মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন

Mughalmari centric Archaeological-tourism

তরুণসিংহ মহাপাত্র।


মোগলমারি। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্বিক উৎখননে প্রখ্যাত এক স্থাননাম। ষোড়শ শতকে মোগল-পাঠানের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতিবহ বা মোগল সৈন্যের যাতায়াতের পথ (মোগল মাড়-ই), যেভাবেই এই নামকরণ হোক না কেন সম্প্রতি এই গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে আনুমানিক ষষ্ঠ শতকে নির্মিত এক বৌদ্ধবিহার অর্থাৎ যে রক্তমাখা ইতিহাসের স্মৃতি রয়ে গেছে গ্রামটির নামের সঙ্গে - তা অর্বাচীন কালের। তারও বহুপূর্বে এখানে ধ্বনিত হয়েছিল অহিংসার বাণী, শান্তির বাণী। “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি....' - এই পবিত্র ধ্বনিতে একদিন মুখরিত হয়ে উঠত এখানকার আকাশ, বাতাস।

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism
শিবরাত্রির সময় সহস্রলিঙ্গ মন্দিরের শিবলিঙ্গ। ছবিঃ তরুণসিংহ মহাপাত্র।

মোগলমারি গ্রামটি দাঁতন শহর থেকে প্রায় ৫ কিমি দূরে অবস্থিত। অনেকে বলেন বর্তমান দাঁতন প্রাচীন দণ্ডভুক্তির স্মৃতিবহ। এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও দাঁতনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজ নানাভাবে স্বীকৃত। কলিঙ্গ যুদ্ধের কাল থেকে ষোড়শ শতকের মোগল-পাঠানের যুদ্ধ পর্যন্ত ভারত ইতিহাসের দিক নির্দেশক বহু যুদ্ধবিগ্রহের নীরব সাক্ষী এই অঞ্চল। অবশ্য সেই ইতিহাস অনুসন্ধানআমাদেরআলোচ্যনয়,তাঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ববিদদের কর্ম। আমাদের অভিপ্রায় এই অঞ্চলের প্রত্নপর্যটনের সম্ভাবনার বিচার। বর্তমান দাঁতনকে যদি আমরা প্রাচীন দণ্ডভুক্তির অংশবিশেষ বলে ধরে নিই, আর প্রাচীন দণ্ডভুক্তিকে যদি আমরা কল্পনেত্রে বর্তমান দাঁতনের চতুপার্শ্বস্থব্লকগুলি এবং বালেশ্বর জেলা(ওড়িশা)-র কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত করি তবে মোগলমারিকে কেন্দ্র করে এক প্রত্বপর্যটনের সম্ভাবনা আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নিরবচ্ছিন্ন রাষ্ট্রিক সংঘর্ষকে উপেক্ষা করে, কালের প্রহার সহ্য করে কোনো স্থাপত্যকীর্তিই আজ হয়তো আর পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় নেই, তবুও যে সকল ভগ্ন ও অভগ্ন মূর্তি, অলংকৃত পাথর ইত্যাদি এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে সেগুলির সংখ্যা, বিশালত্ব ও সৌন্দর্যেই আমাদের প্রাচীন দণ্ডভুক্তির ঐশ্বর্যৈর কথা স্মরণ করায়।

মোগলমারি গ্রামটি দাঁতন শহর থেকে প্রায় ৫ কিমি দূরে অবস্থিত। অনেকে বলেন বর্তমান দাঁতন প্রাচীন দণ্ডভুক্তির স্মৃতিবহ। এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও দাঁতনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজ নানাভাবে স্বীকৃত। কলিঙ্গ যুদ্ধের কাল থেকে ষোড়শ শতকের মোগল-পাঠানের যুদ্ধ পর্যন্ত ভারত ইতিহাসের দিক নির্দেশক বহু যুদ্ধবিগ্রহের নীরব সাক্ষী এই অঞ্চল। অবশ্য সেই ইতিহাস অনুসন্ধানআমাদেরআলোচ্যনয়,তাঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ববিদদের কর্ম। আমাদের অভিপ্রায় এই অঞ্চলের প্রত্নপর্যটনের সম্ভাবনার বিচার। বর্তমান দাঁতনকে যদি আমরা প্রাচীন দণ্ডভুক্তির অংশবিশেষ বলে ধরে নিই, আর প্রাচীন দণ্ডভুক্তিকে যদি আমরা কল্পনেত্রে বর্তমান দাঁতনের চতুপার্শ্বস্থব্লকগুলি এবং বালেশ্বর জেলা(ওড়িশা)-র কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত করি তবে মোগলমারিকে কেন্দ্র করে এক প্রত্বপর্যটনের সম্ভাবনা আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নিরবচ্ছিন্ন রাষ্ট্রিক সংঘর্ষকে উপেক্ষা করে, কালের প্রহার সহ্য করে কোনো স্থাপত্যকীর্তিই আজ হয়তো আর পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় নেই, তবুও যে সকল ভগ্ন ও অভগ্ন মূর্তি, অলংকৃত পাথর ইত্যাদি এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে সেগুলির সংখ্যা, বিশালত্ব ও সৌন্দর্যেই আমাদের প্রাচীন দণ্ডভুক্তির ঐশ্বর্যৈর কথা স্মরণ করায়।

