পবিত্র পাত্র।
আজ পৌড়া অষ্টমী।গ্রামবাংলার বিশেষ লৌকিক উৎসব। আজ আনন্দের দিন। প্রায় সমস্ত রাঢ় বাংলা সমেত দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলা তথা ওড়িশা লাগোয়া সমগ্র অঞ্চলে এই প্রথা প্রচলিত হয়ে আসছে। শীতের সকাল,অগ্রহায়ন মাস ;সেই মাসকেই সুবর্নরৈখিক ভাষায় বলে আঘ্রান মাস,তো এই আঘ্রান মাসেই হয় পৌড়া অষ্টমী। পৌড়া বা পড়ুয়ান কথাটির অর্থ হল, বাড়ির বড়ো সন্তান।আজ সব বাড়ির বড় বা অগ্রজদের আনন্দের দিন,বাড়ির কনিষ্টদের বা ছোটদের নয়। তবে ছোটরাও আজ নাছোড়বান্দা, তারাও নিয়ম মেনে বসে পড়ে ভাগ নিতে,নতুন জামা কাপড় পরতে চায় তারাও। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যেমন কৃষ্ণের জন্মদিন, জন্মাষ্টমী পালিত হয়,তেমনি অগ্রহায়ন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয় এই পড়ুয়ান অষ্টমী বা পৌড়া অষ্টমী।
সকাল থেকে শুরু হয় নানান উৎসব। প্রথমে বাড়ির বড়ো যারা তারা স্নান করেন কাঁচা হলুদবাটা মেখে। অন্যদিকে তুলসী তলা সেজে ওঠে নানা আঙ্গিকে। মঞ্চ ধুয়ে পিঁড়া বা পিঁড়ি রাখা হয় মঞ্চে তার উপর বিছানো হয় হলুদ গাছের পাতা। গোময় দিয়ে বানানো হয় গোবর্দ্ধন ঠাকুর।ছোট ছোট গোলাকার আকার দেওয়া হয় গোময়কে। সংখ্যায় পাঁচ,সাত,আট বা তারও বেশি করা হয়। তারপর সেই ছোট্ট গোময়ের উপর রোপন করা হয় ধানের শিষ,দূর্বাঘাস,ছড়ানো হয় কুলের পাতা,মূলোর চারা। একই সাথে প্রতিস্থাপিত ঘটের সাথে পূজিতা হন গৃহলক্ষী,হাতি,পায়রা,ঘট,ময়ূর ইত্যাদি বিগ্রহ ঠাকুর খেটিয়ালি তে।ঠাকুর খেটিয়ালি হল কাঠের তৈরী বিশেষ ধরনের একটি আসন যাতে মা লক্ষ্মী সহ অন্য সমস্ত বিগ্রহ থাকেন।এই লক্ষ্মী ঠাকুরের পূজো অগ্রহায়ন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়,মকরের সময় মকর খাইয়ে ঠাকুর বাক্সে বা হাঁড়িতে রাখা হয়, যদিও অঞ্চল ভেদে এই গৃহলক্ষ্মীর পজোর সময় ভিন্ন, দূর্গা পোজার পর কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোর সময় আবার সেই বিগ্রহ বের করে আবার পূজা হয়,তেঁতুল দিয়ে ধুয়ে,তেল হলুদ মাখাতে হয় ঠাকুর কে,পেতলের তৈরী মায়ের বিগ্রহে যেন সোনার ছটা দেখা যায়।
পড়ুয়ান অষ্টমী তে পূজিতা হবার পর তা তুলে রাখা ধানের ঘরে। মা লক্ষ্মী কে স্থাপনা করে প্রতিদিন পূজো করতে হয়। লক্ষ্মী বড়ো তাই তাঁকেওও পৌঁড়া অষ্টমী পালনের রীতি চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।এই বিশেষ পূজোতে লাগে মূলো, আখ, ধুবলা বা দূর্বা ঘাস, বাড়ির গোয়ালের পড়ুয়ান ছাড়ার গোবর,অর্থাৎ কোন গাভীর প্রথম সন্তান এর গোময়, চুয়া- চন্দন- সিন্দুর- ধুপ -উয়া বা আচল চাল,ও হলুদ বেটে ঠাকুর কে মাখানো হয় উয়া-হলুদ তাতে মেথি,তিল,চাল,হলুদ থাকে, ধান গাছ দেওয়া হয়,পিঠা করা হয়,উয়া চালকে বেটে ঘি দিয়ে পিঠে করা হয় যা মায়ের প্রসাদ,পানিফল কলা খেসুর,সুজি পালো ইত্যাদি নানান ফল। ঘটে কষাফল আমাডালা সিন্দুর পিঠালো বাটা। মাতৃস্থানীয় যে কেউপূজো করতে পারেন।
