নদী,গাছ গাছালি আর মন্দিরের কোলাজ চিলকিগড় (রম্যভ্রমণ)।
Rivers, trees and temple collage Chilkigarh (Delightful travel).
সুদর্শন নন্দী।
চিলকিগড় যাব বলে মেদিনীপুর রাঙামাটির ফ্লাইওভারের দিকে তাকিয়ে আছি। সকাল সোয়া ছটার এই সরকারি বাসটি পেলে বাড়তি অক্সিজেন পাওয়া যায়। বড় বাস বাড়তি শ্বাস আর কি ! এই ধেড়ুয়া, ঝাড়গ্রাম লাইনের বাসগুলি বেশীরভাগই দেশলাই বাক্সের মতো ছোট । একজ্যাক্টলি বললে পানের গুমটি থেকে একটু বড়, চায়ের ঝুপড়ি থেকে বেশ ছোট। লিলিপুট এই বাসগুলির সামনের গেট আর পিছনের গেটের ফারাকও বেজায় কম। এরকম ভয়ঙ্কর এক বাসে ভিড়ে আমি একবার পুরো ষোলআনা রামধাক্কা খেয়ে পিছনের গেটে উঠেই সামনে গেটে হাজির হয়েছিলুম। সামনের হেল্পার জিগেস করলেন- নামবেন নাকি কাকা? তখনো একটা স্টপেজও মানে পরের স্টপেজ আই টি আই আসিনি। কানমুলি সেবার, হেঁটে যাব তাও আচ্ছা, তবু এই গুমোটমার্কা গুমটি বাসে চাপব না আর। দেশলাই সিগারেট কাপের থেকে সাবেকি লম্বা বাটার জুতোর খাপের বড় সাইজের বাস ঢের ভাল। আর স্টেট বাস হলে তো মনে হয় ঘরের লম্বা ব্যাল্কনিতেই বসে আছি। একটাই দরজা, যতই ঠেল, পথে অন্তত নামতে হবে না। তাই এবার সরকারি বাসে।
ডুলুং নদী।
বাস আসতেই হড়বড় করে চেপে পড়লুম। এক অদ্ভুত দুপেয়ে প্রাণী আমরা। সুখ সুখ ভোগ ভোগ করে করে একটু বেচালে সবেতেই মনে হয় সমস্যা। কম্প্রোমাইজ নেই, এডজাস্টমেন্ট নেই। বাসে সিট না পেলে এক সমস্যা, আবার বেশি সিট খালি থাকলে আরেক সমস্যা। কোনটা ছেড়ে কোনটা বসি। বিয়ের আগে একাধিক মেয়ে পছন্দ হলে যেমন হয় আর কি ! বাসে উঠেই দেখি গড়ের মাঠ, এন্তার সিট। তা চার পাঁচটি সিটে বসি আর উঠি। শেষে জানলার ধারের সিটে গিয়ে বডিটা সেটলড করলুম। ধেড়ুয়া ব্রিজ থেকে সকাল সকাল কাঁসাই নদীর ছবিটা ভালোই উঠবে। বসলুম পা ছড়িয়ে। জানলাটা খুলেছি, ঠাণ্ডা হাওয়ার চোটে পিছনের এক বুড়ো তো মারতে বাকি রাখে। সক্কালবেলা তর্ক এড়াতে ধপাস করে নামিয়ে দিই জানালা।
গাড়ি গাঁ গাঁ করে বাঘের হরিণ ধরা দৌড়ে ছুটছে। ড্রাইভারের বয়সটিও কম। কন্ডাক্টরকে বললাম ভাই, এতো জোর ছুটছে; গর্ত, খানা খন্দ হাম্প যে মানছেই না গো। সে আমার কথা শুনে হাঁক পড়ল- লবা একটু দেখে চালাস। কি শুনল কে জানে লবা, আমরা ভয়ে বোবা। কনডাকটর কথায় কথায় হেসে বললে সামনে বিয়ে ওর, খুব মেজাজে আছে। আমি মনে মনে ভাবি বিয়ের ব্যাপারটা জানতে পারলে বিয়ের পরই না হয় এ গাড়িতে চাপতুম।
রাজবাড়ীর মন্দির।
দেখতে দেখতে ঘড়ঘড় করে ধেড়ুয়া ব্রিজ উঠে পড়লুম। কাঁসাই নদীর ছবি তুলব বলে জানলা খুলতে গিয়ে দেখি সে উঠলই না। ধপাস করে নামানোর প্রতিশোধ মনে হয়। অনেক কসরত করে যখন জানালা উঠল তখন নদী কোথায়, বৈতা স্টপেজই পেরিয়ে গেছি। ভয়ে আছি আমার চিলকিগড় কনকদুর্গা স্টপেজে থামবে কিনা ! সে কথা বলতেই কন্ডাকটর বললে, কোন চিন্তা নেই কাকা, ড্রাইভার রোজ প্রণাম করে বাস থামিয়ে। সে সময় ঝপাং করে নেমে যাবেন। আমি ভীরু বুকে হাসি মুখে ঘাড় নাড়ি।