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism
শরশঙ্কা দীঘি। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

এছাড়া দাঁতন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৃহৎ বৃহৎ পুষ্করিণীগুলিও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। দাঁতনের ৩ কিমি পূর্বে শরশঙ্কা নামে দিঘি যেন দণ্ডভুক্তির লুপ্ত ঐতিহ্য স্মরণ করায়। ৫,০০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২,৫০০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট এই দিঘিটি নানা কিংবদন্তি ও জনশ্রুতির ধাত্রীভূমি কিংবদন্তি যেমন একে যুক্ত করেছে মহাভারতের কালের সাথে তেমনি জনশ্রুতি রাজা শশাঙ্কের কীর্তি এই দিঘি। এ অঞ্চলে শশাঙ্কের আধিপত্যের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেলেও তিনিই যে এই দিঘিটি প্রতিষ্ঠাতা এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ এই দিঘিটির সংস্কার করা হয়েছে। যদি আধুনিক পর্যটনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারা যায়, তাহলে শুধু প্রত্নপর্যটক নয়, সাধারণ পর্যটকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব। একই কথা প্রযোজ্য দাঁতনে অবস্থিত বিদ্যাধর ও ধর্মসাগর নামক পুস্করিণী দু-টির ক্ষেত্রেও। এই দু’টি পুকুর নিয়ে জনশ্রুতিও পর্যটকের মন কেড়ে নেবে।

দাঁতনের অন্যতম পুরাকীর্তি শ্যামলেশ্বর শিবমন্দির। পণ্ডিতদের অনুমান এই পীড়া দেউলটির নির্মাণকাল ষোড়শ শতাব্দী। মন্দিরের চারপাশে মাকড়া পাথরের চওড়া প্রাচীর ও সংকীর্ণ দরজা দেখে দুর্গ বলে ভ্রম হয়। মনে হয়, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বা বিধর্মীদের হাত থেকে মন্দির রক্ষার উদ্দেশ্যেই এইভাবে শক্ত প্রাচীর দিয়ে মন্দিরটিকে সুরক্ষিত করা হয়েছিল। মন্দিরের মধ্যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে সামনেই দেখতে পাওয়া যায় এক উপবিষ্ট বৃষমূর্তি। বৃষমূর্তিটি স্থানে স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ভগ্ন। জনশ্রুতি কুখ্যাত কালাপাহাড়ই নাকি মূর্তিটির এরূপ অবস্থার জন্য দায়ী। এই মন্দিরের নেত্রনালার ওপর কারুকার্যখচিত একটি মকরমূর্তি আছে। অনেক প্রত্বতত্ববিদের অভিমত মূর্তিটি সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন।

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism
জটিয়াবাবা। ছবিঃ পার্থপ্রতিম মিশ্র।

