মহেন্দ্রনাথ করণ

Home » Medinikatha Journal » Mahendranath Karan


খেজুরীর বিস্মৃতপ্রায় মণীষা মহেন্দ্রনাথ করণ

Khejuri's forgotten talent Mahendranath Karan

সুদর্শন সেন।


খেজুরীর সুবিখ্যাত ইতিহাসকার ও সুসাহিত্যিক মহেন্দ্রনাথ করণ জন্মগ্রহণ করেন খেজুরী-২নং ব্লকের ভাঙ্গনমারি গ্রামের এক জমিদার পরিবারে। সালটা ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর। পিতা সম্পন্ন জমিদার ক্ষেমানন্দ করণ একজন সু-সংস্কৃতিবান ও প্রজাহিতৈষী জমিদার হিসেবে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন। এই করণ পরিবার অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে দঃ ২৪ পরগনার সাগরদ্বীপ অঞ্চল থেকে ভাঙ্গনমারী গ্রামে চলে আসেন ভাগ্যান্বেষণে। কশাড়িয়ার মণ্ডল ও ভাঙ্গনমারীর করণ এই দুইটি পরিবার ' মুড়াকাটি ' প্রজারূপে পরিচিত ছিল। কারণ এরা অষ্টাদশ শতকে ধীরে ধীরে খেজুরীর বিভিন্ন অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠার সময় প্রথমদিকে জঙ্গল কেটে খেজুরীর এই অঞ্চলে আদি বাসিন্দা হিসেবে বসতি গড়ে তোলেন৷

খেজুরীর বিস্মৃতপ্রায় মণীষা মহেন্দ্রনাথ করণ | Khejuri's forgotten talent Mahendranath Karan
মহেন্দ্রনাথ করণ | ডান দিকের ছবিটি ইংরেজি ১৯১২ সালে মার্চ মাসে কলকাতায় "সর্ব বঙ্গ শিক্ষা সম্মিলন" সভায় সমবেত প্রতিনিধিদের মধ্যে উপবিষ্ট অবস্থায়।

মহেন্দ্রনাথের পিতা ক্ষেমানন্দবাবু জমিদার হলেও ছিলেন ব্যাতিক্রমী চরিত্রের মানুষ। তিনি বাংলা ১৩১২ সালের ১২ই কার্তিক খেজুরীর অজানবাড়ী হাটে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে জনসভা বিপুল জনতার সমাবেশে সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মহেন্দ্রনাথের মাতা সুভদ্রামণি দেবী ছিলেন খেজুরীর বোগা গ্ৰামের প্রখ্যাত জমিদার গয়াপ্রসাদ মিদ্যা ও মোহিনীদেবীর কন্যা। আবার মহেন্দ্রনাথের মাতামহী মোহিনীদেবী ছিলেন কশাড়িয়ার সুসাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্ৰামী মণীন্দ্রনাথ মন্ডলের পিতামহ খেজুরীর আদি নাট্যকার রসিকচন্দ্রের কন্যা। সেইহেতু বিখ্যাত লেখক মণীন্দ্রনাথ ছিলেন মহেন্দ্রনাথের সম্পর্কিত মামা। বয়সে ছয় বছরের ছোট হলেও মহেন্দ্রনাথ ও মণীন্দ্রনাথ দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। দু'জনেই তৎকালীন খেজুরী তথা মেদিনীপুরের অন্যতম সুসাহিত্যিক ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতৃত্বরূপে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

মহেন্দ্রনাথ বাল্যকালে গ্রামের পাঠশালায় ও পরবর্তীকালে খেজুরীর জালিয়াঘাটা এম. ই স্কুলে পাঠ সমাপনের পরে কাঁথি হাইস্কুলে ভর্তি হন। কাঁথি হাইস্কুলে অন্যতম মেধাবী ছাত্ররূপে পরিচিত ছিলেন চিররুগ্ন মহেন্দ্রনাথ। ক্লাসের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি দু'টি রৌপ্য ও একটি স্বর্ণপদকও লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হলে তিনি গঠন করেন ' বন্দেমাতরম ভিক্ষু সম্প্রদায় '। এই ছাত্র দল গ্রামে গ্রামে ও শহরে ঘুরে ঘুরে বঙ্গভঙ্গের কুফল বোঝানোর চেষ্টা করতো সাধারণ মানুষকে এবং এ-বিষয়ক পুস্তিকাও বিক্রি করত। এ সময়ই মহেন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর সুবিখ্যাত পুস্তিকা 'বঙ্গ লক্ষীর ব্রতকথা'( ১৯০৫)। পরবর্তীকালে তাঁকে আমরা পেয়েছি একজন সুদক্ষ সাহিত্যিক হিসেবে। তাঁর মাত্র ৪২ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এগুলির মধ্যে - 'পৌন্ড্রক্ষত্রিয় জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ', 'পৌন্ড্রক্ষত্রিয় কুলপ্রদীপ ' (১৩৩৫ বঙ্গাব্দ), 'পৌন্ড্রক্ষত্রিয় জাতির বৃহত্তর ইতিহাস ', 'পৌন্ড্রক্ষত্রিয় বনাম ব্রাত্য-ক্ষত্রিয় ' (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ), ' হিজলীর মসনদ-ঈ-আলা ' (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) ও 'খেজুরী বন্দর ' (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

