খড়গপুরে সংস্কৃতি-যজ্ঞ প্রথম শুরু করেছিলেন আচার্য মহাদেব রায়
Remembering Acharya Mahadev Roy of Kharagpur
সৌমেন গাঙ্গুলি।
এই কথাটা শুনতে আজ যেমন বিস্ময়ে ধাঁধা লাগে তেমনি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা যে, যিনি প্রথম খড়্গপুরের সংস্কৃতি চর্চার শুভ সূচনা করেছিলেন তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার বা তথ্য সংগ্রহ করে রাখার কাজটি কেউ করলেন না। অথচ এই শহরের বুকেই সেই আচার্য-প্রতিম-শিক্ষক ব্যক্তিত্ব মহাদেব রায় কর্তব্য নিষ্ঠায় অবিচল, ধ্যানমগ্ন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানরূপ আলোর ঝর্ণাধারা। তৎকালীন খড়গপুর কে তার যান্ত্রিক একঘেঁয়ে জীবন থেকে মুক্ত করে তিনি সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন চিন্তাধারা ও কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। তাঁর বহু প্রথিতযশা ছাত্রের হৃদয়ে আজও তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে আছেন বিভিন্ন সময়ে করা তাদের স্মৃতিচারণের কথায় আমরা জানতে পারি মহাদেব রায়ের কর্মকাণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। একটি কথা মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন হয়নি। দেশের ঘাড়ে তখন চেপে বসে আছে অশিক্ষা, দারিদ্র্যের মতো প্রবল প্রতিবন্ধকতা। তার সঙ্গে আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা মেটাতে ব্রিটিশ প্রভুর সাধারণ জনজীবনের উপর হয়রানি। এই সমস্ত বাধা বিঘ্নকে ফেলায় উপেক্ষা করে খড়্গপুরের পরাধীন মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞানে ও সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কঠিন কাজে মহাদেব রায় যেন মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এইসব কাজ করতে করতেই তিনি তৎকালীন ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হাই স্কুল খড়্গপুরের শিক্ষকতার কাজও সমান তালে চালিয়ে গেছেন।
১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বর্ণপদক প্রদানকালে মহাদেব রায়।
তার এক প্রিয় ছাত্র শ্রী শুভ্রেন্দু মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, 'রাবীন্দ্রিক স্নেহে প্রতিপালিত হয়েও তিনি খড়্গপুরের মত মফস্বল শহরে রেলওয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে আসেন চল্লিশের দশকের গোড়ায়। ...বিদ্যালয়ের পাশেই ছিল আমার বাবার কোয়ার্টার। আমাদের বাড়ির দশ মিটার দূরে ছিল তাঁর কোয়ার্টার। প্রতিদিন কাকভোরে তিনি উঠতেন। স্নান সেরে চন্ডীপাঠ, গীতাপাঠ সেরে ঋষিসুলভ কণ্ঠে তিনি উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করতেন। ... বেতের চাবুকের মতো তাঁর শীর্ণদেহ। বিরল কেসে সুরভিত তাঁর মাথাটির মধ্যে খনিজ সম্পদের মতো বৌদ্ধিক স্তর সুবিন্যস্ত ভাবে সুসজ্জিত। উজ্জ্বল চোখ দুটিতে ব্যক্তিত্বের প্রগাঢ় দীপ্তি সূর্যের মতো উদ্ভাসিত। স্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলে এক অপার স্নিগ্ধতা বিরাজ করতে দেখেছি। ... আজীবন ব্রহ্মচারী তিনি।
