অখিলবন্ধু মহাপাত্র।
সুদূর অতীতের এক স্মরণীয় ঘটনার চিহ্ন খুঁজতে যাত্রা করেছিলাম নারায়ণগড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। লক্ষ্য সতীরহাটের সতীমাতার মন্দির,লোকবিশ্বাসের উপর ভর করে এক মানবীর দেবী হয়ে যাওয়ার কাহিনী জানা।
খড়্গপুর থেকে বাসে চেপে রাণীগঞ্জ - চেন্নাই প্রধানমন্ত্রী সোনালী চতুর্ভূজের ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পৌঁছালাম খড়্গপুর মহকুমার অধীন নারায়ণগড় থানার মকরামপুরে। মকরামপুর থেকে তেমাথানী গামী ট্রেকার ধরে পূর্বে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলে জেলার বৃহত্তম ব্লক নারায়ণগড়ের ৩ নম্বর নাড়মা গ্রামপঞ্চায়েতের মদনমোহনচক গ্রাম। আঁকাবাঁকা পথের দুধারে সবুজ ধানের ক্ষেত। কোথাওবা সারি দিয়ে তালগাছ "এক পায়ে দাঁড়িয়ে" উঁকি দিচ্ছে আকাশে। এখন মকরামপুর থেকে সবং এর তেমাথানী পর্যন্ত পীচ রাস্তা হয়েছে। বছর পনেরো আগে ছিল চওড়া মোরাম রাস্তা।
আগে এই মদনমোহন চকের নাম ছিল দ্বারিকানগর। আর সরকারি নথিতে রয়েছে জায়গাটির নাম - পুরিচক। তবে এখন দ্বারিকানগর বা পুরিচক বলে কেউ বলে না। সবং এবং নারায়ণগড় ব্লকের এই সীমান্ত এলাকা এখন মদনমোহন চক বলে পরিচিত।
মদনমোহন চক বাজারের পিঠ ঘেঁষে রয়েছে সতীর হাট। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অতীতের এক স্মরণীয় ঘটনার ইঙ্গিত। আসলে আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে সতীরহাট ছিল এক শ্মশান ভূমি। গাছ গাছালিতে ভরা এক জনহীন প্রান্তর। হিন্দু শাস্ত্রমতে এখানেই পোড়ানো হত মৃতদেহ।
এই সতীরহাটেই ঘটে গিয়েছিল এক নারীর সহমরণের ঘটনা। সম্ভবত তারপর থেকেই নাম হয় সতীরহাট।
অতীতের দ্বারিকানগর বা পুরিচক, বর্তমানের মদনমোহন চকে ছিল সাঁতরা পরিবারের বাস। গোঁড়া হিন্দু সেই পরিবারেরই এক উত্তরসূরী ছিলেন দ্বারিকানাথ সাঁতরা। সম্ভবত তাঁরই নাম অনুসারে এই জায়গাটির নাম হয় দ্বারিকানগর। পরাধীন ভারতের দ্বারিকানগর এর সতীরহাটেই ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। সে আরও এক অন্য ইতিহাস।
আনুমানিক প্রায় ৩৪০ বছর আগের ঘটনা। রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অনেক আগের কথা। একদিন কোন এক অজানা রোগে সাঁতরা পরিবারের অন্যতম পূর্বসূরি রামচরণ সাঁতরার অকাল মৃত্যু হয়। শোনা যায় তাঁর প্রাণ প্রিয়া সহধর্মীনি কিশোরী বালা সাঁতরা কোলের সন্তানকে বাড়িতে রেখে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। রামচরণ সাঁতরার জ্বলন্ত চিতায় শোক বিহ্বল কিশোরী বালা নিজেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। শ্মশান যাত্রীরা হতবাক ঘটনার আকস্মিকতায়। স্বামীর চিতার পবিত্র আগুনে নিজেকে শুদ্ধ করেছিলেন বলে কিশোরীবালা সাঁতরা আজও এলাকার মানুষের কাছে 'সতীমাতা' নামে পরিচিত।সাঁতরা পরিবারের উত্তরসূরীরা এখনো আছেন। এক সদস্য লক্ষ্মীকান্ত সাঁতরা জানালেন অতীতের সেই কথা।
