জঙ্গলমহলের পুঁটি মাছেরা
Puntius of Jangalmahal
রাকেশ সিংহ দেব।
Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Puntius of Jangalmahal
নাম প্রেক্ষিত
পুটি (পুষঠী) মাছের সংস্কৃত নাম ‘প্রোষ্ঠী’; কারণ, ওই মাছের উপরের ঠোঁট পুরু। আবার আর একটি অভিমত, ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার পর থেকে অর্থাৎ ভাদ্রের প্রোষ্ঠপদা নক্ষত্রের উদয়কাল থেকে এর বাড়বৃদ্ধি হয় বলেই এক কথায় ‘প্রোষ্ঠী’। সেই ‘প্রোষ্ঠী’ থেকে ‘পুঁঠী’ এবং ‘পাঠীন’। (তৎসম বা সংস্কৃত) প্রোষ্ঠী > (প্রাকৃত) পুট্ঠী >।
সত্য যুগে শ্রী হরি বিষ্ণুর মৎস্য (শফরী) অবতার।
পুঁটি মাছের আর এক নাম ‘শফরী’। শ্রীশ্রীভাগবত থেকে ঋষিবর শ্রীশ্রীশুকদেবের শ্রীমুখ থেকে জানা যায়, সত্যযুগে কল্পের অবসান কালে ক্লান্ত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নিদ্রার সুযোগ নিয়ে বলবান অসুর হয়গ্রীব বেদসমূহকে চুরি করে। ভগবান শ্রীহরি হয়গ্রীবের এই দুষ্কর্মের কথা জানতে পেরে স্বয়ং শফরী মৎসের (পুঁটি মাছ) অবতার ধারণ করে তাকে বধ করেন।
লোকপ্রবাদমূলক শ্লোক — “শফরী ফরফরায়তে"; অর্থাৎ অল্প জলেই শফরী ফরফর করে। এর অর্থ ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বল্প পরিসরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে।
পুঁটি মাছের প্রাণ ১ (আলঙ্কারিক) পুঁটি মাছের মতো স্বল্পপ্রাণ বা ক্ষীণজীবী ব্যক্তি; অল্প ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি। (বিশেষ্য) ২ হীনচেতা ব্যক্তি।
চুনোপুঁটি (বিশেষ্য) ১ ক্ষুদ্র মৎস্যবিশেষ ২ (আলঙ্কারিক) প্রতিপত্তিশূন্য সামান্য ব্যক্তি।
সরপুঁটি, সরপুঁঠি শরপুঁটি, শরপুঁঠি (বিশেষ্য) বড় আকারের পুঁটিমাছ বিশেষ।
সর [<(তৎসম বা সংস্কৃত) সরল] + পুঁটি
জঙ্গলমহলের সংস্কৃতি জুড়ে পুঁটি মাছের লাফালাফি
খাদ্য উপাদানের সহজলভ্যতা কোনো অঞ্চলের খাদ্যসংস্কৃতির মূল ভিত তৈরি করে। যে অঞ্চলে খাবারের যে উপাদান সহজলভ্য, সে অঞ্চলে সে উপাদানকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সেই অঞ্চলের প্রধান খাদ্যের পরম্পরা। আর এই খাদ্য পরম্পরা সুপুষ্ট করে এলাকার লোকসংস্কৃতিকে। সহজলভ্যতার কারণে ধান ও মাছ কালক্রমে জঙ্গলমহল তথা সমগ্র বঙ্গভূমির প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে। সে কারণে দেখা যায়, শুধু খাদ্যে হিসেবেই নয়, যাপিত জীবনের বিভিন্ন মাঙ্গলিক বাতাবরণেও ধান ও মাছের উপস্থিতি রয়েছে বিস্তর। হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক উপাদান। সামাজিক মনস্তত্ত্বে তাই, ধান মানেই ধন আর মাছ মানেই (নারীর ক্ষেত্রে) উর্বরতা। ধান ও মাছ থেকে কত রকমের খাবার তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে বাঙালির রয়েছে নিজস্ব লোকায়ত জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার। নদীমাতৃক আমাদের রাজ্যে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-দিঘি, ডোবা-নালা, জলাভূমি। আর এই বিস্তীর্ণ মিঠা জলের মানচিত্র আলো করেছে শত শত প্রজাতির মাছ। তাইতো এখানকার মানুষের খাদ্য তালিকায় মাছ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বর্ষার সময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাড়িতেই খাবারের তালিকায় মাছের একটা পদ থাকতই। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাত ও মাছ খাওয়ার রয়েছে এক সুদীর্ঘ পরম্পরা এবং রসায়ন। এই রসায়ন গড়ে উঠেছে ভূপ্রকৃতি, কৃষিকেন্দ্রিকতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির নিরিখে। সুফলা মাটিতে ধান আর টলটলে জলে মাছ — এই বাস্তবতায় যে জীবনযাপনপ্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে শত শত বছর ধরে, তাতে সুখ ও সমৃদ্ধির নানা সংস্কার-বিশ্বাসে, মাঙ্গলিক চিন্তায় ধান আর মাছ সমানভাবে উপস্থিত। প্রতিদিনের হেঁশেল থেকে উৎসবের ভোজে তো বটেই, সন্তানসন্ততি আর ঐহিক মঙ্গল কামনায় মানুষ ধান আর মাছের কাছেই ফিরে গেছে যুগে যুগে।
