মাড়তলার সত্যেশ্বর শিব মন্দিরের কথা
Satyaswar Shiva Temple Satyapur, Marhtala, Paschim Medinipur
সুতনু ঘোষ।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরার একটি পুরাকীর্তিস্থল সত্যপুর। এখানে প্রাচীন মাকড়া পাথরের সত্যেশ্বর মহাদেব জীউর মন্দির রয়েছে। কেদারকুণ্ড পরগনার রাজা মুকুট নারায়ণের সময়ে দুর্গম বেতবনকে মন্দির চত্বরে রূপান্তরিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে, সত্যেশ্বর শিবের নাম থেকে জায়গাটির নাম হয় সত্যপুর। পার্শ্ববর্তী পাইকপাড়ি গ্রামে জীর্ণ জোড়বাংলা মন্দির বর্তমান। পাইকপাড়ি , গড় কিলা , সত্যপুর প্রভৃতি কংসাবতী নদী তীরবর্তী স্থানগুলি ইতিহাস সমৃদ্ধ।
মাড়তলার সত্যেশ্বর শিব মন্দিরের কথা | Satyaswar Shiva Temple Satyapur, Marhtala, Paschim Medinipur
সুরেন্দ্রনাথ বসুর 'মেদিনীপুরের রাজবংশ' শীর্ষক লেখা থেকে জানা যায় , ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কাশীজোড়ার রাজা রাজনারায়ণ রায় সাহাপুর পরগনার ভূমধ্যকারীর সাথে একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে সাহাপুর অধিকার করেছিলেন। তিনি ৩৬০ বিঘা সম্পত্তি বাসুলীদেবীর সেবার জন্য দিয়েছিলেন এবং কয়েকজন ব্রাহ্মণকে জমি দান করে বসতি গড়ে দিয়েছিলেন।
তরুণদেব ভট্টাচার্য "পশ্চিমবঙ্গ দর্শন : মেদিনীপুর" বইটিতে লিখেছেন - "রাজনারায়ণ কেদারকুণ্ড পরগনায় জমিদার মুকুট নারায়ণকে পরাজিত করে তার রাজ্য অধিকার করেছিলেন।"
মাড়তলার সত্যেশ্বর শিব মন্দিরের কথা | Satyaswar Shiva Temple Satyapur, Marhtala, Paschim Medinipur
যোগেশচন্দ্র বসু গড়কিল্লা ও মুকুট নারায়ণ প্রসঙ্গে লিখেছেন- "জনশ্রুতি, গড়কিল্লায় কেদারকুণ্ড পরগনার জমিদার পূর্বোক্ত রাজা যুগলকিশোর রায় ও রাজা মুকুটনারায়ণ রায় প্রভৃতি বাস করিতেন। উত্তরকালে কাশীজোড়া পরগণার জমিদার রাজা রাজনারায়ণের হস্তে রাজা মুকুটনারায়ণের পরাজয় ঘটিলে উক্ত গড় সমেত সমস্ত কেদারকুণ্ড পরগনা কাশীজোড়া রাজবংশের অধিকারভুক্ত হয়।"
NH16 ধরে কলকাতা - খড়্গপুর সড়কে ডেবরা বাজার , সেখান থেকে পিচের সড়কে তাবাগেড়িয়া যাওয়ার পথে মাড়তলা বাসস্ট্যান্ডে আসতে হবে। ডেবরা বাজার থেকে এই স্থানের দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। মাড়তলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি গাছের নীচে একটি দেবীমুন্ড পুজো হতে দেখা যায়। সত্যপুর মৌজার তিনটি গ্রামের একটি মাড়তলা। মাড়তলার ওপর দিয়ে গিয়েছিল "নন্দ কাপাশিয়া জাঙ্গাল" নামক পুরোনো রাস্তাটি।বাসস্ট্যান্ডের কাছে পুরোনো মাকড়া পাথরের দেউলটির নাম শ্রী শ্রী সত্যেশ্বর মহাদেব জীউ মন্দির। ওড়িশী রীতির মূল দেউলটির ওপর নবরথ বিভাজন করা হয়েছে। গন্ডী অংশে প্রতিকৃতি মন্দির ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চূড়ার মস্তক বিভাগে বেঁকি, আমলক, খপুরি, কলস ও ত্রিশূল উপস্থিত। ডেভিড ম্যাকাচ্চন এই মন্দিরের সম্পর্কে লিখেছেন - "MAROTALA (Midnapore : Debra) , Satyesvara , laterite : largly plain + inlaid images".