সেদিনের খড়গপুর শহরটি মহাদেব রায় নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে ছিল আশ্বস্ত। কেউ তাঁর মাস্টারমশাই বা শিক্ষক রূপে মনে করত না। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে আচার্য। বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ে হয়ে উঠতো প্রাচীন তপবনের মতো। নিরব স্তব্ধতার পবিত্র স্নিগ্ধতায় বিদ্যালয় যেন আপন স্থান করে নিতো আপন মাধুর্যে। সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি ক্লাস নিতেন। তিনি পড়াতেন 'পথের পাঁচালী' সেই অপু দুর্গার ছুটে চলা রেলের লাইন দেখতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার দরুন তিনি তার প্রভাবও এড়াতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতনে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আসলে তিনি সংস্কৃত সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্য, দুইটি শাখাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেছিলেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। এমন বিরল সম্মান লাভ করার ফলেই তৎকালীন বাংলার সারস্বত মহলে তিনি বিপুল পরিচিতি লাভ করেন। তবুও তিনি কলকাতার অর্থ-যশ-প্রতিষ্ঠার মায়াডাক উপেক্ষা করে খড়গপুরকেই তাঁর কাজের জগৎ করে নিয়েছিলেন। শৈলেন বাবুর কথায় "মহাদেব বাবুর আগ্রহ ও চেষ্টায় খড়গপুরবাসী বাঙালিদের সৌভাগ্য হইয়াছিল পরম শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রীর মতো পন্ডিত ব্যক্তির মুখে রবীন্দ্রকথা, সমালোচক প্রমথনাথ বিশীর মুখে রবীন্দ্র আলোচনা ও সাহিত্যিক শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মুখে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা শুনিবার। মহাদেব বাবুর কথায় উইট ও হিউম্যান-এর ছটা। কৌতুকরস সৃষ্টির সহজ প্রয়াস যাঁহারা শুনিয়াছেন, তাঁহারাই উপলব্ধি করতে পারিবেন ঐ ছিপছিপে মেদহীন শরীরে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে রসের কী এক অপূর্ব সংমিশ্রণ হইয়াছিল। তাঁহার হাতের লেখা ছিল ঋজু সুস্পষ্ট, রাবীন্দ্রিক স্টাইলের" তাঁর সাহিত্য প্রেমে মন্ত্রমুগ্ধ শ্রী বিজয় কুমার মাল মহাশয়ের গলাতেও এই এক সমর্থনের সুর। শ্রী মাল মহাশয় জানিয়েছেন, "লিখতেন তিনি কম। আমি 'প্রবাসী'তে তাঁর একটি গল্প প্রবন্ধ দেখেছি। প্রবন্ধটি বাল্মিকী, কালিদাস, তুলসীদাস ও রবীন্দ্রনাথ- এই চার মহাকবির কাব্যে বর্ষবরণের তুলনামূলক আলোচনা। বস্তুত সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ। "
আমরা শ্রী বিজয় কুমার মালের কাছে কৃতজ্ঞ। মহাদেব রায়ের স্মৃতি বিজড়িত অমূল্য বিরল মুহূর্তের ঘটনালিপি তিনি তার স্মৃতিতে ধরে রেখে আমাদের কাছে উপস্থিত করেছেন। মহাদেব রায় নামক সেই অপার বিস্ময়-পুরুষের জীবন ও ব্যক্তিত্বের একটি দিক আমরা জানতে পারি তার কাছ থেকে।