আসি গন্তব্য স্থান নিয়ে।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় পর্যটন স্থান কম নেই কিন্তু। প্রশ্নোত্তরে এভাবে জিজ্ঞাসা করা যায়- কি নেই আমাদের এই গর্বের মেদিনীপুরে? একদিকে সমুদ্র, বিস্তৃত মোহনা, আরেকদিকে ঐতিহাসিক স্থান থেকে মন্দির। অন্যদিকে প্রকৃতি দুহাত ভরে সাজিয়ে রেখেছে নদী-অরণ্য-গাছ গাছালি থেকে সবুজের সমাহার- অবুঝ মনকে, নীরস হৃদয়কে যে এনে দিতে পারে বেঁচে থাকার বাড়তি স্বাদ। আর সেই স্বাদপুরণ সাধ্যের মধ্যেই, হা করে পকেট কেটে নয়। জেলার মানুষ চাইলে ভাগ করে করে সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু অলসতা বড় বিষম বস্তু। যাচ্ছি যাব করতে করতে নবীন থেকে প্রবীণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া। তখন শুন্য-দর্শনের জীবন।
কনকদুর্গা মন্দিরের প্রবেশপথ।
কবিগুরুর কয়েক পংক্তি নিয়ে জাবর কাটা, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ……। তবে ঘোরা ও জানার ইচ্ছাই অলসতাফোবিয়ার মহৌষধ। সঙ্গে ভিটামিন হিসেবে দরকার জেদ।
এরকমই এক স্থান হল সাবেক মেদিনীপুর জেলা তথা হালে ভাগ হওয়া ঝাড়গ্রাম জেলার চিলকিগড় । বাস থেকে নামলাম স্টপেজে। জামবনির অদুরে ডুলুং নদীর তীরে গাছগাছালি ঘেরা চিলকিগড়-এর কনকদুর্গা মন্দির। যাবার অরণ্যময় পথটি রোমাঞ্চে ভরা। পেলাম মিষ্টি নদী ডুলুং । দেখলাম সহস্রাধিক প্রজাতির গাছ গাছালি। উপভোগ করলাম বিহঙ্গের কলতান আর দর্শন করলাম প্রাচীন মন্দির কনকদুর্গা। দেখলাম জামবনি রাজাদের রাজপ্রাসাদ ও সংলগ্ন মন্দিরগুলি।
কনকদুর্গা মন্দির।
জঙ্গলমহল একসময় মাওবাদের সমার্থক ছিল । এখন অবস্থা পাল্টেছে। চিলকিগড় যাওয়া আসার কোন সমস্যা নেই। চিলকিগড় যাবার জন্য আপনাকে ট্রেনে এসে নামতে হবে ঝাড়গ্রাম অথবা গিধনি রেলষ্টেশনে। গিধনি থেকে জামবনি রাজপ্রাসাদ তিন কিলোমিটার। চিচিড়াগামী পাকা রাস্তা। আর রাজপ্রাসাদের মূল ফটক থেকে বেরিয়েছে ঝাড়গ্রামগামী রাস্তা। সেই পথ ধরে চিলকিগড় আর এক কিলোমিটার। আসলে সব মিলিয়ে এক কিলোমিটার একটি টুরিস্ট সার্কিট বলা চলে। আর ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে চিলকিগড় চোদ্দ কিলোমিটার । তবে গিধনিতে সব এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ায় না। তাই ঝাড়গ্রামে নেমে একটি চারচাকা ভাড়া করলে আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন এই চিলকিগড় । যারা নিজেদের গাড়িতে আসতে চান তাঁরা জাতীয় সড়ক ছ নম্বর ধরে (মুম্বাই রোড) চলে আসুন। লোধাশুলি থেকে ডানদিকে ধরে গুগল ম্যাপে নেভিগেট করে সোজা আসুন কনক দুর্গামন্দিরের বিশাল ফটকে ।
