আনন্দরূপ নায়েক।
প্রায় ছ'শ বছরের অতীত নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাড়াজোলের রাজাদের প্রাসাদ। প্রাসাদের সর্বত্র কালের চিহ্ন। জরা গ্রাস করেছে দেহ। খসে পড়া চুনসুরকির পলেস্তরা, ইটের চওড়া দেওয়ালে ফাটল, ধ্বসে যাওয়া কড়িবরগা ছাদ, গজিয়ে ওঠা লতা-গুল্ম-বৃক্ষের আগাছা-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাওয়া মূল রাজবাড়িটিতে। রাজবাড়ির দুটি অংশ। পরিখা দিয়ে ঘেরা অন্তর্গড় আর তার বাইরে বহির্গড়। অন্তর্গড়ে ঢোকার লালমাটির সরু রাস্তাটি চলে গিয়েছে ঘাসের ওপর দিয়ে।
আনুমানিক ষোড়শ শতকে নাড়াজোল জমিদারবংশের সূচনা করেন উদয়নারায়ণ ঘোষ। সাধারণের কাছে তাঁরা ভূম্যাধিকারী, রাজা। জনশ্রুতি, উদয়নারায়ণ বর্ধমানরাজের দেওয়ান ছিলেন। অনেকে তাঁকে ইছাই ঘোষের বংশধর বলে উল্লেখ করেন। সেকালের নাড়াজোল ছিল গভীর বনেজঙ্গলে ঢাকা প্রত্যন্ত অরণ্যভূমি। প্রকৃতই জনবিরল। আদিম জনজাতির বাস ছিল এখানে। ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় নাড়াজোল শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। নাড়া কথাটির মানে হল ধানগাছের অবশিষ্টাংশ। ধান কেটে নেওয়ার পর ধানগাছের যেটুকু মাঠে থেকে যায়, তাকে মেদিনীপুরের মানুষজন নাড়া বলে। জোল কথাটি জলার অপভ্রংশ। শিলাবতী, কংসাবতী, পারাং ঘেরা এই এলাকাটি বছরের অনেকগুলি মাসই জলে নিমজ্জিত থাকে। উদয়নারায়ণ ঘোষের এই এলাকায় আগমন আর রাজবংশ প্রতিষ্ঠাকে ঘিরে এক কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। আখ্যানটি এই রকম, এমন জঙ্গুলে এলাকায় শিকার করতে এসে উদয়নারায়ণ পথ হারিয়ে ফেলেন। বন্য প্রান্তরে সূর্য ডুবে আসার মুহূর্তে এক অদ্ভুত অলৌকিক দৃশ্য দেখেন তিনি। একটি বক আর একটি বাজপাখির যুদ্ধের মাঝে অসীম সাহসে বক বাজটিকে আক্রমণ করছে আর জায়গাটি অসম্ভব আলোয় ভরে উঠছে। সেই রাত্রে উদয়নারায়ণ দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান। পরদিন আবার ওই জায়গায় ফিরে এসে দেবীর সোনার মূর্তি সহ প্রচুর ধনসম্পদ উদ্ধার করেন। তিনি নাড়াজোলেই থেকে যান পাকাপাকিভাবে। আনুমানিক ৮২০ বঙ্গাব্দে উদয়নারায়ণ নাড়াজোলে জমিদারি পত্তন করেছিলেন। পঞ্চান্ন ঘর স্থানীয় নিম্নবর্গের মানুষদের সঙ্গে বর্ধমান থেকে আরও কয়েক পরিবার সদগোপ স্বজাতিকে তিনি নাড়াজোলে নিয়ে এসেছিলেন। উদয়নারায়ণ মন্দির তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেন দেবী জয়দুর্গাকে। সেদিন থেকেই উদয়নারায়ণ প্রতিষ্ঠিত দেবী জয়দুর্গা রাজবাড়িতে প্রতিদিন পূজিতা হচ্ছেন।
উদয়নারায়ণ ঘোষের পর নাড়াজোলের অধিপতি হন প্রতাপনারায়ণ। তারপর ক্রমান্বয়ে উত্তরাধিকারসূত্রে যোগেন্দ্রনারায়ণ, ভরতনারায়ণ এবং কার্তিকরাম ঘোষ। কার্তিকরাম বাংলার তখনকার আফগান শাসক সুলায়মান করনানির কাছ থেকে রায় উপাধি পেয়েছিলেন। মনে রাখা প্রয়োজন সে সময়ে দিল্লিতে মোগল বাদশাহ আকবর। বাংলায় সুলায়মান করনানির শাসনকাল ১৫৬৫ থেকে ১৫৭২ পর্যন্ত। এই রায় উপাধি পাওয়ার পর থেকে নাড়াজোলের জমিদাররা রায় পদবি ব্যবহার শুরু করেন। সুতরাং কার্তিকরাম