মাড়তলার সত্যেশ্বর শিব মন্দিরের কথা | Satyaswar Shiva Temple Satyapur, Marhtala, Paschim Medinipur
সামনের দিকে সমতল ছাদের ( দালান বারান্দা ) নির্মাণ সংযোজিত হয়েছে পরবর্তীকালে । কিন্ত মূল মন্দিরটি তৈরী হয়েছিল জগমোহন ছাড়াই। তার বাইরের দেওয়ালে একটি ফলকে লেখা রয়েছে - "আনুমানিক খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রীশ্রীঁসত্যেশ্বর মহাদেব জীউ আদেশক্রমে তাঁহার সেবাকল্পে মেদিনীপুর জেলাস্থ সাহাপুর পরগণা রাজা মহামান্য মুকুট নারায়ণ রায় বাহাদুরের অনুরোধে বাবার স্বপ্নাদেশে সত্যপুর প্রকাশিত মাড়তলা গ্রামে হুগলী জেলার উত্তর পাড়াস্থ কাশ্যপ গোত্রজ চটোবংশোদ্ভব যদুনন্দন সাংখ্য বেদান্ত তীর্থ মহাশয় আগমন করিয়াছিলেন। বর্তমানে তাঁহার বংশধরগণ রাজদত্ত চক্রবর্তী উপাধিপ্রাপ্ত মন্দির পুনঃসংস্কারের স্মারক হিসাবে এই ফলক স্থাপিত হইল। বাং ৭ই আশ্বিন ১৩৯৬/ইং ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ / শ্রীশ্রীঁসত্যেশ্বর মহাদেব জীউর সেবাইতবৃন্দ / মাড়তলা , মেদিনীপুর।"
তবে তারাপদ সাঁতরা মহাশয় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল সতেরো শতক হিসেবে উল্লেখ করেছেন । মন্দিরের গায়ে অপর একটি ফলকে বলা হয়েছে - "মন্দির পুনঃসংস্কারক / নয়নচাঁদ কামিল্যার পুত্র শ্রী হংসধ্বজ কামিল্যা / পৌত্রগন , শ্রী অনিল কৃষ্ণ কামিল্যা শ্রী বিমল কৃষ্ণ কামিল্যা / শ্রী ভবানীশঙ্কর কামিল্যা / সাকিন পাইকপাড়ি / সন ১৩৩৮ সাল , মাহ বৈশাখ।" দেউলটির গাত্র ভাস্কর্যে - গরুড়, সিংহ, সিংহাসনে রামসীতা , দধিভান্ডে শ্রীকৃষ্ণের হস্তপ্রবেশ , জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা , বংশীবাদক কৃষ্ণ , সন্তান কোলে জননী , যোগী, রাজপুরুষ, নারী পুরুষ মূর্তি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । এই মন্দির চত্বরে ত্রিরথ বিভাজনযুক্ত আটচালা রীতির একটি শিবের মন্দির বর্তমান। মন্দিরটি ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত।১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দের census of India, vol16 তে সত্যপুর এলাকাতে ( মৌজা ২৬০ ) বৈশাখে পনেরো দিন ব্যাপী গাজন উৎসব ও দুহাজার জনসমাগমের কথা উল্লেখ রয়েছে। কমল চৌধুরী সম্পাদিত মেদিনীপুরের ইতিহাস: প্রথম পর্ব বইটিতেও পনেরো দিন ব্যাপী সত্যপুর গাজন উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানেও এখানে গাজন ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এককালে এখানকার নগেন্দ্রনাথ সেন ও প্রমাদরঞ্জন চক্রবর্তীর মতো অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন ও জনহিতকর কাজ করেছিলেন।
midnapore.in
(Published on 22.07.2022)
সমীক্ষা সঙ্গী:
তৃষিতা ঘোষ।
তথ্যসূত্র:
১) মেদিনীপুরের রাজবংশ- সুরেন্দ্রনাথ বসু ( মেদিনীপুরের ইতিহাস : প্রথম পর্ব, কমল চৌধুরী সম্পাদিত)
2) Late Mediaeval Temples of Bengal: Origins and Classification (Calcutta: The Asiatic Society, 1972) - David McCutchion
৩) পুরাকীর্তি সমীক্ষা : মেদিনীপুর - তারাপদ সাঁতরা
৪) বাংলার মন্দির : স্থাপত্য ও ভাস্কর্য - প্রণব রায়
৫) মেদিনীপুর চরিতাভিধান : প্রথম খন্ড - মন্মথনাথ দাস
৬) ডেবরার ইতিহাসের গোড়ার কথা - শ্রী বানেশ্বর চক্রবর্তী (ডেবরা কৌমুদী)
৭) মাড়তলা - অজিতকুমার চক্রবর্তী (ডেবরা কৌমুদী)
৮) জেলার উৎসব ও মেলা, মেদিনীপুরের ইতিহাস, প্রথম পর্ব, কমল চৌধুরী সম্পাদিত
9) Census of India, vol16, 1961
১০) ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য