খেজুরীর বিস্মৃতপ্রায় মণীষা মহেন্দ্রনাথ করণ | Khejuri's forgotten talent Mahendranath Karan
মহেন্দ্রনাথের নিজের হাতে করা সই।

তাঁর প্রকাশিত উপরোক্ত গ্রন্থগুলির মধ্যে শেষোক্ত গ্রন্থদুটি তাঁকে বিপুল খ্যাতির অধিকারী করে তোলে। তবে অকালে প্রয়াত হওয়ায় তিনি তাঁর গ্রন্থের যে বিপুল সমাদর তা তিনি স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেননি । মহেন্দ্রনাথ ইং ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে স্বসম্প্রদায়ের ইতিহাস অনুসন্ধানে অনিসন্ধিৎসু হয়ে প্রকাশ করেন ' A Short History and Ethnology of The Cultivating Pods' । পৌন্ড্র ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের ওপরে প্রকাশিত প্রথম গ্ৰন্থ এটি। এই গ্ৰন্থটি মহেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরবর্তীকালে পাঁচটিরও বেশি দেশী -বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা থেকে একাধিক সংস্করনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অপ্রকাশিত অনেকগুলি বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত ছিল, কিন্তু অসময়ে তিনি চলে যাওয়ায় সেগুলি প্রকাশিত হয়নি এবং বাংলা ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের এতদ্অঞ্চলের প্রবল বন্যায় তাঁর অধিকাংশ পাণ্ডুলিপিসহ ব্যক্তিগত সুবৃহৎ গ্রন্থাগারের ( ক্ষেমানন্দ পাঠাগার ) বহু পুস্তক বিনষ্ট হয়। এছাড়াও অতি উৎসাহী অনুসন্ধিৎসু কিছু ব্যাক্তি মহেন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুস্তক সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ায় - সেগুলির প্রকাশ দূরের কথা অনেক চেষ্টা করে তা আমরা চোখের দেখাও দেখতে পারিনি । মহেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কোহিনূরকান্তি করনের উদ্যোগে 'মহেন্দ্রচরিত' নামে তার সম্পর্কে একটি মূল্যবান সংকলন গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়। এতে স্বপ্লায়ু জীবনের অধিকারী বিরাট ব্যাক্তিত্বসম মহেন্দ্রনাথ করণের চরিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। পুস্তকটি দীর্ঘকাল দুষ্প্রাপ্য থাকার পর ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে একটি সংস্থার উদ্যোগে দঃ ২৪ পরগণায় পুনঃ প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংস্থার কর্মকর্তা ধীরেন্দ্রনাথ দাসবাবু মহেন্দ্রনাথের “পৌন্ড্রক্ষত্রিয় কূলপ্রদীপ ” ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বই পুনঃপ্রকাশ করেছিলেন বলে শুনেছি।

সম্প্রতি উ: ২৪ পরগণার একটি সংস্থা “পৌন্ড্র মহাসংঘ" মহেন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি বই ও লেখা পুনঃপ্রকাশ করেছেন তাদের 'পৌন্ড্র মণীষা ' গ্রন্থের ৭টি খণ্ডে। ব্যক্তি মহেন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীতের সমঝদার বোদ্ধা, আবার চিত্রশিল্পী, হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, সার্ভেয়ার, স্কুলশিক্ষক, পত্রপত্রিকার লেখক ও প্রকাশক আবার অন্যদিকে দরদী জমিদার, স্বাধীনতা সংগ্রামীও। মহেন্দ্রনাথের দুষ্প্রাপ্য একটি ছবিতে তাঁকে বেহালাবাদনরত অবস্থায় দেখা যায়। বহুল প্রচারিত মহেন্দ্রনাথের ছবিটি তাঁর নিজেরই আঁকা। মহেন্দ্রনাথ তাঁর ভাঙ্গনমারি গ্ৰামের বাড়িতে ( ক্ষেমানন্দ কুটির ) একটি সার্ভে স্কুল খুলেছিলেন যাতে বেকার যুবকরা সার্ভে শিখে আত্মনির্ভর হতে পারে। এছাড়াও ১৯১৬ খ্রীঃ ২০ শে মে তাঁরই উদ্যোগে জনকা আলেকজান্দ্রা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারী প্রতিষ্ঠিত হয় অজানবাড়ী গ্রামে। বর্তমানে এটি শতবর্ষ উত্তীর্ণ হওয়া একটি প্রতিষ্ঠান - জনকা প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্র রূপে পরিচিত। বর্তমানে খেজুরীর সবচেয়ে প্রাচীন চালু থাকা স্বাস্থকেন্দ্রও এটি।

