চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর পরে বঙ্গদেশে যে তিনজন বৈষ্ণব সাধকের আবির্ভাব হয়, শ্রীশ্যামানন্দ হলেন তাঁদের একজন। এই বৈষ্ণব সাধক মূলত সমগ্র মেদিনীপুর ও উৎকল প্রদেশে ভক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। শ্রীশ্যামানন্দের প্রধান ও প্রিয় শিষ্য ছিলেন শ্রীরসিকানন্দ। শ্যামানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর গুরুশিষ্য দুজনে মিলে বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলনকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারই নয়, বৈষ্ণব সাহিত্যেও এই মহাত্মাদের অবদান ছিল প্রচুর। দুজনেই ছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সন্তান। শ্যামানন্দের মৃত্যুর পরে উৎকল ও মেদিনীপুরের সমগ্র অংশে বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলন প্রসারের ভার পড়ল রসিকানন্দর ওপর।
শ্রীরসিকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে (১৫১২ শকাব্দে কার্তিক মাসে) অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার, বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলার রোহিনী রাজবংশে। তাঁর পিতা ছিলেন রাজা অচ্যুতানন্দ পট্টনায়ক এবং মাতার নাম রানী ভবানী। রসিকানন্দের পূর্বপুরুষেরা হিন্দুরাজত্বের সময় থেকেই এখানে প্রতিষ্ঠিত আছেন। রসিকানন্দর শিষ্য গোপীজনবল্লভ দাসের রচিত 'রসিকমঙ্গল' জীবনচরিতে রোহিনী গ্রামের একটি খুব সুন্দর বর্ণনা আছে।
বর্ণনার মধ্যে একটু অতিশয়োক্তি থাকলেও তখন রোহিনী 'নগর' না হোক ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র ও সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল তো অবশ্যই। মার্কণ্ডেওপুরাণ থেকে জানা যায় বাঁকুড়া ও মানভূম জেলায় মালপাহাড়িদের একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। সুপন্ডিত উইলসন সাহেবের মতে মার্কন্ডেওপুরাণ খৃষ্টিয় নবম-দশম শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবংশ মাল বা মল্লজাতীয় ছিলেন। অবিভক্ত মেদিনীপুরের ওই সমস্ত অরণ্য অঞ্চলের কিছু অংশও মল্লভূম নামে পরিচিত ছিল। রোহিনীর মধ্য দিয়ে খুব সুন্দর একটি মিষ্টি নামের নদী বয়ে গেছে। নাম ডুলুং। ডুলুং নদী। এই ডুলুং আবার রোহিনীর কাছে আঁধারিতে সুবর্ণরেখার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গোপীজনবল্লভ দাস ১৬৫৪ সালে এই 'রসিকমঙ্গল' চরিতকাব্যটি রচনা করেন। এই চরিতকাব্যে গুরু রসিকানন্দর জীবনকাহিনি বর্ণনা করেন তিনি। পয়ার ছন্দে গুরুর জীবনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সে সময়কার ওই সমস্ত অরণ্য অঞ্চলের সমাজজীবনের নানা চিত্র ফুটে উঠেছে এই কাব্যে। আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগের অবিভক্ত মেদিনীপুরের ওই সমস্ত অরণ্য অঞ্চলকে জানার আর কোনও তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি সম্ভবত। এই চরিতসাহিত্য বৈষ্ণবযুগের অন্যতম অক্ষয় কীর্তি। এই গোপীজনবল্লভ দাসও মেদিনীপুর জেলার অধিবাসী। তাঁর পিতা রসময় দাস ছিলেন শ্রীশ্যামানন্দের শিষ্য এবং তিনি নিজে শ্রীরসিকানন্দর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