নতুন করে গড়ে ওঠা শহর খড়্গপুরে তখন বাঙ্গালী কম হলেও আজকের নিরিখে সাহিত্যচর্চা ও অনুষ্ঠান নেহাত কম হত না। সাহিত্যিক সংবর্ধনার অনুষ্ঠান হত রবীন্দ্র ইনস্টিটিউটে বা দূর্গা মন্দির সংলগ্ন নাট্যমঞ্চে। জানা যায় সেই সব অনুষ্ঠানে ক্ষিতিমোহন সেন, প্রমথনাথ বিশী, প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, সরোজ কুমার রায় চৌধুরী, গোপাল হালদার, জনার্দন চক্রবর্তী, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সীল, জগদীশ ভট্টাচার্য প্রমুখ বহু সাহিত্যিক ও মনীষীদের দেখার ও তাদের কথা শোনার সৌভাগ্য খড়গপুরবাসীর হয়েছিল। এই সমস্ত অনুষ্ঠানেই মনীষীদের আমন্ত্রণ ও এদের পরিচয় করার বা ভাষণ দেওয়ার একমাত্র মুখপাত্র ছিলেন মহাদেব রায়। বাংলার তৎকালীন সকল সাহিত্যিক ও প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কথা
বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত দুর্গম গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেইখানেই তার প্রাথমিক শিক্ষা। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষাও সেখানে। বাঁকুড়ার আরেক সর্বজ্ঞ পন্ডিত প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির স্নেহছায়ায় তিনি পরিণত হন। কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে তার প্রথাগত শিক্ষা জীবন তিনি শেষ করেন। এরপর তার সামনে বহু সম্মানীয় ও লোভনীয় চাকরির সুযোগ আছে। সেই সমস্ত কিছুটান, হাতছানি ছেড়ে খড়্গপুরেই ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন।
তাঁর কিছু সাহিত্যিক নিদর্শন
মহাদেব রায় সুসাহিত্যিক ছিলেন। তিনি বৈদান্তিক হওয়ায় সাহিত্য সেবাকেও তিনি নিষ্কাম কর্মযোগের দৃষ্টিভঙ্গিতেই গ্রহণ করেছিলেন। তাই তখনকার দিনে বিখ্যাত সব পত্রিকাতে তার প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশ পেলেও তিনি প্রচারের ডংকা নিনাদ থেকে দূরেই থেকেছেন। সম্প্রতি কমল চৌধুরীর সম্পাদনায় 'প্রবাসী'র নির্বাচিত সংকলন প্রকাশিত হয়েছে মিত্র ও ঘোষ থেকে। সেখানে মহাদেব রায়ের একটি কবিতা নির্বাচিত হয়েছে। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলার ১৩৬৩ সালের ভাদ্র সংখ্যায়। কবিতাটিতে রয়েছে তার কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর।
আচার্য যোগেশচন্দ্র প্রয়াণে
মহাদেব রায়
জন্মতিথি করি' শেষ 'স্বস্তিকে'র আম্রবনচ্ছায়ে,
শক্তি-অর্চনার তত্ত্ব গেলে রাখি শারদার পায়ে,
শারদবোধন লগ্নে। মহাকাল ধ্বনিল অন্তরে-
শত শরতের মূর্তি, হে আচার্য, সারদার বরে
দেখ এ অঙ্গনে তব। তবু কেন লভিল নির্বাণ
বাণীর অর্চনা রত সুবর্ণের দীপ অনির্বাণ
না ফিরিতে জন্মদিন? চিরদীপ্ত মেধাভস্মসার
মহাশুন্যে রচে শিখা দশদিকে করিয়া বিস্তার
জ্ঞানের গৌরব দীপ্তি। বহু বিদ্যাগর্ভ বঙ্গবাণী
লভিল যে পুত্র-করে বহুধা-প্রদীপ্ত মূর্তি খানি,
আশাহতা বঙ্গমাতা সেই পুত্রশোকে মূহ্যমান,
সহস্র সন্তান তাঁর কাঁদে স্মরি মহামূল্য দান-
মূল্যঋণ শোধে ব্রত-নিষ্ঠা আজি সমগ্র জাতির
রচিবে কি আলোকিত পথ সপ্তনবতি স্মৃতির?