খেজুরীর বিস্মৃতপ্রায় মণীষা মহেন্দ্রনাথ করণ | Khejuri's forgotten talent Mahendranath Karan
বামদিকের ছবিতে মহেন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যারা। বাম দিক থেকে দাঁড়িয়ে মঞ্জুলা, কোহিনুর ও কৌস্তভ। বাম দিক থেকে বসে প্রমীলা, ঐন্দ্রিলা ও উর্মিলা | ডান দিকের ছবিতে মহেন্দ্রনাথের পত্নী শিরোমনী দেবী ( ৬০ বছর বয়সে )।

মহেন্দ্রনাথের পিতা ক্ষেমানন্দবাবু জমিদার হলেও ছিলেন ব্যাতিক্রমী চরিত্রের মানুষ। তিনি বাংলা ১৩১২ সালের ১২ই কার্তিক খেজুরীর অজানবাড়ী হাটে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে জনসভা বিপুল জনতার সমাবেশে সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মহেন্দ্রনাথের মাতা সুভদ্রামণি দেবী ছিলেন খেজুরীর বোগা গ্ৰামের প্রখ্যাত জমিদার গয়াপ্রসাদ মিদ্যা ও মোহিনীদেবীর কন্যা। আবার মহেন্দ্রনাথের মাতামহী মোহিনীদেবী ছিলেন কশাড়িয়ার সুসাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্ৰামী মণীন্দ্রনাথ মন্ডলের পিতামহ খেজুরীর আদি নাট্যকার রসিকচন্দ্রের কন্যা। সেইহেতু বিখ্যাত লেখক মণীন্দ্রনাথ ছিলেন মহেন্দ্রনাথের সম্পর্কিত মামা। বয়সে ছয় বছরের ছোট হলেও মহেন্দ্রনাথ ও মণীন্দ্রনাথ দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। দু'জনেই তৎকালীন খেজুরী তথা মেদিনীপুরের অন্যতম সুসাহিত্যিক ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতৃত্বরূপে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

মহেন্দ্রনাথ চারটি পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদনাসূত্রে যুক্ত ছিলেন। এগুলির মধ্যে 'পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সমাচার ' (১৩৩০-১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) পত্রিকাটির কথা উল্লেখযোগ্য। প্রথমে মহেন্দ্রনাথ করণ ও ক্ষীরোদচন্দ্র দাস (রামচক) ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে এই পত্রিকাটির প্রকাশ শুরু করেন। মাসিক পত্রিকাটির দু'টি কভার পেজই রঙিন কাগজে ছাপা হত। দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা থেকে এঁর সম্পাদক হন রাইচরণ সরদার ও ক্ষীরোদচন্দ্র দাস। অবার চতুর্থবর্ষ চতুর্থ সংখ্যা থেকে অষ্টম সংখ্যা পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন - ক্ষিরোদচন্দ্র দাস, মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল ও মহেন্দ্রনাথ করণ। পঞ্চমবর্ষের শ্রাবণে প্রয়াণকাল পর্যন্ত মহেন্দ্রনাথ এই সংখ্যার সম্পাদকের দায়িত্ব সামলে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে সম্পাদক পরিবর্তিত হলেও মহেন্দ্রনাথকেই এই পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা থেকে বিতরণ সব দায়িত্ব সামলাতে হতো। বারংবার অসুস্থ হয়ে পড়া ও পর পর গ্রন্থগুলির প্রকাশজনিত ব্যস্ততার কারণে মনে হয় মহেন্দ্রনাথ সাময়িকভাবে সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছিলেন। এছাড়াও 'প্রতিজ্ঞা ' নামক সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সাথে যুক্ত ছিলেন সম্পাদনা সূত্রে। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত এই পত্রিকায় তাঁর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন - ভবসিন্ধু লস্কর। ১৯২১ সাল অবধি এটি চলেছিল। কালীঘাট থেকে শৈলেন্দ্র চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বদান্যতায় এটি প্রকাশিত হত। এছাড়াও মহেন্দ্রনাথ সত্যযুগ (১৯২৭) ও বাত্যক্ষত্রিয় বান্ধব (১৯১০) পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। উপরোক্ত পত্রিকাগুলি দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় এই চারটিপত্রের সম্পাদক ছিলেন মহেন্দ্রনাথ এমন তথ্য কেউ কেউ দিয়েছেন। তবে তা ঠিক নয়। মহেন্দ্রনাথ ছিলেন চিররুগ্ন তাই তাঁর স্বাস্থ্য মোটেই ভাল ছিল না। বাড়ি থেকে দূরে থেকে তাই তাঁর পড়াশোনাও বেশী দূর অবধি করা ওঠা হয়নি। একমাত্র ভ্রাতা যোগেন্দ্রও শৈশবে মৃত হওয়ায় তিনি ছিলেন তাঁর পিতা মাতার একমাত্র সহায়।