রায়। এরপর জয়মনি রায়, শ্যামসিং রায়। ১৫৯৬ সালে পরবর্তী শাসক বলবন্ত রায় বাংলার সুবাদার বা নাজিমের কাছ থেকে খান উপাধি পান। সুতরাং বলবন্ত রায় হলেন বলবন্ত খান। বলবন্ত খানের পর গুনবন্ত, মহেশ, অভিরাম (১৬৮৭-১৭১৭), যদুরাম (-১৭৪৫), মতিরাম (-১৭৫১), সীতারাম (-১৭৮৪), আনন্দলাল, মোহনলাল (-১৮৩০)। দীর্ঘদিন শরিকি বিবাদে জর্জরিত থেকেছে নাড়াজোলে শাসকের উত্তরাধিকার। মোহনলাল থেকে পরবর্তী প্রায় দেড়শ বছর নাড়াজোলের শাসকদের সুবর্ণযুগ বলা যেতে পারে। মোহনলাল খানের সময় থেকে স্থাপত্য, চিত্রশিল্প, সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটতে শুরু করে। চুনিলাল খান সংস্কৃত সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। অপরদিকে চুয়াড় বিদ্রোহের সমকালে কর্ণগড়ের রানি শিরোমণির সঙ্গে যৌথভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চুনিলাল খানের ভূমিকা যথেষ্ট। অনেকগুলি পুঁথি সে সময়ে অনুলিখিত হয়েছিল। মহেন্দ্রলাল খান লোককবি ছিলেন। রাজা মহেন্দ্রলাল খান 'The History of the Midnapur Raj', 'সংগীতলহরী', 'মানমিলন', 'গোবিন্দগীতিকা', 'শারদোৎসব', 'মথুরামিলন' ইত্যাদি বই লিখেছিলেন।
১৮৮৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারত সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি উৎসব উপলক্ষে ইংরেজ সরকার মহেন্দ্রলাল খানকে রাজা উপাধি প্রদান করে। রাজা নরেন্দ্রলাল খান লিখেছিলেন 'পরিবাদিনী শিক্ষা' নামে একটি বই। এছাড়াও সঙ্গীত বিষয়ক বেশ কতকগুলি বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। রাজা নরেন্দ্রলালের স্ত্রী রানি মৃণালিনী দেবী কবি ছিলেন। 'স্তুতিকুসুমাঞ্জলি' নামে তাঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা লিখেছিলেন। এছাড়াও তাঁর লেখায় কীভাবে যেন বিষাদের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়, 'ঙকার সর্বস্ব আমি দিয়াছি ও পদে / তবে কেন ভাগ্যদোষে ফেলিলে বিপদে / নারায়ণি পদে কিবা করিয়াছি পাপ / কোন অপরাধে এত দিলা মনস্তাপ'। রাজা নরেন্দ্রলাল স্বদেশী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন। এ কারণে ১৯০৯ সালে ইংরেজ সরকার নরেন্দ্রলালের রাজা উপাধি ফিরিয়ে নিয়েছিল। যদিও জনকল্যাণমূলক কাজে তিনি স্বনামধন্য। রাজা নরেন্দ্রলাল খানের পুত্র দেবেন্দ্রলাল খান অগ্নিযুগের বিপ্লবী ছিলেন। অজস্র উল্লেখ করার মতো বিখ্যাত মানুষজনের সংযোগ ছিল এই রাজপরিবারটির সঙ্গে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, ক্ষুদিরাম বসু, মহাত্মা গান্ধি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ঋষি অরবিন্দ, মতিলাল নেহেরু, জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, সরোজিনী নাইডু, বিধানচন্দ্র রায়, কে ছিলেন না সেই তালিকায়! ক্ষুদিরাম বসুর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু নাড়াজোল রাজ এস্টেটের তহসিলদার ছিলেন।