কবি ও সম্পাদক রঘুনাথ ঘোষের সম্পাদনায় তৎকালীন খড়গপুর শহরের সাহিত্য পত্রিকা 'নবজাতক' পত্রিকার প্রথম বর্ষ, প্রথম প্রকাশ 'ভাদ্র, ১৩৬৪' সংখ্যায় মহাদেব রায়ের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির নাম 'কবীন্দ্র স্মরণে', তার কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল-
তোমাতে প্রদীপ্ত, কবি ভারতের শাশ্বত গরিমা
রসরূপে দিলে তুমি অন্য অনন্তের অনন্ত মহিমা
বঙ্গভারতীর কর নব তুলিকায় প্রতীচীর
নয়নে আঁকিয়া দিলে অমৃতের প্রলেপ গভীর,
মিশ্রিত হইয়া বিশ্ব হেরে দিব্য বঙ্গভাষা পুষ্টকান্তি নব।
মহাদেব রায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯০০ সালের কথা। খড়্গপুর তখন রেলসহর হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেছে। সেই সময় খড়্গপুর ছিল আরণ্যক রম্যতায় ভরপুর, নির্জন ছোট স্বল্প জনবসতিপূর্ণ জনপদ। বিভূতিভূষণের ব্যক্তিগত দিনলিপির পাতায় বহুবার খড়্গপুরের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। বিভূতিভূষণের উপস্থিতিতে খড়্গপুরের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের গণ্ডিকে সমৃদ্ধ করার কাজে পুরোধা ঋত্বিকের অসামান্য ভূমিকা রচনা করে গেছেন মহাদেব রায়।
বড় কোন নদীর টানে তার কোলে এসে মিলন পিয়াসী অন্য কোন নদীর মিশে যাওয়ার মতই কিংবদন্তি কথাকার বিভূতিভূষণের সঙ্গে মহাদেব রায়ের বন্ধুতা একসময় অত্যন্ত অন্তরঙ্গতায় এসে মিশেছিল। সেই সারস্বত মিলনযজ্ঞে তৃপ্তিময় অবহন করেছিলেন- এমনই এক ভাগ্যবান ছাত্র প্রয়াত শৈলেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন কিভাবে বিভূতি-মহাদেব সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। আসলে সেই সময় ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বাংলা খাতা দেখার সূত্রেই বিভূতিভূষণ ও মহাদেব রায়ের আলাপ ও ঘনিষ্টতা শুরু। ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতা দেখার অবসরে যে সাহিত্য আড্ডা জমে উঠত ভাষাবিদ গবেষক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'বিভুতিস্তুতি' বন্দনায় তাঁর উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন- 'তাঁর সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হল যখন তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বাংলার পরীক্ষক হয়ে সহকর্মী পরীক্ষকদের সঙ্গে পরম আনন্দে কয় বছর কাজ করবার সুযোগ আমার হয়।
বন্ধু মহাদেব রায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে গোল বাজার দুর্গা মন্দিরে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে বিভূতিভূষণ যোগ দিতে আসতেন। খড়্গপুরে সেই সময় বাঙ্গালীর সংখ্যা নেহাতি কম। তবুও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই দুর্গা মন্দির চত্বর। এই শহরেরই সন্তান সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীও তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'প্রথম প্রহর' উপন্যাসেও দুর্গা মন্দিরের সংস্কৃতি চর্চার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন' এ সম্পর্কে একটি মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন ট্রাফিক হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, সাহিত্যিক শ্রী বিজয় কুমার মাল মহাশয়। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা- "...বিভূতিভূষণকে আমরা দেখেছি ও তার সঙ্গে কথা বলেছি রেল স্কুলের পশ্চিমে মহাদেব বাবুর বাসায়। আমাদের হাতে লেখা পত্রিকাটির তিনি প্রশংসা করেছিলেন।