উত্তর-পশ্চিমে দাঁতনের পার্শ্ববর্তী ব্লক কেশিয়াড়ি। প্রত্নসম্পদে এই ব্লকটিও সমৃদ্ধ। ইতিহাসের উত্থান-পতনের অনেক নিদর্শন কেশিয়াড়ি ও তার পাশাপাশি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। মোগল-পাঠান যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুরুমবেড়া দুর্গ এই ব্লকেই অবস্থিত। যদিও এ দুর্গের প্রতিষ্ঠাতাওড়িশার রাজা কপিলেশ্বরদেব (পঞ্চদশ শতাব্দী) তবুও এই দুর্গ দীর্ঘদিন আপন মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছিল। ওড়িশার রাজা, মোগল-পাঠান এমনকী মারাঠারা পর্যন্ত এই দুর্গকে সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত এই দুর্গটি কেশিয়াড়ি-সংলগ্ন গগনেশ্বরে অবস্থিত। প্রায় ২০ফুট উচ্চতাযুক্ত ও ৩ ফুট প্রস্থের দেওয়ালের ভিতরে প্রায় ৮ ফুট চওড়া। খিলানযুক্ত প্রকোষ্ঠসারি চারদিকে বেষ্টিত। দুর্গের ভেতরে পূর্বদিকে একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আর পশ্চিমে একটি মসজিদ চোখে পড়ে। মনে হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের ফলে মন্দিরটি ভেঙে তার পাথর দিয়েই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।

কেশিয়াড়ির অন্যতম পুরাকীর্তি সর্বমঙ্গলা মন্দির। সর্বমঙ্গলা যেমন এই অঞ্চলের জাগ্রত দেবী তেমনই পুরাতত্ব প্রেমীদের কাছে এই মন্দিরের গঠনশৈলীটিও বিশেষ আকর্ষণীয়। আনুমানিক ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই মন্দিরটিতে যেন বাংলা ও ওড়িয়াস্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধন ঘটেছে। এই মন্দিরের অনতিদূরে অবস্থিত কাশীশ্বর শিবমন্দিরটিও এই মিশ্র নির্মাণশৈলীর নিদর্শন। “কেশিয়াড়ির মঙ্গলামাড়ো পল্লীর মাঝখানে সর্বমঙ্গলা মন্দির প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রাচীর দেওয়া এবং তিনটি অংশে বিভক্ত। সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। তার পশ্চিমে সিংহদ্বার। পুবদিকে দোলমণ্ডপ, নহবতখানা ইত্যাদি। সামনের সিঁড়ি দিয়ে বারদুয়ারী নামে বারোটি খিলানযুক্ত নাটমন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। সিঁড়ির দু-পাশে দু-টি পাথরের বড়ো-বড়ো সিংহের মূর্তি। বারদুয়ারী নাটমন্দিরের মাঝখানে একটি ঘণ্টা টাঙানো, প্রকাণ্ড ঘণ্টা। যাত্রীরা মন্দিরে যাতায়াতের সময় ঘণ্টা বাজিয়ে যান। বারদুয়ারী নাটমণ্ডপ থেকে পশ্চিমমুখে অগ্রসর হয়ে পূর্বদ্বারী দ্বিতীয় অংশ জগমোহনে প্রবেশ করতে হয়। এই জগগমোহনে সর্বমঙ্গলা দেবীর বাহ্যপূজার অনুষ্ঠানাদি অর্থাৎ দুর্গোৎসব, কালীপুজা, নিত্যপূজা, হোম ইত্যাদি সম্পন্ন হয়। জগমোহনের উত্তর ও দক্ষিণদিকের দেওয়ালে আলো আসার জন্য ছোটো-ছোটো গবাক্ষ আছে। জগমোহন পার হয়ে পূর্বদ্বারী সর্বমঙ্গলা মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। সর্বমঙ্গলা মন্দিরের জগমোহন অংশে একটি সুন্দর গণেশমূর্তি, একটি কমণ্ডলু ও ত্রিশূল হস্তে দেবমূর্তি ও একটি চতুর্ভূজা অসুরনাশিনী মূর্তি আছে। এ ছাড়া ঝামাপাথরের কাশীশ্বর শিবের মন্দির (পঙ্খ -পলেস্তারা যুক্ত) মাকড়া পাথরের তৈরি জগন্নাথের সপ্তরথ শিখর দেউল, শাহ আলম নির্মিত মসজিদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism
কাকরাজিত গ্রামে গাছের তলায় রক্ষিত মূর্তি। ছবিঃ কার্তিক মাইতি।

এ ছাড়া কেশিয়াড়ির বিভিন্ন গ্রামে নানা প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। তবে দ্বীপ কিয়ার চাঁদ গ্রামটি প্রত্নতত্ত্বের নিরিখে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এ গ্রামের প্রধান রাস্তার ডানপাশে পাথরভাঙা নামে এক চত্বরে একমিটার উচ্চতাযুক্ত শিখর দেউলের আকৃতিবিশিষ্ট অসংখ্য মাকড়া পাথরের ক্ষুদ্রাকার মন্দিরের প্রতিকৃতিদেখাযায়।অনেকের মতে এগুলি নিবেদন মন্দির।