'রসিকমঙ্গল' চরিত সাহিত্য থেকে জানা যায় রসিকানন্দের হাতেখড়ি হয়েছিল এবং তিনি গ্রামের পাঠশালায় অধ্যয়ন করেছিলেন।
রসিকানন্দের পাঠশালার সেই শিক্ষকের নাম ছিল বাসুদেব। সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে এই সমস্ত অঞ্চলে একক গুরুর পাঠশালা ছিল।রসিকানন্দ খুব অল্পবয়সে হিজলী-মন্ডলের অধিকারী বলভদ্র দাসের কন্যা ইচ্ছাদেবীকে বিয়ে করেন। ইচ্ছাদেবীর পিতা ছিলেন বিভীষণ মহাপাত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র। মহাপাত্র সম্ভবত উপাধি। বিভীষণ মহাপাত্রের বাসস্থান ছিল এখনকার পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার বাহিরীতে। রসিকমঙ্গল গ্রন্থে ইচ্ছাদেবীর বাবার বাড়ির পরিচয় পাওয়া যায়। রসিকানন্দর সঙ্গে ইচ্ছাদেবীর বিয়ে উপলক্ষে ওই বংশের ধনসম্পত্তি ও খ্যাতি প্রতিপত্তির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। বলভদ্র দাসকে মেদিনীপুরে অবস্থিত বাদশাহের কর্মচারীর কাছে হিজলীর রাজস্ব দিতে হত। বিভীষণ মহাপাত্র ও তাঁর বংশধরেরা হিজলীর অন্তর্গত বাহিরী গ্রামে বাস করতেন। হিজলীর নবাব তাজ খাঁ মসনদইর দেওয়ান ভীমসেন মহাপাত্র এই বিভীষণ মহাপাত্রের পুত্র। বাহিরীতে প্রাচীন মন্দির এবং ভীমসাগর ও লোহিতসাগর নামে যে বড় বড় জলাশয়গুলি দেখা যায় তার বেশিরভাগই এই মহাপাত্র বংশের। অনুমান বিভীষণ মহাপাত্র ও ভ্রাতুস্পুত্র বলভদ্র দাস বাহিরীর প্রাচীন দেশাধিপতি বংশদ্ভূত ছিলেন।
পিতার মৃত্যুর পরে রাজপুত্র রসিকানন্দ রাজ্যলাভ করেন কিন্তু কেবলমাত্র রাজ্যলাভ করেই বসে থাকেননি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভাগবৎ অনুরাগী। বৈষ্ণবপ্রভু শ্রীশ্যামানন্দের সঙ্গে রসিকানন্দের প্রথম সাক্ষাত হয় ঘাটশিলাতে।
শ্রীশ্যামানন্দ বৈষ্ণব সমাজে শ্যামানন্দ ও দুঃখী কৃষ্ণদাস, দুই নামেই পরিচিত ছিলেন। ঘাটশিলাতে এই সাক্ষাতের ফলে রাজপুত্র হয়েও ভিখারি বৈষ্ণব শ্যামানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন রসিকানন্দ। শ্যামানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দেশে দেশে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি বেরিয়ে পড়েন।
সপ্তদশ শতকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ওই সমস্ত অরণ্য অঞ্চল ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের অধীন ছিল। ধলভূমগড় থেকে রোহিনী গোপীবল্লভপুর পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চলে রাজা প্রজা প্রায় সকলেই ছিলেন নৃশংস, অত্যাচারী ও অসৎ। তাঁদের মধ্যে যাঁরা উল্লেখযোগ্য ছিলেন তাঁরাও প্রায় সবাই নানা খারাপ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। শত শত ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব সাধুকে তাঁরা হত্যা করতেও দ্বিধা করতেন না। 'রসিকমঙ্গল' গ্রন্থে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
