রেবন্তের খোঁজে কাকরাজিতে....
Revanta | Raivata | रेवन्त
শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
এসেছিলাম কেশিয়াড়ির নছিপুরে, একটা কাজে। কাজ শেষে ভাবলাম একটু ঘুরে আসা যাক, কারণ, বসে থাকতে মন চায় না। বেরিয়ে পড়লাম। নছিপুর থেকে কলাবনী হয়ে উঠলাম হাই রোডে।
কাকরাজিত গ্রাম। ছবিঃ শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
প্রাচীন বাংলায় বিশেষত দক্ষিণবঙ্গে বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুটি জনপদ প্রধান হয়ে উঠেছিল। একটি তাম্রলিপ্ত(তমলুক) ও অন্যটি দণ্ডভুক্তি (দাঁতন)। এদের মধ্যে একটি বাণিজ্য সড়কও ছিল। তাম্রলিপ্ত থেকে বাণিজ্য পথটি মেদিনীপুর শহর, নারায়ণগড় হয়ে দণ্ডভুক্তির মধ্যে দিয়ে বালেশ্বর ছুঁয়ে কটক পর্যন্ত গিয়েছিল । এই পথের উল্লেখ আইন-ই-আকবরীতেও রয়েছে ।
এই পুরোনো সড়কটি কে কবে তৈরি করেছিলেন তা জানা যায় না । পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাস্তাটি 'জগন্নাথ সড়ক' নামে পরিচিত ছিল । কারণ, শ্রী চৈতন্যদেব এই পথেই সুবর্ণরেখাকে ছুঁয়ে নীলাচলে গিয়েছিলেন । বৃন্দাবন দাসের 'শ্রীচৈতন্যভাগবত' এ তার সবিস্তার উল্লেখ রয়েছে -
" এইমতে মহাপ্রভু চলিয়া আসিতে।
কতদিনে উত্তরিলা সুবর্ণরেখাতে।।
সুবর্ণরেখার জল পরম নির্মল।
স্নান করিলেন প্রভু বৈষ্ণব সকব।।
স্নান করি স্বর্ণরেখা নদী ধন্য করি।
চলিলেন শ্রীগৌরসুন্দর নরহরি।। "
[শেষ খন্ড, দ্বিতীয় অধ্যায় ]
তীর্থযাত্রীরাও এই পথ ধরেই পুরীতে যেতেন। কিছুকাল আগে পর্যন্ত রাস্তাটি "উড়িষ্যা ট্রাঙ্ক রোড" নামে পরিচিত ছিল । বর্তমানে এটি NH 60.
এই পথ ধরে এগিয়ে এসে পৌছলাম মনোহরপুর গ্রামে । ডানদিকে সামান্য এগিয়ে(দাঁতন থেকে ৪ কিমি উত্তর পশ্চিমে) মোগলমারি প্রত্ন স্তুপ । একসময় এখানেই ছিল দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার " শ্রী বন্দক মহাবিহার "। এই মোগলমারি থেকে ২ কিমি পূর্বে কাকরাজিত গ্রাম । ১১শ শতকে পাল সামন্ত জয়সিংহ উৎকলরাজ কর্ণকেশরীকে এখানেই প্রবল যুদ্ধে নিহত করেন । আমাদের গাড়ি তাই বামদিকে নেমে গিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ধরে পৌছলো কুন্ড পুকুরের পাড়ে।
কাকরাজিত গ্রাম। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
বর্তমানে অসংখ্য পুকুর নিয়ে কাকরাজিত গ্রাম শুধুমাত্র চৈতন্যের স্মৃতিবাহী বৈষ্ণবক্ষেত্রই নয়, এক বিপুল প্রত্নক্ষেত্রও । গ্রামের মাঝখানে বর্গাকার প্রশস্ত উঁচু জায়গা । তার উত্তরে বিশাল এই কুণ্ড পুকুর । এই পুকুর ভাস্কর্য মূর্তির আকর । পঙ্কোদ্ধারের সময় বহু ভাস্কর্য মূর্তি উদ্ধার হয়েছে । আরও বহু মূর্তি এখনো এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে । সম্ভবত, মোগল-পাঠান যুদ্ধের সময় মূর্তিগুলিকে বাঁচানোর জন্য পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল । গবেষণায় জানা গেছে, মূর্তিগুলি চতুর্থ-পঞ্চম শতকের বা তারও আগে তৈরি । মূর্তিগুলি তৈরি করেছিলেন স্থানীয় শিল্পীরা সুলভ ল্যাটেরাইট শিলা দিয়ে ।