পরিখা বেষ্টিত অন্তর্গড়ের সিংহদরজা পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। দুদিকের দুই থামের ওপর দুটি সিংহ রাজবংশের বিক্রমের প্রতীক। কালের অতলতায় ধুঁধুল লতা ঢেকে ফেলেছে তাদের একটিকে। সামনে পলেস্তরা খসা নহবতখানা দাঁড়িয়ে। পুরাতন দিনে এই নহবতখানা থেকে নিশ্চয়ই বেজে উঠত বৃন্দাবনী সারাং। রাজপরিবার ললিত কলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতের সঙ্গে সংযোগ সূত্রে তাঁরা চেয়েছিলেন ধারাটিকে বিকশিত করতে। অষ্টাদশ ঊনবিংশ
অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতকে নাড়াজোলের রাজপরিবার শিল্প-সংস্কৃতি-শিক্ষার চেতনায় যথার্থ অর্থেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর দেশের রাজনীতিতে এই রাজপরিবারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা উল্লেযোগ্য। দেশের স্বাধীনতার পরে রানি অঞ্জলি খান বিধায়ক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে নাড়াজোল রাজবাড়ির কিছু অংশে জুড়ে নাড়াজোল রাজ কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৬৬ সালে। নাড়াজোল রাজাদের মেদিনীপুরের গোপ প্যালেসটিতে ১৯৫৭ সালে রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সুরম্য গোপ প্যালেসটি রাজা নরেন্দ্রলাল খান কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন।
সেকালের কাছারি বাড়িটি নাড়াজোল রাজ কলেজের ছাত্র সংসদ ও ক্যান্টিনের কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। কাছারি বাড়ির ঠিক ডানদিকে রয়েছে রাজা নরেন্দ্রলাল খানের মা নিস্তারিনী দেবী প্রতিষ্ঠিত মৃত্যুঞ্জয় শিব মন্দির। মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার কাজ করা। মন্দিরের ওপরে লেখা আছে 'প্রত্যয়ঃ ক্ষুদি অংশে শকাব্দের লক্ষী লগ্নে / মৃত্যুঞ্জয় শিবং নিস্তারিনী ভূপ নরেন্দ্রম্ঃ'। কাঠের ভেজানো দরজা খুলে ফুল সাজানো শিবলিঙ্গ দর্শন হল। মন্দিরের পাশে ভাঙা ইট আর খসে পড়া পলেস্তরা নিয়ে দাঁড়িয়ে নাটমন্দির। তার গায়ের কোথাও কোথাও এখনও কিছু নকশা থেকে গেছে। দুর্গা দালানটি এখন লুপ্ত। ডেভিড ম্যাকাচ্চন তাঁর লেখায় এই দুর্গা দালানটিকে এক উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য বলে উল্লেখ করেছিলেন। ধ্বংস হতে বসেছে সেকালের সরস্বতী দালান, মঞ্চের দুপাশের সাজঘর। সরস্বতী দালান আসলে একটি মঞ্চ, যেখানে রাজাদের সময়ে সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা হত।
কাছারি মাঠ পেরিয়ে রাজবাড়িতে প্রবেশপথের ঠিক বামদিকে ঠাকুরবাড়ির অবস্থান। নাটমন্দির পেরিয়ে নতুন মন্দিরটিতে দেবী জয়দুর্গার অধিষ্ঠান করছেন। মন্দিরে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে আর ঢাকের শব্দে চত্বরটির অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি হয় প্রতিটি সকালবেলায়। দুর্গাপুজোর সময় পনরো দিন আগে থেকেই প্রাচীন রীতি মেনে চলে দুর্গাপুজোর কল্পারম্ভ। প্রস্তুতি চলে পারিবারিক দুর্গাপুজোর। চারিদিকে ধোওয়া মোছা, আলো ও শব্দযন্ত্রের আয়োজন। এখানে দেবী পূজিতা হন একাই। দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী গনেশ কার্তিক থাকেন না। পুজোর সময় পুরাতন কাঁসার থালায় দেবীকে পঁচিশ কেজি চালের নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। সঙ্গে রাজবাড়িতে তৈরি মুড়ি, মুড়কি, মিষ্টি, লুচি। