রাকেশ সিংহ দেব।
Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Shalbani Elephant Fair (Pathrajuri Chandankath)
সরকারি তথ্য অনুসারে এখানকার মাটিতে দলমার দামালদের যাতায়াত শুরু হয় ১৯৮৬-৮৭ সাল নাগাদ। সেসময় দলমা পাহাড় থেকে নেমে আসত প্রায় পাঁচ থেকে সাতটি ছোট ছোট হাতির দল। নতুন জায়গায় এসে স্বাভাবিকভাবেই তারা জঙ্গল ছেড়ে বাইরে বেরোত না। শাস্ত, নিরীহ প্রকৃতির এই হাতিরা আঁধার নামলেই সুযোগ বুঝে পাকা ধানের ক্ষেতে ঢুকে পড়ত। আবার দিনের বেলা লুকিয়ে থাকত জঙ্গলের নিরাপদ অন্তরালে।
এভাবেই জঙ্গলমহল তথা দক্ষিণবঙ্গের লৌকিক সংস্কৃতি এবং লোকগাথায় হাতি ঠাকুর এক শ্রদ্ধা ও ভালবাসার চরিত্র হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে দেবত্বের আসনে। এখানকার বিভিন্ন জঙ্গলের প্রান্তে আজও দেখা যায় পোড়ামাটি বা কংক্রিটে নির্মিত সিঁদুর-মাখা হাতির মূর্তি। বনভূমির রক্ষক ঠাকুর হিসেবে নিত্যপূজা হয় অনেক জায়গায়। সারা জঙ্গলমহলে এভাবে সম্মান আর শ্রদ্ধার সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে হাতি ঠাকুর।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনি ব্লকের প্রত্যন্ত পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ গ্রাম দুটি আজ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে হাতিঠাকুরের কল্যাণে। জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের হৃদয়ে জঙ্গলের হাতি শুধু বিভীষিকা হয়ে নয়, রয়েছে হাতিঠাকুর হিসেবেও৷ গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, হাতিঠাকুর গ্রামের রক্ষক। এখন এই এলাকা হাতি পূজো ও মেলা নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই প্রচলিত লোকবিশ্বাস ও বন্যপ্রাণের প্রতি অসীম ভালবাসার বন্ধনে হাতিঠাকুর হয়ে উঠেছেন গ্রামের সর্বজনীন দেবতা।
সালটা ছিল ২০১৩ । বাংলার ১৪১৯ সন৷ ৩রা ফাল্গুন, বেশ গরম ছিল দিনটা। সেই অস্বস্তি থেকে সেদিন গভীর রাতে দুই হাতি শাবক পুকুরে নেমেছিল। কিন্তু তলিয়ে যেতে থাকে গভীর জলে। এরপরই মা হাতি তাদের বাঁচাতে নামে পুকুরে। কিন্তু শেষ অবধি তাদের কেউই আর ডাঙ্গায় উঠতে পারেনি। পরদিন গ্রামবাসীরা দেখে পুকুরের জলে তিনটি হাতি মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। খবর দেওয়া হয় গোদাপিয়াশাল ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে। বনকর্মীরা এসে মৃত হাতিদের দেহ উদ্ধার করে। নিজের সন্তানদের বাঁচাতে এক মায়ের সেই আমৃত্যু লড়াইকে শ্রদ্ধা জানাতে ভেঙে পড়ে হাজার হাজার জনতা। তারপরে বনদপ্তরের উদ্যোগে দুই গ্রামের বাসিন্দারা ঠিক করেন, হাতির স্মৃতিতে মূর্তি তৈরি করা হবে।
দুই গ্রামে প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বাস। যাদের চাষাবাদই প্রধান পেশা। প্রথমে দুই গ্রামের গুটিকয় গ্রামবাসী ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেনি। তাদের ও বনদপ্তরের উদ্যোগে হাতি ঠাকুরের মূর্তি বানানো হয়। এখন এই হাতিঠাকুরেই এই দুই গ্রাম সহ পাশাপাশি প্রায় দশ বারোটি গ্রামের সর্বজনীন ঠাকুর হয়ে উঠেছে। পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ গ্রামের সংযোগস্থলে