উদ্ধার হওয়া মূর্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিরত্ন, ধর্মচক্র, বৌদ্ধ দেব মণ্ডলী এবং ঘোড়ার পিঠে চড়া এক মূর্তি । এই মূর্তিটি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে । কেউ কেউ বলেন, এটি সূর্য মূর্তি । কারোর মতে, এটি রামপালের সামন্ত জয়সিংহের মূর্তি । এই মূর্তির সামনে উপবিষ্ট এক সিংহ মূর্তিও চোখে পড়ে । এই মূর্তিই আসলে রেবন্তের মূর্তি ।
বিভিন্ন পুরাণ ও মহাপুরাণে রেবন্তের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে । ঋগ্বেদের মতে, রেবন্ত সূর্য ও তাঁর স্ত্রী শরণ্যুর কনিষ্ঠ পুত্র । তিনি হিমালয়ের গভীর জঙ্গলের অধিবাসী অর্ধেক দেব অর্ধেক যক্ষ গুহ্যকদের অধিপতি।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, তিনি ছায়ার সন্তান, তাঁর ভাইবোনেরা হলেন শনি, তপতী ও ভদ্র ।
কাকরাজিত গ্রাম। ছবিঃ শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, তিনি বর্ম পরিহিত, তরবারি ও ধনুকধারী, হাতে তীর ও তূণীর। কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে অশ্বাসীন তাঁর ডান হাতে তরবারি, বাম হাতে চাবুক । তাই তাঁকে বলা হয়েছে "হয়বাহন(অশ্বারোহী)"। বরাহমিহির তাঁকে শিকারী অনুগামীদের দ্বারা পরিবৃত বলে বর্ণনা করেছেন ।
ভাস্কর্য গুলিতে রেবন্তকে সাধারণত গুহ্যকদের সঙ্গে শিকার দৃশ্যে দেখানো হয়েছে । তিনি কখনো হাতে তীর ধনুক কখনো বা সুরাপাত্র নিয়ে চলেছেন । কোনো কোনো ভাস্কর্যে দেখা যায় , তিনি লম্বা বুট পরিহিত । লক্ষ্যণীয়, সূর্য ছাড়া অন্য দেব দেবীরা সাধারণত নগ্ন পদ । কোথাও অশ্বারোহী তাঁর সঙ্গে রয়েছে একটি শিকারী কুকুর । ভাস্কর্য গুলিতে রেবন্তের অনুগামীরা সকলেই বল্লম ও তরবারীর মতো অস্ত্র সাজে সজ্জিত । তাদের কেউ শাঁখ বাজাচ্ছেন, কেউ বা ঢাক ঢোল, কেউ বা তাঁর মাথার ওপরে ছাতা ধরে রয়েছেন । মাথার ওপরে ছাতা ধরে থাকা তাঁর রাজকীয়তাকেই প্রমাণ করে । কোথাও অনুগামীরা জলপাত্র অথবা সুরাপাত্র হাতে নিয়ে ছুটন্ত! কোথাও অনুগামী বয়ে নিয়ে চলেছেন মৃত শূকর কিংবা শিকারী কুকুরটি তাড়া করে চলেছে শুকরটিকে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, দেবী ভাগবত পুরাণে রেবন্ত সাত মাথা বিশিষ্ট ঘোড়ায় আসীন বলা হলেও, প্রাপ্ত মূর্তিগুলিতে এক মাথা বিশিষ্ট ঘোড়াই দেখা যায় । সাত মাথা কি সূর্য দেবকেই ইঙ্গিত করে না??