পুঁটি মাছের সংসার।
সারা বাংলার পাশাপাশি জঙ্গলমহলে প্রতিদিন চর্বচোষ্য না জোটা অধিকাংশের কাছে তাই খাল বিলের মাছই তাই হয়ে উঠেছে প্রকৃত স্বাদবিলাস। মোটা স্বর্ণ চালের ভাতের সঙ্গে যদি একটু মাছ কোনও দিন পাওয়া যায়, তবে সে বড় সুখের দিন! নদী, পুকুর, খালবিল বা বর্ষার জমা জলে মাছের খোঁজ চলে সময় সময়ে। এই জঙ্গলমহলের লাল মাটির নির্যাস আর এখানকার খাল বিল ছোট নদীর ধারা এখানকার শ্রমজীবী মানুষের রসনার সাথে সাথে পরিপুষ্ট করেছে কবির কাব্য সুষমা। কবির কাব্যধারায় এখানকার গ্রাম্যজীবনের পাশাপাশি ফুটে উঠেছে এখানকার মেছো গন্ধমাখা জীবনের কাহিনী। এই গ্রাম্য ভাবধারার বাহক হয়েছেন স্বর্গের দেবদেবী। ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়কালে এই জঙ্গলমহলের কর্ণগড়ে বসে শিবায়ণ কাব্যধারায় ‘শিব সংকীর্তণ’ পালা রচনা করেন কবি রামেশ্বর চক্রবর্তী (ভট্টাচার্য্য)। মোট আটটি পালার এই মহাকাব্যে কবি মহাদেব শিবকে উপস্থাপন করেছেন গ্রাম বাংলার এক কৃষকের চরিত্রে। ত্রিশূল ছেড়ে তিনি ধরেছেন লাঙলের হাল। কিন্তু মহাদেব নেশাতুর, বড়ই অলস। সপ্তম পালায় কবি বর্ননা করেছেন, অলস শিবকে চাষাবাদে নিয়োজিত করতে না পেরে গৌরি বাগদিনীর ছদ্মবেশে শিবের ক্ষেতে মাছ ধরতে এসেছিলেন। এই পালাটি বাস্তবধর্মী ও চিত্তাকর্ষক। দেবী পার্বতী মেছুনীর বেশ ধরে শিবকে কামাবিষ্ট করলে শিবের যে আচরণ প্রকাশ পেয়েছে তা গ্রাম্যরুচি সুলভ গানে হয়ে উঠেছে বাস্তবিক। দেবীর দৈবত্ব্য নয়, এই পালায় উঠে এসেছে দেবী গৌরীর এক গ্রাম্যবধূর রূপে মাছ ধরার কথা।
“ধরেন পাবদা পুঁটি পাঙ্গাস পাধীন।
চিতল চিংড়ি চেলা চাঁদকুড়ড়্যা মীন।।“
এই কাব্যধারা প্রস্ফুটিত হয়েছিল এক বিশেষ আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে। এই সময় জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। হরগৌরির সংসার যাপনের মধ্য দিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভাবী ঘরকন্নার সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। জঙ্গলমহলের মেয়েদের গানে মাছের প্রসঙ্গ তাই বারেবারে আসে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে গ্রামীণ মেয়েরা খুশিই হয়, কারণ নতুন জলের সাথে খলখল করে বেরিয়ে আসে নানান মাছ। আটপৌরে জীবনে এই জলের ধন এক পরম প্রাপ্তি। মাছ ধরা, রান্না করা, আস্বাদনের সাথেই মিশে থাকে দৈনন্দিন যাপনের হাজারো অভাবের মাঝে তৃপ্তির আবেশ। সারাদিন মাঠে কাজ করার পাশাপাশি অবসরে চলে চুনোপুঁটির সন্ধান। জঙ্গলমহলের মেয়েরা খালি হাতে মাছ ধরতে বিশেষ দক্ষ। হাঁটুজলে মাছ ধরে সংগ্রহ করে রাখে কাপড়ের কোঁচড়ে। রাতে ক্লান্ত শরীরে ডিবরির মৃদু আলোতে গরম ভাত আর সেই চুনোমাছের যুগলবন্দী সঞ্চার করে নতুন প্রাণশক্তির। টিপির টিপির বৃষ্টিতে ফোটে ঝুমুরের কলি।
“রিমিঝিমি হইল্য জল, পুঠিমাছে চলাচল
মাছগাকে ওল মিশাই রাধলি
ও জুড়া ঝুমুর গাহলি..।” (ঝুমুর গান)