মাঠের মাঝে পাকা বেদী নির্মান করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাতিঠাকুরের মূর্তি। প্রতি বছর বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে ফাল্গুন মাসের ৪ ও ৫ তারিখ ব্রাহ্মণ দিয়ে নিয়ম মেনে হাতিঠাকুরের পুজো করা হয়। হাজার হাজার মানুষ ধুপ, সিঁদুর, বাতাসা, কলা, নারকেল দিয়ে পুজো দেন। পুজোকে কেন্দ্র করে পাশের মাঠে দুদিন ধরে মেলা চলে। মেলা কমিটির উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ঝুমুর গান, ছৌ নাচ, মোরগ লড়াই সহ নানান সাংস্কৃতিক অনু্ষ্ঠানের।
সারা বছর জুড়ে যে কোনও শুভ কাজের আগে এলাকার মানুষ হাতিঠাকুরে থানে নারকেল ফাটিয়ে ভোগ দেন। জঙ্গলমহলের প্রতিটি গ্রামের ‘গরাম থান’-এ (দেবস্থান) পোড়া মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়ার ছোট ছোট ‘ছলন’ (মূর্তি) থাকে। আবহমান কাল থেকে চলে আসা লোকবিশ্বাস অনুযায়ী গরাম থানের গ্রামদেবতাকে গ্রামের সব শুভ শক্তির উৎস ও বিঘ্নবিনাশক হিসেবে মনে করা হয়। হাতির বিশাল আকৃতি ও অসীম শক্তির কারণে প্রাচীন কাল থেকেই তার উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। লোক বিশ্বাস অনুসারে দেবস্থানে হাতি থাকলে গ্রামের কারও কোনও ক্ষতি হবে না।
হুলা পার্টির তাড়া খেয়ে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলের মধ্যে ঘুরছে হাতির দল। গৃহস্থের ঘর ভেঙে ধান-চাল সাবাড় করছে, স্কুলের গোডাউনের দরজা ভেঙে খেয়ে নিচ্ছে মিড-ডে মিলের চাল। এলাকা থেকে হাতি তাড়ানোর দাবিতে প্রায়ই ঘেরাও, বিক্ষোভ, পথ অবরোধ হয়। কিন্তু সেই হাতিই রেলে কাটা পড়লে, তড়িদাহত বা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে শোকে ভেঙে পড়েন এলাকাবাসী। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য! হাতি ঠাকুর একদিকে ভয়, অপরদিকে ভক্তির আধার। আজ ভক্তির মাধ্যমে ভয়কে জয় করার পন্থা অবলম্বন করেছেন জঙ্গলমহলবাসী। দিনের পর দিন ফসল ঘরবাড়ি তছনছ করে চলেছে হাতির দল, তবুও প্রথা মেনে বছরের এই সময়টা গ্রাম দেবতাদের পাশাপাশি হাতি পুজো করেন ভক্তরা। ইদানিং জঙ্গলমহলে হাতির দাপাদাপি বেড়ে যাওয়ায় হাতি ঠাকুরকে তুষ্ট করতে পূজার্চনাকে আঁকড়ে ধরছেন কেউ কেউ। তাদের বিশ্বাস হাতি দেবতা স্বরূপ, হাতি ঠাকুরকে তুষ্ট করলে হাতিও মানুষের ঘরবাড়ি অনিষ্ট করবেন না। আর এই সরল বিশ্বাসেই তো মেলে ইষ্ট, তর্কে বহুদূর!
মেদিনীপুর থেকে শালবনিগামী ৬০ নং জাতীয় সড়কের পাশেই গোদাপিয়াশাল চকে গার্লস হাইস্কুলের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে প্রায় চার কিমি দূরেই পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ গ্রাম। রেলগেট পেরিয়ে পাকা সড়ক উজিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখেই হাতিঠাকুরের মন্দিরের ঠিকানা। থানের অদূরে রয়েছে সেই জলাশয়, যেখানে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের কাশীজোড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রাম দুটি ঘন শালজঙ্গলে ঘেরা। গ্রাম-লাগোয়া জঙ্গলে সারা বছরই তিন-চারটি স্থানীয় হাতি ঘোরাফেরা করে। পরিযায়ী হাতির দলও যাতায়াত করে এই এলাকার জঙ্গল দিয়ে।
midnapore.in