মন্টু পান।
পুরাকালের পুরাকীর্তি তে শুনেছি, রামের চৌদ্দ বছরের বনবাস সময়ে তিনি যেখানে যেখানে অবস্থান করেছিলেন, আজও সেই সব জায়গার নাম "রাম" বা রাম সম্বন্ধীয় কিছু না কিছু হয়েছে। এ রামগড় ঝাড়গ্রাম জেলার রামগড় নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা-২ ব্লকের রামগড় গ্রাম। চন্দ্রকোনার পশ্চিমে, চন্দ্রকোনা থেকে এক-দেড় কিমি দুরে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, মনোরম পরিবেশে নির্জন এই ছোট গ্ৰাম সম্পর্কে আলোচনা করা আমার মতো অর্বাচীনের অকারণে আস্ফালন কিনা জানিনা।
রামগড়ের উত্তরে রয়েছে ধামকুড়া ও গোপীনাথপুর গ্রাম। দক্ষিণে রয়েছে রানীগঞ্জ, ঢুড়াবিলা ও ধরমপুর গ্রাম। পূর্বে অযোধ্যা ও মাধবপুর গ্রাম এবং পশ্চিমে জঙ্গল। চন্দ্রকোনার ইতিহাস রচয়িতা শ্রীযুক্ত কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী উল্লেখ করেছেন ভান বংশের ও চন্দ্রকেতু রাজার কাহিনী। চন্দ্রকোনা কে ঘিরে যে চারটি গড় বা দুর্গ ছিল তার অন্যতম ছিল এই "রামগড়"। রামগড়ের মধ্যেই বিরাজমান ছিলেন এক মন সোনার তৈরী বিগ্ৰহ রঘুনাথ। বর্দ্ধমান রাজা কীর্ত্তিচাঁদ রামগড় আক্রমণ শেষে, এখান থেকে পালকিতে করে রঘুনাথ জিউর মূর্তি বর্ধমান নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। শোনা যায় রামজীবনপুরের কাছে পালকি বাহকরা বিশ্রাম নেওয়ার পরে আর পালকি তুলতে পারেননা। বাধ্য হয়ে রাজা রঘুনাথ জিউকে ফিরিয়ে এনে নতুন ঠাকুর বাড়ি নির্মাণ করে রামগড়ের লাগোয়া অযোধ্যাতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন (রামগড়ের লাগোয়া খালার ওপারে মন্দির নির্মাণ করে)। আমি বা আমার মতো বহু মানুষ যা প্রত্যক্ষ করে ধন্য হয়েছি।
রামগড় খনন করলে আজও মন্দিরের "পুড়া চাল" পাওয়া যায়। বর্তমানে চন্দ্রকোনা থানার সামনে রাখা যে বিশাল দুটি কামান রয়েছে, তার একটি এই রামগড় থেকে এবং অপরটি লালগড় থেকে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে, আমরা সেই সব দেখেছি। বহু মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এই রামগড় থেকে লুট করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে সব আমার ছোটবেলার কাহিনী।
গড়টি বেশ উঁচু জায়গার উপরে অবস্থিত ছিল। এখনো এই গ্রামে এলে দেখতে পাবেন ১০-১৫ বিঘা জমির উপরে জঙ্গলাবৃত গড়ের ধ্বংসাবশেষ। ছোটবেলায় আমরা এই গড়ের ভেতরে একটি কুয়ো দেখতে যেতাম। কুয়োতে বাঁধা লোহার শিকল ধরে আমরা টানতাম, অনেক্ষন টানার পরে আটকে যেত শেকলটি। গ্রামেরই আরেক প্রান্তে রয়েছে রামতল পুকুর। ছোটবেলায় বড়োদের মুখে শুনেছিলাম যে এই পুকুরের মধ্যে অবস্থিত কুয়োর সঙ্গে গড়ের ঐ কুয়োর যোগাযোগ রয়েছে। অর্থাৎ গড় থেকে বিপদে পালিয়ে যাওয়ার সুড়ঙ্গ।
গ্রামের নাম রামগড় কিভাবে হল জানিনা তবে আজ থেকে ২৫ পুরুষ আগে সুদারাম পান নামে এক সদগোপ ২০০০ বিঘা নিস্কর জমি পেয়েছিলেন। তার বংশধররা এখনো এই গ্রামের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছেন। হতে পারে এই সুদারাম থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে রামগড়।
শ্রী দীর্ঘাঙ্গী উল্লেখ করেছেন - 'শ্রী রামচন্দ্র তাঁর মানবলীলা সম্বরণের পূর্বে লক্ষ্মণের দ্বিতীয় পুত্র মহাবীর "চন্দ্রকেতু"কে মল্লভূমির রাজ্য তথা রাজধানী চন্দ্রকোনা'র রাজা করেছিলেন। পৌরানিক যুগে ইনিই চন্দ্রকোনার আদি চন্দ্রকেতু রাজা।' যাইহোক এবিষয়ে ঐতিহাসিক গন বিচার বিবেচনা করতে পারেন আমার মতো সামান্য মানুষের কাছে এটা একেবারেই অবাস্তব।