সেকালে রেবন্তকে যোদ্ধা ও ঘোড়াদের অভিভাবক দেবতা হিসেবে জঙ্গলের বিপদ থেকে রক্ষাকর্তা এবং শিকারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পূজা করা হতো । বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে ও কালিকা পুরাণে সূর্য বন্দনার রীতিতেই রেবন্ত বন্দনার নির্দেশ রয়েছে । শব্দকল্পদ্রুমে আশ্বিন মাসে যোদ্ধাদের দ্বারা রেবন্ত পূজার কথা বলা হয়েছে । চতুর্থ পাণ্ডব নকুল তাঁর ঘোড়া বিষয়ক গ্রন্থ "অশ্বশাস্ত্রম্" এ অপদেবতার হাত থেকে ঘোড়াদের রক্ষার জন্য রেবন্ত পূজার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন ।
কাকরাজিত গ্রাম। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
মধ্যযুগের প্রথম দিকে পশ্চিম ভারতে বিশেষত রাজস্থানে রেবন্তের বন্দনা খুব জনপ্রিয় ছিল । প্রধানত বৈষ্ণব ও সূর্য মন্দিরে রেবন্তের মূর্তি দেখা যায় । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কণারকের বিখ্যাত সূর্য মন্দিরে রেবন্তের একটি প্রায় অক্ষত অপূর্ব মূর্তি রয়েছে ।
কাকরাজিতে প্রাপ্ত মূর্তিটি ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যায়, মূর্তিটি খানিক ভগ্ন হলেও, ঘোড়ার মাথাটি ও হাতের খানিকটা অদৃশ্য হলেও তিনি যে বর্ম পরিহিত তা সুস্পষ্ট । ঘোড়ার লাগাম এমনকি পায়ের বুট ও বোঝা যায় । মুখের দুপাশে সনাল পদ্মের উপস্থিতি সূর্য প্রভাবকেই ইঙ্গিত করে । লক্ষ্যণীয়, সূর্য মূর্তিগুলিতেও মুখের দুপাশে সনাল পদ্মের উপস্থিতি দেখা যায় । অন্য মূর্তি গুলিতে তাঁর মাথার উপরে রাজ ছত্র থাকলেও এখানে ছাতার বদলে গন্ধর্ব ও যক্ষদের উপস্থিতি । এই মূর্তির সঙ্গে কণারকের মূর্তির মিল খুবই স্পষ্ট । এটা অনুমান করতে বাধা নেই যে, রেবন্তের মূর্তি নির্মাণের সময় শিল্পী কণারকের মূর্তির দ্বারা বিপুল প্রভাবিত হয়েছিলেন । স্থানীয় অনেকে মূর্তিটিকে সূর্য দেবতা জ্ঞানে পূজা ও শ্রদ্ধা জানান ।
কাকরাজিত গ্রাম। ছবিঃ শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
সংস্কৃতে রেবন্ত শব্দের অর্থ "উজ্জ্বল"। পুরাণ ও মহাপুরাণ গুলিতে তিনি সত্যিই উজ্জ্বল , অথচ বর্তমানে অনেকেই তাঁর কথা জানেন না । বাংলাদেশে রেবন্তের কিছু মূর্তি পাওয়া গেলেও পশ্চিমবঙ্গে রেবন্ত মূর্তি বেশ বিরল । কোলকাতায় জাদুঘরে রেবন্তের একটি মূর্তি সংরক্ষিত আছে । সেই দিক থেকে বৈষ্ণব ক্ষেত্র কাকরাজিতে প্রাপ্ত মূর্তিটি দক্ষিণ বঙ্গের ইতিহাসকেই আরো সমৃদ্ধ করে ।
ফিরে আসার সময় ভাবছিলাম, এমন অমূল্য বস্তুর রোদ জল ঝড় সয়ে গাছতলায় থাকাই কি ভবিষ্যৎ?? সংগ্রহশালায় কি এর জায়গা হবে না?? এদেশের পুরাতত্ত্ব রক্ষায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা কবে তাকাবেন এর দিকে??
midnapore.in
(Published on 31.07.2021)
তথ্য সহায়তা :
● মোগলমারির বৌদ্ধবিহার : বিবিধ প্রসঙ্গ - (সম্পা. সূর্য নন্দী।
● চৈতন্যভাগবত।
● উইকিপিডিয়া।
● অনুসন্ধিৎসু সুতনু ঘোষ।