বর্ষা শুধু কবি মনকেই চঞ্চল করেনা, জঙ্গলমহলের মানুষের বুকেও দ্রিম দ্রিম বেজে ওঠে রোমান্টিকতার মাদল। প্রান প্রকৃতির এই মাদকতার জৌলুসে পুঁটিমাছের চোখকেও কাজল পরা বলে মনে হয়। মাছ ধরতে ধরতে তাই বারবার প্রকৃতির রূপে আত্মহারা হয়ে পড়ে যুবতি বঁধুয়া।
“ডুব্যে ডুব্যে মাছ ধরি শুধাই পুঁটি টেংরা
অ ছট দেঅরা,
মালি ফুলে বইসল্য ভমরা।” (ঝুমুর গান)
শুধু বড় পুকুরের বড় মাছেরা নয় এখানকার খাল বিলের প্রাকৃতিক চুনো পুঁটিরা স্বাদে কোনও অংশে কম নয়। শুধু গানের সুরেই নয় ছেলে ভুলানো নানান ছড়ার ছন্দেও উঠে এসেছে মাছেদের কথা। এই জঙ্গলমহলের শিশুমননের ছান্দিক বিকাশে আজও সেগুলি চিরনতুন।
“তিরিং রিঁগা রিঁগা
পুঁঠি মাছে গীত গাহিইছে
লাইরছে বাড়ির ঝিঁগা।” (প্রচলিত ছড়া)
কয়েক বছর আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াতে গিয়েছিলাম পট মেলা উপলক্ষে। সেখানে পটচিত্রে মাছের বিয়ের ছবি দেখিয়ে একটা গান শুনিয়েছিলেন এক মহিলা পটুয়া।
মাছের বিয়ে পটচিত্র।
“দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো রঙিলা
পাবদা, ভেটকি বলছে দেখো,
তোমার হাতের চুড়ি হবো গো রঙিলা।” (পটের গান)
লোকগান জুড়ে এই মাছের প্রসঙ্গ মন কে নাড়া দেয়। যুগ যুগ ধরে মেছো স্বাদ ঘ্রাণ নিয়ে জঙ্গলমহলের লোকজীবন থেকে লোক-সংস্কৃতির অন্তরাত্মায় বিরাজমান জঙ্গলমহলের মৎস্যমঙ্গল কথা আজও তাই অমৃত সমান। ডাহি ডুংরির বুক ভিজিয়ে বয়ে চলা ধারাস্রোতে এইভাবেই বেঁচে থাক মাছ-মানুষের গান।
জঙ্গলমহলের প্রচলিত দাঁতকথা প্রবাদ ধাঁধাঁ জুড়ে পুঁটিমাছ
‘আঘাইল্ বঘের্ পুঁঠি তিতা’।
(‘আঘাইল্’ = যার পেট ভর্তি রয়েছে বা পেটভর্তি খাওয়া। ‘বঘ্’ = বক। ধনবান ব্যক্তির ধনলাভের প্রতি অনীহা।)
‘চুনা চিংড়ির একই দর।’
(‘মুড়ি মিছরির এক দর’ প্রবাদের অনুরূপ। বিবেকহীন সমাজের বিচারব্যবস্থায় উৎকৃষ্ট বিশেষ বিশেষত্বের মর্যাদা পায়না।)
‘ছিঁড়াকানি সিয়া, পুঁটিমাছ জিয়া, বুঢ়াকালে বিহা।’
(কিছু কিছু কাজ শুধুমাত্র লোকহাসির কারণ হয়। বুড়া বয়সে বিয়ে, ছেঁড়া জীর্ণ কাপড় সেলাই করে ব্যবহার এবং পুঁটিমাছ জিইয়ে রাখার চেষ্টা শুধুমাত্র উপহাসের কারণ হয়।)
দেশি পুঁটি
ইংরেজি নাম : Pool Barb, Spotfin Swamp Barb, Stigma Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius sophore (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : পুঁটি, জাত পুঁটি, দেশি পুঁটি।
দেশি পুঁটি।
এদের দেহ মোটামুটি চওড়া ও চাপা। পিঠ এবং পেট উভয়ই ধনুকের মত উত্তল। তবে পৃষ্ঠদেশ উদর অংশের তুলনায় বেশী উত্তল। এদের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ প্রায় ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। মুখে কোনো শুঁড় নেই। পৃষ্ঠপাখনা পিঠের উঁচু অংশ থেকে শুরু করে পিঠের নিম্ন ঢালে শেষ হয়েছে। পৃষ্ঠ পাখনার কাঁটা নরম। পুচ্ছ দ্বিবিভাজিত। দেশী পুঁটির দেহ মাঝারি মাপের আঁশ দ্বারা ঢাকা। এদের কানকো ঈষৎ লালচে ধূসর। এদের গায়ের রঙ রূপোলি। অনেক জাত পুঁটির দেহের রূপোলি রঙের সাথে লালচে ভাব থাকে। জাতপুঁটির লেজের বেশ কাছে প্রায় গোলাকার একটি কালো দাগ থাকে। অনেকসময় এই দাগ অত্যন্ত হালকা থাকে বা থাকেনা। পৃষ্ঠ পাখনার গোড়াতেও কালো দাগ দেখা যায়। পুরুষ মাছের অন্যান্য পাখনার গোড়ার অংশ হালকা লাল রঙের থাকে, প্রজনন ঋতুতে যা অপেক্ষাকৃত গাঢ় হয়। পুরুষ মাছেদের দেহের পার্শ্বদেশ বরাবর কানকো থেকে পুচ্ছ পাখনার গোড়া পর্যন্ত একটি চওড়া লাল দাগ বিস্তৃত থাকে। স্ত্রী মাছেদের ক্ষেত্রে এই দাগ অনেকটা ফিকে হয়। এরা পরিস্কার এমনকি গন্ধযুক্ত উভয় জলেই বাস করতে পারে। আবার জলজ আগাছাযুক্ত কাদাময় তলদেশের প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে সক্ষম। এদেরকে নদী, মৃদু স্রোতযুক্ত জলাধার, পুকুর এবং ধানক্ষেতে সর্বত্র বাস করতে দেখা যায়। দেশী পুঁটি পেটুক স্বভাবের মাছ। খাদ্যের বিচারে এর সর্বভূক। সাধারণত এরা ভাসমান শৈবাল, ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী, কাদা, বালি, মৃত প্রাণীর পচা দেহাংশ, অন্যান্য মাছের ডিম ইত্যাদি খায়। এই মাছ ঝাঁক বেঁধে চলাচল করে এবং দলবদ্ধভাবে বাস করে। খুব ছটপটে এবং দ্রুত। জল না নাড়লে ঘাটের কাছে বিশেষ করে যেখানে এঁটোকাঁটা ফেলা হয় সেখানে ঝিলিক মেরে ঘুরে বেড়ায়। জলের উপরে এই মাছ খুব কম সময়ই বাঁচে এবং দ্রুত পচতে শুরু করে। অন্যান্য পুঁটি মাছেদের মতো এদের প্রজননকাল বর্ষাকাল। এসময় এই মাছ প্রচুর পাওয়া যায়। বর্ষাকালে এরা তাদের আবাসস্থলের সর্বত্রই প্রজনন করতে পারে। এই মাছটি ছোট এবং প্রচুর কাঁটাযুক্ত তবে সস্বাদু হওয়ার কারণে বাজারে এর ভালো চাহিদা রয়েছে। এটি অ্যাকুরিয়ামে পালনের উপযোগী মাছ। বাসস্থান সংকোচন এবং কীটনাশকের কারণে জলদূষণ এর কারনে এদের সংখ্যা কমেছে। তবে পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক নয়। অন্য পুঁটি প্রজাতির তুলনায় এই মাছ এখনও বেশী পাওয়া যায়।
তিত পুঁটি
ইংরেজি নাম : Ticto Barb, Firefin Barb, Two-spot Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius ticto (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : তিত পুঁটি, তিতা পুঁটি
তিত পুঁটি।
তিত পুঁটি সাধারণত ৩ ইঞ্চি থেকে ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তিত পুঁটির মাথা ছোট। মাথার পেছনের অংশ ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে (অনেকটা কাতলা মাছের মতো)। দেহের মাথা ও লেজের গোড়ার অংশটুকু সরু ফলে দেহটি দেখতে প্রায় গোলাকার। তিত পুঁটির মুখে কোনও শুঁড় থাকেনা। তিত পুঁটির পৃষ্ঠপাখনাটি শ্রোণীপাখনার গোড়ার চেয়ে সামান্য পিছন থেকে শুরু হয়। পৃষ্ঠপাখনাটির কাঁটা নরম। পার্শ্বরেখা অসম্পূর্ণ। সারাদেহ উজ্জ্বল রূপোলী আঁশে ঢাকা। সাধারণত দেহের দুই পাশে কানকোর পেছনে এবং লেজের গোড়া থেকে বেশ কিছুটা আগে পার্শ্বরেখা বরাবর একটি প্রায় গোলাকার কালো দাগ থাকে। অনেকসময় কানকোর পরেরে দাগটা স্পষ্ট হয়না। দেহের পৃষ্ঠভাগ ধূসর থেকে ঘাসের ন্যায় সবুজ, পার্শ্বভাগ উজ্জ্বল রূপোলী কিন্তু পেট প্রায় সাদা রঙের হয়ে থাকে। পরিণত পুরুষ মাছের দেহাকৃতি ও পৃষ্ঠপাখনার রঙ দেখে সহজেই স্ত্রী মাছ থেকে পৃথক করা যায়। কেননা প্রজনন ঋতুতে পুরুষ মাছের দেহের পিঠের দিকে অনেকসময় হালকা সবুজাভ রঙ দেখা যায়। এসময় পুরুষ মাছের পৃষ্ঠ পাখনায় লালের ছিটে দেখা যায়। পরিস্কার জল এবং কর্দমাক্ত তলদেশ এরকম পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। তিত পুঁটি স্থির ও অগভীর জলাশয়, পুকুর, নালা, খাল, বিল এর জলে পাওয়া যায়। নদীর ধারের কর্দমাক্ত তলদেশে বাস করে। এরা জলের উপরিতল এবং তলদেশ উভয় জায়গাতেই স্বচ্ছন্দ্যে বসবাস করে। সাধারণত জলজ উদ্ভিদ, কাদায় বসবাসরত ছোট ছোট অমেরুদন্ডী প্রাণী এবং পোকামাকড় খায়। এরা গভীর জলাশয়ের তলায় জমে থাকা বিভিন্ন খাবার খেয়ে থাকে। তিত পুঁটি মাছ জলের উপরিভাগ ও তলদেশ উভয় স্তরেই চলাচল করে। দেশী পুঁটির ঝাঁকের সাথে থাকে। খুব একটা দ্রুত এবং ছটপটে নয়। অল্প