চেঁচুয়ার হাট, ঘাটাল, স্বাধীনতা, সংগ্রাম, দাসপুর, মেদিনীপুর, Chechua Hat, Ghatal, Daspur, Medinipur

১৪ শহীদের রক্তে রাঙা চেঁচুয়ার হাট


ঘাটালে মহকুমার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ৬ই জুন ১৯৩০


দেবাশিস কুইল্যা।



Home » Medinikatha Journal » Debashis Kuila » ১৪ শহীদের রক্তে রাঙা চেঁচুয়ার হাট



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত কংসাবতী নদীর পূর্ব পাড় ও পলাশপাই খালের দক্ষিন পাড়ে উনিশ শতকের শেষ সময়কাল থেকে চেঁচুয়ায় সপ্তাহে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হাট হয় । তৎকালীন সময়ে জলপথে কোলাঘাট , বাক্সী , কোলকাতার সাথে যোগাযোগের ফলে পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ।


চেঁচুয়ার হাট, ঘাটাল, স্বাধীনতা, সংগ্রাম, দাসপুর, মেদিনীপুর, Chechua Hat, Ghatal, Daspur, Medinipur
ঘটনাস্থলে নির্মিত প্রথম শহীদ স্মৃতি। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

এই হাটকে কেন্দ্র করে বৃহৎ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে স্বদেশিকতার ঢেউ আছড়ে পড়ে । বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় বাঙালি যখন নিজেদের একটি জাতি হিসেবে চিন্তা করতে লাগল তখন থেকেই তার উত্তাপে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে এখানকার জনপদ । ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের পর কয়েকজন বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তুলে চেঁচুয়া হাটের আশেপাশের বিভিন্ন গ্ৰামে । ১৯২০ খ্রিঃ মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কংগ্ৰেসের সহকারী সভাপতি রাধা কান্ত পুরের মোহিনী মোহন দাস ও তার পুত্র স্বদেশ রঞ্জন দাস সোনাখালি , নন্দনপুর , শ্যামগঞ্জ , চেঁচুয়া , তেমুহানী প্রভৃতি জায়গায় গুপ্ত সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী দলকে আরও শক্তিশালী করেন ।


বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী দলের পুরোভাগে থাকা যোগেন হাজরা , বিনোদ বিহারী বেরা , মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য , কানন বিহারী গোস্বামী , অরবিন্দ মাইতি -দের অগ্ৰনী ভুমিকায় অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিনা লভ্যাংশে স্বদেশী জিনিস বিক্রির ব্যবস্থা ও প্রচার করা হয় চেঁচুয়ার হাটে । বিভিন্ন আন্দোলন ও সভার মাধ্যমে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হয় । ফলে প্রতিটি সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে অনায়াসে সন্ধ্যা, যুগান্তর, নবশক্তি প্রভৃতি ইংরেজ সরকারের নিষিদ্ধ পত্রিকা পৌঁছে যেত । এর মধ্যে ১৯৩০ খ্রিঃ গান্ধীজীর 'লবন আইন অমান্য আন্দোলন' ব্যাপক সাড়া ফেলে । এই গুপ্ত সমিতিগুলিতে । কারণ হিসেবে রূপনারায়ন নদীর জোয়ার বাহিত নোনাজল হতে লবন তৈরীর উপযুক্ত ভৌগলিক অবস্থান শ্যামগঞ্জ আর চেঁচুয়ার হাট লবন বিক্রির মূল কেন্দ্র ।


চেঁচুয়ার হাট, ঘাটাল, স্বাধীনতা, সংগ্রাম, দাসপুর, মেদিনীপুর, Chechua Hat, Ghatal, Daspur, Medinipur
ঘটনাস্থলের কাছেই পরবর্তীকালে নির্মিত শহীদ স্মৃতি। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

৭ই এপ্রিল ১৯৩০ থেকে লবন তৈরি চলতে থাকল শ্যামগঞ্জে আর চেঁচুয়ার হাটে স্বদেশী ও স্বেচ্ছাসেবক দল লবন বিক্রির সাথে সাথে স্বদেশী জিনিস ব্যবহার ও বিক্রয়ের অনুরোধ করতে থাকে । হাটের প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ীদের কাছে বিদেশি লবন , চিনি , কাপড় আমদানি ও বিক্রি বন্ধের অনুরোধ করলেও কর্ণপাত করেননি পরন্তু নিজেদের লোকসানের কথা ভেবে স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মকাণ্ডের খবর পৌঁছে যেত থানায় ।