১৩৯৬ বঙ্গাব্দের মহালয়ার দিন সতীমাতার স্মৃতিতে একটি ফলক বসানো হয়। সেই ফলকের সামনে রয়েছে একটি কুন্ড। কুণ্ডটির চারদিক প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এটাই সতীমাতার মন্দির। নিরাকার সতীমাতার কুণ্ডে সিঁদুর দিয়ে যা কিছু কামনা করা হয় তাই নাকি ফলে যায় বলে মানুষের বিশ্বাস। এরকম বহু কাহিনী শোনা গেল সাধারণের মুখে। সেই বিশ্বাসের টানে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন মনস্কামনা পূরণের জন্য। সতীমাতার মন্দিরে পূজা দিয়েই স্থানীয় দুর্গাপূজার সূচনা হয় আজও। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। সতীমাতার স্মৃতিচিহ্নিত স্থানের দুইদিকে দুটি মন্দির। একটি কালীমন্দির এবং অন্যটি শিব মন্দির গড়ে উঠেছে, মাঝেই দেবী সতীমাতার অবস্থান। শিব ও কালী মন্দিরে নিত্যপূজা হলেও সতীমাতার আরাধনার নির্দিষ্ট কোন দিন বা আচার নেই। সতীমাতা কাউকে বিমুখ করেন না বলেই সবসময় লাল সিঁদুরে রাঙা থাকে তাঁর স্মৃতিস্থল। কেউ কেউ আবার জাগ্রত সতীমাতাকে সাক্ষী রেখে বিয়েও করেন এই মন্দিরে।
কিশোরীবালা সাঁতরার সতী হয়ে যাওয়ার সাল, তারিখ, মাস কোন কিছুই মনে নেই। তবে প্রতিবছর মহালয়ার দিন সেই নারীকে স্মরণ করেন কিছু মানুষ। পূজা হয় সতীমাতার। নানান উপাচারে মাতৃপক্ষের সূচনায় তাঁর পূজা হয়। লোক বিশ্বাসই মানবী কিশোরীবালা সাঁতরাকে দেবীতে পরিনত করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত- সতীরহাটে সতীমাতার মন্দির। লোকের মনে তিনি অত্যন্ত জাগ্রত দেবী।
তবে সতীমাতার মন্দিরের ইতিহাস ছুঁয়ে এলাকা ছাড়বেন না। তাহলেই মিস করবেন আরেক ইতিহাস, যা লোকবিশ্বাসের উপর ভর করে গড়ে ওঠেনি। সতীরহাটের দক্ষিণপূর্ব কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটি ভঙ্গুর স্মৃতি স্তম্ভ। যেগুলি পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দূর্ভেদ্য ঘাঁটির দ্যোতক। জঙ্গলে ঢাকা সতীরহাটের শ্মশানের কাছেই গড়ে উঠেছিল গুপ্ত সমিতি। ১৯০২ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুরে গুপ্তসমিতি গড়ে ওঠে। সেই গুপ্তসমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসুর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সত্যেন্দ্র নাথ বসু, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য হেমচন্দ্র কানুনগো। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা সেই গুপ্তসমিতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করেন। মেদিনীপুরে এসে তিনি হেমচন্দ্র কানুনগো , সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে মিলিত হন। সম্ভবত ভগিনী নিবেদিতার নির্দেশে হেমচন্দ্র কানুনগো অবিভক্ত মেদিনীপুর এর বিভিন্ন জায়গায় গুপ্তসমিতি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মদনমোহনচকের সতীরহাটেই ছিল সেই গুপ্তসমিতি, যার সদস্য ছিলেন বিপ্লবী পুলিনবিহারী রায়, ডমনচন্দ্র মাইতি,সতীশচন্দ্র সেনপতি এবং বিপ্লবী কিশোরীমোহন প্রমূখ। একটি ফলকে গুপ্তসমিতির দীক্ষাগুরু হিসেবে হেমচন্দ্র কানুনগো র নাম উল্লেখ আছে। এই গুপ্তসমিতির কোন কোন বিপ্লবী শহীদ হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের অনেক পরে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ খ্রীস্টাব্দের মধ্যেই এই স্মৃতিস্তম্ভগুলি স্থাপিত হয়। স্মৃতি স্তম্ভের একটি আবার উৎসর্গ করা হয়েছে জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধীকে। শুধু স্মৃতিস্তম্ভ দেখেই ফিরে আসবেন না।