জলে থাকতে পছন্দ করা এই মাছ জলজ উদ্ভিদ এবং গলিত ও পচা আবর্জনা খেয়ে জল বিশোধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রজনন ঋতুতে বিশেষ করে মে থেকে অক্টোবর মাস দেহের পার্শ্বভাগ লাল বর্ণ ধারন করে। পুঁটি মাছেদের মতো এদের প্রজনন মরসুম বর্ষাকাল। মে-জুন মাসে এদের সর্বাধিক প্রজনন হয়। জলাশয় অথবা পুকুরের অগভীর কিনারে এরা ডিম দেয়। একদিনের মধ্যেই ডিমগুলি ফুটে পোনা বের হয় এবং পরবর্তী দিন থেকে পোনাগুলো মুক্তভাবে সাঁতার থাকে। নিজেদের ডিম পোনা খেয়ে ফেলার ব্যাপারে এদের বদনাম আছে। দেশী পুঁটির ঝাঁকে থাকলেও এদের গায়ের দাগ দেখে আলাদা করা যায়। তিত পুঁটি প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ। এই মাছের মাথা তিতা স্বাদযুক্ত হওয়ায় কিছু কিছু লোক খেতে চায় না। বাজারে দেশী পুঁটির মতো চাহিদা নেই। এই ক্ষুদ্রাকৃতির বর্ণময় পুঁটি মাছটি অ্যাকুরিয়ামে অনেকেই পালন করেন। স্বাভাবিক বাসস্থানে সংখ্যায় উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে।
টেরি পুঁটি
ইংরেজি নাম : One spot Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius terio (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : টেরি পুঁটি
টেরি পুঁটি।
টেরি পুঁটি।
টেরি পুঁটির দেহ গভীর এবং চাপা। পৃষ্ঠভাগ উদরীয় অংশের তুলনায় অধিক উত্তল। স্পর্শী অনুপস্থিত। মুখ মধ্যম আকৃতির। পৃষ্ঠপাখনা পুচ্ছপাখনার গোড়া ও তুন্ড শীর্ষের মধ্যবর্তী স্থানে উৎপন্ন হয় এবং শেষোক্ত পাখনাদন্ড অশাখান্বিত, অস্থিগঠিত ও মসৃণ যা দৈর্ঘ্যে মাথার সমান। শ্রোণীপাখনা পৃষ্ঠপাখনার নিচে থেকে শুরু হয়। পার্শ্বরেখা অসম্পূর্ণ। দেহের উপরের অংশ হলুদাভ রুপালি বর্ণের। একটা বড় কালো ফোটা দেহের পার্শ্বদিকে পায়ুপাখনার উপরে ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। আবার ফুলকা পর্দার ঠিক পিছনে ও একটি কালো আড়াআড়ি চিহ্ন দেখা যায়। পাখনাগুলো হয় স্বচ্ছ বা হালকা হলুদাভ বর্ণের প্রতিটি আঁইশে সূক্ষ কালো বিন্দু থাকে। কানকোতে একটা লালচে কমলা বর্ণের দাগ এবং পুচ্ছপাখনার গোড়া ও দেহে বিদ্যমান দাহের মাঝে একটা সূক্ষ কালো রেখা থাকে। পুরুষ মাছ মোটামুটি হলুদাভ বর্ণের এবং এর শ্রোণী ও পায়ুপাখনা প্রায় কমলা বর্ণের হয়ে থাকে। কিন্তু স্ত্রী মাছের দেহ রুপালি বর্ণের এবং পাখনাগুলো স্বচ্ছ হয় । প্রজনন ঋতুতে পুরুষ মাছটি কমলা বর্ণ ধারণ করে। এই মাছের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৯ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। টেরি পুঁটি জলের উপরিভাগ এবং তলদেশ উভয় স্তরেই বাস করে। জলের প্রধানত শ্যাওলা, পোকামাকড় খায়। সাধারণত নদী, ডোবা, মৃদু স্রোতযুক্ত জলাধার, খাল-বিল, পুকুর এবং প্লাবন ভূমিতে বাস করে। তবে কাদা এবং বালুময় তলাবিশিষ্ট স্থির জলেও এদের পাওয়া যায়। এরা শান্ত প্রকৃতির এবং অ্যাকুরিয়ামের উপযুক্ত মাছ।
ফুটানি পুঁটি
ইংরেজি নাম : Pygmy Barb, Spotted Barb, Dwarf Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius phutunio (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : ফুটানি পুঁটি, ফোঁটা পুঁটি।
ফুটানি পুঁটি।
ফুটানি পুঁটি।