বাস্তবে তিনি 'মহাদেব', 'প্রথম প্রহর' উপন্যাসে তিনি 'সদাশিব'
ইলিয়াড ওডিসি'র সঙ্গে যেমন গ্রীস দেশের সম্পর্ক, মহাভারতের সঙ্গে যেমন ভারতবর্ষের যোগাযোগ ঠিক একইভাবে 'খড়গপুর' কেন্দ্রিক একমাত্র এপিক উপন্যাস লিখেছেন জনপ্রিয় সাহিত্যিক শ্রী রমাপদ চৌধুরী। কিংবা অন্যভাবে বললে বলতে হয়, খড়গপুর শহরের 'পথের পাঁচালী'ই হলো 'প্রথম প্রহর'। পথের পাঁচালী'র কিংবদন্তি কথাকার বিভূতিভূষণের সঙ্গে এ শহরের একরকম নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্র স্নেহধন্য খড়্গপুরিয়ান মহাদেব রায়ের সঙ্গে বন্ধুতার সূত্রেই এই যোগাযোগের পথচলা। বিভূতিভূষণ 'পথের পাঁচালী' লেখা শেষ করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ছাব্বিশে এপ্রিল। সেই সময় এবং তারপরে পরেও পন্ডিত, বাগ্মী, অসাধারণ শিক্ষক মহাদেব রায় শিক্ষকতা করতেন 'ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হাইস্কুল' (বি এন আর)-এ। ছাত্রদের মধ্যে 'পথের পাঁচালী'র আরণ্যক চেতনা সঞ্চারিত করার গুরুভার কাজটি তখনই শুরু করে দিয়েছিলেন মহাদেব রায় মশাই। তারই এক সুযোগ্য ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। আমরা আজ যে খড়গপুর শহর দেখছি, বেঙ্গল-নাগপুর রেল কোম্পানির খড়গপুর স্টেশন ও কারখানা তৈরির উদ্যোগকে কেন্দ্র করেই সেই আধুনিক শহরকেন্দ্রিক খড়্গপুর শহরের গড়াপত্তন। নগরায়ণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল স্থানীয়-কিছু বহিরাগত-বহু মানুষের সুখ দুঃখ ভালো-মন্দয় মেশানো আনন্দ বেদনার গতিশীল পথ চলা। খড়গপুর শহরের কাজ চলছে। এই কাজে একদিকে যেমন রয়েছে রেললাইন, লেভেল ক্রসিং, ইঞ্জিনের শান্টিং, কয়লার ধোঁয়া, রেল কারখানা, শ্রমিক আন্দোলন, রেলকুঠির কোলাহল মুখরতা, যা খরগোপুরের আরণ্যক মৌনতাকে এনে দিয়েছিল সুরেলা মৌতাত তেমনই মহাদেব রায়, শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী, নারায়ণ চৌবে প্রমুখ ব্যাক্তিত্বরা শহরের জীবনকে জীবন যোগ করার কাজে 'চাইনিজ ওয়াল' হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশেষ করে মহাদেব রায় হয়ে উঠেছিলেন 'লার্জার দেন লাইফ' এক মহাচরিত্র।
খড়্গপুরের জীবনকে তথা 'প্রথম প্রহর'কে মহাদেব রায় কতটা প্রভাবিত করেছিলেন, কিভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ঐতিহাসিক চরিত্র- সে কথা বর্তমান খড়্গপুরের সারস্বত সমাজ ভুলে গেলেও সাহিত্যিক শ্রী রমাপদ চৌধুরী তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাসে তাকে জীবন্ত কিংবদন্তি করে মূর্ত করে রেখেছেন। ১৯৫৪ সালে 'প্রথম প্রহর' প্রকাশিত হয়। ৫৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই শহরকে ঘিরে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার কাজ অনেকেই করেছেন। ব্যক্তিত্ব হিসেবে মহাদেব রায়ের ঐতিহাসিক ভূমিকম্পকে স্বীকৃতি দানের কৃপণতা আমাদের হতাশ করেছে কিন্তু শ্রী চৌধুরী যেমনটি শুনেছেন দেখেছেন পড়েছেন, অনুভবী অন্বেষণে তাই দিয়েই এক বর্ণময় চিত্রনাট্য রচনা করে গেছেন। এই উপন্যাসে ছোট্ট 'তিমু' ওরফে লেখক কখনো নিজে শহরের বর্ণনা দিচ্ছেন, কখনো চরিত্রের মুখ দিয়ে উপন্যাসে সংযোজন করেছেন। লেখক সৃষ্ট প্রায় সব চরিত্রই ঐতিহাসিকভাবে বাস্তব চরিত্র। এরকমই এক বর্ণময় চরিত্র 'সদাশিব জ্যাঠা'। আসলে কাল্পনিক নামের আড়ালে 'মহাদেব' হয়েছেন 'সদাশিব'। আমৃত্যু ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী মনের এই প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক সম্বন্ধে উপন্যাস বলবে, '... আচ্ছা সদাশিব জ্যাঠা সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেছেন, শুনেছো? সন্ন্যাসী? সদাশিব জ্যাঠা? বিস্মিত ও আহত হলাম। কিন্তু সন্ন্যাসী তো ছিলেন তিনি। ভোরবেলায় তাঁর তুলসীদাস আবৃতি যেন কানের কাছে ভেসে এল।' মহাদেব রায় সন্ত কবি তুলসী দাসের 'রামচরিতমানস'-এর অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। তিনি বহুদিন ধরে এর বাংলা অনুবাদ কর্মে ব্যাপৃত ছিলেন।