খেজুরীর বিস্মৃতপ্রায় মণীষা মহেন্দ্রনাথ করণ | Khejuri's forgotten talent Mahendranath Karan
মহেন্দ্রনাথ করণ।

মহেন্দ্রনাথের পিতা ক্ষেমানন্দবাবু জমিদার হলেও ছিলেন ব্যাতিক্রমী চরিত্রের মানুষ। তিনি বাংলা ১৩১২ সালের ১২ই কার্তিক খেজুরীর অজানবাড়ী হাটে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে জনসভা বিপুল জনতার সমাবেশে সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মহেন্দ্রনাথের মাতা সুভদ্রামণি দেবী ছিলেন খেজুরীর বোগা গ্ৰামের প্রখ্যাত জমিদার গয়াপ্রসাদ মিদ্যা ও মোহিনীদেবীর কন্যা। আবার মহেন্দ্রনাথের মাতামহী মোহিনীদেবী ছিলেন কশাড়িয়ার সুসাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্ৰামী মণীন্দ্রনাথ মন্ডলের পিতামহ খেজুরীর আদি নাট্যকার রসিকচন্দ্রের কন্যা। সেইহেতু বিখ্যাত লেখক মণীন্দ্রনাথ ছিলেন মহেন্দ্রনাথের সম্পর্কিত মামা। বয়সে ছয় বছরের ছোট হলেও মহেন্দ্রনাথ ও মণীন্দ্রনাথ দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। দু'জনেই তৎকালীন খেজুরী তথা মেদিনীপুরের অন্যতম সুসাহিত্যিক ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতৃত্বরূপে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

তবে মহেন্দ্রনাথের অদম্য জ্ঞানলাভের আকাঙ্খা তাঁকে পরিচিত করিয়েছিল তৎকালীন বাংলাদেশের বহু গুণী মানুষের সাথে। এঁদের মধ্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার, বিজ্ঞানী প্রফুল্ল রায়, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের নাম করা যায়। এঁরা ছাড়াও দেশ-বিদেশের বহু মণীষির সাথে তাঁর নিয়মিত পত্র যোগ্যযোগ ছিল। মহেন্দ্রনাথ হাইড্রোপ্যাথিও শিখেছিলেন। দেশী-বিদেশী বহু চিকিৎসকের সাথে তার সু-সম্পর্ক ছিল। বিনে পয়সায় তিনি বহু গ্রামবাসীর চিকিৎসা করতেন আবার বহু দরিদ্র মেধাবী ছাত্রের পড়াশোনারও সুব্যবস্থা করতেন তিনি। এমনই এক ছাত্র ছিলেন সদূর খুলনানিবাসী রাজেন্দ্রনাথ সরকার। পরবর্তীকালে তিনি একজন সু-সাহিত্যিক, দক্ষ সংগঠক ও রাজনীতিবিদে পরিণত হন। তাঁর লেখা 'জীবনকথা' পুস্তকটিতে (আত্মজীবনী) ছাত্রদরদী মহেন্দ্রনাথের একটি সুন্দর পরিচয় ফুটে উঠেছে।

খেজুরীর বিস্মৃতপ্রায় মণীষা মহেন্দ্রনাথ করণ  |  Khejuri's forgotten talent Mahendranath Karan
বাম দিকের ছবিটি 'খেজুরী বন্দর' পুস্তকের | ডান দিকের ছবিটি পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের ওপরে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজী গ্ৰন্থটির (A Short History and Ethnology of the Cultivating Pods)

মহেন্দ্রনাথ করণের মত বিস্ময়কর প্রতিভা তৎকালীন সময়ে তো নয়ই তাঁর মৃত্যুর নয় দশক (মৃত্যু ১৭ জুলাই, ১৯২৮) পরেও আর একজনও জন্মগ্রহণ করেনি খেজুরীতে। খেজুরীতে বিস্মৃত এই প্রথম ইতিহাসকার, সু-সাহিত্যিক ও দক্ষ সংগঠকের প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম। কামনা করি অবিভক্ত মেদিনীপুরের বর্তমান নবীন প্রজন্ম গত শতকের প্রথমার্ধের এই বিস্মৃতপ্রায় মনীষার জীবনকথা জেনে উদ্বুদ্ধ হোক। জানুক তাদের জন্মভূমিতে জন্মগ্রহণ করা পরিজনদের, সর্বোপরি আর তার জন্মভূমিকে।


midnapore.in

(Published on 19.11.2020)