আসি এই স্থান ও মন্দির প্রসঙ্গে । এই জামবনি চিলকিগড় পুরো এলাকা ছিল জামবনি রাজাদের অধীন। এরা আগে ধলভুমগড়ে রাজত্ব করতেন। পরে তাদেরই কোন উত্তরাধিকারী বা অন্য একটি শাখা চলে আসেন জামবনি এলাকায়। শুরু করেন রাজত্ব। কনকদুর্গা এদেরই অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবী জাগ্রত। দেবীর স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে ১৭৪৯ সালে তৎকালীন রাজা গোপীনাথ সিংহ মওগজ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । পরে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির থেকে সোনার বিগ্রহটি চুরি যায়। প্রায় তিন দশক এই মন্দিরের কোনো বিগ্রহ ছাড়াই মায়ের পূজা আরাধনা চলত। এরপর রাজার বংশধরেরা কনক দূর্গার অনুরূপ একটি অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি এখানে প্রতিষ্ঠা করেন এই মন্দিরে। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত পূজা দেন আর দুর্গাপূজায় নামে মানুষের ঢল। এখানকার দুর্গাপূজাও বেশ বৈচিত্রময়। চিলকিগড় কনকদুর্গা মন্দির ডুলুং নদীর পূর্ব পাড়ে , আর রাজবাড়ি নদীর পশ্চিম পাড়ে।
কংসাবতী নদী।
কনক দুর্গা মন্দিরে প্রবেশের সময় প্রায় ৭০০ মিটার রাস্তা গাছ গাছালিতে ভরা। অসংখ্য প্রজাতির গাছ লতা বা ঔষধি গুল্ম পাওয়া যায় এখানে। চারিদিকে পাখির গুঞ্জনে মন ভরে যায়।
রাজবাড়ীর প্রবেশপথ।
জামবনি রাজবাড়ী।
মন্দির চত্বরটিও খুব ছিমছাম। হিসেবে পুরানো মন্দির ৩৭০ বছরের পুরানো। প্রায় সাড়ে আট মিটার লম্বা ও সাড়ে ছ মিটার চওড়া বারো মিটার উচ্চতার । নতুন মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ১৩৪৪ সালে। অনেকটা গির্জার মতো। দেবী কনক দুর্গা অশ্বরূঢ়া, ত্রি নয়না, চতুর্ভুজা । মন্দির চত্বরের এক পাশে রয়েছে চিলড্রেন পার্ক। মন্দির দেখে পাশের ডুলুং নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করুন। চাইলে স্নান করতে পারেন। রাজপ্রাসাদে চলুন এবার। দেখবেন মূল ফটকের বাম দিকে কনকদুর্গা মন্দিরের স্থাপত্য, কালাচাঁদ মন্দির, শিবমন্দির আর বিশাল রাজপ্রাসাদ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব সুস্পষ্ট। বিশাল চত্বরে ঘুরে বিশ্রাম নিন প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের নিচে। আমি অবশ্য ঘণ্টা দুই তিন কাটিয়ে সামনের চায়ের দোকানে জিভ ভিজিয়ে দুদণ্ড গল্প করে বাসে উঠি। আসার সময়কার আতক তখনো কাটেনি। তাই ড্রাইভারের দিকে তাকাই। দেখে মনে হল সকালের মতো অতো বিয়ে ফুরুফুরে আমোদী নয়, খানাখন্দ দেখেই বাস ছোটাবে। কিন্তু বসার সিট নেই। অগত্যা কাছাকাছি নামার যাত্রী খুঁজতে থাকি।
midnapore.in
(Published on 07.02.2021)