দেহ কিছুটা চাপা এবং উঁচু। পৃষ্ঠদেশ অংকীয়দেশের তুলনায় বেশ উঁচু। আঁশগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। এদের দেহ সবুজাভ রূপোলি বর্ণের। দেহের পার্শ্ব বরাবর এবং পেটে বিদ্যমান আঁশ থেকে রূপোলি প্রতিফলন দেয়। উলম্বভাবে প্রসারিত দুইটি লম্বা প্রশস্ত ডোরা বিদ্যমান যার মধ্যে একটি পৃষ্ঠ থেকে বুক পাখনার মাঝ পর্যন্ত, আর অপরটি পৃষ্ঠ থেকে পায়ুপাখনার পেছন পর্যন্ত বিস্তৃত। দুইটি হালকা ডোরা থাকে যার মধ্যে একটি পৃষ্ঠপাখনার সামনের প্রান্ত থেকে এবং অপরটি পশ্চাৎ প্রান্ত থেকে বিস্তৃত। প্রজনন ঋতুতে এদের পৃষ্ঠ ও বক্ষপাখনা হালকা হলুদ বর্ণে কিন্তু শ্রোণী ও পায়ু পাখনা কমলা বর্ণ ধারণ করে। এই প্রজাতি সর্বোচ্চ ৪ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। ফুটানি পুঁটি বালি বা কাদাযুক্ত স্থানে বাস করে। এটি নদী, স্রোতযুক্ত জলাধার, ডোবা, বিল এবং পুকুরে পাওয়া যায়। এরা উন্মুক্ত জলাশয়ে বা কোনো তলদেশের উপর ডিম পাড়ে তবে ডিমগুলোকে পাহারায় রাখে না। সকালবেলা জলের উপরিতলে লতাপাতার মধ্যে ডিম পাড়ে। বর্ষার শুরুতেই এদের প্রজনন ঘটে। এই প্রজাতির তরুণ এবং পূর্ণবয়স্ক মাছ গলিত ও পচা খাবার, কাদার প্রাণী যেমন পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিজ উপাদান প্রভৃতি খায়। আকর্ষনীয় অ্যাকুরিয়াম মাছ হিসেবে এটি পরিচিত।
সোনা পুঁটি
ইংরেজি নাম : Golden Dwarf Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Pethia gelius (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : গিলি পুঁটি বা সোনা পুঁটি
সোনা পুঁটি।
সোনা পুঁটি।
সোনা পুঁটির দেহ মাঝারি ও চাপা। শরীর লালচে-বাদামি বর্ণের হয়। এদের লেজের উপর কালো ডোরা থাকে. পৃষ্ঠ পাখনার গোড়ায় গাঢ় কালো ফোঁটা থাকে। এরা সাধারণত মৃদু স্রোতযুক্ত জলে থাকতে পছন্দ করে। ধানজমির ভেতরে বা তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলজ আগাছাপূর্ণ নালায় এদের পাওয়া যায়। এরা নদীতেও থাকে। স্ত্রী মাছগুলি পুরুষের তুলনায় আকারে বড় হয়। তাদের পেট স্ফীত ও গোলাকার হয়। পুরুষ মাছের গায়ের রঙ স্ত্রী মাছেদের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়। এদের সোনালী হলুদ গায়ে মোটা কালো দাগ দেখা যায়। এদের পাখনা উজ্জ্বল হলুদ রঙের হয় এবং পাখনার গোড়ায় কালো দাগ থাকে। অন্যান্য পুঁটি মাছের মতো এরা বর্ষাকালে জলজ লতাপাতার মধ্যে ডিম পাড়ে। এরা ঝাঁকে ঘোরাফেরা করে। পূর্ণবয়স্ক মাছ গলিত ও পচা খাবার, কাদায় থাকা পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ উপাদান খায়। আকর্ষনীয় অ্যাকুরিয়াম মাছ হিসেবে এদের চাহিদা রয়েছে। অনেকসময় বদ্ধ অবস্থাতেও এরা ডিম পাড়ে।
চোলা পুঁটি
ইংরেজি নাম : Swamp Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius chola (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : চেলা পুঁটি / চোলা পুঁটি
চোলা পুঁটি।
দেহ চাপা ও গভীর। দেহের অঙ্কীয় প্রান্তের চেয়ে পৃষ্ঠীয় প্রান্ত অধিক উত্তল । ছোট ও প্রান্তীয় মুখের উপরের চোয়ালে একজোড়া ছোট শুঁড় উপস্থিত। রূপোলী দেহে সোনালী বর্ণের কানকো দেখতে পাওয়া যায়। পুচ্ছপাখনার গোড়ায় একটি কালো বর্ণের গোলাকার দাগ দেখতে পাওয়া যায়। পৃষ্ঠপাখনার গোড়ায় ২য় থেকে ৫ম রশ্মির মধ্যবর্তী স্থানে একটি গোলাকার কালো দাগ উপস্থিত। পৃষ্ঠপাখনার মাঝ বরাবর এক থেকে দুই সারি কালো দাগ উপস্থিত। নদী, খাল, পুকুর এবং প্লাবিত ক্ষেত্রে বসবাস করে। পাথুরে তলদেশের বালি, নুড়ি, শিলা-পাথর সমৃদ্ধ স্থান যার গভীরতা প্রায় ১.