সাধুজন যাঁরা তাঁরা সাধারণত বেশিরভাগই ছিলেন বহিরাগত, তাঁদের লুন্ঠন করে যা পেত তাই দিয়ে মদ মাংস খেত এবং পতিতাবাড়ি যেত। বৈষ্ণব দেখলেই তারা তস্কর ভেবে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিত। কিন্তু এই চিত্রের অনেকটাই বদল ঘটে শ্যামানন্দ ও রসিকানন্দর যুগ্ম উপস্থিতিতে। তাঁরা দুজনে মিলে উৎকল প্রদেশে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। বিনয় ঘোষ লিখেছেন। - "কিন্তু গ্রামের লোকজন রসিকানন্দের এই বৈষ্ণব ভাবান্তর খুব ভালো চোখে দেখত না। দুর্জনদের বৈষ্ণব নিন্দায় অসহিষ্ণু হয়ে অবশেষে রসিক নিজগ্রাম ছেড়ে সুবর্ণরেখার দক্ষিণতীরে একটি স্থানে বাসস্থান নির্মাণ করেন।"
সেই স্থানটির নাম ছিল কাশপুর বা কাশীপুর। নির্জন এই স্থানটি ছিল ঘন কাশ জঙ্গলে ঢাকা। তাই নাম কাশপুর বা কাশীপুর। গ্রামের মানুষদের খারাপ ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে রসিকানন্দ এখানে এসে একটি আশ্রম স্থাপন করেন এবং বসবাস করতে শুরু করেন। রসিকমঙ্গলে উল্লেখ আছে এখানেও পরম পাষন্ড ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব হন্তারক পাপিষ্ঠ মানুষেরা বসবাস করত। কিছুকাল পরে একদিন শ্যামানন্দ এই কাশীপুর আশ্রমে আসেন এবং গুরুশিষ্য দুজনে মিলে শ্রীগোপীবল্লভজীউর মন্দির নির্মাণ করেন। রসিকানন্দ কর্তৃক পূজিত বিগ্রহ রাধাগোবিন্দের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় ও বিগ্রহর নাম রাখা হয় শ্রীশ্রী গোপীবল্লভপুর রায়। বিগ্রহের নাম অনুসারেই কাশীপুর স্থান নামটি পরিবর্তিত হয়। গ্রামটির নাম হয় শ্রীপাট গোপীবল্লভপুর। এই গোপীবল্লভপুর অঞ্চলটি বাংলা, বিহার অর্থাৎ এখনকার ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যার মিলনস্থল। এই গ্রাম ঠাকুরবাড়ি নামেও পরিচিত।
সুবর্ণরেখার দক্ষিণতীরে বিশাল এলাকা জুড়ে বৃন্দাবনের আদলে গড়ে উঠেছিল বলে এই শ্রীপাট গোপীবল্লভপুর স্থানটি 'গুপ্তবৃন্দাবন' নামে সারা ভারতজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। সমগ্র রাঢ় বাংলা থেকে বৈষ্ণবভক্তগণ কংসাবতী পার হয়ে সুবর্ণরেখার তীরে এই তীর্থে উপনীত হতে শুরু করেন। সুবর্ণরেখা নদী যেন বৃন্দাবনের যমুনা। সুবর্ণরেখার তীরে কদম্বকানন, তাল-তমালের উপবন, অষ্টবক্রাকার রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, সাধনক্ষেত্র, জগন্নাথদেবের মন্দির, যাত্রীনিবাস ও রাধাগোবিন্দের মূল মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। রাধাগোবিন্দের মূর্তি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শোনা যায় যে, শ্রীরসিকানন্দ প্রভু প্রতিবৎসর রথযাত্রার সময় পদব্রজে শ্রীক্ষেত্রে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের দর্শনে