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় বিশেষ নৈবেদ্য ময়দা, ঘি, চিনি দিয়ে তৈরি চাঁদসাই। দেবী জয়দুর্গা এখন অধিষ্ঠান করেন নবরত্ন গোবিন্দজি মন্দিরে। মনে করা হয় সভারাম খানের প্রথম পুত্র, সীতারাম খান এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কার্যকাল ১৭৫২-১৭৮৪। সীতারাম খানের সময়ে নাড়াজোলের বিশেষ উন্নতি ঘটে। বর্গিদের হাত থেকে রাজবাড়িকে রক্ষা করার জন্যে তিনি পরিখা তৈরি করে রাজবাড়িকে ঘিরেছিলেন। অন্তর্গড়ের চারপাশে যে পরিখা রয়েছে সেই পরিখার এক পাশের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ছ'শ ফুট আর প্রস্থ প্রায় চল্লিশ ফুট। একদিন পরিখার জলে ফুটে থাকত শাদা ও লাল পদ্ম। মহেন্দ্রলাল খানের লেখা 'The History of the Midnapur' Raj বই থেকে পড়ি, 'Wickermen or Domes and even Mussulmans were formmerly allowed to reside in the Gar as eyots, on condition of doing military service on the Khan family at the time of any exigency of foreign attack especially that of the Mahrattas.'। নবরত্ন গোবিন্দজি মন্দিরটির কার্নিশে কালো পাথর দিয়ে তৈরি ব্রহ্মা, নারদ, মহিষমর্দিনী ইত্যাদির ফলক রয়েছে। জয়দুর্গার পুরাতন পঞ্চরত্ন মন্দিরটি রাজবাড়ির অন্দরমহলে আজ জীর্ণ পরিত্যক্ত আগাছায় ঢেকে আছে। এটিই রাজবাড়ির সবথেকে প্রাচীন মন্দির। এখানেই উদয়নারায়ণ দেবী জয়দুর্গাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির মাঝের জায়গাটিতে রঙিন বেলজিয়াম গ্লাসের কাজ করা বিখ্যাত নাটমন্দিরটি। শোনা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বালক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একবার নাড়াজোলে এসেছিলেন। এই নাটমন্দিরটির শৈল্পিক দিক তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। এরই অনুকরণে তিনি শান্তিনিকেতনে উপাসনাগৃহ তৈরি করেছিলেন। মোহনলাল খানের সময় থেকেই নাড়াজোল রাজাদের স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। স্থাপত্যগুলিতে ইন্দো-ইউরোপীয় শিল্পরীতির ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। তিনি পরপর বেশ কতকগুলি নির্মাণ করেছিলেন। বহির্গড়ে হাওয়ামহল তাঁর নির্মাণ। এটিকে চাঁপাবাগান বলাও হয়। কয়েক শ বছর আগে কোনও জ্যোৎস্নার রাতে নিশ্চয়ই হাওয়ামহলের চারপাশে ভেসে বেড়ানো চাঁপাফুলের গন্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলে উঠত নৃত্যাঙ্গনাদের নুপূরের ধ্বনি। আজ চোখের সামনে খোলা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে পাষাণ স্থাপত্য। শুকিয়ে গিয়েছে ফোয়ারার জল। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ২০০৮ সালে হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করে। আঠেরো সাল নাগাদ কিছু সংস্কারও হয়েছিল। রাজবাড়ি থেকে কিলোমিটার দুই দূরে লঙ্কাগড়ে সাড়ে ষাট বিঘা জমিতে পুকুর খুঁড়ে ১৮১৮ সালে জলহরি নির্মাণ রাজা মোহনলাল খানের আর একটি কাজ। রাজা মহেন্দ্রলাল খান তাঁর 'The History of the Midnapur Raj' বইতে লিখেছেন, 'Its banks are planted with the choicest fruit trees; and in the centre of it is a fine building used as a summer-house by the Rajah. This tank and the garden surrounding it costed Rajah Mohon Lall Khan Rs-80,000 in 1225 (B.S).'।