খড়গপুরে সংস্কৃতি-যজ্ঞ প্রথম শুরু করেছিলেন আচার্য মহাদেব রায় | Remembering Acharya Mahadev Roy of Kharagpur
"কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি সেই গৃহ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান ও সেখানে ভীষণ অসুস্থ হইয়া পড়েন। খবর পেয়ে তারই প্রাক্তন ছাত্র তাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দেয় এবং তার সেবা কার্যে ব্রতী হয়। সৌভাগ্যক্রমে যে চিকিৎসকের অধীনে তাহাকে রাখা হয় তিনি ও তাহার প্রাক্তন ছাত্র হওয়ায় চিকিৎসার বিষয়ে কোনো রূপ ত্রুটি হয় নাই। তৎসত্বেও তাহার পীড়া গুরুতর আকার ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ওই হাসপাতালের বেডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অন্তিম সময়ে তাহার পাশে আত্মীয়-বলিতে কেহই ছিলেন না। উক্ত দুই ছাত্রের চেষ্টায় তার শেষকৃত্য কলকাতায় সম্পন্ন হয়। তাহার এই অবহেলিত শেষ পরিণতির কথা চিন্তা করিলে চক্ষু সজল হইয়া ওঠে। তাহার আন্তরিক স্নেহের স্পর্শ পাইয়াছিলাম তাহা আমার জীবনের অমূল্য সঞ্চয় হইয়া রহিয়াছে।
আত্মীয় পরিজন তার কোন খবর না রাখলেও আকাশবাণী কলকাতা থেকে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে নিমতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক ও সাহিত্যিক যেমন- বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মহেশ্বর দাস, গজেন্দ্রনাথ মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ, সুখময় দত্ত এবং তার ছাত্র মনোরঞ্জন বন্দোপাধ্যায়। এই তথ্য জানিয়েছেন তার ভাতুষ্পুত্র সিলভার জুবিলী স্কুলের শিক্ষক রঞ্জন রায়।
উপসংহার
কিছু মানুষ থাকেন মেঘের মতোই মহৎ। যা কিছু গ্রহণ করেন, বিলিয়ে দেন অকাতরে। জগতের নিয়ত প্রগতিশীলতায় তারা যে এক অসামান্য ভূমিকা যোগ করে দিয়েছেন স্বয়ং তিনি হয়তো তা জানতে পারেন না। কর্ম করে যাওয়াই তাদের লক্ষ্য, ফলকে বিষবৎ পরিত্যাগ করেন। মহাদেব রায় এমনই এক জলন্ত ব্যক্তিত্বের উদাহরণ। জনতার মাঝে তাদের জন্মই শুধু পৃথিবীর কাজে প্রকৃতির কাজে গতি এনে দেওয়া। এটাই তাদের জীবনধর্ম। তাদের 'পথের পাঁচালী'। সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী মহাদেব রায়ের চরিত্র চিত্রন করতে গিয়ে এই মহাসত্য তাদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়েছেন তাদের অর্থাৎ মহাদেব রায় ও তার বন্ধু চিরন্তন কথা শিল্পী বিভূতিভূষণের কাছে ঋণ গ্রহণ করেছেন। 'পথের পাঁচালী'র শেষ প্রান্তে যেন এই কথারই প্রতিধ্বনি।
"দিন-রাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মরণ পার হয়ে, মাস বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায় ...পথ তখনও ফুরায় না ... চলে ... চলে ...এগিয়ে চলে ..." কিংবা রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফটোগ্রাফ খাতাতেও লিখেছেন সেই মহাসত্য। গতিই জীবন'! আত্মপ্রত্যয়ী মহাদেব রায়কেও আমরা গতিশীলতার ধারক-বাহক হিসেবেই পেয়েছি।
midnapore.in
(Published on 12.03.2023)