যেতেন। তাঁর এইরূপ কষ্টকর পদযাত্রায় ব্যথিত হয়ে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দেন, "তুমি কাশীপুর গ্রামে শ্রীগোবিন্দজীউর প্রতিষ্ঠা কর, তথায় আমি সর্বক্ষণ বিরাজ করব"। তারপর জনৈক ভাস্কর একদিন একখন্ড শিলাসহ শ্রীরসিকানন্দের নিকট উপস্থিত হন এবং রসিকানন্দের নির্দেশানুক্রমে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান শ্রীগোবিন্দজীউর মূর্তি নির্মাণ করেন। এখনও গোপীবল্লভপুরে সেই শ্রীগোবিন্দজীউ বিরাজ করছেন।
কথিত, শ্রীগোপীবল্লভজীউর মন্দিরে দন্ডমহোৎসব উপলক্ষে বারো দিন ধরে সারাদিনরাত সুউচ্চরবে হরিনাম সংকীর্তন হওয়ার জন্যে ওই স্থানে কোনও কাক-পক্ষীর সমাগম হত না। সেজন্য দয়ালু রসিকানন্দ মহোৎসবের পরেরদিন রাজ্যের যত কাককে জড়ো করে কাকের খাদ্য দিয়ে 'কাক মহোৎসব' প্রচলন করেন। এখনও পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি এই স্থানে পালন করা হচ্ছে। নাম সংকীর্তন ও মহোৎসব উপলক্ষে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন অংশ থেকে প্রায় দুশ প্রখ্যাত কীর্তনীয়ার দল আসে এবং সহস্র পুণ্যার্থী নর-নারী গুপ্তবৃন্দাবনের এই মহোৎসবে যোগদান করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব জগতে মনোহরসাহী, গরানহাটি, রেনেটী ও মন্দারানী নামে ৪টি সংকীর্তন 'ঠাট' প্রচলিত আছে, তারমধ্যে শেষোক্ত দুটি 'ঠাট' শ্যামানন্দ প্রভু ও রসিকানন্দ প্রভুর দ্বারা প্রবর্তিত হয়। এখনও এই স্থানে ওই দুটি ঠাটে কীর্তন গাওয়া হয়।
ক্রমে রসিকানন্দ এই মন্দিরের গাদীশ্বর বা Chief Of Head Quarter বা গোস্বামী হিসেবে পরিচিত হন। তখন থেকেই এই রোহিনী রাজবংশ গোস্বামী বংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রসিকানন্দর অপার প্রেমধারায় সমস্ত মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা প্লাবিত হয়েছিল। তাঁর দেবতু্ল্য চেহারা ও উপদেশামৃতে শতশত দস্যুতুল্য পাষণ্ডের কলুষিত হৃদয়ও শুদ্ধ হয়েছিল। ময়ূরভঞ্জের রাজা বৈদ্যনাথ ভঞ্জ গোপীবল্লভপুরে এসে বৈষ্ণবধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। সেই সূত্রে বৈষ্ণবধর্মের সামনে খুলে গেল উৎকল প্রদেশের দ্বার। এই সময় অসংখ্য উৎকলবাসী বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। বৈদ্যনাথ ভঞ্জ ছাড়াও বালেশ্বরের নৃসিংহপুর পরগনার নিষ্ঠুর জমিদার উর্দন্ড রায় যিনি প্রায় কয়েক'শ সাধুকে হত্যা করে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করেছিলেন, তাঁকে রসিকানন্দ প্রেমধর্মে দীক্ষিত করেন। এছাড়াও পটাশপুরের রাজা, পঁচেটের রাজা, ময়নার রাজা ছাড়াও অনেক ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও রসিকানন্দের শিষ্য শ্রেণিভুক্ত হয়েছিলেন। উৎকলের মুসলমান শাসনকর্তা আহম্মদ বেগও তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। এর ফলে মুছে গিয়েছিল ধর্মের ভেদাভেদ ও জাতপাতের তীব্র বৈষম্য।