কেশিয়াড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৬ কিমি দূরে ওড়িশা সংলগ্ন নয়াগ্রাম ব্লকের অবস্থান। জঙ্গলাকীর্ণ এই ব্লকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দু-টি শিবমন্দিরের দৌলতে। একটি রামেশ্বর শিবমন্দির, অপরটি সহস্রলিঙ্গ শিবমন্দির । দু’টি মন্দিরেরই নির্মাণকাল অজানা। দু’টি মন্দিরই দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে নয়াগ্রামের স্থানীয় রাজারা জঙ্গল পরিষ্কার করে মন্দির দু-টিকে লোকচক্ষুর গোচরে আনেন।

সুবর্ণরেখার দক্ষিণ তীরে দেউলবাড় গ্রামে রামেশ্বর শিবমন্দিরটির উল্লেখ যেমন রসিকমঙ্গল কাব্যে আছে তেমনি ধোয়ীর পবনদূত কাব্যেও উল্লেখিতহয়েছে,যা রামেশ্বর মন্দিরেরপ্রাচীনত্বেরসাক্ষ্যদেয়।বাংলায়ওড়িশীমন্দিরশৈলীরএকউল্লেখযোগ্যনিদর্শনএইমন্দির।

সহস্রলিঙ্গ মন্দিরটি নয়াগ্রামের প্রান্তসীমায় স্বস্তিনী গ্রামে অবস্থিত। মন্দিরটির জগমোহন অংশ বর্তমানে ভেঙে গেলেও এটিওওড়িশীশৈলীর নির্মাণ। এখানের শিবলিঙ্গটি অদ্ভুত ধরনের। প্রধান লিঙ্গের ওপর দশটি সারিতে একশোটি করে লিঙ্গ খোদিত আছে দেখা যায়, তাই এর নাম সহস্রলিঙ্গ। এই মন্দিরের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর প্রবেশদ্বার পশ্চিমমুখী।

এই মন্দিরের প্রায় ২কিমি পশ্চিমে অবস্থিত চন্দ্ররেখা দুর্গ (গড়)। দুর্গের মধ্যস্থিত কিছুই আর অবশিষ্ট নেই কিন্তু এর উঁচু এবং চওড়া প্রাচীর এবং আয়তন (দৈর্ঘ্যে ১,০৫০ গজ, প্রস্থে ৭৮০ গজ) দেখে একদা এই দুর্গ যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তা বেশ বোঝা যায়। কিন্তু কে এর নির্মাতা তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। স্থানীয় কোনো ভূস্বামীর পক্ষে এই বিশাল দুর্গ নির্মাণ যে সম্ভব নয় তা সহজেই অনুমেয়। অনেকে মনে করেন এই দুর্গটিও শশাঙ্কের কীর্তি। শশাঙ্ক তাঁর রাজ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়া রয়েছে খেলাড় গড় বা দুর্গ। চন্দ্ররেখা গড় থেকে এক মাইল দূরে। পাথরের তৈরি রাজবাড়ি, প্রাচীর, পরিখা এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ।

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism
প্রবন্ধটি পড়ার পরে অনুমান করে বলুন ছবিটি কোন মন্দিরের ? নিচে ফেসবুক কমেন্টবক্স রয়েছে। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

