খড়গপুরের শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু : ভারতবর্ষের রেল পর্যটন শিল্পের প্রথম পথিকৃত
Sripaticharan Kundu of Kharagpur The pioneer of rail tourism industry in India
সৌমেন গাঙ্গুলি।
ইতিহাস সাক্ষী আছে,পায়ের তলায় সর্ষে নিয়েই বাঙালির আবহমান পথচলা। সুপ্রাচীন গঙ্গারিদি বা তাম্রলিপ্ত বন্দরের বিদেশ জোড়া জয় জয়কার,চাঁদ সওদাগর এর ব্যবসাতরীর দূরদেশ যাত্রাই হোক কিংবা শ্রীচৈতন্যের দলবলসহ তীর্থ ভ্রমনের বাঙালির নিজস্ব ঐতিহাসিক ধারার মত আজকের আধুনিক কালের ভারতীয় রেলযোগে কন্ডাক্টেড ট্যুর এর ধারণাও কিন্ত এক উদ্যোগী বাঙালীরই দেওয়া। তিনি শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু। তিনি বিখ্যাত 'কুন্ডু স্পেশাল' এর প্রতিষ্ঠাতা। বাঁকুড়া থেকে তিনি খড়্গপুরে এসেছিলেন রেলের ক্যাটারিং বিভাগে কাজ করতে। ক্রমে বেঙ্গল নাগপুর রেলের খড়্গপুর - বালেশ্বর শাখায় সোডা - জলের ব্যবসার দায়িত্ব নেন। যিনি ইতিহাস বদলে দিতে এসেছিলেন। তিনি আর থেমে থাকেননি সোডা - জলের ব্যবসার গন্ডিতে নিজেকে বেঁধে রাখতে। শুরু হল জয়যাত্রা রেলের পর্যটন শিল্পের। না স্বয়ং তিনি মানে খড়্গপুরের শ্রীপতিচরণ কুণ্ডুও জানতেন না যে ভ্রমণ একদিন পর্যটনের তকমা এঁটে ইন্ডাস্ট্রির শিরোপা পাবে তার প্রথম 'গ্রীণ সিগন্যাল' টা তাঁর হাত দিয়েই সূচিত হবে। আশ্চর্য হলেও সত্যি রেলশহর খড়্গপুর দিয়েই শুরু সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের ।।
খড়গপুরের শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু : ভারতবর্ষের রেল পর্যটন শিল্পের প্রথম পথিকৃত | Sripaticharan Kundu of Kharagpur The pioneer of rail tourism industry in India
১৯৩৩ সালের মাঘ মাসে মাথাপিছু ১৪৬ টাকা চাঁদায় ৮০ জন স্ত্রী-পুরুষকে সঙ্গী করে খড়্গপুর স্টেশন ছেড়ে গিয়েছিল কুণ্ডু বাবুর ট্রেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী শৈলবালা। ৫৬ দিনে তারা ঘুরেছিলেন রেলপথ ছুঁয়ে যাওয়া প্রায় সমস্ত ভারত। একদিকে ব্যবসায়িক সাফল্যের ইঙ্গিত, অন্যদিকে নিছক 'ভ্রমণের স্বার্থেই ভ্রমণ' এই বোধ মিশেছিল সেই আদি অকৃত্রিম ট্যুরে। প্রথম ব্যবসায়িক ভিত্তিতে দলবদ্ধ ভ্রমণের মাসদেড়েক আগে কুণ্ডুবাবু বাজারে একটি লিফলেট ছেড়েছিলেন। তাতে ছিল ব্রিটিশ সরকারের দিশি আমলার স্ত্রী কিংবা ব্যস্ত বণিক বাড়ির মহিলারা যাতে বিনা দ্বিধায় শ্রীপতিচরণ কুণ্ডুর নিরাপত্তায় দেশ ভ্রমণে বেরোতে পারেন সেই ভরসার সুর।
শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু মহাশয়ের স্ত্রী শৈলবালা।
খড়গপুরের শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু : ভারতবর্ষের রেল পর্যটন শিল্পের প্রথম পথিকৃত | Sripaticharan Kundu of Kharagpur The pioneer of rail tourism industry in India