এবার আসুন গুরু নানকের সঙ্গে আমার গ্রামের সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করে দেখা যাক। প্রায় পাঁচ শতাধিক বছর আগের কথা। নানক দেব স্বয়ং এই রামগড় গ্ৰামে এসে কয়েকটি দিন অবস্থান করেছিলেন। যেটাকে বর্তমানে আমরা অনেকেই নানক অস্থল বা রামগড় গুরুদ্বোয়ারা বলে চিনি। শিখ সম্প্রদায় এবং উদাসীন সম্প্রদায়ের সহাবস্থান এই স্থানকে ভারতের অন্যতম পীঠস্থান হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে। কারন শিখ ও উদাসীন একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে একটি ঘেরার মধ্যে বিরাজমান দেখতে পাবেন না, যদি এই রামগড়ে না আসেন। এটি অনেকটাই অহি-নকুল সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, তবুও স্থান মহিমায় বিরাজিত। চন্দ্রকোনা শহর থেকে যখনই আপনি পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসবেন তখনই এই স্থান টি দেখতে পাবেন। রামগড় গ্ৰামের উত্তর-পূর্ব স্থানে এই মহা মহিমান্বিত বহু বহু মনীষীদের বিচরণ ভূমি। এই ভূমিতে এসে মানুষের মনের মতো প্রার্থনা পূরণ হয় শুনেছি। এখনো প্রতিটি পূর্নিমায় হাজার হাজার ভক্ত সমাগমে এই স্থান মুখরিত হয়ে উঠে। ভদ্র মাসে ১ মাস ধরে চলে অখন্ড হরিনাম যজ্ঞ। প্রতিদিন ৫০০০-৭০০০ ভক্ত সমাগম হয়।
চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা অচল সিংহের দুই বলিষ্ঠ সহযোদ্ধা এই গ্ৰামের বাসিন্দা ছিলেন। নাম ফাগু ও সুবল। এই সুবলের নামে গ্ৰামের উত্তর-পশ্চিম দিকে বিশাল একটি বাঁধ, "সুবল বাঁধ" নামে পরিচিতি নিয়ে আজও মানুষের উপকার করে আসছে। ফাগু ও সুবল'কে নীলগঞ্জের ফাঁসিডাঙ্গায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম পর্যায়ে এই গ্ৰামের এক যুবক অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনায় নিজেকে নিয়জিত করেন, আমৃত্যু কারাবাস বা মৃত্যুর পরোয়ানা জারি থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ছয়টি বছর আত্মগোপন করে গড়বেতা থানার কাদড়া গ্ৰাম ও আসে পাশে লুকিয়ে কাটিয়ে ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ১৭ই নভেম্বর লরীতে ধাক্কা মেরে এই যুবককে হত্যা করা হয়। ঐ সময়ে চন্দ্রকোনার সবচেয়ে আধুনিক মানুষ শ্রীযুক্ত সত্য ঘোষাল, গোঁসাই বাজারে একটি স্মরণ শোভা করে এই যুবকের স্মৃতি চারন করেছিলেন। এই যুবকের নাম "শচীন পান"।
এই গ্ৰামের আরো দুটি কৃতি সন্তান বিজ্ঞান গবেষণায় যুক্ত। ডঃ অরবিন্দ পান পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণায় তাইওয়ান গিয়েছিলেন (বর্তমানে দেশে চাকুরীরত) এবং অনিরুদ্ধ পান পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন আমেরিকায়। এই গ্রামের জগবন্ধু পান গুরুদ্বোয়ারার শ্রী স্মরণদাস উদাসীনের সংস্পর্শে এসে পরমাত্মার খোঁজে আধ্যাতিক সাধনার জন্য কাশিবাসি হয়েছেন।
একসময়ে এই গ্রামে বৈষ্ণব সাহিত্যের চর্চা ছিল। এখনো রামকৃষ্ণ পানের বাড়িতে গেলে পদাবলী সাহিত্যের পুঁথি পাওয়া যায়। পাশের ধামকুড়া গ্রামের দুঃখীরাম চক্রবর্তীও লিখেছিলেন অনেক পুঁথি।
গ্রামে ১ টি প্রাইমারি স্কুল, ১ টি আই.সি.ডি.এস ও একটি উপসাস্থ কেন্দ্র রয়েছে। গ্ৰামের মধ্যে কত বৈচিত্র্য, কত সম্পদ, বিবিধের মধ্যে মহা মিলন, একদিকে অরন্য, অপরদিকে শহর চন্দ্রকোনা, গ্ৰামের বুকচিরে পাকা রাস্তা মনোরম পরিবেশ। আমি এই গ্ৰামেরই একজন অতি সাধারণ মানুষ। পাঠক বর্গের কাছে আমার অনুরোধ, লেখাটি পড়ে একটি বার এসে ঘুরে যান আমার গ্রাম রামগড়। তবে এ কথা স্বীকার করে নিতে হবে, মেদিনীপুর জেলার এক কৃতি শ্রীযুক্ত অরিন্দম ভৌমিক ফোন করে আমাকে একটি প্রবন্ধ লিখতে বলেন। আমি লিখবো স্বপ্নেও ভাবিনি, মূলত তার জোরাজোরিতে প্রেরণা পেয়ে হটাৎ এই লেখা। যদি একটি পাঠকও পড়েন তবে আমার লেখা ধন্য হয়ে যাবে।
midnapore.in