৫ মিটার এমন স্থান এদের পছন্দ। প্রকৃতিতে এরা সর্বভূক অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয় প্রকারের খাবারই খেয়ে থাকে। কীট, পতঙ্গ এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র অমেরুদণ্ডী, উদ্ভিদের অংশ ও পচা-গলা উদ্ভিদ বা প্রাণীর অংশবিশেষ এদের অন্যতম খাদ্য। পুরুষেরা স্ত্রীদের তুলনায় উজ্জ্বল বর্ণের হয়ে থাকে অন্যদিকে স্ত্রীরা পুরুষদের আকারে বৃহৎ হয়ে থাকে। এছাড়াও প্রজনন ঋতুতে পুরুষদের কমলা বর্ণের শ্রোণীপাখনা ও পায়ুপাখনা দেখতে পাওয়া যায় যেমনটি স্ত্রীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়না। জুন থেকে জুলাই এদের প্রজনন কাল। বর্ষাকালে ভারী বর্ষণের সময় এরা প্রজননের উদ্দেশ্যে অগভীর জলাশয় ও প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করে এবং জলজ উদ্ভিদের পাতার উপরে ডিম পাড়ে। এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে এর চাহিদা রয়েছে।
কাঞ্চন পুঁটি
ইংরেজি নাম : Rosy Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius conchonius (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : লাল পুঁটি, কাঞ্চন পুঁটি।
কাঞ্চন পুঁটি।
এই প্রজাতির মাছের দেহ Puntius গণের অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় গভীর এবং চ্যাপ্টা। মুখ প্রান্তীয়। উর্ধ্বচোয়াল কিছুটা দীর্ঘতর। ঘাড়ের উপরের অংশ সামান্য অবতল। পৃষ্ঠপাখনা পুচ্ছপাখনার গোড়ার চেয়ে তুন্ড শীর্ষের বেশি কাছ থেকে শুরু হয়। বক্ষপাখনা তুন্ড ছাড়া মাথার দৈর্ঘ্যের প্রায় সমান। শ্রোণীপাখনা পৃষ্ঠপাখনার শুরুর ঠিক নিচে থেকে শুরু হয়। এদের দেহ রূপোলি রঙের তবে পিঠের দিক কিছুটা কালচে, আবার আঁশগুলো গাড়ো কালো হয়ে থাকে। একটা বড় কালো দাগ পায়ুপাখনার পেছন অংশের ঠিক উপরে অবস্থিত। পুরুষ মাছেদের রঙ স্ত্রী মাছেদের চেয়ে গাঢ় হয়। এরা বিভিন্ন ডোবা, নদী, খাল-বিল, ঝিল, এবং পুকুরে বাস করে। কাঞ্চন পুঁটি প্রজাতির মাছ বিভিন্ন পোকা, জলজ কীটপতঙ্গ এবং বিভিন্ন প্রকার ডায়াটম, শৈবাল বা জলজ আগাছা খেয়ে বেঁচে থাকে। সারাদিন জলজ গাছের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে খাবার খুঁজে বেড়ায়। স্বভাবত এরা আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে। ঝাঁকে থাকতে পছন্দ করে। একটি দলে অল্প কিছু পুরুষ এবং অনেক মহিলা থাকে। বর্ষাকালে এই মাছ প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। প্রজনন ঋতুতে মাছগুলির দেহ চমৎকার লাল বর্ণ ধারণ করে। বাজারে অন্যান্য পুঁটি মাছের সাথে মেশানো অবস্থায় পাওয়া যায়। এদের সুন্দর এবং উজ্জ্বল রঙের কারণে অ্যাকুরিয়ামের জন্য ভাল চাহিদা রয়েছে। স্বাভাবিক বাসস্থানে এদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। বর্তমানে দুর্লভ দর্শন বলা যেতে পারে।
সর পুঁটি
ইংরেজি নাম : Olive Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius sarana (Hamilton, 1822)
স্থানীয় নাম : সরপুঁটি, সরনা পুঁটি, সরল পুঁটি
সর পুঁটি।
পুঁটি মাছেদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ওজন প্রায় এক কিলোগ্রামের কাছাকাছি হতে পারে। চওড়া দেহ, ছোট মাথা। পিঠের দিক বেশী বাঁকানো। এই মাছ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চির কাছাকাছি হতে পারে। উপরের চোয়ালে একজোড়া এবং নীচের চোয়ালে একজোড়া- মোট দুইজোড়া শুঁড় থাকে। পাখনাগুলো ধূসর সাদা বর্ণের হয়। বুক ও পায়ু পাখনাগুলোর প্রান্তভাগ লাল রঙের। উজ্জ্বল বড় বড় আঁশে দেহ ঢাকা। এদের দেহ রূপোলি রঙের। পিঠের দিকটা অপেক্ষাকৃত গাঢ় হয়। কালচে