১৬৩০ সালে শ্যামানন্দের মৃত্যুর পরে রসিকানন্দ সমারোহের সঙ্গে গোবিন্দপুর গ্রামে গুরুর মহোৎসব করেছিলেন। এই উপলক্ষে সেই সময়কার অনেক বৈষ্ণব মহাজন গোবিন্দপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন। শ্যামানন্দের মৃত্যুর পরে রসিকানন্দ হলেন শ্যামানন্দ সম্প্রদায়ের নেতা। এই সম্প্রদায় বারোটি শাখায় বিভক্ত। কিশোর, উদ্ধব, পুরুষোত্তম, দামোদর এই চার শাখা ছিল কেশিয়াড়িতে। রসিকমুরারী রোহিনীতে। দরিয়াদামোদর ধারেন্দাতে। ঝাড়গ্রামে চিন্তামনি। রাজগ্রামে বলভদ্র, হরিহরপুরে শ্রীজগতেশ্বর, সাঁকোয়াতে শ্রীমধুসূদন, গোপীবল্লভপুরে গোপীনাথ এবং ভোগরাই-এ আনন্দানন্দ। এই বারোটি শাখায় শিষ্যগণ বিভক্ত। রসিকানন্দ ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত। তিনি নিজে অনেক বৈষ্ণব পদ রচনা করে গান করতেন। রসিকানন্দ 'শাখাবর্ণন', 'শ্যামানন্দশতকম' ও 'রতিবিলাস' নামে তিনটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত কিছু পদও বৈষ্ণব সাহিত্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রসিকানন্দর 'পদকল্পতরু' গ্রন্থ থেকে দুটি পদ উল্লেখ করা হল।
চব্বিশ বছর বয়সে যখন নিমাই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নাম গ্রহণ করে সন্ন্যাস নিলেন, সেই সময় জননী শচীদেবী এই ভাগবৎ-প্রেমোন্মত্ত যুবককে পুত্রবধূর রূপে ভুলিয়ে ঘরে বেঁধে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। সঙ্গীগণও এই অপূর্ব ভক্তি-উচ্ছ্বসিত পূর্বরাগের আবেশময় যুবককে ফিরিয়ে আনতে কত উপায় অবলম্বন করলেন, কিন্তু সবই ব্যর্থ হল। নিমাই সন্ন্যাস নিলেন। রসিকানন্দের নিচে উল্লেখিত পদ দুটি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের সন্ন্যাস নেওয়ার আগে শিরোমুন্ডন উপলক্ষে লেখা।
আসলে তখনকার দিনে শিরোমুন্ডন একটি ভয়ানক ব্যাপার ছিল। এই জন্য চৈতন্য ভাগবতে চৈতন্যের শিরোমুন্ডনের সময় শিষ্যদের বিলাপ করতে দেখা যেত। শিরোমুন্ডন বা কেশচ্ছেদ অর্থে তখন চিরদিনের জন্য পিতা মাতা ও স্ত্রী পুত্রের বিয়োগ বোঝাত। একবার শিরোমুন্ডন করে সন্ন্যাস নিলে কেউ আর সমাজে প্রত্যাবর্তন করতেন না। এই জন্য শিরোমুন্ডন উপলক্ষে এত আক্ষেপ শিষ্যর।
শ্রীরসিকানন্দর 'পদকল্পতরু' গ্রন্থ থেকে আর একটি পদ উল্লেখ করা হল যেটি শ্রীরাধার উক্তি।
১৬৫২ খিষ্টাব্দে শ্রীরসিকানন্দ প্রভুর মৃত্যু হয়। বালেশ্বর জেলার রেমুনা গ্রামে শ্রীরসিকানন্দর পবিত্র দেহ সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন-
রেমুনা বালেশ্বর শহরের পশ্চিমে আড়াই ক্রোশ দূরে পুরী যাওয়ার পথে অবস্থিত। রেমুনাতে প্রসিদ্ধ ক্ষীরচোরা গোপীনাথের মন্দির আছে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য পুরী যাওয়ার সময় এই গোপীনাথের মন্দিরে একদিন যাপন করেছিলেন।