সতীরহাট থেকে প্রায় ১কিলোমিটার পূর্বে সবং থানার প্রবেশদ্বারেই রয়েছে কেলেঘাই নদীর উপর তৈরি একটি সেতু। পরাধীন ভারতে এখানেই নদীর পশ্চিম পাড়ে জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় ছিল বিপ্লবীদের একটি ছাপাখানা। সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে বিপ্লবীদের বিভিন্ন নির্দেশ এবং কাজের রূপরেখা ছাপিয়ে বিলি করা হত। অত্যাচারী বৃটিশ যাতে ছাপাখানার নাগাল না পায় সেইজন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে বিপ্লবীরা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেদিনের সেই ছাপাখানাটি আজ নেই। আছে স্রোতস্বিনী কেলেঘাই আর দুপারে ঘাস এবং কাশের ঝোপঝাড়। এই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে অতীতের সেই অগ্নিগর্ভ মেদিনীপুরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সহজেই স্মরণ করা যায়। যদিও যন্ত্রণার বিষয় এলাকার মানুষ সতীমাতার মন্দির রক্ষায় যতটা তৎপর, স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস এর সাক্ষী স্বরূপ স্মৃতিস্তম্ভগুলি রক্ষায় ততটাই উদাসীন। কোন কোন স্মৃতি স্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়েছে,আবার কোন স্মৃতিস্তম্ভের গা ঘেঁষে তৈরি হয়েছে পাকাবাড়ি। এখানকার বাসিন্দারা অবশ্য প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের দিন স্মৃতিস্তম্ভে মাল্যদান করেন। এছাড়া স্বধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার তেমন কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
মদনমোহনচক বাজারের পরেই সবং এর বেলতলা। এখান থেকে তিন কিলোমিটার এগোলেই দেখবেন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে ফুল চাষ বা মাদুর চাষের জমি। নীল আকাশের নীচে তুতরাঙাগ্রামে রজনীগন্ধার চাষ দেখতে ভুলবেন না।
এই জায়গাগুলি দেখার জন্য প্রথমে খড়্গপুর পর্যন্ত ট্রেনে,তারপর খড়্গপুর থেকে দীঘাগামী (ভায়া বেলদা) বাস ধরে মকরামপুর পৌঁছাতে হবে। মকরামপুর থেকে পূর্বে তেমাথানী যাওয়ার রাস্তায় সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেকার, অথবা তেমাথানী গামী বাস ও পেতে পারেন। মকরামপুর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে মদনমোহনচক বাজার। তার আগে বিরবিরা, কোতাইগড়, বড়কলঙ্কাই প্রভৃতি বাজার পড়বে। আগে এগুলি ছিল ছোট ছোট গ্রাম। এখন এক একটি ছোট বাজারে পরিনত হয়েছে। মদনমোহনচক ঢোকার মুখেই রাস্তার বাম দিকে রয়েছে একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। আর গ্রামের ভিতরে সাঁতরা পরিবারের বাসভূমি।
midnapore.in