লঙ্কাগড়ে শিবমন্দিরের উল্টোদিকে রাজা মোহনলাল খানের সমাধি রয়েছে। অন্তর্গড়ের ঠাকুরবাড়িতে বেলজিয়াম গ্লাসের নাটমন্দিরের ঠিক পাশেই সীতারামজিউ মন্দির। ১৮১৯ সাল নাগাদ অযোধ্যা থেকে বেলেপাথর ও দেবমূর্তি এনে এই সীতারামজিউর মন্দিরটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা মোহনলাল। খরচ হয়েছিল এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা। এই মন্দিরের দেববিগ্রহ রাম, সীতা, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন। প্রতিবছর রামনবমীতে তাঁদের নিয়ে রথযাত্রা উৎসব হয়, যার সূচনা করেছিলেন মোহনলাল খান। রাজা মোহনলালের ভগবান রামচন্দ্রের প্রতি অনুরাগের কারণ রয়েছে। তাঁর চারজন রানি ছিলেন। প্রথম দুই রানি অপুত্রক অবস্থায় অকালে মারা যান। দ্বিতীয়া স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। দীর্ঘদিন তৃতীয়া রানি কুন্দলতার সন্তান না হওয়ায় চতুর্থবার বিয়ে করেন রানি রঙ্গলতাকে। চতুর্থ বিয়ের পরেই পুত্রকামনায় মোহনলাল রাজগড়ে রঘুনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হয়ত বা দৈববলে কুন্দলতার গর্ভে অযোধ্যারাম, রামজয়, ব্রজকিশোর আর রঙ্গলতার গর্ভে রামচন্দ্র, হৃদয়রাম, রামকমল নামে মোট ছজন পুত্র সন্তান জন্মায়। রঘুনাথকে অনুসরণ করে রাজা মোহনলাল তাঁর পুত্রদের এমন নাম রেখেছিলেন। বহির্গড়ে রাজবাড়ির ফটক থেকে খানিকটা দূরে ছাউনির নিচে নাড়াজোলের সুউচ্চ রথটি রাখা আছে। এর কাছেই রয়েছে ষষ্ঠ শিবালয়। আটচালা রীতিতে গড়া শিবমন্দিরগুলি রাজা মোহনলালের পঞ্চম পুত্র ব্রজকিশোর খান ১৭৬৫ শকাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। একটি মন্দিরের লিপি থেকে একথা জানা যায়। মনে করা হয়, বাকি মন্দিরগুলিও সমসাময়িকালে তৈরি হয়েছিল। ষষ্ঠ শিবালয়ের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে ইটের তৈরি পঁচিশচূড়া রাসমঞ্চ।
মূল রাজবাড়িটি ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে কয়েক শতাব্দী ধরে পর্যায়ে পর্যায়ে তৈরি হয়েছে। রাজা মহেন্দ্রলাল লিখেছেন, সঠিক করে বলা কঠিন, ঠিক কবে এবং কে সম্পূর্ণ গড়টি নির্মাণ করেছিলেন। অন্তর্গড়ের মূল রাজবাড়ির অন্দরমহলে রানিমহল বা রাজপরিবারের সদস্যদের বাসগৃহগুলি সুন্দর কারুকাজে ভরা দেশীয় শিল্পকর্মে সাজানো ছিল। ঘরগুলিকে রাজারা জয়পুর, দিল্লী, লাহোর থেকে শিল্পসামগ্রী এনে সাজিয়ে ছিলেন। অন্তর্গড়ে কক্ষের সংখ্যা ছিল প্রায় দু'শ চল্লিশটি। প্রাচীন জয়দুর্গা মন্দিরের সামনে লোহার কাজ করা পরিত্যক্ত নাটমন্দির। তার পাশে ইটের তৈরি ভোগঘর। এর পূবদিকে চুনিলাল খানের বাসভবন এখন আগাছা আর জঙ্গলে ভরা ধ্বংসস্তুপ। উত্তর পশ্চিম দিকের বাসভবনগুলিও ভেঙে পড়ছে ক্রমশ। এখানে লতাপাতা