শ্রীরসিকানন্দর তিন পুত্র ও এক কন্যা। নাম রাধানন্দ, কৃষ্ণগতি, রাধাকৃষ্ণ ও দেবকী। এই গোস্বামী বংশের রীতিতে জ্যেষ্ঠ পুত্র মহান্ত হয়ে গাদীশ্বর হন এবং অন্য পুত্রগণ বাবু গোস্বামী হিসেবে দেবোত্তর জমিদারির কিছু অংশের অধিকার পেতেন। তাই রসিকানন্দর মৃত্যুর পরে রাধানন্দ দেব গোস্বামী শ্রীপাট গোপীবল্লভপুরের মহান্ত পদে অধিষ্টিত হন। রাধানন্দ দেবের দুই পুত্রের নাম নয়নানন্দ ও রামানন্দ। নয়নানন্দের আবার তিন পুত্র। তাঁরা হলেন ব্রজজনানন্দ, বৃন্দাবনানন্দ ও উৎসবানন্দ। ব্রজজনানন্দের তিন পুত্র ভজনানন্দ, গোবিন্দানন্দ ও বিচিত্রানন্দ। তাঁরা তিনজনেই নিঃসন্তান ছিলেন। বৃন্দাবনানন্দর পুত্র বৈষ্ণবানন্দ। বৈষ্ণবানন্দের দুই পুত্র গোকুলানন্দ ও নেত্রানন্দ। গোকুলানন্দ দেব গোস্বামীর পুত্র ত্রিবিক্রমানন্দ। এই ত্রিবিক্রমানন্দের আবার পাঁচপুত্র- মধুসূদনানন্দ, রামকৃষ্ণানন্দ, সচ্চিদানন্দ, বিশ্বম্ভরানন্দ ও সান্দ্রানন্দ। এই পাঁচ পুত্রের মধ্যে সচ্চিদানন্দ ছাড়া সকলেই নিঃসন্তান ছিলেন। সচ্চিদানন্দের পুত্র সর্বেশ্বরানন্দ এবং তাঁর পুত্র নন্দনানন্দ দেব গোস্বামী মঠাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। কিন্তু নন্দনানন্দ দেব গোস্বামীর কোনও পুত্রসন্তান ছিল না তাই তাঁর পরে বৃন্দাবন দেব গোস্বামীর পুত্র গোপালানন্দ দেব ওয়ারিশ সূত্রে গোস্বামী মহান্ত হয়েছিলেন। এরপর তাঁরই উত্তরসূরি শ্রীকৃষ্ণকেশবানন্দ দেব গোস্বামী মহান্ত হন। এভাবেই গোস্বামী মহান্তরা ওয়ারিশ সূত্রে এই মন্দিরের নিত্য পূজা অর্চনা ও মহোৎসব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন। উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরের বহু প্রসিদ্ধ পরিবার এই গোস্বামী বংশের শিষ্য। পুরী ও বৃন্দাবন থেকে এই গোস্বামী বংশ বহু দেবোত্তর সম্পত্তি পেয়েছিলেন। এছাড়াও গোপীবল্লভপুর মঠের সেবার জন্য অনেক রাজা, জমিদার ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বহু সম্পত্তি দান করে গেছেন, তার সাহায্যে মঠের সেবা পূজা সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়ে চলেছে। রসিকানন্দ প্রভুর এই বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলন উড়িষ্যা ও মেদিনীপুর জেলার প্রায় সমগ্র অংশে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছিল। 'গুপ্ত বৃন্দাবন' ও 'ঠাকুরবাড়ি' নামে গোপীবল্লভপুরের মহিমা সারা ভারতবর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি, ধারেন্দা, হাউর, তমলুক, নন্দীগ্রাম, সূতাহাটা, ময়না, নাড়াজোল, ডেবরা, ভগবানপুর, পটাশপুর, নারায়ণগড় প্রভৃতি অঞ্চল ছাড়াও উত্তরভারতের ২০টির ও বেশি জেলায় এই সম্প্রদায়ের মহান্ত-গোস্বামীদের ৩০০টিরও বেশি মঠ-মন্দির আছে। এছাড়াও পুরীর বালিশাহী কুঞ্জমঠ, রেমুনার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির এবং বৃন্দাবনের গোপীন্নাথ মন্দির শ্যামানন্দ-রসিকানন্দর সুখ্যাতির পরিচয় বহন করে। মেদিনীপুরের কাছে গোকুলপুর গ্রামে শ্রী সত্য অধিকারীর বাড়িতে দামোদর জীউর একটি প্রাচীন ভাঙ্গা মন্দির ছিল। বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। ওখানে প্রতি বছর