স্বাভাবিকভাবেই প্রথমদিকে সাড়া মিলল না। কিন্ত যাওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসতে থাকল, পর্যটন পিপাসু বাঙালির তালিকা দীর্ঘ হতে থাকল ততই। শোনা যায় এই ভ্রমণের শেষতম যাত্রীটি সেদিন ট্রেন ছাড়ার মুহুর্তে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে কামরার হাতল ধরে বলেছিলেন 'চলুন আমিও বেরিয়ে আসি'। ছিল নানা কর্মচারী, ছিল রাঁধুনী-জোগাড় নিয়ে এলাহি আয়োজন। সেই যাত্রায় তবু কলকাতার ভ্রমণ প্রিয় মানুষ ছিলেন মাত্র একজন। বাকিরা সকলেই খড়্গপুর পার্শ্ববর্তী গঞ্জ-মফস্বলের। বাঙালির আটপৌর জীবনের একঘেঁয়ে গতানুগতিক জীবনযাত্রা থেকে মুক্ত করে পথপ্রদর্শক শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু দেখিয়েছিলেন প্রয়োজনের গন্ডিটুকু ছাড়িয়েও কেবলমাত্র ভ্রমণের আনন্দ নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়া যায়। শুধু বাঙালিরাই নয়, সাধারণ ভারতবাসীরাও তখন 'বাণিজ্যযাত্রা' কিংবা তীর্থযাত্রার মধ্যে ভ্রমণ সীমাবদ্ধ রেখেছিল। বস্তুত ভ্রমণ যে শুধু চেনার-দেখার-বেড়ানোর আনন্দেও হতে পারে এর আগে কেউ ভাবতে পারেনি। প্রমোদ ভ্রমণের এই আইডিয়াটাই ছিল আপাদমস্তক নতুন। আর এইখানেই রেলভ্রমণের ইতিহাসে খড়্গপুরের শ্রীপতিচরণ কুণ্ডুর নাম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে লেখা থাকবে। সেদিন থেকে বাঙালির হাতের তালুর মধ্যে চলে এল কেদার বদ্রী গোমুখ মানস কৈলাসের কাছাকাছি নৈনিতাল, আলমোড়া। কৌশানি কিংবা মুসৌরি, দেরাদুন, পঞ্চপ্রয়াগ। পূর্ব হিমালয়ের ছোট ছোট হিলস্টেশন দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মংপুর প্রগাঢ় সৌন্দর্য এসময়েই ছুঁয়ে দেখল বাঙালি। বিভুতিভূষণ মনোহরন ভাষায় আঁকলেন প্রকৃতির পোট্রেট। লবটুলিয়ার ধু ধু সবুজের সীমানায় টিলা জঙ্গল-বন্যতা, আর বন জ্যোৎস্নার অসহ্য সৌন্দর্যের কুহক, - 'কখনও যদি এসবদিকে না আসতাম, বাংলাদেশের নিকটে এরূপ সম্পূর্ণ জনহীন অরণ্য প্রান্তর ও শৈলমালা আছে, যাহা সৌন্দর্যে আরিজোনার পাথুরে মহাদেশ বা রোডেশিয়ার বুশডেন্টের অপেক্ষা কম নয়। (পঞ্চম পরিচ্ছেদ, আরণ্যক) তবে এই সমস্ত ছাড়িয়ে স্বাধীনতার পরে বাঙালিকে সবচেয়ে বেশি হিমালয়ের দিকেই দুর্বার আকর্ষণে ভাসিয়ে নিয়ে গেল 'কুণ্ডু স্পেশাল'। সামনে সমূহ বিপদকে উপেক্ষা করেও বাঙালী-অবাঙালী পর্বতপ্রেমী পর্যটকেরা কুণ্ডু ট্রাভেলস এর হাতে নিজেদের জীবন সঁপে দিয়ে নিশ্চিত হয়েছিল। এরকম একটি ঘটনা আজও পুরোনো মানুষদের মুখে মুখে ফেরে।