ঢাকা দুটি পাতালঘর আর সুড়ঙ্গের মুখ এখনও চোখে পড়ে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি পৌঁছে যাওয়া যেত চাঁপাবাগানের হাওয়ামহলে। ভেঙে পড়া বাসভবনের এই অংশেই মেদিনীপুরের অগ্নিযুগে রাজা নরেন্দ্রলাল খান এবং পরে পুত্র দেবেন্দ্রলাল খানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আর অর্থসাহায্যে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছিল। ১৯০২ সালে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু মেদিনীপুরের গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠার পর তার কাজকর্ম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। রাজা নরেন্দ্রলাল খানের সময় থেকে তাঁর সহযোগিতায় রাজবাড়িতে গুপ্ত সমিতির বৈঠকগুলি হত। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডগুলি রাজার অর্থানুকূল্যেই ঘটত। নিয়মিত যাতায়াত ছিল অরবিন্দ ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগো, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্তর মতো নামকরা বিপ্লবীদের। ক্ষুদিরাম বসুর সঙ্গে এখানকার প্রত্যক্ষ সংযোগ তো ছিলই। নরেন্দ্রলাল খান জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর হাত দিয়ে ক্ষুদিরামকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন মেদিনীপুর শহরের বড়বাজারে তাঁদের স্বদেশী জিনিস বিক্রির প্রতিষ্ঠান ছাত্র ভাণ্ডারের জন্যে। বিপ্লবীদের গোপন আস্তানায় ছিল বোমা তৈরির ঘর। অস্ত্র রাখার গোপন জায়গা। প্যারিস থেকে কৌশল শিখে আসার পর বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতেন অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র কানুনগো৷ বিষয়টি ইংরেজ সরকারের দৃষ্টি এড়ায়নি। কিংসফোর্ড হত্যার ব্যর্থতার পর মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার মিস্টার কার্নিশ জেলা জুড়ে ধরপাকড় শুরু করেন। ১৯০৮ সালের ২৮ আগস্ট নাড়াজোলের রাজপ্রাসাদ, কাছারিবাড়ি, হাওয়ামহল সহ মেদিনীপুরের গোপ প্যালেসে পুলিশ খানাতল্লাশি চালায়। নাড়াজোল রাজবাড়ি থেকে টোটা বারুদ বন্দুক উদ্ধার হয়। মেদিনীপুর বোমা মামলায় নরেন্দ্রলালকে গ্রেপ্তার করে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড সেলে রাখা হয়। যদিও প্রমাণের অভাবে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
রাজবাড়ির কাছারি মাঠটিতে ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কর্মীসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। নেতাজিকে চাঁপাফুলের মালা পরিয়ে শঙ্খধ্বনি দিতে দিতে সভাস্থলে নিয়ে আসা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, ওই সেই সময় যখন হরিপুরা কংগ্রেসে নেতাজি দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, মেদিনীপুরে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগের সেই সময়কাল যখন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স গ্রুপের মেদিনীপুর শাখা তৈরি হয়েছে। সুভাষচন্দ্র দীনেশ গুপ্তকে ১৯২৮-এ দিয়েছেন মেদিনীপুর শাখার দায়িত্ব। ১৯৩১-এর ৭ এপ্রিল মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডি হত্যা। বিমল দাশগুপ্ত এবং জ্যোতিজীবন ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৩০ এপ্রিল জেলা বোর্ডের মিটিংয়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট ডগলাস হত্যা। প্রদ্যোত ভট্টাচার্য এবং প্রভাংশুশেখর পাল। গুলিটি করেছিলেন প্রভাংশুশেখর। প্রদ্যোত ভট্টাচার্যর ফাঁসি হয় ১৯৩৩-এর ১২ জানুয়ারি। গ্রেপ্তার করা হয় বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের তেত্রিশ জন সদস্যকে। ১৯৩৩ সালেরই ২ সেপ্টেম্বর। মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ও মেদিনীপুর ক্লাবের ফুটবল ম্যাচে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ হত্যা। অনাথবন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ দুজনেই বার্জের দেহরক্ষী পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। বার্জ হত্যার জন্য ১৯৩৪-এর ২৫ অক্টোবর ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায়ের ফাঁসি হয় এবং পরের দিন ২৬ অক্টোবর ফাঁসি হয় নির্মলজীবন ঘোষের। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় নন্দদুলাল সিং, সুকুমার সেনগুপ্ত, শান্তিগোপাল সেনের। এই উত্তপ্ত সময়ে দেবেন্দ্রলাল খান স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯২০ সালে ইংরেজ সরকার দেবেন্দ্রলালকে রাজা উপাধি দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশবন্ধু তাঁকে বুঝিয়েছিলেন রাজা উপাধিতে কোনও গরিমা থাকতে পারে না। ১৯২৫ নাগাদ গান্ধিজি এই নাড়াজোল রাজবাড়িতে অস্পৃশ্যতা বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি দেবেন্দ্রলাল নাড়াজোল রাজবাড়িতে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মেদিনীপুরের বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দিয়ে গুপ্ত সমিতির কার্যকলাপকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। নেতাজি ১৯৩৮-এ মেদিনীপুরে এসে যে তিনটি সভা করেছিলেন, তা দেবেন্দ্রলালকে সঙ্গে নিয়েই করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর ভিয়েতনামে থাকা এবং চিকিৎসার পুরো খরচ দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রলাল খান।
রাজগরিমা আজ অবলুপ্ত। চারিদিকে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। স্থাপত্যগুলি, পুরাতন ঘটনাসব চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে প্রয়োজন সেগুলিকে টিকিয়ে রাখা। না হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে একদিন এসবই মুছে যাবে। রাজ পরিবারের কিছু সদস্যকে নিয়ে তৈরি হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল প্রিজারভেশন কমিটি। কিন্তু এসবের থেকেও বেশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। প্রয়োজন নাড়াজোলকে সত্যিকারের এক পুরাতাত্বিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। 'মন তুমি ঘুমাবে কত / চেয়ে দেখ রে হয়ে জাগ্রত' (গোবিন্দগীতিকা / রাজা মহেন্দ্রলাল খান)।
midnapore.in