পঞ্চম দোল অনুষ্ঠিত হয়। বৈষ্ণব শ্রী অধিকারী মহাশয়ের কাছ থেকে জানা যায় এই গোকুলপুর কয়েকশ বছর আগে বড়কোলা গ্রামের মধ্যেই ছিল এবং সেই সময় কাঁসাই নদী এর কাছ দিয়েই বয়ে যেত। বর্তমানে কাঁসাইয়ের মরাখাতের চিহ্ন আছে এই মন্দিরের কাছাকাছি। কিংবদন্তী অনুসারে শ্রীশ্যামানন্দ ও শ্রীরসিকানন্দের দ্বারা অনুষ্ঠিত পঞ্চম দোলৎসবে যে মণ মণ আবির খেলা হয়েছিল তারই ফলস্বরূপ বড়কোলার এই অংশ পরিণত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয় গোকুলে। তখন থেকেই এই স্থান গোকুলপুর নামে প্রসিদ্ধ হয়। মন্দিরটির সংস্কারের ফলে মন্দিরের বাইরের অংশের এত পরিবর্তন হয়েছে যেন মনে হয় মন্দিরটি নতুন নির্মিত হয়েছে। ফলে আগের কোনও খোদাই থাকলেও তা আর এখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। পুরাতাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংস্কার করলে হয়ত চারশ বছরের প্রাচীন মূল্যবান একটি ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য এভাবে নষ্ট হত না।
কেবল মন্দির প্রতিষ্ঠা নয়, স্থানীয় ভক্তদের মধ্যেও বৈষ্ণব প্রেমসুধারসের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন শ্রীরসিকানন্দ প্রভু। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ওই অরণ্য অঞ্চলে অবৈষ্ণব মানুষেরা বসবাস করতেন। তাঁদের বেশীরভাগই মদ মাংসে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা সাধু সন্তদের ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন না এবং বহিরাগত কাউকেই সহজে ঢুকতে দিতেন না গ্রামে। সেই সময়ে ওখানকার অধিবাসীরা যে খুব সুখে বসবাস করতেন তা নয়। জমিদার বা তাদের পাইকদের কাছে রোজ লাঞ্ছিত হলেও তাকেই জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন।শ্রীরসিকানন্দর অপার প্রেমকরুণাধারায় সেই অরণ্য অঞ্চলের প্রথাবদ্ধ জীবনে নতুন হাওয়া লাগল। বৈষ্ণব প্রেমের জোয়ারে ওই সমস্ত অরণ্য অঞ্চলের স্থির বদ্ধ জীবনে এল পরিবর্তনের ছোঁয়া। সমগ্র জীবনচর্যায় এল নতুন স্পন্দন। ওই সমস্ত এলাকায় এখনও নবজাতক সন্তানের অন্নপ্রাশন হয় ঠাকুরবাড়ির মন্দিরের প্রসাদ ছুঁইয়ে। গোপীবল্লভপুরের আদিবাসী সাঁওতাল ও মুন্ডা সম্প্রদায় বাৎসরিক পিন্ডদান উপলক্ষে 'দামোদর যাত্রা' করে গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। এই সময়ে তারা 'ঠাকুরবাড়ির গঁগা সিনান (গঙ্গা স্নান), বল হরি হরিবোল' ধ্বনি দেয় এবং অনুষ্ঠান শেষে মন্দিরের মহান্তকে উপঢৌকন দেয়।তবে শুধু বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারই নয়, বৈষ্ণব সাহিত্যেও এই বৈষ্ণব সাধকের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তাঁর রচিত পদগুলিতে একটা মাধুর্য ও মাদকতা মেশানো আছে। এই সাধকের কবিত্বশৈলি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যেন 'কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া' মন প্রাণ আকুল করে।
midnapore.in