এমনই এক হাটের দিন ৩রা জুন ১৯৩০, শনিবার । স্বদেশীরা বিলেতি কাপড় ব্যাবহার ও বিক্রি বন্ধের পক্ষে প্রচার করছিল । সেই দুপুরে দাসপুর থানার বড়বাবু ভোলানাথ ঘোষ ও তার সহকারী অনিরুদ্ধ সামন্ত চারজন সিপাই নিয়ে হাটে পৌঁছে কয়েকজনকে বন্দী করে । এর পরই মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ইচ্ছাকৃত ভাবে ভোলা দারোগার নামধরে ডাকে ও একই বেঞ্চিতে তার পাশে বসলে অপমানিত দারোগাবাবু হাতের ভেতর নিয়ে মৃগেন্দ্রকে প্রহার করেন । সাহসী মৃগেন্দ্রনাথও ছেড়ে দেবার পাত্র নন । দারোগাবাবুর হাতের বেতটিই কেড়ে ঐ বেত দিয়েই প্রতিশোধের উপযুক্ত বেত্রাঘাত ফিরিয়ে দেন । তা দেখে উত্তেজিত জনতা ভোলাদারোগাকে পিটিয়ে হত্যা করে, রাতে অর্ধদগ্ধ অবস্থায় ডোমনার পুকুর পাড়ে মাটি চাপা দিয়ে কলাগাছ লাগিয়ে দেওয়া হয় । অন্যদিকে লুকিয়ে থাকা অনিরুদ্ধ সামন্তকে নিবারন মাজীর কাপড় দোকান থেকে বের করে স্বদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া হলে ঐ দিন রাত্রে চকবোয়ালিয়ার চিৎমল্লিক পুকুরের পাড়ে টুকরো টুকরো করে কেটে সারা মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় । বাকি চার সেপাই নন্দনপুরের জমিদার দেবেন্দ্র ঘোষের সাহায্যে মলিঘাটি হয়ে মেদিনীপুরে পৌঁছায় ।


চেঁচুয়ার হাট, ঘাটাল, স্বাধীনতা, সংগ্রাম, দাসপুর, মেদিনীপুর, Chechua Hat, Ghatal, Daspur, Medinipur
২০২১ সালে খালের অন্যদিকে নির্মিত শহীদ স্মৃতি। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

৩রা জুনের ঘটনা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে গ্ৰামান্তরে । ৪ঠা জুন দুপুরের পর বসল পুলিশ ক্যাম্প সঙ্গে চেঁচুয়া সহ আশেপাশের গ্ৰামে চলল অকথ্য অত্যাচার সঙ্গে লুটপাট । মঙ্গলবার ৬ই জুন জলপথে আরও পুলিশ ও সেপাই আসার খবর মেয়েদের শঙ্খধ্বনির মধ্যদিয়ে আশেপাশের গ্ৰামে ছড়িয়ে পড়লে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কাতারে কাতারে স্বাধীনতাকামী মানুষ হাটের উত্তরে পলাশপাই খালের পাড়ে জমা হতে থাকে । স্লোগান দিতে থাকে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আর পুলিশ ক্যাম্প তুলে নেওয়ার দাবিতে । পুলিশের আদেশ অমান্য করে জনতা পলাশপাই খাল অতিক্রমে প্রস্তুত হলে পুলিশের গুলিতে চন্দ্রকান্ত মান্না (তেমোহানি), অশ্বিনী দোলই (চকবোয়ালিয়া), ভৃগুরাম পাল (মোহনচক), শশীভূষন মাইতি (শায়লা ),কালীপদ শাসমল (জালালপুর), দেবেন্দ্র নাথ নাড়া (জো্ৎভগবান), সতীশ চন্দ্র মিথ্যা (রাধাকান্তপুর ) রামচন্দ্র পাড়ই ( জোৎশ্যাম ), নিতাই পড়িয়া ( পাঁচবেড়িয়া ) , অবিনাশ দিণ্ডা , সত্য বেরা (দু'জনেই বাঁশখাল ) , শশশী দিণ্ডা (গোবিন্দ নগর ), পূর্ণ চন্দ্র সিংহ ও মোহন মাইতি ( খাড়রাধান্ত পুর )সহ চোদ্দজন নিহত ও ১৪৫জন আহত হন ।এতদসত্ত্বেও সাধারণ মানুষ ভয় না পেয়ে সামনে অগ্ৰসর হলে পুলিশ বাহিনী পলাশপাই খালের খাসিকাটা ঘাট অতিক্রম করে জলপথে কংসাবতীর মধ্যদিয়ে পিছু হটে । বাকি সময়ের জন্য পুলিশ ক্যাম্পকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ পেডি ও পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যান ১৫০জন গোরা সৈন্য নিয়ে এলেন সঙ্গে চলল ধড়পাকড় ও অত্যাচার । বিভিন্ন স্বদেশী ও স্বেচ্ছাসেবীদের গ্ৰেপ্তার হয় তাদের বিচারের জন্য বসে বিশেষ আদালত । বিচারপতি ছিলেন সি.এম.এইচ. লেথব্রিজ । আসামি পক্ষের সমর্থনে বিনা পারিশ্রমিকে মামলায় সওয়াল করেছিলেন ব্যারিস্টার সুনন্দ সেন । এই মামলায় বিভিন্ন ভাবে আসামি পক্ষকে সাহায্য করেছিলেন ব্যারিস্টার বিরেন্দ্রনাথ শাসমল, শরৎচন্দ্র বসু , সাতকড়ি রায় , বরদা প্রসন্ন পাইন , জমিদার দেবেন্দ্রলাল খাঁন প্রমুখ ।