চন্দ্ররেখা দুর্গের কাছাকাছি আর একটি বিশাল আয়তনের দুর্গ রাইবনিয়া,ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় অবস্থিত। এই দুর্গের ইতিহাসও রহস্যময়। বাংলা ওওড়িশার সর্ববৃহৎ এই দুর্গ লোকমুখে বিরাট রাজার গড় নামে পরিচিত। জনশ্রুতি, মহাভারতের কালে এই অঞ্চল ছিল মৎস্য দেশের অন্তর্ভুক্ত । রাজা বিরাটের গড় ছিল আজকের রাইবনিয়া। অজ্ঞাতবাসকালে, পঞ্চপাণ্ডব এখানেই অতিবাহিত করেন এক বৎসর। বস্তত, এই বিশাল গড়ের প্রতিষ্ঠাতা কে তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। ইতিহাসও এ বিষয়ে নিরুত্তর, তবে ওড়িশার স্বাধীন হিন্দু রাজা প্রথম নরসিংহদেবের (ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ) সময় থেকে এর নাম পাওয়া যাচ্ছে। হয় তিনিই এই দুর্গের প্রতিষ্ঠাতা নতুবা প্রাচীন কোনো দুর্গের সংস্কারসাধন করে তিনি এটিকে ব্যবহারোপযোগী করে তুলেছিলেন। বর্তমানে এই দুর্গে টিকে আছে কেবল ৬ বর্গমাইল এলাকাকে বেড় দিয়ে থাকা বিশাল প্রাচীর, কয়েকটি দ্বার, একটি ভগ্ন মন্দির, কয়েকটি পুকুর আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু প্রত্নসামগ্রী। পঞ্চকোণী এই দুর্গের ছিল তিনটি দ্বার। প্রাচীরকে বেষ্টন করে ছিল সুগভীর পরিখা যার কিছু অংশ আজও বর্তমান। দুর্গের মধ্যে মাকড়া পাথরে নির্মিত একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। মন্দিরটি যে ওড়িশীশৈলীতে নির্মিত এই সুউচ্চ দেউল দেখে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শুধু রাইবনিয়া বা চন্দ্ররেখা নয়, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার এই অঞ্চলে আরও ছোটো-বড়ো কিছু গড় ছিল - যা প্রমাণ করে এই অঞ্চলের সামরিক গুরুত্বের কথা।

মোগলমারি কেন্দ্রিক প্রত্নপর্যটন | Mughalmari centric Archaeological-tourism
সহস্রলিঙ্গ মন্দির এবং শিবরাত্রির সময় মন্দির চত্বরে মানত পূরণের জন্য সারারাত্রি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। ছবিঃ তরুণসিংহ মহাপাত্র।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় দাঁতন-সংলগ্ন সব প্রত্নক্ষেত্রের পরিচয় দেওয়া হয়তো সম্ভব হল না, কিন্তু একটি প্রাথমিক রূপরেখা অঙ্কিত হল। প্রত্ন-অনুসন্ধানীদের কাছে মোগলমারি আজ এক অতিপরিচিত স্থান, কিন্তু মোগলমারি বৌদ্ধবিহার ছাড়াও যে এই অঞ্চলে প্রত্নবস্তু বা প্রত্নক্ষেত্রের অভাব নেই তারই যৎসামান্য পরিচয় দেওয়া হল। আবার যেসব প্রত্নবস্তু বা প্রত্নক্ষেত্রের পরিচয় দেওয়া হল সেগুলি অধিকাংশই দণ্ডভুক্তির (আ:৬০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক বলেই মনে হয়, সেক্ষেত্রে দণ্ডভুক্তির প্রাচীন সমৃদ্ধির একটি আভাসও রইল। আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব আজ স্বীকৃত। খণ্ড খণ্ড আঞ্চলিক ইতিহাস জোড়া লাগিয়েই রচিত হতে পারে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাস। আর সেক্ষেত্রে প্রত্নক্ষেত্রগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এগুলির যেমন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎখনন প্রয়োজন তেমনি যথাযথ রূপে সংরক্ষণও জরুরি। আবার নিরন্তর প্রচার ও উপযুক্ত পরিকাঠামোই পারে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে। ফলে আগামী দিনে সরকারি বা বেসরকারি প্রচেষ্টায় মোগলমারিকে কেন্দ্র করে আলোচ্য অঞ্চলে প্রত্ন-পর্যটনের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়। তবে পুরাতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী অথবা বিশেষ জ্ঞানপিপাসু পর্যটক নিশ্চয় পরিকাঠামোর তোয়াক্কা করবেন না। কাঁধে সাইড ব্যাগ, তাতে ডায়েরি, ক্যামেরা, আর হাতে স্মার্টফোন নিয়ে অচিরেই বেরিয়ে পড়বেন মোঘলমারি কেন্দ্রিক প্রত্ন-পর্যটনে।


midnapore.in

(Published on 13.09.2020 / প্রথম প্রকাশঃ মোঘলমারির বৌদ্ধমহাবিহার বিবিধ প্রসঙ্গ, সম্পাদক - সূর্য নন্দী)