আভার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু দেখা যেতে পারে। কানকোতে সোনালী ছোপ দেখা যেতে পারে। দেহের মাঝ বরাবর একটা গোলাপী আভার দাগ থাকতে পারে। সরপুঁটি জলের উপরিভাগ এবং তলদেশ উভয় স্তরেই বাস করে। এরা খাদ্যের জন্য শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ, কাদায় বসবাসকারী অমেরুদন্ডী প্রাণী, কুচো চিংড়ি এবং পোকামাকড়ের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ১৩ সেমি মতো লম্বা হলে এই মাছ প্রজননের জন্য পরিপক্ক হয়। অন্যান্য পুঁটির মত বর্ষাকাল প্রজনন মরসুম। পরিস্কার মৃদু স্রোতযুক্ত জলে বোল্ডার পাথরের খাঁজে এবং ঘাসযুক্ত জায়গায় এরা ডিম ছাড়ে। এই মাছ খেতে সুস্বাদু। কিছু মৎস্য চাষীরা পুকুরে রুই মাছের সাথে এই মাছের চাষ করে থাকে। বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে। আকারে বড় হয় বলে অ্যাকুরিয়ামে পালন করার ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা নেই। স্বাভাবিক বাসস্থানে উদ্বেগজনক ভাবে এদের সংখ্যা কমে গেছে। বর্তমানে দুষ্প্রাপ্যই বলা চলে। এই মাছ দ্রুত বড় না হওয়ার কারণে পুকুর জলাশয়ে বিদেশী জাভানিজ পুঁটি আমদানি করায় বর্তমানে এদের চাষ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
জাভান পুঁটি
ইংরেজি নাম : Silver Barb, Java Barb
বৈজ্ঞানিক নাম : Puntius javanicus (Bleeker, 1855)
স্থানীয় নাম : ‘জাভান পুঁটি’ জঙ্গলমহলে নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘জাপানী পুঁটি’ হিসেবে জনপ্রিয়।
জাভান পুঁটি।
দেশি পুঁটির মতো চ্যাপ্টা আকার ও গড়ন। তবে এদের পিঠটা অনেক কোনাচে হয়ে উঠেছে। আকারে অনেক বড় হয়। গড়ে দুশো গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত ওজনের হয়ে থাকে। মুখে খুব ছোট দুজোড়া শুঁড় আছে যা প্রায় চোখেই পড়েনা। গায়ে উজ্জ্বল ও বড় বড় রূপালী আঁশ থাকে। পিঠ ও লেজ পাখনা ধূসর থেকে হলুদাভ ধূসর। পায়ু ও শ্রোণী পাখনা ধূসর কমলা ও পাখনার ডগায় লালচে দাগ দেখা যায়। বক্ষ পাখনা হালকা হলুদাভ হয়ে থাকে। এরা শাকাহারী মাছ। এরা শৈবাল, জলজ গাছপালা, হাইড্রিলা, প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে থাকে। স্থির জল বিশেষভাবে পছন্দ করে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মাছ। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে চাষ করা হয়। এই মাছ দ্রুত বৃদ্ধিলাভ করে। পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে ১৫০ গ্রাম থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে যায়। বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে।
পুঁটি স্পেশাল ‘পুঁটিজাল’
পুঁটিজাল গ্রামাঞ্চলের বহুল ব্যবহৃত জাল। এই জাল নদী, বিল, জলাভূমি, প্লাবনভূমি ও ধানক্ষেতের স্বল্প বা গভীর পাতা হয়। এই জাল দিয়ে সাধারণত পুঁটি মাছ ধরা হয়ে থাকে বলে এই ফাঁসজালের এইরূপ নাম। এই ধরনের ফাঁসজাল দিয়ে চুনোপুঁটি মাছ সবই ধরা যায়।
পুঁটি জাল।
এই জালের ফাঁসের আকার ১.৫ সেমি থেকে ৩.২ সেমি হয়ে থাকে। এটি সাধারণত জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অগভীর জলাভূমি, ধানজমিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। এই জালে ধরা পড়া মাছেদের মধ্যে ৭০-৮০ ভাগই পুঁটি মাছ। এছাড়াও এই জালে খলিসা, শিঙি, ট্যাংরা ইত্যাদি মাছ ধরা পড়ে।
Medinikatha Journal
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 18.06.2023)