তুলশী মঞ্চে রাখা হয় নতুন জামা কাপড়।সেসব ও পূজো করা হয়। এরপর পৌড়াদের ডেকে বসানো হয় মঞ্চে,কোমরে বাঁধা হয় রেশম বা সুবর্নরৈখিক ভাষায় পোঁনচি বা পৌঁচি।এটাকে প্রায় সকলেই কোমরে ধারন করেন কেই লাল আবার বাচ্চাদের কেউ কেউ কালো।ওড়িশা লাগোয়া অঞ্চলে দেখা যায় পৌড়া দের গলায় তুলশীকাঠির মালা পরিয়ে দেওয়া হয়,তাদের মঙ্গল কামনা করে। বাড়ির মা বা ঠাকুমারা এই পূজো করে থাকেন। সকল গুরুজন আশীর্বাদ করেন। মাখায় রাখের দূর্বা,গাঁদা ফুল,আতব চাল ইত্যাদি। পাশে রাখা হয় কাঁসার ঘটি বা ঘট,যাতে দেওয়া হয় আমডালা,কষাফল,আতবচাল,দূর্বা সহ প্রদীপ সিন্দুর চন্দনের ফোঁটা।অনেকে কোন কোন সব্জি দিয়ে পূজো করেন,অনেকে আবার করেন না।আরও একটি বিশেষ জিনিস লাগে পূজোতে,সেটি হল চুয়া,যা বেনে দোকান থেকে আনতে হয়,খানিকটা চন্দনের মতো,নরম আঠালো পদার্থ যা ঘট,ঠাকুর সহ পড়ুয়াদের মাথাতে টিকা হিসেবে দেওয়া হয়,এর সাথে দেওয়া হয় আঁউলা নামের একটি হলুদ তরল পদার্থ,যা ছড়িয়ে দেওয়া হয় গোবর্দ্ধন ঠাকুর সহ সমস্ত জায়গায়।
তবে গোময় সবার ঘরেই পূজিত হয়। অন্যদিকে গোয়ালঘরের গোমাতাও পূজিতা হন। গোয়ালের যে সব বাছুর বড় বা পৌড়া তাদের ও স্নান করানো হয়,তারপর শালুক ফুলের থেকে মালা তৈরী করে তার গলায় পরানো হয়,এবং কপালে লাগানো হয় চন্দন সিন্দুর। এরপর বান্ধাপানা করা হয় পৌড়া দের। প্রদীপের আলোয় ছুঁয়ে যায় মায়ের মমতা।আনন্দের সুর বেজে ওঠে। সদ্য ঘরে তোলা ধান ভেঙে তা দিয়ে রাঁধা হয় পরমান্ন।নানান রকম পিঠে পুলি সহ পৌড়াদের জন্য থাকে ভুরিভোজের আয়োজন।শাঁখের আওয়াজ ধূপের সৌরভে ভরে যায় দশ দিক। ঘরে ঘরে পালিত হয় পৌড়া অষ্টমী। বাড়িতে ছাড়াও মামাবাড়ি থেকে পালন হওয়ার রীতিও প্রচলিত রয়েছে,অর্থাৎ পৌড়া দের সোনায় সোহাগা। আদরে আদরে কেটে যায় বেলা। মামাবাড়ি থেকে পালন করার জন্য বাড়িতে আসেন দিদিমা-মামা-মামিরা। ঘর ভরে ওঠে আনন্দ-সমারোহে। এভাবেই বেঁচে থাকে আমাদের লোক সংস্কৃতি,আমাদের উৎসব,আমাদের আনন্দের দিন।সংস্কৃতি বেঁচে থাকে পরম্পরায়,পরম্পরা বেঁচে থাতে ঐতিহ্যে,আর ঐতিহ্য বাঁচে উৎসবে। সেই গ্রামবাংলার উৎসব এই পৌড়া অষ্ঠমী।
আমার সুবর্নরৈখিক ভাষায় একটি লেখা -
midnapore.in