হাইকোর্টের চুড়ান্ত রায় অনুযায়ী যাবজ্জীবন দীপান্তরের সাজা হয় কানন গোস্বামী, সুরেন দাস , যোগেন হাজরা , মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সহ ১৩ জনের এবং দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় পুষ্প চ্যাটার্জী সহ পাঁচ জনের । পরবর্তী সময়ে ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই মার্চ গান্ধী আরউইন চুক্তি অনুসারে এঁরা সকলেই মুক্তি পান ।


চেঁচুয়ার হাট, ঘাটাল, স্বাধীনতা, সংগ্রাম, দাসপুর, মেদিনীপুর, Chechua Hat, Ghatal, Daspur, Medinipur
পলাশপাই খালের উপরে নির্মিত সেতু। এই দিকে ছিলেন বিপ্লবীরা আর ওই পাড় থেকে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

একটা রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পর যে ইতিহাস লেখা হয় তা মূলতঃ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস । একানব্ব্বই বৎসর আগে উত্তাল সময়ে দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে চেঁচুয়া হাটকে কেন্দ্র করে পাশ্ববর্তী গ্ৰাম থেকে হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল তা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ছিলনা । সে আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত । লক্ষ্য ভারতের স্বাধীনতা । সে স্বাধীনতার স্বাদ অনেকেই পাননি । কিছু জন পেয়েছেন অল্প সময়ের জন্য । তাদের উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যাওয়া স্বাধীনতার আড়ালে গনতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্রুর প্রতিযোগিতা । সে প্রতিযোগিতায় মগ্নতা আছে আত্মতৃপ্তি নেই । এই ভাবনার ব্যাতিক্রম নয় চেঁচুয়া হাটের ঘটনার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষদের উত্তর প্রজন্ম । দেশের ও রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পালা পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রচ্ছন্ন দাম্ভিকতা প্রদর্শীত হয় । শ্রদ্ধার থেকে বেশি বাহুল্য বেশি । শহীদদের স্মরণ করি অনুসরণ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই তাদের দেখানো পথে । সেই ১৪ জন মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ও তাদের সঙ্গীদের নিঃস্বার্থ ভাবনা ছুঁয়ে দেখার মত ধৃষ্টতা দেখানোর মত সময় নেই


১৯৩০ এর ৬ই জুন ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের পাতায় ঘটনার বর্ননা লেখাই আছে । বিশ্লেষণ নেই । আমাদের মানসিক দৈন্যতার গণ্ডি ছাড়িয়ে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে এই দিনের তাৎপর্য অনুভব করতে পারাটাই প্রকৃত শ্রদ্ধা।


চেঁচুয়ার হাট, ঘাটাল, স্বাধীনতা, সংগ্রাম, দাসপুর, মেদিনীপুর, Chechua Hat, Ghatal, Daspur, Medinipur
পলাশপাই খাল। ডান দিকে ছিলেন বিপ্লবীরা আর বাম দিক থেকে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

প্রতিবছর ঐ৬ই জুনের ঘটনা ও ১৪জন শহীদদের আত্মবলিদানের কথা স্মরণ করে স্থানীয় কয়েকজনের উদ্যোগে শহীদ দিবস পালিত হলেও সে ইতিহাস যেন ক্রমশই বিস্মৃতির আড়ালেই চলে যাচ্ছে দিন দিন ।


রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ক্ষমতায়নের উর্দ্ধে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভুমিতে ঘাটাল মহকুমার পূর্ব পুরুষদের আত্মবলিদানে রেখে যাওয়া স্বাধীনতায় দেশের‌ জাতীয় পতাকার তিনটি রঙ ছাড়া যেদিন সমগ্ৰ ভারতবর্ষকে দেখতে পাব সে সময় সার্থক হবে ৬ই জুনের শহীদের আত্মদান।





M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 06.06.2024)


তথ্যসূত্র:

১) সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ : মেদিনীপুর ও মানভূম ১৯০০-১৯৪৭ - শ্যামাপ্রসাদ বসু
২) রক্তাক্ত চেঁচুয়ার হাট ১৯৩০ - দিবার ঘোষ
৩) স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর- বসন্ত কুমার দাস


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।