা অপরূপ হয়ে উঠত। তাই নাম চাঁদনি পুকুর।

নদী তার আপন খেয়ালে কলকল ছলছল শব্দে নিরন্তর বয়ে চলেছে । সে অতীতের সাক্ষী সে বর্তমানকে দেখছে। দেখবে ভবিষ্যৎও। কিন্তু কুলটিকরি রাজবাড়ির যে ধ্বংসাবশেষটুকু প্রায় পঁচিশ বছর আগেও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে কিছু দিন আগেও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে থাকা দীপাকিয়ারচাঁদের মায়াসৈন্য। হয়ত ওখানকার মাটির নীচে কান পাতলে শোনা যাবে ওই সমস্ত রাজকাহিনি। শুধু এক আধজন প্রবীণ তাঁর পূর্বপুরুষের কাছে শোনা অতীতের এই রাজকাহিনির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এখনও ফিরে যান সেই সময়ে।


midnapore.in

(Published on 20.12.2020)
তথ্যঋণ:
১. মেদিনীপুরের ইতিহাস (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ) – যোগেশচন্দ্র বসু। অন্নপূর্ণা প্রকাশনী। পৌষ, ১৪১৬।
২. Bengal District Gazetteers – Midnapore – L.S.S. O’Malley (Published in 1911). Government of West Bengal. December, 1995.
৩. মেদিনীপুর ও স্বাধীনতা – হরিসাধন দাস। সেপ্টেম্বর, ২০০১।
৪. মেদিনীপুর উৎসব, মেলা ও অর্থনীতি – হরিসাধন দাস। জানুয়ারি, ১৯৯৮।
৫. জঙ্গলমহল কথা – সম্পাদনাঃ তাপস মাইতি। উপত্যকা। আগস্ট, ২০১৬।
৬. মেদিনীপুরের গ্রামের কথা (প্রথম খণ্ড) – সম্পাদনাঃ তাপস মাইতি। উপত্যকা। জুলাই, ২০০৬।
৭. পুরাকীর্তি সমীক্ষাঃ মেদিনীপুর - শ্রীতারাপদ সাঁতরা। প্রত্নতত্ত্ব অধিকার, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। জানুয়ারি, ১৯৮৭।
৮. ঝাড়্গ্রামঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি – মধুপ দে। মনফকিরা। জানুয়ারি, ২০১৩।
৯. সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা – নলিনী বেরা। দে’জ পাবলিশিং। তৃতীয় সংস্করণ মে, ২০১৯।
১০. Google
১১. Wikipedia.