৫৬ সালে অমরনাথ যাওয়ার পথে কুন্ডু স্পেশালের বাইশ জনের একটি দল অতিরিক্ত তুষারপাতের ফলে থমকে পড়ে। কোনওক্রমে তীক্ষ্ণ বরফঝড় আরও হাড়-হিম ঠান্ডায় মৃত্যুকে দু হাতে ঠেলে তারা নেমে আসেন পঁহেলগাঁওয়ে। তারপর টানা ৪৫ দিন হাঁটুডোবা বরফে ঢেকে যাওয়া পঁহেলগাঁও হয়ে ওঠে তাদের ঠিকানা। খাওয়ার রসদ ফুরিয়ে আসছে, অসুস্থতা দখল নিচ্ছে শরীরে, তবু পর্যটকদের দুর্মর ইচ্ছে অমরনাথ যাব। প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েও কুণ্ডুবাবু কিন্ত তাঁদের শেষতক ঘুরিয়ে আনেন। আর এই ঘটনা পথের ঝক্কি-ঝামেলা ভুলে এই সংস্থার সুনাম বাঙালীকে ভ্রমণে আরও আস্থাশীল করল। বহু নামি সাহিত্যিকদের লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে কুণ্ডু স্পেশালের কথা।
খড়্গপুর শহরে অবস্থিত শ্রীপতিচরণ কুণ্ডু মহাশয়ের বাসভবন।
বিখ্যাত ভ্রমণ লেখক প্রবোধ কুমার সান্যাল মহাশয়ের হিমালয় ভ্রমণের ওপর লেখা কিংবদন্তী গ্রন্থ "দেবতাত্মা হিমালয়" এ গুরুত্বের সঙ্গে এই ভ্রমণ সংস্থার কথা পরিবেশন করেছেন। অমরনাথ যাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, "সকলের আগে বেরিয়ে গেল কুণ্ডু স্পেশালের যাত্রীরা। মেয়ে, ছেলে, বৃদ্ধ, প্রবীণ, পৌঢ় মিলিয়ে প্রায় দেড়শো। মস্ত তাদের আহারাদির আয়োজন। বিস্তৃত তাদের যানবাহনের ব্যবস্থাদি। তাদের দখলে আছে প্রায় চারশো ঘোড়া, পনেরো কুড়িটি ডান্ডি, গোটা পঞ্চাশেক তাঁবু এবং প্রচুর পরিমাণে ভোজ্যবস্তু। পরিচালনা ও বিধি ব্যবস্থা দেখলে আমাদের মতো লোকের মাথা ঘুরে যায়।" এই বর্ণনা শুনে সহজেই বোঝা যায় স্বাধীনতা লাভের আগে যখন মিডিয়ার এই বাড়বাড়ন্ত হয়নি তখন শুধুমাত্র মানুষের আস্থা অর্জন করেই পর্যটনে কুন্ডু ট্রাভেলসের জুড়ি মেলা ভার। অমরনাথ যাত্রায় চলেছেন সাহিত্যিক প্রবোধ কুমার সান্যাল। লিখছেন- "পঞ্চতরণী পেরিয়ে মহাগুনাস গিরিসঙ্কটের পথ পার হয়ে চলেছি বায়ুযানের দিকে। কুণ্ডু স্পেশালের শঙ্কর কুণ্ডু বলে রেখেছিল, পঞ্চতরনীতে আমাদের তাঁবুতে আপনাদের নিমন্ত্রণ।"
পর্যটনে ভারতীয় রেল।
এইভাবেই পর্যটন শিল্পের প্রথম পথিকৃত হয়ে কুণ্ডু স্পেশালের উন্নতি বহু শাখা-প্রশাখা পল্লবিত করে গোটা দেশে তাদের ডালপালা মেলে দেয়। প্রথম দিকে খড়্গপুর থেকেই এই মহাউদ্যোগ পরিচালিত হত। ইন্দা অঞ্চলে থাকা কুণ্ডুদের সুদৃশ্য অতিথি নিবাসটি আজও সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কলকাতাসহ ভারতবর্ষের বহু গুনীমানী মানুষদের পদধূলি ধন্য এই বিল্ডিংটি খড়্গপুর শহরের একটি অন্যতম হেরিটেজ সম্পদ। রাজনীতিক সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক প্রবোধ কুমার সান্যাল কিংবা গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত দিকপাল মানুষদের ছায়া গায়ে মেখে আজও হাতছানি দেয় স্মৃতির ভ্রমণে আমাদের নিয়ে যাবে বলে।
midnapore.in
(Published on 06.11.2022)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
● লাগেজে কলমে বাঙালীর ভ্রমণ বিবর্তন- রাহুল রায়
● শ্রী সৌমিত্র কুণ্ডু- কুন্ডু স্পেশাল ধর্মতলা
● শ্রী অমিতাভ কুণ্ডু- ইন্দা , খড়্গপুর
ছবি :
● সুতনু ঘোষ।